Subscribe:

অহম দর্পণ (একুশের বিশেষ লেখা-২)

পিজ্জার ট্রে-টা সশব্দে টেবিলে আছড়ে ফেলে চিৎকার করে উঠলো আম্ব্রিন - “আমি যাব না ... জাস্ট ... আই ডৌন্ট ওয়ান্না গো ...

মিসেস ইয়াসমিন আহত দৃষ্টি নিয়ে তার পনের বছরের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল - “তোমাকে যেতে হবে মা, আমরা সবাই যাচ্ছি”। তোমার পাপা, খুশি আন্টি আর আমি কত বছর ধরে এমন সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। কেন যাবে না তুমি?।
তোমার তো হ্যাপি হওয়া উচিৎ যে এবার তোমার নতুন কিছু এক্সপেরিয়েন্স হবে। শেষ যখন তুমি আমাদের সাথে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলে তখন অনেক কম বয়স ছিল তোমার। অনেক কিছুই মনে নেই। এবার যাবে, ফ্যামিলির সবার সাথে দেখা হবে, দেখবে অনেক ভালো লাগবে।


-“কাম অন মম, আই কান্ট টেক দিস এনিমোর। বিডিতে আসার পর থেকে তোমরা পেইন করছ আমাকে। বাট আম নট ইন্টারেস্টেড।” বিরক্তিতে কাঁধ ঝাঁকাল আম্ব্রিন।
-আম্ব্রিন, তুমি কি ভেবে দেখেছ, তোমার পাপা জানলে কত হার্ট হবেন যে তুমি বাংলাদেশে আসার পর থেকে সব কিছু নিয়ে এত ওভার রিয়েক্ট করছো...
- ইটস অ্যাম্বি, মম, নট আম্ব্রিন, প্লীজ! ভ্রু কুঁচকে নিজের ঘরে চলে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো সে।


ইয়াসমিন ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে পিজ্জার ট্রে, গ্লাসগুলো সিঙ্কে দিতে থাকলো। সপ্তাহ খানেক হয়েছে এনাম, খুশি, আম্ব্রিন আর সে নিউ ইয়র্ক থেকে ঢাকায় এসেছে। অনেক অনেক বছর পর সবার একসাথে এভাবে দেশে আসা। দিলু রোডের ছোট্ট ফ্ল্যাটটা আগে সারা বছর খালিই থাকতো, গত সপ্তাহ থেকে তারা এখানে থাকছে। এখানে এসে মনে হচ্ছে নিজের দেশে প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার শান্তি মনে হয় আর কোথাও নেই। আজ থেকে প্রায় ষোল বছর আগে এনাম আর সে দেশ ছেড়ে নিউ ইয়র্কের কুইন্স নামক অভিজাত শহরে সংসার শুরু করেছিলো। কুইন্স নামের শহরটি এখন আগাগোড়াই আপন মনে হয় তাদের। তবুও আবার কোথাও যেন আপন না, দেশের জন্যে মন পরে থাকে, মন কাঁদে। আম্ব্রিন হওয়ার পর এ পর্যন্ত মেয়েটা মাত্র দুইবার বাংলাদেশে এসেছে। প্রথমবার আম্ব্রিনের বয়স ছিল এগারো মাস আর দ্বিতীয়বার ছিল সাত বছর। এখন আম্ব্রিনের বয়স পনের, এতগুলো বছরের মাঝে মেয়েটা আর দেশে আসেনি।

ইয়াসমিন চুপচাপ বসে থাকে, আম্ব্রিনের রুম থেকে জাস্টিন বেইবারের গানের শব্দ ভেসে আসছে। কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে এই মেয়েটা। পারিবারিক বন্ধন, নিজস্ব সংস্কৃতি, দেশপ্রেম কিছুই যেন গায়ে লাগে না ওর। দেশে আসার পর থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। কারণে অকারণে চিৎকার করছে। আর গ্রামের বাড়িতে কিছুতে যেতে চাইছে না। অথচ ওকে দেখার জন্যে গ্রামে থাকা পরিবারের সবাই অপেক্ষার প্রহর গুনছে। মাঝে মাঝে ইয়াসমিন শঙ্কিত বোধ করে, এভাবে বেড়ে ওঠা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে ? হাজার হাজার মাইল দুরের কুইন্স শহরে উদ্বাস্তুর মত করে তারা যে উন্নত জীবন যাপন করছে তা কি আদৌ উন্নত? তারা আসলে কী? মুক্ত পাখি নাকি বনের স্বাধীন পশু? ইয়াসমিনের মনে হয়, এতগুলো বছর নিজের দেশ, নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকতে থাকতে তারা আসলে বাদুড় শ্রেণীর প্রাণী হয়ে গেছে - না পশু না পাখি। ইয়াসমিনের হঠাৎ করে তার ছেলেবেলার সাদাসিধে দিনগুলো মনে পড়তে থাকে, নিজের অজান্তেই চোখের কোণ ভিজে আসে।




-“তোমার নতুন গ্লাসের ফ্রেমটা বেশ অন্যরকম।” এক গাল হাসি দিয়ে ফ্রেমটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে বলে খুশি। -“তুমি অযথা টাইম স্পয়েল করছ আন্টি” ভ্রু কুঁচকে বলে আম্ব্রিন। -“কেন?” -“আমি তোমার কোন কথায় ইম্প্রেসেড হবো না আন্টি। এসব হালকা কথা বলে তুমি আমার মুড ভালো করতে পারবে না। ইউজলেস কথা সব।”-“কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করা মানেই কিন্তু কাউকে ইম্প্রেসেড করতে চাওয়া না। আম্ব্রিন, তুমি সবাইকে কেন ভুল বুঝছ? যে কোন একটা ব্যাপারকে কেন সহজভাবে নিচ্ছ না?” -“ওহ, প্লিজ লেকচার দিও না। এই দেশ, দেশের মানুষ, সবাই অনেক উইয়ার্ড। আমার নাম আম্ব্রিন, আমার বন্ধুরা ডাকে অ্যাম্বি , বাট, এখানে আসার পরে সবাই আম্বিয়া ডাকা শুরু করেছে। ড্যাম হেল ... এখানে আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা। আই জাস্ট হেইট দিস প্লেস।


-ছিঃ আম্ব্রিন এভাবে বলে না। তুমি কি জানো কত কষ্ট করে এই দেশ পেয়েছি আমরা? আমাদের কত আবেগ জড়িত আছে এই দেশে? তোমার কাজিন তনয়া, গত বছর থার্ড ইয়ারে পড়ার সময় স্কলারশিপ পেয়ে ছয় মাসের জন্যে যখন একটা ডিপ্লোমা করতে ফ্রান্সে গিয়েছিলো, তখন সে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করেছে কবে নিজের দেশে ফিরে আসবে? নিজের দেশ সবার কাছে অনেক আপন। কারণ একান্ত নিজের দেশ। হাজার সমস্যার মাঝেও পৃথিবীর সব চেয়ে সুন্দর আর অসাধারণ বাংলাদেশ।
- “কচু দেশ এইটা। উফফ ... ওয়াটেভার ...” বলেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে যায় আম্ব্রিন।


আম্ব্রিন গট গট হেঁটে চলে যাচ্ছে। দেশে আসার পর থেকে খুশি আন্টির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয় না তার, কথা বলতে গেলে মনে হয় ক্লাস নিচ্ছে । আর যে কোন কিছুর হিস্ট্রি বলতে শুরু করলে আর থামার নাম নিবে না। এমনিতেই এত রিলেটিভদের সাথে দেখা করা, গ্রামে থাকা সব কিছুই অসহনীয় লাগছে । এত্ত ইমোশন এদের! অসহ্য!। তার কিছুতেই মন বসে না, কিছুই ভালো লাগে না, এখানকার মানুষজনের কাজ কর্মকে তার ভাঁড়ামো বলে মনে হয়। ‘এই একমাসের জন্যে বাংলাদেশে আসাটা রীতিমত একটা যন্ত্রনা হয়ে গেছে। সব সময় মুখে একটা হাসি হাসি ভাব রাখতে হয়। ক্র্যাপ! এ দেশের মানুষগুলো এত সেন্টি টাইপ কেন?’ আত্নীয় স্বজন বারবার তাকে দেখছে, আর সে এত বড় হয়ে গেছে বলে জড়িয়ে ধরে চোখে পানি ফেলছে। বুড়ো বুড়ো মানুষজন সবার সামনে এভাবে কাঁদতে পারে! এবসার্ড! আম্ব্রিন এদের কাছ থেকে দূরেই থাকতে চায়। এদের কালচার, এদের মেন্টালিটি সবই যেন এক যন্ত্রণা। পাপাকে সে কিছুটা ভয় পায় তাই সব কথা তার মায়ের সাথেই হয়; নইলে অনেক আগেই এখান থেকে কুইন্সে যাওয়ার জন্যে রেডি হয়ে যেত।

খুশি দীর্ঘসময় ধরে একটা মোটা গাছের গুড়িতে ঠেস দিয়ে বসে থাকলো। এনাম তার চাচাত ভাই, তিন বছর আগে স্কলারশিপ নিয়ে খুশি নিউ ইয়র্কে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলো। দেখতে দেখতে তিনটা বছর কেটে গেছে। এত দিনেও সে অভ্যস্ত হতে পারেনি বাইরের সংস্কৃতির সাথে। এনাম ভাইয়ের মেয়েটার মাঝে কেমন যেন ভিনদেশি একটা ভাব। যেখানে দীর্ঘদিন দেশে না থাকার পরেও এনাম ভাই বা ইয়াসমিন ভাবীর মাঝে সে কোন জড়তা দেখেনি, খুঁজে পায়নি কোন ভাণ অথচ তাদের অসাধারণ এই রূপবতী মেয়েটাকে দেশে আসার পর থেকেই সে দেখেছে দুই চোখে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে চারপাশের সবাইকে আর সব কিছুকে দেখতে। ওর চোখের দৃষ্টিতে কোন ভালোবাসার রেশ মাত্র নেই, তবে কেমন যেন একটা সারল্য আছে, অভিমান আছে, আছে না পাওয়ার বেদনা। যে মেয়েটা নিজের দেশের মাটির কাছে থাকেনি, ১লা বৈশাখে মঙ্গলযাত্রার উত্তাল তরুণের দল দেখেনি, একুশে বইমেলার নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেয়নি, বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে স্নাত হয়নি, পলাশীর রাস্তায, উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটাহাঁটি করেনি, ঈদের দিনে পরিবারের সবার আনন্দিত মুখ দেখেনি, তার কাছ থেকে অবশ্য খুব বেশি কিছু আশা করা যায় না। একটা নিঃসঙ্গ মেয়ে তার নিজের বানানো ছোট্ট একটা বাক্সে ফিরে যেতে ছটফট করছে। লাল সূর্য বা সবুজ ঘাস তাকে টানছে না। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে!!!




আম্ব্রিনের জেদের কারণে তার পরিবার কে দু দিন আগেই গ্রাম থেকে চলে আসতে হল। ওদেরকে বিদায় দেওয়ার সময় আম্ব্রিন বিরক্ত হয়ে দেখল একগাদা মানুষ বিদায় দিতে এসে তার পাপা-মমকে ধরে কান্নাকাটি করছে। তার মনে হচ্ছিল সে নরকে চলে এসেছে। মানুষের চোখের পানি কি এতই ভ্যালুলেস নাকি যে চাইলেই যখন তখন শো করতে হবে!!! সকালবেলা আম্ব্রিন চোখ খুলে দেখতে পায় রাতে সে টেবিল ল্যাম্পটি জ্বালিয়ে রেখেই ঘুমিয়ে গেছে। ঘোর ঘোর লাগা চোখে সে চারপাশে তাকিয়ে থাকে। গতকাল সে প্রায় সারা রাত জেগে ছিল। অনেক কান্নাকাটির পরে ভোরের দিকে সে একটু ঘুমিয়েছে। পাপার সাথে বিশ্রী একটা ঝগড়া হয়েছে তার। গ্রামের বাড়ি থেকে আসার পর থেকে পাপা ঠিকমত কথা বলছে না তার সাথে। গতকাল রাতে ডিনারের সময় পাপা ঠাণ্ডা গলায় যা বললেন, তার সারমর্ম হল এই যে, আম্ব্রিন গ্রামে গিয়ে কারো সাথেই ভাল ব্যবহার করেনি। তিনি লজ্জিত বোধ করেছেন যে এত বড় হওয়ার পরেও তিনি আম্ব্রিনকে নুন্যতম ম্যানার্‌স শেখাতে পারেননি। আর দেশের বাইরে থাকার সময় তিনি কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত ছিলেন যে তার সন্তান যে অধঃপতনে চলে গেছে তা তিনি এত দিন উপলব্ধি করতে পারেন নি। একজন বাবা হিসেবে তিনি পরাজিত এবং আম্ব্রিনের মা-ও পরাজিত একজন মা। পাপার কথাগুলো শুনে আম্ব্রিনের মনে হয়েছিল তার জীবনের সব চেয়ে অপমানজনক ও কষ্টদায়ক একটা সময় সে পার করছে। সারা জীবনে তার সাথে যা হয়নি শুধু মাত্র এই বাংলাদেশে আসার পর থেকে তা-ই হয়ে যাচ্ছে। ‘সব কিছু আউট অফ কন্ট্রোল ... সব কিছু মিনিংলেস ...’

ডাইনিং রুম থেকে মম আর খুশি আন্টির গলার স্বর ভেসে আসছে। আম্ব্রিন বেড থেকে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারে সারা রাত কাঁদার কারণে মাথার বাঁ পাশে কেমন যেন ভোঁতা একটা অনুভূতি কাজ করছে। কিছুটা টলতে টলতে ডাইনিং এ যায় আম্ব্রিন। ওকে দেখেই ঝকঝকে একটা হাসি উপহার দিয়ে খুশি আন্টি বলে, “শুভসকাল মিস আম্বিয়া খাতুন।”


-“ওয়াট!!! ওহ প্লিজ আন্টি গিম্মি অ্যা ব্রেক। এই নামগুলো খুব অসহ্যকর।”
-“তুমি রেডি হয়ে যাও আমরা সবাই মিলে শপিং করতে যাব।”
-“নো ওয়ে ... আমার ভাল্লাগেনা। এ দেশের রাস্তাঘাট - জাস্ট গার্বেজ। এত ডাস্টের মধ্যে শপিং!!! হাহ!” আম্ব্রিন মুখ বাঁকায়।
- “আমি জানতাম তুমি এমন কিছুই বলবে, ঠিক আছে না গেলে না যাও। আমি ভাবীকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি। ভাবী চল ... আমাদের হাতে সময় কম, কুইক।” আম্ব্রিন অবাক হয়ে দেখল তার মা বেশ খুশি খুশি মনে রেডি হতে চলে গেলো।
-“পিকুলিয়ার পিপলস!” প্রচন্ড রাগে টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা ছুঁড়ে নিচে ফেলে দিলো সে। ঝন ঝন শব্দে গ্লাসটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেলো। খুশি আহত দৃষ্টি নিয়ে আম্ব্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ইয়াসমিন বেড রুম থেকে এসে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার দু চোখে সূক্ষ্ণ বেদনার ছায়া।
-“একবার খালি আমি নিউ ইয়র্কে ব্যাক করি.. জীবনে আর এই দেশে ফিরে আসব না আমি। নেভার ... এভার” পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে, নীচের ঠোঁট উল্টিয়ে, দু পাশে হাত ছড়িয়ে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি উলটো করে দেখিয়ে বলল আম্ব্রিন।


বিড়বিড় করে প্রায় অস্ফুট কন্ঠে বলল খুশি, “তুমি নিজেই একসময় যেতে চাইবে না এই দেশ থেকে ... ... আমরা এমন এক জাতি যারা নিজের মাতৃভাষা ও স্বাধীনতার জন্যে লড়াই করেছি এবং গৌরবময় সাফল্য অর্জন করেছি। দেশে থাকো কিংবা বিদেশে ... বাঙালির রক্ত বইছে তোমার শরীরে ... তোমার আত্নাই তোমাকে উপলব্ধি করাবে সব ... ...




খুব কোমল স্বরে কেউ একজন আম্ব্রিনকে ডাকছে। আর তার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আম্ব্রিনের মনে হচ্ছে সে কোন শান্ত সমুদ্রের বালুচরে একলা বসে আছে। মৃদু ঢেউ একটু একটু করে তার পা ভিজিয়ে যাচ্ছে , সমুদ্রের ঠাণ্ডা পানিতে তার গা জুড়িয়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের দুপাশে অনেক অনেক ঘন সবুজ গাছ। সে গাছগুলো আম্ব্রিনের নাম ধরে ডাকছে। চারপাশে গুঞ্জন তুলছে তার নাম। বাতাসে পাতার মর্মর শব্দের সাথে মিশে যাচ্ছে তার নাম। স্পষ্ট হয়ে আসছে গাছগুলোর স্বর। খুব কোমল আর আপন সেই স্বর।

“আম্ব্রিন ... আম্ব্রিন ... আম্ব্রিন, মা আমার ...” অল্প অল্প করে তার চেতনা ফিরে আসছে। গাঢ় ঘুমভাব কেটে যাচ্ছে। চোখ খুলে সে বুঝতে পারে মম মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর তাকে ডাকছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে আলতো একটা হাসি দিলো আম্ব্রিন।


ইয়াসমিনের মন অদ্ভুত আনন্দে ভরে যায় নিজের মেয়ের পবিত্র হাসি দেখে। কতদিনপর মেয়েটা এভাবে হাসছে, কতদিন পর!! নরম গলায় সে বলল, “প্রভাতফেরীতে যাবে না মা? তোমার জন্যে সবাই অপেক্ষা করছে। অনেক ভিড় হবে আজ, চটজলদি রেডি হয়ে যাও। তোমার খালামনি আর ইভান ভাইয়া আমাদের সবাইকে নিতে এসেছে। তোমার বাবা, খুশি আন্টি, আমি-তুমি একটু পরেই রওনা দিচ্ছি...উঠে যাও মা।”


-“প্রভাতফেরী কী?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করে আম্ব্রিন!

“প্রভাতফেরী? ইটস লাইক, অ্যা প্রোসেশান টু পে হোমেজ টু সাম গ্লোরিয়াস ফাইটার্স। অনেক বছর আগে, ১৯৫২ সালে, এই দিনটায়, ওরা বাংলা ভাষার জন্য, আমাদের মাতৃভাষার জন্য, টু আপহোল্ড দ্য অনার, ফাইট করেছিল। আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার জন্য ওরা উইদাউট হেজিটেশান ওদের লাইফ স্যাক্রিফাইস করেছিল। ওদের সম্মানে যে শহীদ মিনার, ওখানে আজকে সবাই, সব বাঙালী খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে ... “নো মম...আমি কোথাও যাব না। আমি ঘুমাবো।”


ইয়াসমিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কিছুটা ঝাঁঝ নিয়ে বলল , “টিভি খুলে দেখো আজকে দূর দূরান্ত থেকে কতো মানুষ আসছে ফুল দিতে, আর তুমি যেতে চাইছ না! ব্যস অনেক হয়েছে, আর না। তুমি গিয়ে তোমার পাপাকে বলো যে তুমি যাবে না। আমি তাকে এই কথা জানাতে পারবো না।” ড্রয়িং রুমে গিয়ে আম্ব্রিন দেখে ইভান ভাইয়া সাদা পাঞ্জাবী পরে বসে আছে, খুশি আন্টি আর বড় খালামনিও সাদা কালো রঙের শাড়ি পরেছেন। পাপার সাথে কথা বলতে যায় সে, গিয়ে দেখে তার বাবাও ধবধবে সাদা একটা পাঞ্জাবী পড়ে প্রায় রেডি। তার বিরক্ত লাগে। এত্তসব বাড়াবাড়ি কি আছে? সাত সকালে নিজেদের ঘুম নষ্ট করে কোথাও ফুল দিতে যাওয়ার মানে কী?


-“পাপা, আমি বাসায় থাকতে চাই। আমি যেতে চাইনা তোমাদের সাথে।” আড়চোখে মমের দিকে তাকিয়ে বলে আম্ব্রিন।


সে দেখে ইভান ভাইয়া বেশ অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে চায়, তার আগেই হাত দেখিয়ে তাকে থামিয়ে দেয় পাপা। তারপর ঠাণ্ডা গলায় বলে- “ঠিক আছে। তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে না। আমরা চলে যাচ্ছি। আম্ব্রিন আশঙ্কা করেছিলো তাকে এখন বকা শুনতে হবে, নানা কথা বলতে হবে, কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং পাপার কথায় এমন একটা কিছু ছিল, যা শুনে একটা সূক্ষ্ণ অপমানের ছায়া পড়লো তার মুখে।

সবাই আম্ব্রিনকে রেখেই চলে গেলো। কেউ আর আম্ব্রিনকে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করেনি। বরং সবার চলে যাওয়ার পেছনে কেমন যেন একটা উপেক্ষার ভঙ্গি ছিল। আম্ব্রিনের মেজাজ খারাপ হতে থাকে। বিড়বিড় করে সে বলে- “আই জাস্ট হেইট দিস কান্ট্রি ...”


একবার ঘুম ভেঙে যাওয়াতে আম্ব্রিনের আর ঘুম আসে না। তার উপর আশে পাশের ফ্ল্যাট থেকে গানের শব্দ ভেসে আসছে। বিরক্ত হয়ে আম্ব্রিন বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে থাকে। বাইরে আলো ফুটে গিয়েছে। আর ঘুম আসবে না। আম্ব্রিন খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আশে পাশের অনেক বাসা থেকে এখনো বাংলা গান ভেসে আসছে। রুমে ফিরে আসতে যেয়ে তার চোখে পরে তাদের বাসার সামনের খোলা জায়গায় চার পাঁচটা বস্তির ছেলে মিলে ইট দিয়ে কি যেন করছে। আম্ব্রিন আরেকটু মন দিয়ে দেখে ওরা কি করছে আসলে! একটার উপর আরেকটা ইট রেখে তিনটা স্তম্ভ করেছে। কাগজে লাল কি যেন এঁকেছে। আর বেশ কিছু ফুল এনে রেখেছে ইটগুলো নিচে। একেকজন এসে ফুল দিয়ে যাচ্ছে।

অবাক লাগে আম্ব্রিনের। সবাই কেন আজকে ফুল দিচ্ছে। সমস্যা কী এদের? ড্রয়িংরুমে এসে টিভি অন করে সে। প্রতিটা চ্যানেলে লাইভ প্রোগ্রাম দেখাচ্ছে। একই গান হচ্ছে। আর হাজার হাজার মানুষ ফুল নিয়ে যাচ্ছে। একটা, দুইটা, তিনটা এভাবে একের পর চ্যানেল বদলাতে থাকে সে। প্রতিটা চ্যানেলে একই দৃশ্য! ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবাই ফুল নিয়ে সারি বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকের হাতে প্ল্যাকার্ড। ব্যাকগ্রাউন্ডে গান হচ্ছে-“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি...” আম্ব্রিনের বিস্ময় বাড়তে থাকে। এখানে তার পাপা, মম, ইভান ভাইয়া, খালামনি, খুশি আন্টি সবাই গেছে? এমন কি হয়েছে আজকের দিনে? টিভি অন রেখেই সে ছুটে নিজের ঘরে যায়। ল্যাপটপটা দ্রুত অন করে। গুগলে সার্চ দিতে গিয়ে দেখে আজকের দিনের জন্যে গুগলের হোম পেজে ডুডল দেওয়া হয়েছে। বস্তির ছেলেগুলো ইট দিয়ে যা বানিয়েছিল ঠিক সেই ছবি। উত্তেজনায় নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে আম্ব্রিনের। কাঁপা কাঁপা হাতে সার্চ দেয়- ইন্টারন্যাশনাল মাদার ল্যাংগুয়েজ ডে লিখে। গুগোল থেকে ছবি চলে আসে আর উইকি থেকে হিস্ট্রি চলে আসে সাথে সাথে। এক নিঃশ্বাসে পড়তে থাকে সে সব লেখা।


ভাষা আন্দোলন- ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়, কিন্তু পাকিস্তানের দুটি অংশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পার্থক্য ছিল প্রচুর। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, যা পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে তুমুল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ এ সিদ্ধান্তকে মোটেই মেনে নিতে চায়নি। পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর খাজা নাজিমুদ্দিন জানান যে পাকিস্তান সরকারের সিদ্ধান্তই মেনে নেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়ে ওঠে। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে মিটিং-মিছিল ইত্যাদি বেআইনি ঘোষণা করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এই আদেশ অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু সংখ্যক ছাত্র ও কিছু রাজনৈতিক কর্মী মিলে মিছিল শুরু করেন। মিছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ মিছিলের উপর গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হন সালাম, রফিক,বরকত,জব্বারসহ আরও অনেকে। এই ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে কেন্দ্রীয় সরকারগণ আন্দোলনের মুখে নতি স্বীকার করে এবং ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করে। ২০০০ সালে ইউনেস্কো বাংলা ভাষা আন্দোলন ও মানুষের ভাষা ও কৃষ্টির অধিকারের প্রতি সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণাকরে।


একের পর এক লিঙ্ক ঘাঁটতে থাকে আম্ব্রিন, ছবি দেখতে থাকে...কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব কাজ করে তার। এত কিছু ঘটে গেছে এই ছোট্ট দেশটা উপর? ভাষার জন্যে এত মানুষ মারা গেছে!! আম্ব্রিন নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। একটা অসহ্য ক্রোধ কাজ করতে থাকে তার নিজের ভেতর। ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখা এক একটা ছবি , ইউটিউবের দৃশ্যগুলো জীবন্ত হয়ে ওর চোখের সামনে ঘুরতে থাকে। একটা কষ্ট, একটা আর্তনাদ দলা পাকিয়ে উঠে আসতে থাকে ওর গলা দিয়ে। এতগুলো বছর সে এসব নিয়ে কিছুই জানতো না, কেন জানেনি? কেন প্রশ্ন করেনি পাপা বা মমের কাছে? সে ছুটে আবার টিভির সামনে যায়- এখনো শত শত মানুষ আসছে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে। সবার হাতে ফুল। সবার মুখে অন্যরকম একটা পবিত্রতা। সাদা কালো ফ্রক পড়া চার-পাঁচ বছরের একটা মেয়ে এক হাতে তার বাবার হাত ধরে আছে আর অন্য হাতে একটা প্ল্যাকার্ড ধরে আছে। তাতে রঙপেন্সিল দিয়ে কাঁচা হাতে লেখা- আমি বাংলায় কথা বলি। আমি গর্বিত বাঙালি। আম্ব্রিন স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট মেয়েটাকে অবাক হয়ে দেখে। কি আত্মবিশ্বাস মেয়েটার চোখে, কি আবেগ দিয়েই না সে প্ল্যাকার্ডটা ধরে রেখেছে।

সমস্বরে গান গাইছে অনেক মানুষ- আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো একুশে ফেব্রুয়ারি...আমি কি ভুলিতে পারি... আম্ব্রিনের চোখে ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা লিঙ্কের হরফগুলো ভেসে উঠে, গান, ভিডিওর লিঙ্ক সব কিছু একের পর আসতে থাকে চোখের সামনে।


নিজেকে অসাড় মনে হয় তার। সে বুঝতে পারে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে । শত শত মানুষের ভিড়ে সে নিজেকে মিশিয়ে ফেলতে চায়। তার মনে হয় কোথাও তার যেতে হবে, খুব বড় কিছু একটা সে মিস করছে। খুব বড় কিছু। কিছুতেই একে মিস করা যাবে না। আম্ব্রিন দ্রুত সেলফোন বের করে পাপাকে ফোন করতে থাকে। পাপা ফোন ধরছেন না। আম্ব্রিনের বার বার মনে হচ্ছে খুব দেরী হয়ে যাচ্ছে। ওর তো এখন এখানে থাকার কথা না......মম, খুশি আন্টি কেউ ফোন পিক করছেনা। আম্ব্রিনের কষ্ট বাড়ছে। খাঁচায় আটকে পরা পাখির মত সে ছটফট করতে থাকে বারবার পাপা, মম, ইভান ভাইয়াকে ফোন করতে থাকে। যখন ও প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলো তখন ইভান ভাইয়া ফোন রিসিভ করে।

আম্ব্রিন কাঁপা কাঁপা গলায় ইভানকে বলে-তোমরা কোথায় ভাইয়া?-আমরা তো সবাই প্রভাতফেরীতে আম্ব্রিন। শহিদ মিনারে ফুল দিতে যাচ্ছি।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে আম্ব্রিন- কিছু ফুল আমার কাছেও আছে……আমিও দিতে চাই……কথাগুলো বলতে গিয়ে নিঃশব্দে পানি পরে ওর দুচোখ থেকে।
ওপাশ থেকে ইভানের মৃদু হাসির শব্দ আসে। দৃঢ় কণ্ঠে সে বলে- তুমি অপেক্ষা করো…আমি তোমাকে নিতে আসছি……


আম্ব্রিন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ঢাকার আকাশ আজ গাঢ় নীল……বিশ্ববাসী আজ তার দেশের কারণে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছে। হাজার হাজার, কোটি কোটি মাইল দুরের দেশেও আজ একই দিবস পালন হচ্ছে। আম্ব্রিন আকাশ থেকে চোখ নামায়…নিচে তাকিয়ে দেখে ইট দিয়ে বানানো শহীদ মিনারে ফুল উপচে পড়েছে……আম্ব্রিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে আর আপন মনেই প্রান শোনা না যাওয়া স্বরে বলে- আই এম প্রাউড অফ মাই নেশন......আমি একজন গর্বিত বাঙালি......


( এই গল্পে কিছুটা নাটকিয়তার মাধ্যমেই আম্ব্রিনের দেশপ্রেম ও মাতৃভাষা নিয়ে উপলব্ধি দেখানো হয়েছে। বাস্তবে আম্ব্রিনরা হয়ত "জাস্ট হেইট দিস প্লেস" বলে শেষ পর্যন্ত কুইন্সেই ফিরে যাবে আর বাংলাদেশে থাকা সময়গুলো প্রতিনিয়ত ভুলতে চেষ্টা করবে। তাই বাস্তবতার চাইতেও আমার কাছে গল্পজগৎ প্রিয়। গল্পের আম্ব্রিনরা বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে চাইবেনা। আমার ভাবতে খুব ভাল লাগে আম্ব্রিন হাতে ফুল নিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে একটু একটু করে শহিদ মিনারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিংবা আম্ব্রিন এক বুক ভালবাসা নিয়ে কুইন্সে ফিরে গিয়েও ছটফট করছে কবে আবার দেশে ফিরে আসবে...আমার সত্যিই এমন ভাবতে খুব ভালো লাগে...)



-একুয়া রেজিয়া

No comments:

Post a Comment