ক্লাসে ঢুকতেই ডানদিকের কোণ হতে হেড়ে গলাটা ভেসে এলো ...
"তুমি বেশ বদলে গেছোওওও
পুরোনো সৈকতে আর পানশী ভেরাও না আআআআ !!"
বাসায় সবার সাথে সাত সতেরো নানা কিছু নিয়ে ঝগড়া করে ক্লাসে এসেছি , মেজাজ এমনিতেই সপ্তম , অষ্টম বাদ দিয়ে একেবারে নবমে চড়ে আছে আর ফাজিলটার ফাজলামি বন্ধ হয় না ! চড়ায়ে চাবকায়ে গাল পিঠ সব লাল নীল বানায়ে দেয়া দরকার ।
ব্যাগটা ধড়াম করে ডেস্কে রেখে ফাজিলটার কাছে গেলাম , কান টেনে আজ আধ হাত লম্বা করে দেবো !
ঐ ইতর , কোনা থেকে হাঁড়িচাচার মত চেঁচাচ্ছিস ক্যান ?
"আহ্ ! কতদিন শুনিনি গালিইইই
তবু ... মনে পড়ে তব সব গালিইইই "
ঐ আবার ? আবার ? সমস্যা কি ? হেমন্তের গানের তো সাড়ে তেরোটা বাজিয়ে দিলি ? অফ যা !
ম্যাডাম কি সকালে করল্লার জুস খেয়ে এসেছেন ?
না রে তবে টয়োটা করল্লার বারোটা বাজায়ে দিয়ে আসছি ! দাঁত বের করে হাসলাম ।
ঘটনা কি দোস্ত ? শোভন অতিরিক্ত মাত্রায় উত্সাহী হয়ে বকের মত গলাটা বাড়িয়ে দেয় !
ও আচ্ছা , আমি তো শোভনের পরিচয় দেইনাই এখনো । আমি আর শোভন , ভার্সিটির সবচেয়ে হিট জুটি । এইচ এস সি তে চায়না পান্ডার মত বিশাল সাইজের ব্যাম্বু খাবার পর দুজনেই একসাথে একটা প্রাইভেট ইউনিতে ভর্তি হয়ে যাই । তার কারণ ও ছিল ! এডমিশন টেস্ট দিলে কে কোন মুল্লুকে পড়তাম কে জানে , আমি আর শোভন আর যাই হোক দুজন একসাথে কলেজ থেকে আছি ।
কলেজ লাইফের সময় দিনের চব্বিশ ঘন্টার চৌদ্দ ঘন্টাই একসাথে কাটিয়েছি আর এখন বিশ ঘন্টাই কোন না কোন ভাবে একসাথে থাকা হয় , যতক্ষন পাশে থাকিনা , ভার্চুয়ালি পাশে থাকি , চিন্তা কি ফেসবুক হ্যায় না ?
ইত্যাদি সব কারণে ক্লাসের বেবাক মানুষের ধারণা হয়েছে শোভন আর আমার মাঝে হয়তো কোন চক্কর আছে ! শুধু আমি জানি ওর ভেতরের খবর ! ক্লাস সিক্স থেকে কোন মেয়ের উপর পোলটি খেয়ে আছে , তুমি আমার প্রথম প্রেমে মগ্ন মজনু আজো গ্রীণ সিগনাল পায়নি ,তাতে কি নিয়মিত ঐ মেয়ে কে তার জ্বালানো চাই !
একদিন রাতের তিনটার সময় আমাকে ফোন দিয়ে বলে দোস্ত জানিস কি হয়েছে ?
এমনেই আমার ঘুম টুম হয় না যাও একটু ঘুমিয়েছি এই ইতরের তা সহ্য হয় নাই ! মেজাজ কোনরকমে কন্ট্রোলে রেখে জানতে চাইলাম
সে তার বিখ্যাত হে হে হাসি দিয়ে বলে জুঁইরে ফোন দিসি ।
তো ?
কথা হইসে ! [আবার হেহে হাসি !]
তো ?
ওরে ফার্স্ট কি বলসি জানিস ?
কি ?
তোমার বাসার টেবিল ক্লথ কি রঙের ?
ও কি করসে ?[আমার মাথায় আগুন ধরে গেসে]
ও ফোন রেখে দিসে !!
খুব ভাল করসে , বলে আমিও ফোন কেটে দিয়েছিলাম ! এরকম আজাইরা খেজুরে পকপকানি করতে করতেই আমাদের অনেক দিন কেটে গেছে , এখন আমরা ফোর্থ ইয়ারে । শোভন তার নায়িকা নিয়ে খুব এগোতে পারে নাই , আমার বাসাতে বিয়ে নিয়ে সব পাগল হয়ে গিয়েছে এমনি একদিনে ক্লাসে রেগে মেগে এসেছি , বাকী টুকু তো জানেন ই !
শোভনের সামনে ঝোঁকানো মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে বললাম ,৪ টয়োটা করল্লার মালিকের সাথে আমার বিয়ে !
"ভালো না !" মুখ বেঁকিয়ে শোভনের উত্তর ।
আমি অবাক হয়ে বললাম,"ক্যান ?"
"প্রিমিও হলে ভালো হইতো" , বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব নিয়ে উত্তর দিল ।
আমার খুব রাগ হলো , ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে এলাম । সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে বললাম , মা আমি বিয়েতে রাজী ।
তারপর সবকিছু খুব দ্রুত ঘটে যেতে লাগলো , এনগেজমেন্ট এর পর ভার্সিটি যাওয়া বন্ধ করে দিলাম , মোবাইলের সিমটাও চেন্জ করলাম । কেন কি করছি জানি না , কারো উপর খুব অভিমান হচ্ছে ।
সময় যেন আমার হাতের তালুতে থাকা ঘোড়া হয়ে গেলো , টগবগ টগবগ করে পেরিয়ে যাচ্ছে , কিন্তু আমি হাত মুঠো করেও আটকাতে পারছিনা !
এমনি করেই আমার বিয়ের দিন এসে গেলো । বউ সেজে স্টেজে বসে আছি , শোভন এসে আমার পাশে বসলো । আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে কষে দুটো চড় লাগাতে ! ওকে দেখে আমার বুকের ভেতরে কেমন একটা দোমড়ানো মোচড়ানো অনুভূতি , খুব কষ্ট করে বললাম , ভাল আছিস ?
গত কয়েকদিন ধরেই শোভন আমাদের বাড়ীতে , বিয়ের যাবতীয় কাজ সে নিজ হাতে করেছে । খুব উত্ফুল্ল একটা ভাব ও দেখিয়েছে । এতো খুশির কারণ কি আল্লাহ মালুম !
দাঁত কেলিয়ে শোভন উত্তর দিলো
তুই জানিস তোর বর প্রিমিও নিয়ে আসবে ?
আমার মেজাজ খারাপের শেষ সীমায় চলে গেছে , ওকে শুধু বললাম তুই যা এখান থেকে ।
শীষ বাজাতে বাজাতে ভয়াবহ নির্বিকার ভাব নিয়ে ও চলে গেলো , ছেলেটাকে কি তবে আমি একাই এতো ভালবেসেছি ? আমার খুব কান্না পাচ্ছে , খুব বেশি ।
কেমন করে কাজী কে কবুল বলেছি জানি না , কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করছিল ঐ সময়ে , আমি এখন আরেকজনের বৌ , এটা ভাবতেই মাথা ঘুরাচ্ছে ! শুভ দৃষ্টির সময় আমার সদ্য হওয়া জামাই আমার পাশে এসে বসলো , ইচ্ছে করছিলো একলাফে উঠে যাই ! গোল আয়নাটা সামনে এনে যখন রাখলো থাবা দিয়ে ঐটা ভাঙার ইচ্ছা খুব কষ্টে সামাল দিলাম ! চোখ দুইটা জলে ভরে যাচ্ছে , কীসের শুভ দৃষ্টি , কীসের কী ?
আয়না থেকে ওড়না সরিয়ে সবাই চোখ রাখতে বলছিল , আয়নায় দৃষ্টি পড়তেই আমি ও মা "একি" বলে ফিট হয়ে গেলাম !
ঘোড়ার গাড়িতে বসে আছি , এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না শোভনের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে ।
শোভনের ম্যালা ফিচলামি বুদ্ধি আছে ,কিন্তু বিয়ের মতো ব্যাপারে ও সে এটা দেখাবে বুঝিনাই ।
বর পক্ষকে সে এবং আমার আপন ছোটভাই যেয়ে বলে এসেছে নিজেদের কিছু সমস্যায় বিয়েটা নেক্সট উইকে হবে , সব ঠিক ঠাক শুধু আজকের জায়গায় নেক্সট উইক । ঐ বেচারা রা সরল বিশ্বাসে তা মেনেও নিয়েছে । এই ফাঁকে শোভন তার পরিবার নিয়ে এসে আমাকে বিয়েই করে ফেললো ! আত্নীয় স্বজন এবং সমাজ ইত্যাদির জন্যে আম্মা আব্বাও ঝামেলা করে নাই ।
পান থেকে চুন খসলে যে কি হতো চিন্তা করে আমি শিউরে উঠছিলাম ।
হঠাত্ শোভন আমার হাতে হাত রাখলো । আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো , কীরে প্রিমিও পছন্দ হয়েছে ?
অনেক আগে কোন এক বিকেলে বলেছিলাম , আমি শশুড়বাড়ী ঘোড়ার গাড়ী করে যাবো , সব ও মনে রেখেছে ! চোখ বারবার ভিজে আসছিলো !
ওর হাতেও দু এক ফোঁটা পড়েছিলো , ও আবার কানের কাছে মুখ এনে বলল , আজকে যা কাঁদার কেঁদে নে , ফিউচারে কাঁদতে দেখলে চোখ গেলে দিবো !
তারপর বেসুরো হেঁড়ে গলায় গান ধরল,
"তুমি আর নেই সে তুমিইইই
ছিলে বান্ধবী হলে বউউউউ
তুমি আর নেই সে তুমি..."
(সত্যি কাহিনী অবলম্বনে)
-নূহা চৌধুরী
No comments:
Post a Comment