Subscribe:

সাঁঝবেলার রুপকথা

অন্ধকারে এদিক ওদিক হাতড়ে কোথাও দিয়াশলাইটা খুজে পেল না বিষ্ণু । এটা নিশ্চই লক্ষীর কাজ । প্রতিদিনই ওর ঘর থেকে কিছু না কিছু উধাও করে দেবে মেয়েটা। তারপর অদ্ভুদ সব আবদার করে বসবে সেটা ফিরে চাইলে ! কে জানে আজ কোন ঢেকি গিলতে হয় বিষ্ণুকে !


            -আমারে কালীঘাটের মন্দিরে পুঁজা দেখতে লইয়া যাইবা? দরজায় দাড়িয়ে ফিসফিস করে জিগ্যেস করে লক্ষী ।

            -এই রাইতের বেলা ! তোর মাথা নি খারাপ হইছে ! মাইনষে দেখলে কি কইব ! অন্ধকারে লক্ষীর ছায়া কে উদ্দেশ্য করে বলে বিষ্ণু

            - কি আর কইব ! কইব ভূত আর পেত্নী পুঁজা দিতে আইছে... হি হি..

লক্ষীর কাঁচ ভাঙা হাসি বিষ্ণুকে যেন কিছুক্ষণের জন্য সাহসী করে দেয়। কিছু আদিম অনুভূতির কাছে হার মানে লোকলজ্জার ভয়..

ছনের ঘরের ঝাপিটা নিঃশব্দে ফেলে বলে- চল !

ভালবাসা কি জিনিস তা জানেনা বিষ্ণু.. নুন আনতে যার পান্তা ফুরোয় তার এই অমৃত বিষের স্বাদ না জানা খুব একটা অস্বাভাবিক কিছুনা । তবে সারাদিন মাটি কেটে সন্ধ্যায় যখন উনুনে আগুন জ্বালতে হয় এক মুঠো ভাত ফুটানোর জন্য, তখন মনে হয় কেউ একজন যদি এক থালা শাকান্ন তার জন্য রেধে দিত তবে খুব একটা মন্দ হত না । আর তখন কেন যেন লক্ষীর মুখটাই ভাসতে থাকে তার চোখের সামনে । তবে কি বিষ্ণু লক্ষীকেই চায় তার ঘরনী হিসবে ?

চাইলেই বিয়ে করে সংসারী হতে পারে দুজন.. তিনকুলে বিষ্ণুর কেউ নেই । একমাত্র বুড়ো পিসি ছাড়া লক্ষীর ও কোন পিছুটান নেই । তবু মুখফুটের মনের কথাটা বলার সাহস পায়না বিষ্ণু। বিয়ের লক্ষীকে খাওয়াবে কি এ ভাবনা তাকে শেকল পড়িয়ে রাখে ।
       

            ২.

মন্দিরে ঢুকতেই লাল নীল আলোতে চোখ জুড়িয়ে গেল লক্ষীর । মাটির তৈরী একেকটা মূর্তি কি অপরুপ ভাবেইনা সাজানো হয়েছে!
            -ঐগুলান কি সত্যকারের সোনার গয়না ?! লক্ষীর চোখে মুখে বিস্ময় ।

এতক্ষনে বিষ্ণু ভাল করে দেখে লক্ষীকে । চোখজুড়ে কাজল পড়েছে ইচ্ছেমত । কলাপাতা রঙের আধ-পুরানো শাড়িটাতে একটু অন্যরকমই লাগছে ওকে । অথচ এই শাড়িটা এর আগেও বহুবার লক্ষীর পরনে দেখেছে বিষ্ণু । আসলে শাড়ি বলতে ঐ দুটোই সম্বল লক্ষীর । একটা সবুজ আর একটা হলুদ..

আচ্ছা সিদুঁর লাল শাড়িতে লক্ষীকে কেমন লাগবে?! হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি আর কপোল জুড়ে একটা টকটকে লাল টিপ । মনে মনে স্বপ্নের ছবিটা আঁকতে থাকে বিষ্ণু । এমন সময় লক্ষী এসে তাড়া দেয়
            -চল বাড়ি যামু ।

স্বপ্নের ছবিটা অসমাপ্ত রেখেই লক্ষীর পিছু পিছু হাটতে থাকে বিষ্ণু । মন্দিরের বাইরে অনেক বেদেনীরা চুড়ি ফিতা এটা সেটা নিয়ে বসেছে । সেখান দিয়ে পাশ কাটানোর সময় লক্ষী ছেলে মানুষী আবদার করে বলে
            -আমারে এক ডজন চুড়ি আর এক কৌটা সেদুর কিন্যা দিবা ?

            বিষ্ণু অসহায় কণ্ঠে দাম জিগ্যেস করে দোকানী কে ।
            - দাম বেসি লাই রে বাবু । চুড়ি গাছা বিস রুপি আছে আর সেদুর দাস রুপি ।

বিষ্ণু বুকপকেটে হাত দিয়ে দেখে সেখানে সব মিলিয়ে সতের টাকা আছে । তারপর মাথা নিচু করে সেখান থেকে চলে আসে । পুরো পথে লক্ষীও আর কোন কথা বলে না । বাড়ির কাছাকাছি এসে বিষ্ণু মৃদু স্বরে বলে-
            -লক্ষী শোন !
            -কি কইবা তাড়াতাড়ি কও, মেলা রাইত হইছে ।

বিষ্ণু আলতো করে লক্ষীর হাত টা ধরে বলে "দেহিস শহরে গিয়া তোর লাইগা আমি চুড়ি আর সেন্দুর কিন্যা আনুম । একখান লাল বেনারশী ও আনুম । তারপর সেইগুলান পিন্দাইয়া তোরে আমার বউ বানামু ! তুই আমার বউ হবি লক্ষী ?!"

লক্ষী কোন কথা না বলে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে । তার জীবনের সুন্দরতম মুহূর্ত মৌনতায় আরো কিছুক্ষন বেঁচে থাক ।
    

            ৩.

আজ প্রায় দিন দশেক হল বিষ্ণু শহরে এসেছে । এখনো থাকা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারে নি । গ্রাম থেকে যে কটা টাকা ধার করে এনেছিল তার সবটাই খরচ হয়ে গেছে ।

অনাহারে অর্ধাহার যখন খোলা আকাশের নিচে তার দিন কাটছিল তখন এক রিকশাওয়ালার সাথে পরিচয় হল । সেই তাকে একটা ভাড়া রিকশা চালানোর ব্যবস্থা করে দিল ।

বিষ্ণু এখন শহরের এ গলি থেকে ও গলি ঘুরে বেড়ায় রঙ বেরঙের মানুষ নিয়ে । প্রতিদিন যা আয় করে তার সিংহ ভাগ তুলে দিতে হয় মহাজনের কাছে তাই ছয় টাকায় কেনা ছোট্ট মাটির ব্যাংক টা পূর্ণ হতে তাকে অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক মাস ।

অবশেষে ফাগুনের কোন এক আগুনলাগা শেষ বিকেলে বিষ্ণু তার কথা রাখতে লক্ষীর জন্য একটা টুকটুকে লাল বেনারশী , লাল রেশমী চুড়ি আর এক কৌটা সিঁদুর কেনে । চুড়ি গাছা একবার বুকের কাছে এনে রাখে.. একবার শাড়িখানা খুলে গন্ধ শুঁকে দেখে ! সেদিন কিছুতেই রাতে ঘুম হয় না তার !
       

            ৪.

পরদিন খুব ভোরে বেরিয়ে পরে বিষ্ণু । দুপুরের মধ্যেই বাড়ি চলে যাবে সে । কত হাজার বছর ঐ গাঁয়ের পথ মাড়ায় না বিষ্ণু ! যে পথের প্রতিটা ধুলিকনায় লক্ষীর ছোঁয়া আছে...

            - এই রিকশা যাবা ?
            -কই যাইবেন দাদা ?
            - যে দিকে তোমার খুশি.. পাশ থেকে মিষ্টি হেসে জবাব দেয় শাড়ি পরা দিদি মনিটি ।
            বিষ্ণু মাথা নাড়ে ।
            - ভাড়া যা চাও তাই দেব ! বিরক্তি নিয়ে বলে ছেলেটি ।
            - দুপুরের আগে আমারে ছাইড়া দিতে হইব..
            - আচ্ছা তাই দিব ! এখন চল ।

বিষ্ণু উদাস মনে রিকশা টানছে । আরোহী দম্পতি ফিসফিস করে প্রেমালাপ করছে । অন্য সময় হলে বিষ্ণু তা মনোযোগ দিয়ে শুনত । কিন্তু আজ তার কিছুতেই মন বসছে না..

            -একটা গান শুনাও না.. প্লীজ..
            -রিকশায় !
            -হুম.. শুনাও না ..

            - সাঁঝবেলার বেলার রূপকথায় আমাকে আর পাবেনা ....
            আমি এখন রাতের কাব্য রচনায় ব্যস্ত থাকি ...
            মন খারাপের একটা প্রহর শেষে আমাকে খুঁজো না আর..
            আমি এখন অনেক বড় , তোমার দেয়া কষ্ট সইতে পারি..
            -ভ্যালেনটাইন ডে তে কেউ এমন গান শোনায় ? অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিল দিহান ।

            তাদের প্রেমালাপে ব্যাঘাত ঘটিয়ে বিষ্ণু বলল
            "দাদা আমি আর যামু না ! "
            এবার ছেলেটি রেগে গিয়ে বলল
            - এখনও তো দুপুর হয়নি !
            মেয়েটি এবার ও মিষ্টি হেসে বলল
            - তোমার জন্য ও বুঝি কেউ অপেক্ষা করছে ? হাহা
            -হ দিদিমনি ! লজ্জিত স্বরে জবাব দিল বিষ্ণু ।
            " রিকশা ওয়ালার আবার ভালবাসা ! " রাগে গজগজ করতে করতে বলল দিহান..

তারপর মেয়েটি তার খোঁপা থেকে একটা ফুল খুলে দিয়ে বলল -এটা তোমার ভ্যালেনটাইন কে দিও..বিষ্ণু বোকার মত তাকিয়ে থাকল এই নিষ্পাপ দেবীরূপী দিদিমনিটার দিকে ।

এসব বাড়াবাড়ি মোটেও ভাল লাগল না দিহান এর । পিউ টা সারাজীবন ছেলেমানুষ ই রয়ে গেল ।

            ৫.

বাস থেকে নেমে বিষ্ণু হাতের ব্যাগটায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল । তার সমস্ত স্বত্তা জুড়ে লক্ষীর হাতের কাঁকনের রিনিঝিনি শব্দ বেজেই চলেছে ।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একটা অজানা আশংকা বিষ্ণুকে গ্রাস করল । উঠোনে এত মানুষ কেন ?! পিসির কিছু হলনা তো !

ভীড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই দেখল একটা চাটাই এ লক্ষী শুয়ে আছে । আজ সকালে জংলার ধারে শাক তুলতে গিয়ে একটা বিষাক্ত সাপ কেটেছে তাকে । কেউ জানার আগের পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অজানার দেশে চলে গেছে চিরকাল অবহেলিত এই হতভাগিনী ।

বিষ্ণু লক্ষীর নিলাভ হাত দুটো বুকের কাছে ধরে প্রথমবারের মত মৃত্যু জন্ত্রনা ভোগ করল । তারপর ব্যাগ থেকে কাঁচের চুড়ি গুলো বের করে পড়িয়ে দিল লক্ষীর হাতে । বেনারশীটা জড়ায়ে মন ভরে একে নিল স্বপ্নের ছবিটা...

কাঁপাকাপা হাতে বিষ্ণু যখন লক্ষীর কপালে সিদুর পড়াচ্ছিল তখন লক্ষী কি একটু হেসেছিল ? ওর সেই হৃদয় পোড়ানো হাসি ?
নাকি সবটাই বিষ্ণুর দৃষ্টিভ্রম ছিল..? সে শুধু লক্ষীর কানে কানে চুপি চুপি বলল - আমি আমার কথা রাখছি লক্ষী !
        

            পরিশিষ্ট : এ বছরের শুরুর দিকে থাইল্যান্ডের এক ছোট্ট শহরে সারিনিয়া কামসুক (২৯ বছরের এক যুবতী) বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন তার ভালবাসার মানুষ চ্যাদিল ড্যাফিকে (২৮) । কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের বিয়ের দিন একটা রোড ক্র্যাশে মারা যায় সারিনিয়া !

            ভালবাসার মানুষটিকে দেয়া কথা রাখতে ড্যাফি মৃত সারিনিয়ার হাতে আংটি পড়িয়ে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে চার্চে!
            ভালবাসা দিবসে বিরল ভালবাসার নির্দশন স্থাপনের জন্য এই দম্পতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি ।


- মেঘলা তাসনীম
সারিনিয়া & ড্যাফি... <3 <3

No comments:

Post a Comment