Subscribe:

বেঁচে থাকুক অনুভুতিগুলো.......

রাস্তা ধরে হাঁটছি তো হাঁটছিই।কত সময় ধরে হাঁটছি তা ঠিক মনে নেই।মেজাজটা এত বেশী খারাপ হয়ে আছে যে সময়ের দিকে খেয়াল করিনি।পায়ে ব্যাথা করছে।কোথাও একটু বসা দরকার।সামনেই একটা পার্ক আছে। পার্কের দিকেই এগোলাম। বাসা থেকে বেরিয়েছি ঠিক ভরদুপুর বলতে যা বোঝায় সে সময়ে।দুপুরে খাওয়া ও হয়নি।ভুল হয়ে গেছে।খাবারের উপর রাগ দেখানো ঠিক হয়নি।অবশ্য রাগ না করেই বা কি করবো?
এই রোদের ভেতর
ভার্সিটি থেকে এসে রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখি সৃজন তাঁর বন্ধুবান্ধ নিয়ে আমার রুমে এক বড়সড় আসর বসিয়েছে।তুই
তোর বন্ধুদেরকে নিয়ে কম্পিউটারে গেমস্ খেলছিস খেল,কিন্তু আমি যখন রোদে পুড়ে বাসায় ফিরলাম তখন তুই ওদের নিয়ে তোর রুমে চলে যেতে পারতি।মা কে বললাম।

মা আমাকে বলল,"তুই একটু ড্রয়িং রুমে বসতে লাগ,আমি সৃজনকে বলছি"।
মেজাজটা গেলো আরো খারাপ হয়ে,"আমি ড্রয়িং রুমে বসবো কেন?ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে আমার রুমের ভেতর হইহুল্লোড় করবে,আর আমার বসে থাকতে হবে ড্রয়িংরুমে"?
মা বলল,"ও তো রোজ রোজ এমন করেনা।ও তো বন্ধুবান্ধব নিয়ে তেমন বাসায় আসেনা।তুই একটু বোস,আমি ওকে ওর বন্ধুদেরকে নিয়ে ওর রুমে যেতে বলছি"।

বাইরে থেকে এসেছি বিধায় গরম একটু বেশীই লাগছে।তাই চিন্তা করলাম কিছুক্ষন ড্রয়িংরুমে বসা যাক।এর ভেতর মা নিশ্চয় আমার রুমটা ফাঁকা করে ফেলবে।ড্রয়িংরুমের দিকে এগোলাম।ফ্যান ছেড়ে মাত্রই বসতে যাবো,হঠাত্‍ করেই চোখ পড়লো গিটারটার দিকে।কাল রাতে তো আমি গিটারটা ব্যাগে ঢুকিয়ে আমার রুমেই রেখেছিলাম।তবে এটা ড্রয়িংরুমে কেন?ব্যাগ খুলে গিটারটা বের করেই আমার রাগ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেল।গিটারের ১টা তাঁর ছেড়া।বুঝতে বাকি রইলোনা গিটারের এই অবস্থা কে করেছে।চিত্‍কার করে মাকে ডাকলাম।আমার চিত্‍কারে মা হতভম্ব হয়ে ছুটে এলো।
"মা,তোমার ছেলে এগুলো কি শুরু করেছে?আমার রুমে আমি ওর জন্য ঢুকতে পারবোনা,আমার গিটারের তার ছিড়ে ফেলবে,আর কি কি করবে ও"?

একটু জোরেই বোধহয় বলেছিলাম কথাগুলো।দেখলাম সৃজন ভয়ার্ত চোখে দরজার পাশে দাড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।ইচ্ছা করছিলো ওর মুখের উপর জোরে একটা চড় বসিয়ে দিই।ইচ্ছাটা অনেক কষ্টে দমন করলাম।রাগ করে বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি তখনই।মা কয়েকবার পিছন থেকে ডেকেছিলো,কিন্তু আমি রাগলে আমার রাগ ভাঙ্গাবে কে?

হাঁটতে হাঁটতে পার্কের ভেতর ঢুকে পড়লাম।বসার একটা জায়গা পেয়ে গেলাম।কখন যে বিকেল হয়ে গেছে টেরই পাইনি।আজ বিকেলের আবহাওয়াটা খুব সুন্দর।সূর্যটা সারাদিনের কর্মব্যাস্ততার শেষে ছুটি নেওয়ার আয়োজন করছে।
এখন রাগটা একটু কমেছে।ক্ষুধা লেগেছে খুব তা বুঝতে পারছি।ক্ষুধার সাথে রাগের বোধহয় একটা সম্পর্ক
আছে।

"ভাইজান,বাদাম লইবেন"?
যে ক্ষুধা লেগেছে তা এই বাদাম খেয়ে মিটবেনা,তাই বাদামওয়ালা ছেলেটাকে বললাম,"লাগবেনা"।

ছেলেটা বিষন্ন মুখে চলে গেল।ছেলেটার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম,বয়স আনুমানিক ১৪-১৫ হবে।পুরো পার্ক জুড়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে আর বাদাম বিক্রির চেষ্টা করছে।কিন্তু অনেক বাদামওয়ালার ভিড়ে বিক্রি করতে পারছেনা।অবশেষে আমি ডাকলাম ছেলেটাকে।
-"ভাইজান বাদাম লইবেন"?
-"দে,ক্ষুধা মেটাই।"
-"ভাইজান,আমার কাছে এহন ১০ ট্যাহার মতো বাদাম আছে,পুরাটুক লইবেন"?
-"দে"।
ছেলেটার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক দেখলাম।
-"পুরোটুকু নিয়েছি বলে অনেক খুশী হয়েছিস মনে হচ্ছে"?
-"হ ভাইজান।অনেক খুশী হইছি"।
-"বাদাম তো এক সময় না এক সময় বিক্রী হতোই,এতে এতো খুশী হওয়ার কি আছে?"অবাক হয়ে জিঞ্জস করলাম ছেলেটাকে।ছেলেটা আমার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,

-"ভাইজান,আমার একটা ছুডো ভাই আছে।অনেকদিন ধইরা ও আমারে কইতাছে একটা বল কিইন্যা দিতে।
কিন্তু আমি ট্যাহা পামু কই?বাদাম বেইচ্যা যা পাই তা দিয়া বাজার করন লাগে,মায়ের ওষুধ কেনন লাগে।বাপ বাইচ্যা থাকলে বাপেই ওরে বল কিইন্যা দিতো।কিন্তু বাপ তো মইরা গেছে।অনেক দিন ধইরা ১ ট্যাহা কইরা জমাইতেছি। আর আইজতো সব বাদাম বেইচ্যা ফ্যালাইছি,আইজ মনে হয় ওরে বল কিইন্যা দিতে পারুম।আর যদি একটু আগে আগে যাইতে পারি তাইলে ওর লগে কিছুক্ষন খেইলতে ও পারুম।এই জন্যিই খুব খুশী খুশী লাগতেছে।"

ছেলেটার কথা শুনে মনে হল কিছু সময়ের জন্য আমার পৃথিবীটা থেমে গেছে।নিজের ভেতর কেমন একটা অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছে যেন।এই ছেলেটার যেমন একটা ছোট ভাই আছে,তেমন তো আমারো একটা ছোট ভাই আছে,যার উপর রাগ করে আমি বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি!আচ্ছা,এই ছোট্ট বাদামওয়ালা ছেলেটা কি আমাকে নতুন করে "ভালবাসা" নামক অনুভূতিটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেল?নিজের উপর কেন যেন তীব্র ঘৃনাবোধ জন্মালো।এই বাদামওয়ালা ছেলেটা অনেক আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে,কারন ও আজ ওর ছোট ভাইকে একটা বল কিনে দিতে পারবে।আর আমি?আমি বাসা থেকে বেরিয়ে এসেছি আমার ছোট ভাইয়ের উপর রাগ করে!

আচ্ছা,আমি কি সৃজনকে কখনো কিছু কিনে দিয়েছি?অবাক হলাম,কারন আমার ঠিক মনে পড়ছেনা সৃজনকে কখনো কিছু দিয়েছি কি না!সব সময় তো ওর সাথে রাগারাগিই করি।
সৃজন আমার ৫ বছরের ছোট।ছোটবেলায় তো এই পিচ্চিটা সবসময় আমার ঘাড়েই থাকতো!সেই ছোট্ট পিচ্চিটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে।
সময়ের সাথে সাথে ওর আর আমার দূরত্ব ও বেড়ে গেছে অনেক।হয়তো আমার কারনেই এই দূরত্বের সৃষ্টি।এই দূরত্বটা কি ঘোচানো যায় না?বাদামওয়ালা ছেলেটার মতো আমারো ইচ্ছা করছে আমার ছোট ভাইটাকে কিছু একটা উপহার দিতে।কিন্তু কি দেওয়া যায়?ও কি পছন্দ করে তাইতো আমি জানিনা!ছোট বেলায় ও চকলেট অনেক পছন্দ করতো,কিন্তু এখন তো ও অনেক বড় হয়ে গেছে!ঠিক করলাম আজ আমি ওকে চকলেটই দেবো,ঠিক সেই ছোট্টবেলার মতো।ও হয়তো চমকে যাবে!
ওর এই চমকে যাওয়া দিয়েই শুরু হোক না আবার নতুন করে ভালবাসার গল্প লেখা!এভাবেই না হয় শুরু হলো আমার দূরত্ব ঘোচানো পর্ব!বুকের মাঝে নতুন করে অনুভব করি হারিয়ে যেতে বসা এক অনুভূতি।ছোট ভাইটার জন্য ভালবাসার অনুভূতি।আমি উঠে পড়ি।সৃজনের জন্য চকলেট কিনতে হবে।পা বাড়াতেই মোবাইলটা বেজে উঠলো।

স্ক্রীনে মা এর নম্বরটা দেখতে পেলাম।-"ভাইয়া,আমি সৃজন।স্যরি ভাইয়া।ভাইয়া,আমি আর কখনো কম্পিউটারে বসবোনা,কখনো তোমার গিটার ধরবোনা।ভাইয়া,তুমি শুধু বাসায় এসো.....।"

এক নিঃশ্বাসে ভাঙ্গা গলায় কথাগুলো বলে গেলো সৃজন।আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আমার ভাইটা কত সুন্দর
করে স্যরি বলা শিখেছে!অথচ এক সময় আমার নামটা ও ভাল করে বলতে পারতোনা!অনেক কষ্ট করে মুখ বাঁকিয়ে বলতো "তুবো ভাইয়া"!
 চোখটা কেন যেন বারবার ভিজে যেতে চাচ্ছে আজ।গলাটাও কেন যেন ধরে আসছে।খুব ইচ্ছা করছে আজ সৃজনের মুখ থেকে "তুবো ভাইয়া" ডাকটা শুনতে।সৃজনকে শুধু বললাম,"সৃজন,ভাইয়া তুই বাসায় থাক,আমি আসছি......."

-মোস্তাফিজুর রহমান (শুভ)
FB ID:Shuvo Rahman

No comments:

Post a Comment