Subscribe:

প্রিয়...

এটা কি হলো ? এটা এরকম হলো কেন ?? এটা আমার সাথেই বা হলো কেন ??? আই মিন যে আমার পুতুপুতু ভালবাসা দেখলেই এলার্জির মতো লাগে , যে আমি ছেলেদেরকে শুঁয়াপোকার নজরে দেখি , মাত্র তিনদিনের ওয়ার্কশপের পর সেই আমারই কেন রাত্রিতে একটা ছেলেকে স্বপ্ন দেখতে হবে ? এটা মোটেই ঠিক হচ্ছে না । কিন্তু এই ঠিক হচ্ছে না ব্যাপারটাই কেন ঘটছে ? তাও আবার সাথে ?? হোয়াই দিজ কলাভেরি ডি ?? তাহলে কি ঐ ছেলে আমার এতোদিনের পোলা দেখলেই পার্ট খাওয়া ব্যাপারটাকে কলা দেখিয়ে আমাকে ভেড়ী [ভেড়ার মেয়ে ভার্সন] বানিয়ে চলে গেলো !!


আমি খুবই মাথা গরম টাইপ মেয়ে এরকম যারা ভাবছেন ব্যাপারটা মোটেও তা না , বন্ধুদের কাছে আমার পরিচিতি অতিরিক্ত মাত্রায় শান্ত শিষ্ট এবং ধৈর্যের সাগর টাইপ এবং অতিভাল একটা মেয়ে । কলেজে ওঠার পর আমি সেইরকম লেভেলের ভাল কিছু বন্ধু পেয়েছি যাদের সবকিছুই আমার খুব ই ভাল লাগতো একটা ব্যাপার ছাড়া , তা হলো দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা তাদের বয় ফ্রেন্ড [যেটা কীনা তাদের ভাষায় তাদের জামাই ] এর গুনগান !

আমি ছোট্ট মফস্বলের সরকারি স্কুলের মেয়ে ছিলাম , ইট কাঠের ঢাকার অনেক কিছুই বুঝতাম না , আমার অতিরক্ষণশীল মাতা আমাকে সব সময় শিক্ষা দিয়েছেন প্রেম জিনিসটা মহা পাপ একদম ঘোর কলিকালের পাপ , কিন্তু ঢাকায় এসে আমি বেআক্কেল বনে গেলাম এই দেখে সবাই এই কলিকালের পাপকে পকেটে নিয়ে ঘুরছে , প্রথমদিন আমার বয়ফ্রেন্ড নেই শুনে সবাই চোখ মুখ উল্টিয়ে যে ইমো দিয়েছিলো সেটা আজ ও ভুলবার নয় , যেখানে তারা সবাই একেকজন দেখতে সালমান শাহ , খেলায় সাকিব আল হাসান , কন্ঠে বাপ্পা মজুমদার আর পড়ালেখায় বিদ্যাসাগরকে বগলদাবা করে ফেলেছে সেখানে মফস্বলের এই মেয়ের জন্য ইমো দেয়া ছাড়া তাদের আর কিছুই করবার অবশ্য ছিলো ও না !

এবং সেটা অবশ্যিই স্বান্তনার । যাইহোক এই ভয়াবহ টাইপ লুতুপুতু মেয়েগুলোর মধ্য থেকে দুইজন অসাধারণ বন্ধু আমি পেয়ে গেলাম যাদের একজন তুতুল আরেকজন প্রিয়তা । যদিও এই দুজন ও সারাদিন ই তাদের জামাই এর গল্প করতো । যাইহোক এদের জামাইদের প্রশংসা শুনতে শুনতে এবং কলেজে প্রাকটিকাল করতে করতে আমার জীবন যখন নাকের ডগায় চলে এসেছে আর একটাবার নিঃশ্বাস ছাড়লেই দুম করে বের হয়ে যাবে তাতে কোন সন্দেহ নাই ঠিক তখনি মুশকিলে আসান হয়ে টিএসসিতে বসলো বিতর্ক উত্‍সব । খুব ভাল তার্কিক হওয়ার সুবাদে তিনদিনের ওয়ার্কশপে কলেজ থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলো একগাদা অচেনা মানুষের মাঝখানে । প্রথমদিনেই ঘটলো ব্যাপারটা যা ঘটুক আমি কখনোই চাইনি ..

বিতর্ক উত্‍সব ছিলো চারদিনের , প্রথম দিন বিকেলে যেয়ে শুধু রেজিষ্টেশনের কার্ড টা নিতে হবে । সারাদিন ল্যাবে খেটে আমার অবস্থা যখন হালুয়া টাইট , তখন আমি বাসে ঝুলতে ঝুলতে একে তাকে জিজ্ঞেস করে টিএসসি পৌঁছে গেলাম । গিয়ে দেখি বিশাল লাইন , ছেড়ে দে বাবারা , কেঁদে বাঁচি অবস্থা , চোখ বন্ধ করেই কলেজ সিস্টারদের দাঁত মুখ খিঁচানো চেহারা কল্পনা করতে করতে এবং দুর্ভাগ্যের গুষ্টি কিলাতে কিলাতে লাইনে দাঁড়ালাম । কে জানতো চৈত্রের সে বিকেলে ভাগ্যদেবী আমার ভাগ্য নিয়ে আরো কিছু রচনা করবেন !

মিনিপ্যাক শ্যাম্পু সাইজের কার্ড হাতে নিয়েই আমি তার দিকে তাকালাম , সেই মানুষটার দিকে যার দিকে তাকিয়েই হয়তো আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবো ! এরকম কোন সময়েই হয়তো ঠাকুর সাহেব-

প্রহর শেষে আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলেম
আমার সর্বনাশ !

লিখেছেন । এবং তারপরের তিনটা দিন ওয়ার্কশপের কম্বল পুঁড়িয়ে আমার দুটো চোখ শুধু বারবার ঐ মানুষটাকে খুঁজেছে যে কিনা সর্বনাশের বিকেলে গাঢ় নীলের পান্জাবি পড়েছিলো , এবং বলা বাহুল্য তাকে কখনো ব্ল্যাক টি শার্ট কখনো বা সাদা ফতুয়ায় দেখে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখেছে ! তার দেবদূতের মতো চেহারায় এক নিষ্পাপ চাহনি কিংবা তার ভরাট কন্ঠস্বর তারপর থেকেই আমাকে তাড়া করে ফিরেছে ! কখনো ক্লাসে , কখনো প্রাকটিকালে , কখনো কখনো গভীর রাতের স্বপ্ন হয়ে !

অবাক করা সত্যি , ঐ মানুষটা আমার চারপাশটা দখল করে নিলো , যাকে চিনি না , যার নাম পর্যন্ত জানিনা তাকে ভেবে ভেবে পড়াশুনা গেলো চান্দে , চোখের নিচে দেখা গেলো বিটুমিনাস কয়লার খনি ! এবং আমি আবিষ্কার করলাম আমি প্রেমে পড়েছি , কেউ কেউ মোহ ভাবতে পারেন কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি তা আর যাই হোক মোহ নয় , আমি মোহে পড়ার মেয়ে না !

ছেলেরা প্রেমে পড়লে কবি হয় , আমি প্রেমে পড়ে মহিলা কবি হয়ে গেলাম , খাতায় ছাইপাশ লিখতাম অবশ্যই পড়ার টাইমে , প্রতিদিন রিচার্ড মার্কসের ওয়েটিং ফর ইউ শুনতে শুনতে নিজের এবং রুমমেটদের কান পঁচিয়ে ফেললাম এবং অবশেষে একদিন বুধবারের দুপুরে রাজপুত্রের দেখা পেলাম এবং তাও আমারই এলাকায় ! আমার জায়গায় খুব সাহসী কোন আবেগি মেয়ে থাকলে হয়তো ছুটে গিয়ে রাজপুত্রকে জড়িয়ে ধরতো ,হয়তো বলতো-

শুধু একবার ছোঁব তোমায়
তারপর হবো ইতিহাস !

অন্তত আমি সাহসী হলে তাই করতাম কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমাকে সৃষ্টি করার সময় অনেক আবেগ ঢেলেছেন ঠিক ই কিন্তু সাহসের ভান্ডারটা একদম খালি রেখে দিয়েছেন ! আমি তাকিয়ে তাকিয়ে সেদিন আমার রাজপুত্র কে হারিয়ে যেতে দেখলাম , কাঁদবো না কাঁদবো না করেও আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো এবং সেই মানুষটার অবয়ব হয়ে গেলো ঘোলাটে ! প্রিয় পাঠক হয়তো বিশ্বাস করবেন না এরপর থেকে টানা একবছর বুধবারের ঐ সময়টাতে আমি ঐ জায়গায় একা একা ঘুরেছি , প্রচন্ড গরমে কিংবা খুব শীতে অথবা ঝুম বরষায় ! কিন্তু সেই প্রিয়মুখটা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেলো !

একবছর একটা নামজানা মানুষের পায়ে পূজো দিলাম , সময়টা ঠিক একবছর , দিন হিসেবে ৩৬৫ দিন , মফস্বলের সেই আমি তখন অনেকটাই শহুরে , একখানা ফেসবুক একাউন্ট ও আছে ! চৈত্রের বিকেল গুলো খুব সুন্দর হয় , সেরকম একবিকেলে ল্যাপটপ কোলে নিয়ে বারান্দায় বসেছি উদ্দেশ্য বিকেলের আলো দেখা আর সময় কাটানো , বারান্দা আমার অতিপ্রিয় জায়গা আমি সময় পেলেই সেখানে বসে থাকি । যাই হোক , লগ ইনের প্রথম যে ব্যাপারটা আমি চেক করি তা হলো ইনবক্স , আজ উদ্দেশ্য ভিন্ন , ক্লাসের কিছু মেয়ে রিকোয়েস্ট দিয়েছে , বন্ধুতালিকা অতি ছোট রাখার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু ক্লাসমেটদের ঝাড়ি খেয়ে সোজা হয়ে গিয়েছি !


কিন্তু তারপরে যেটা হলো তার জন্য আমি মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না , হঠাত্‍ ই আমার সাজেশনে চোখ পড়ে এবং আমি অবাক বিস্ময়ে দেখি সেই মানুষ টার ছবি ..
ফেসবুকে কাউকে সাজেশনে পাওয়ার আনন্দেও যে মানুষ ভেউ ভেউ করে কাঁদতে পারে তার জ্বলন্ত প্রমান আমি ! ইগোর মাথা খেয়ে তাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিলাম ... তারপর চব্বিশ ঘন্টা টানা ফেসবুকে বসে ছিলাম আমি , যতক্ষণ না অপরপক্ষ একসেপ্ট করে !

এবং যখন তা হলো সবার আগে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস দেখলাম , সত্যি বলছি এতো আনন্দ কখনো লাগেনি যতোটা লেগেছিলো সিঙ্গেল দেখে ! ঐকদিনে আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার ছিলো আমি তার নাম জানি এটা ! সারাক্ষণ হাসনাত প্রতীক নামটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম আর ছবি দেখতাম , এই পোলা আর কিছু পারুক না পারুক খুব ভাল পোজ দিতে জানে , ছবিতে গাদা গাদা নেকু কমেন্ট
ভাইয়া ইউ লুক খিউলজ
ইউ আর অওসাম
ইত্যাদি ইত্যাদি ... ঐসব মেয়েদের চুল ছিঁড়ে শাক রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছে করতো খুব ...

কিন্তু অপেক্ষার পালা শেষ করে একদিন সেই সময় আসলো , সেই সময়টা যার জন্য আমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারতাম !

আমার একমাত্র প্রিয় জন যাকে ঘিরে আমার একজীবনের সমস্ত ভালবাসা , সমস্ত আশীর্বাদ বা শুভকামনা তাকে সে আমার কাছে চৈত্রের দ্বিতীয় বিকেল টা চাইলো , সন্ধ্যাটা চাইলো ...

আমি তাকে না করতে পারিনি , সেই ক্ষমতা তো নিয়েই আসিনি আমি ! তাছাড়া যে সময়ের জন্য এতো অপেক্ষা তা উপেক্ষা করার শক্তি আমার কখনোই ছিলো না ..

কেউ কাউকে গেন্দা ফুল দিয়ে প্রপোজ করতে কেউ জীবনে শুনেছেন ? এই ছেলের রুচি এতো খারাপ ক্যান ? এটা নাকি আবার সামথিং ডিফারেন্ট ! আমি বেআক্কেল হয়ে গেলাম ! টানা একবছর আমি এই রুচিহীন মানুষটার জন্যে অপেক্ষা করে আছি ? শালা আমার কপালটাই এমন কেন ? এই ব্যাটাতো পুরাই একটা খ্যাতের ডিব্বা !

সে যখন আমাকে একটা গাঁদা ফুলের তোড়া ধরিয়ে দিয়েছে এসবই ভাবছিলাম মনে মনে ! আমার একবছরের আবেগ এক মুহুর্তের বেলুনের মত চুপসে গেলো , এই ছেলেকে বাকি জীবন কেমনে শোধরাবো সেই চিন্তা করতে করতে সেদিন বাড়ি ফিরলাম আমি !
বিস্ময়ের আরো কিছু বাকি ছিলো তখনো ...

আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলো সে, হাতে ১৪৩ টা কাঠগোলাপ ...

আমি তখন একজন খ্যাতের ডিব্বার হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার পরম আনন্দে উপর নিচ দুই পাটির সব দাঁত বের করে হাসছি !!


-নূহা চৌধুরী

No comments:

Post a Comment