Subscribe:

ভাববাচক

ধ্যাত্তেরি! ধুস্! যত্তসব!
মাত্র কলমটা হাতে নিলাম। এমন সময় আম্মু এসে বলল, অপু তোকে একটু ভাবী মিঁয়ার দোকানে যেতে হবে। কেন?, অনেক কষ্টে বিরক্তির ভাবটা থামালাম।
“তুই তো জানিসই যে তোর পাশের বাসার আঙ্কেল-আন্টির খুব ইচ্ছে ছিল যে তাদের একটা মেয়ে হবে। আজ একটু আগে তাদের মেয়ে হয়েছে। কিন্তু তবুও ওরা খুশি হতে পারছে না এখন। ঝামেলায় খেয়াল করেনি যে ওদের বাসার খুশির ভাব শেষ। এদিকে আমাদেরটাও শেষ। তুই এক দৌড়ে নিয়ে আয় না বাবা!”
 
আচ্ছা যাচ্ছি, বলে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। আম্মুর দেয়া টাকা হাতে নিয়ে দিলাম দৌড়।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ভাবী মিঁয়ার কথা। তার বাবা দরিদ্র হলেও সাহিত্যমনা ছিলেন। তাইতো তাদের পরিস্থিতি আর কবি নজরুলের দুঃখু মিঁয়া নামের ছাঁয়া অবলম্বনে ছেলের নাম রাখলেন অভাবী মিঁয়া। নামের সার্থকতা রেখেই দিন যাচ্ছিল মুদি দোকানদার অভাবী মিঁয়ার। হঠাৎ ভাবের ডিলারশিপ পেয়ে তার দিন বদলালো, সেই সাথে নামটাও বদলে গেল। আজ সে সবার পরিচিত, প্রয়োজনীয় ভাবী মিঁয়া।
একবিংশ শতাব্দী পার হয়েছে প্রায় দুই শতাব্দী আগে। সভ্যতার কল্যাণে আজ মানুষের আর কোন কিছুর অভাব নেই, অভাব কেবলমাত্র ভাবাবেগ বা ভাবের।
ছেলে-মেয়ে হয়েছে? খুশি হতে পারছেন না? কিনতে হবে খুশির ভাব। পাশের বাসার জামাল সাহেব নতুন গাড়ি কিনেছে? কিনতে হবে ঈর্ষার ভাব। কাছের কেউ ধরণীর মায়া ত্যাগ করেছে? কান্নার ভাব তো কিনতেই হবে।
ভাবের ব্যাপারে আমাদের পাড়ার একমাত্র ভরসা ভাবী মিঁয়ার দোকান। ঢুকলাম তার দোকানে। ভাবী মিঁয়া একাই রয়েছে দোকানে। আমাকে দেখে হাসতে গিয়েও থেমে গেল। হাজার হোক পয়সার জিনিস তো!
কিছু খুশির ভাব দিতে বললাম তাকে। টাকা দিতে গিয়ে মনে পড়ল আমার লেখালেখির ভাবটা প্রায় শেষ। তখন ভাবী মিঁয়াকে বললাম, কিছু লেখার ভাবও দেন। 
দিতে দিতে ভাবী মিঁয়া আমাকে জিজ্ঞেস করল, কত দিন ধইরাই তো লেহার ভাব নিতাছো। তা কিছু কি লেখছো? বেশি না দুই-তিনটা গল্প আর কি, বললাম আমি।
“তা ছাপানের ইচ্ছা নাই?”
আমি বলি, আছে তো। আমার খুবই ইচ্ছা দৈনিক পত্রিকাতে গল্প ছাপানোর।
তা কোন দৈনিকে?, বলে ভাবী মিঁয়া।  
“ঐ যে একটা পত্রিকা আছে না যেটার নাম “দৈনিক পত্রিকা”। এইটাই তো এখন সবচে বেশি চালু।
আরে ঐটাতো আমার বোন জামাইয়ের!, একটু জোরেই বলে ভাবী মিঁয়া। তা তুমার গল্প দিও। ছাপানের ব্যবস্থা হইয়া যাইবো।   

ভাবী মিঁয়ার কথা শুনে খুব দেখাতে ইচ্ছে হল। তাই দেখিয়ে দিলাম আমার বত্রিশটা দাঁত। বললাম, বিকালেই আমার লেখা প্রথম গল্পটা দিয়ে যাব। বলেই খুশির ঠেলায় দিলাম বাসার দিকে দৌড়। আংকেলদের খুশির ভাব থেকে একটু ধার নিয়ে।
ভাবী মিঁয়ার কাছে গল্প দিয়ে আসার তৃতীয় দিন ভোরে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাঁতায় দেখি আমার গল্পটা। দেখে ছোট ভাইটার ঢোলটা নিয়ে বাসায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে নিজের ঢোল পিটালাম। নিজের বাসায় প্রতিভার কদর না থাকলে এমনই করতে হয়।
বিকালে গেলাম ভাবী মিঁয়াকে ধন্যবাদ দিতে। কি কান্ড! ভাবী মিঁয়া আমাকে দেখে প্রায় দশ টাকার হাসলো। আর বলল, আরে লিখক বাবু আহেন আহেন।
আমি বললাম, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
“তুমি ধইন্যবাদ দিবা ক্যান! ধইন্যবাদ তো  আমি তুমারে দিব”, বলেই আমার হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিল সে।
আমার চোখে প্রশ্ন দেখে সে বলল, তুমার গল্প আমারে খুশ করছে। আইজকা ব্যবসাও অনেক ভালা হইছে।
প্রশংসা শুনে আমিও প্রায় পাঁচ টাকার হেসে ফেললাম।
ভাবী মিঁয়া এরপর বলল, তুমি প্রত্যেক হপ্তায় আমার কাছে একটা কইরা গল্প দিবা। আমি ছাপামু।            
তার কথা শুনে তখন নিজের টাকায় খুশির ভাব কিনে খুশিতে নাঁচতে নাঁচতে বাসায় গেলাম।
পাঁচ সপ্তাহে আমার পাঁচটা গল্প ছাপা হয়েছে দৈনিক পত্রিকায়। ভাবী মিঁয়াকে ছয় নাম্বার গল্পটা দিতে গিয়ে দেখি তার দোকানের সামনে মানুষের লম্বা লাইন। ঠেলে-ঠুলে বহু কষ্টে ভিতরে ঢুকলাম।
দেখি ভাবী মিঁয়া খুশিতে ষোলখানা হয়ে আছে। আমার হাত থেকে জলদি গল্পটা নিলেন। আজকে আমার হাতে দুই হাজার টাকা দিয়ে বললেন, তুমার গল্পের জন্যে আমার ব্যবসা অনেক বাইড়া গেছে। তুমার গল্প পইড়া আমার দোকানে পাড়া ভাইঙ্গা মানুষ ভাব কিনতে আইতাছে।
ভাবী মিঁয়া হঠাৎ আমার  চোখের দিকে তাকিয়ে ঝলমলে খুশি দেখে বলল, দুক্ষু খালি একটাই!
আমি বললাম, কিসের দুঃখ?
“সবাই খালি একটা ভাবই কিনতাছে।”
কোন ভাবটা?, আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
বিরক্তির ভাব, হাসিমুখে বলে ভাবী মিঁয়া।   
তার জবাব শুনে হাসির ভাব কিনব না কান্নার ভাব কিনব বুঝতে পারছিলাম না। মিনিট কয়েক চুপ থেকে কিছু কষ্টের ভাব নিয়ে দোকান থেকে বের হলাম। ভাবী মিঁয়া টাকা নেয়নি, এম্নিতেই দিয়ে দিল।
পাড়ার মোড়ে গিয়ে দেখি অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। হাতে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাঁতা। তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় কানে এল, ধাত্তেরি! ধুস্! যত্ত………!!!


-মশিউর রহমান খান(ঈদ গল্প লেখা প্রতিযোগিতা)

No comments:

Post a Comment