Subscribe:

ভাঙ্গা-গড়া

প্রচন্ড বৃষ্টি । আশেপাশে শুধু পানির টুপটাপ শব্দ । রাস্তার কাদা সব ভেসে ভেসে নালায় গিয়ে পড়ছে । পাখিগুলো সব দালানের সানসেটে কিংবা গাছের পাতার ভেতর । কীটপতঙ্গগুলো যে কোথায় পালিয়েছে বলা মুশকিল । বাতাসের শো শো আওয়াজকে উপেক্ষা করে শোনা যাবে এমন কিছু কানের পাশে নেই । ভর দুপুর । বিকেল হবার সময় হয়েছে । সূর্য বৃষ্টির ফোটাগুলোকে আলোয় ঝলসে দিচ্ছে । ছোট্ট একটা যাত্রীছাউনি । দুজন মানুষ ।



একজনকে মানুষ না বলে বাচ্চা বলা ভালো । নাম মানিক । এই এলাকার টোকাই । বয়স বেশি হলে তের কি চোদ্দ । বাবা ছোট থাকতেই চলে গেছে সংসার ছেড়ে । মা আর একটা বোন ছাড়া আপন বলে কেউ নেই । আর একটা ছোট্ট পলিথিনের বাসা । এই মানিকের দুনিয়া ।
মানিককে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে । তার কারন একটা দুটো নয় । বৃষ্টি হচ্ছে তার মনেও । এই মূহুর্তে চোখ বন্ধ করেই মানিক দেখতে পারছে - বাসায় মা পলিথিনের ফুটোগুলো দিয়ে পড়া বৃষ্টির পানি ঠেকাতে ব্যস্ত ; ছোট বোনটা কাতরাচ্ছে অসুধের অভাবে । শুধু তাই নয় সকালে এসে বস্তির সর্দার জামাল চাচা এসে বলে গেছে গত দুমাসের টাকা পরিশোধ করতে । নইলে আর থাকার জায়গা মিলবেনা কাল থেকে । মানিক আর তার ছোট বোন দুজনেই টোকাইয়ের কাজ করে । দিন শেষ পায় কিছু টাকা । সে টাকাতে কিছুই হয়না । শুধু পেটে পাথর বেধে বেচে থাকা যায় । মানিকের মা ঘরে ঘরে কাজ করে বেড়ান । তিনি টাকা জমান , তবে খুবই অল্প । সেটা দুর্দিনের সাথী হিসেবে রাখা । কিন্তু তা আর নেই বললেই চলে ।


গত এক সপ্তাহ ধরে মানিকরা খুব সমস্যার মধ্যে আছে । প্রথমেই হল ছোট বোনের জ্বর । তার পর থাকার ভাড়া । মায়ের কাজ পাওয়ার ব্যাপারটাও কমে গেছে এখন । সব মিলিয়ে বিভিষিকার মাঝে পড়ে গেছে তিনটি নিরীহ প্রাণী । কারোই কিছু করার নেই । মা ঠিকমত কাজে যেতে পারছেন না । মেয়ের দেখাশোনা করতে হচ্ছে । মানিক তার ছোট বোনের কাজটাও নিজের সাথে মিলিয়ে করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে । কিছু করার নেই , কারন নইলে ওস্তাদ দুজনের টাকা দেন না , একজনের টাকা দেন । আর এই সময়ে টাকার বড়ই দাম । টাকার অভাবে বোনকে ঠিকমত ওষুধ দিতে পারছেনা মানিক । মায়ের জমানো টাকা প্রায় শেষ । যা আছে , তা দিয়ে ভাড়া বা বোনের ওষুধ কোনটাই পুরো সামলানো যাবেনা । একটাই উপায় ছিল- ওস্তাদকে বলে অগ্রিম টাকা নেয়া । কিন্তু সে চেষ্টাতেও ব্যর্থ হয়েছে মানিক । কারন আজ ওস্তাদের বড় ছেলে মোবাইল চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে । পুলিশের কাছ থেকে ছুটিয়ে আনতে ভালই টাকা গেছে ওস্তাদের । মানিকের কথায় তাই দাম দেননি ওস্তাদ । অর্ধেক কথা শুনেই খেপে বলেছেন “ওই গরীবের বাচ্চা গরীব , কাম ঠিক মত করবার পারস না , আবার ট্যাকা চাস কোন দুঃখে ? দূর হ আমার সামনে থেইকা । হারামজাদা ।” বলেই একটা লাথি মেরেছেন ওস্তাদ । মানিক ছোটলোকের মত আবার বলতে চায় , কিন্তু কি ভেবে আর বলে না । তারপর সোজা এসে রাস্তায় হাটতে থাকে । এই সময় শুরু হয় বৃষ্টি । বস্তির চাচি মাঝে মাঝেই বলতেন “গরীবের লাইগা সবচে বড় ঝামেলা হইল গিয়া পানি । পানি মানেই ট্যানশন , বিরাট ট্যানশন ।” কথাটা ভাবতে ভাবতে যাত্রীছাউনির নিচে আসল মানিক । ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে , খেয়ালই করেনি । খেয়াল করবেই বা কিভাবে , তার মাথায় এখন মায়ের আর ছোটবোনের চিন্তা । নিজের ভেতর ডুবে গেছে মানিক । সেই যে বসে আছে , এখনো বসার জায়গা থেকে একচুল নড়েনি । নড়ার বোধটাও হয়নি ।


আরেকজন হল কাব্য । ভার্সিটির ছাত্র । ডিপার্টমেন্টের থার্ড বয় । ছিমছাম গড়ন , মায়াবী চেহারা । ডিপার্টমেন্টের ছোট ভাই বড় ভাই সবাই তাকে চেনে । কাব্যরা তিন ভাই বোন । মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান সে । কাব্য শুধু লেখাপড়া করে তা না , ভালো গান গায় (সুপ্ত প্রতিভা) , কবিতা লেখে আর অভিনয় করে । অভিনয় করতে গিয়েই সাফার সাথে পরিচয় হয় । দু বছরের জুনিয়র ছিল সাফা । প্রথম যেদিন সাফাকে দেখল , সেদিন কাব্য থিয়েটারে জমিদার দর্পনের একটা পার্ট করছিল । এই সময়ে মেয়েটাকে চোখ পড়ে তার । মেয়েটা হা করে তাকিয়ে আছে কাব্যর দিকে । কাব্যর হঠাৎ কি হল – স্ক্রিপ্ট ভুলে গেল । আবার প্রথম থেকে শুরু করতে হল । এভাবে সপ্তাহ খানেক কাটল । প্রতিদিন একই অবস্থা । কাব্য অভিনয় করে আর মেয়েটা হা করে সব গিলে । নাহ , আর থাকা যায়না । একদিন কাব্য রিহার্সেলের মাঝখানে বলেই ফেলল “এই মেয়ে । কি দেখ ? হা ?” প্রশ্ন দুটো শুনে সাফা ফাটা বেলুনের মত চুপসে যায় । কোথায় যে লুকোবে সেটা ভাবতে ভাবতেই কাব্য স্টেজ থেকে নেমে এসে সাফার সামনে দাড়ায় ।


-নাম কি তোমার ? কোন ডিপার্টমেন্টে পড় ? এভাবে চেয়ে থাকার কি হল ? কি দেখার আছে এত ?
কথাগুলো বলা শেষ না হতেই মেয়ে ঠোট উলটে দৌড় । কাব্য অবাক । কি রকম মেয়ে রে বাবা ? কিছু না বলতেই.........? যাই হোক , এত ভাবার সময় নেই কাব্যর । সে আবার রিহার্সেলে মন দেয় ।


          বাসায় ফিরে গোসল সেরে খাওয়া দাওয়া করে টিভি দেখতএ বসল কাব্য । এই সময় বাবা এলেন । বাবার হাতে রিমোট দিয়ে সরে বসল কাব্য । সে জানে বাবা তাকে এখন কিছু ছকবাধা প্রশ্ন করবেন । সেও উত্তরের জন্য প্রস্তুত ।
-কখন এসেছ ?
-সন্ধায় ।
-খেয়েছ ?
-জ্বী ।
-সারাদিন একটাও ভালো কাজ করেছ ?
-না ।
-মাশআল্লাহ । এই না হলে আমার বেটা । সারাদিন একটাও খারাপ কাজ করেছ ?
-না ।
-ভাল কাজ করনি , খারাপ কাজও না । এর চেয়ে এক বস্তা ঘাস কাটা ভাল ছিল ।
-আমি যাই ।
বলে নিজের রুমের দিকে রওনা দিল কাব্য । বাবা যেমন রসিক , তেমন খোচা মারতেও ওস্তাদ । তাই আর খোচা খাওয়ার ইচ্ছে নেই কাব্যর । রুমে ঢুকে শুয়ে পড়ল কাব্য । ঘুমাতে চাইছে , ঘুম আসছেনা । কেন জানি মনটা খটখট করছে । বাবার সাথে কথাগুলো আবার মনে করার চেষ্টা করল কাব্য । ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল মেয়েটার কথা । বেচারী । কাব্য ভাবেওনি মায়েটা এভাবে দৌড়ে পালাবে । নাহ , এভাবে বলা ঠিক হয়নি । কাল গিয়ে একটা সুরাহা করতে হবে । ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল কাব্য ।


          পরদিন ভার্সিটিতে গিয়ে খোজ লাগালো কাব্য । জানা গেল মেয়ের নাম সাফা , একই ডিপার্টমেন্টে পড়ে , দু ব্যাচ জুনিয়র । খবর নিয়ে মেয়েটাকে খোজা শুরু করল সে । দুদিন পর দেখা মিলল সাফার । কাব্যকে দেখে উলটো ঘুরে যেই পালাতে যাবে , কাব্য ডাক দিল “এই মেয়ে , এদিকে আসো ।” আর পালানো হলনা সাফার । তাড়াতাড়ি এসে ক্ষমা চাইল কাব্য ; প্রস্তাব দিল চা খাওয়ার । সাফাও লাজুক মেয়ে , না বলতে পারলনা ।


          এভাবেই শুরু দুজনের কথা বলা , একসাথে হাটা , ভাল লাগা । শেষমেষ তিন মাসের মাথায় ভালোবাসা । সাফা যথেষ্ট ধনী ঘরের মেয়ে । তার চালচলন তাই একটু ভিন্ন ধরনের ছিল , তার পছন্দ , তার চাওয়া পাওয়া , তার চিন্তাভাবনাও । সবই মেনে নিয়েছিল কাব্য , কিন্তু সেটা আর বেশিদিন ভালো থাকলনা । সাফা ভালো গান করত , এভাবেই একটা মিউজিক ফার্মে যাওয়া আসা ছিল তার । সেখানে অনেক রকম বন্ধু ছিল । কাব্য কখনো সাফাকে এটা নিয়ে বেশি ঘাটাত না । সাফা মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন আড্ডা বা অনুষ্ঠানে যেত । কিন্তু এভাবেই যেতে যেতে একটা ব্যাপার কাব্যর কাছে ধরা পড়ে যায় । সে জানতে পারে সাফা ইয়াবা আসক্ত । জানার পর কাব্য ঠান্ডা মাথায় সাফাকে জিজ্ঞেস করে- সেটা সত্য কিনা । সাফা মেনে নেয় । খুব কষ্ট পায় কাব্য । কারন সাফার প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ছিল । তার ভালোবাসা তাকে এভাবে কষ্ট দেবে ভাবতেও পারেনি । তাই কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল কাব্য । সাফাকে বলল “আমি তোমাকে ভালোবাসতাম , ভালোবাসি । কিন্তু তার দাম যদি দিতে চাও , নিজেকে শুধরে নাও । তোমাকে আমি এক মাস সময় দিচ্ছি । ” বলে চলে আসে কাব্য ।


          এরপর কাব্য সাফার সাথে যোগাযোগ কিছুটা কমিয়ে রেখেছিল । কিন্তু প্রতিদিন তিনবেলা সাফার খোজ নিত । সাফাও বাসায় বেশি সময় কাটাত । ভালই চলছিল , কিন্তু দু সপ্তাহ যাবার পরেই সাফার কিছু পুরোন বন্ধু বাসায় আসতে শুরু করে । সেখানে আবার নিজেকে হারিয়ে ফেলে সাফা । গতকাল দুপুরে বাসায় সাফার বাবা মা ছিলেননা । এ সুযোগে বন্ধুদের সাথে আবার ইয়াবা খায় সাফা । সাথে আরো কিছু । পরিস্থিতি খারাপ হয়ে পড়ে । কাব্যকে কথাগুলো জানায় সাফার বাসার কাজের ছেলে । সাথে সাথে কাব্য আসে । এসে যা দেখে তার জন্য ও কখনোই প্রস্তুত ছিলোনা । একদল মাতালের সাথে পড়ে আছে সাফা , একজনের হাতের পাশে একটা হ্যান্ডিক্যাম । সেটা তুলে নিয়ে প্লে ব্যাক করে কিছু ভিডিও চোখে পড়ে কাব্যর । অবাক হয়ে খেয়াল করে , সেখানে গত দুমাসের করা আরো বেশ কিছু ভিডিও আছে । সেগুলো আগের থেকেও খারাপ । সাফাকে দেখা যাচ্ছে সেখানে , ইয়াবা খাবার আগে এবং পরে । দুটো ফুটেজেই সে তার কাজ সম্পর্কে সচেতন ছিল বলে মনে হল । আর কিছু ভাবতে পারলোনা কাব্য । সব ঘোলা হয়ে আসল ।


           আজ কাব্য সাফার সাথে শেষ দেখা করেছে । রাতে কথার ফাকে কাব্য সাফার কাছে সব ঘটনার কারন জানতে চায় । জানতে চায় ভিডিওগুলোর কথা । কিন্তু সাফা কিছু বলতে পারেনা । ফোন রেখে দেয় কাব্য । সকালে উঠে সাফাকে আসতে বলে ।
          যখন দেখা হয় , তখন কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা কাব্যর । সাফাই সব বলে , ক্ষমা চায় । কাব্য তা পারেনা , অনেক দেরি হয়ে গেছে । অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে , যা পুরণ হবার নয় । বাইরে তখন টুপটুপ করে বৃষ্টি হচ্ছে ।


          রাস্তায় বের হয়ে কোথায় যাবে , বুঝে ওঠেনা কাব্য । কি মনে করে টিউশনিতে যায় , সাফাকে ভুলে থাকা তার জন্য এখন অতীব জরুরী । টিউশনি শেষে বেতন পায় কাব্য । বের হয়ে আবার হাটতে থাকে । বৃষ্টি আরো জোরে পড়তে শুরু করে । আশেপাশে তাকিয়ে যাত্রীছাউনিটা চোখে পড়ে তার ।


          যাত্রীছাউনিতে বসে বাবার কথা খুব মনে পড়ে । বাবা সবসময় বলেন “যখন দেখবি খুব মন খারাপ , তখন আশেপাশের কিছুর দিকে মনযোগ দিবি । একটা ভালো কাজ করার চেষ্টা করবি , মন ভালো হয়ে যাবে ।” এইমুহুর্তে আশেপাশে “কিছু” না , “কাউকে” দেখা যাচ্ছে । পিচ্চি একটা ছেলে , টোকাই বোধহয় । ভিজে একাকার । ঠান্ডায় চোখ ছোট হয়ে আছে । কাব্য আস্তে করে বলে “কি হইসে রে তোর ?........................”
************************************************************************
মানিক ওর হাতের খামটার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে । আস্তে করে মুখটা খোলে সে । খুলে দেখে ৫০০ টাকার দশটা নোট । অবাক চোখে মানুষটার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে মানিক । মনের অজান্তে মানিকের চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়াতে থাকে । আর মানুষটা ধীরে ধীরে ঝাপসা হতে থাকে ।
          কাব্য হাটছে । মনটা একটু হাল্কা হাল্কা লাগছে । বাসায় গিয়ে বাবাকে বলতে পারবে আজ একটা ভালো কাজ করেছে । আবার পরক্ষনেই সাফার কথা মনে পড়ে যায় , চোখ বন্ধ করে ফেলে কাব্য । মনের ভেতর ভাসতে থাকে টিউশিনিতে গিয়ে লেখা কবিতাটা –

সেদিনও এমন বৃষ্টি ছিল
বোবা মনের সৃষ্টি ছিল একটি অলস ফুল
সেদিনও এমন কষ্ট ছিল
চোখের তারায় স্পষ্ট ছিল জোড়া কানের দুল ।

সেদিনও এমন মগ্ন হয়ে
আশায় থাকার কষ্ট সয়ে দাড়িয়েছিলাম ক্ষণ
সেদিনও এমন তপ্ত বুকে
তোমার দিকে একটু ঝুকে দিয়েছিলাম মন ।

 সেই তুমি আজ বৃষ্টি ভিজে দিচ্ছ আমায় ফুল 
সেই তুমি আজ কষ্ট সয়ে মানছ তোমার ভুল ।
সেই আমি আজ বদলে গেছি বদলে গেছে মন
হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেছে তোমার প্রয়োজন ।



-Blockhead Hasnat

No comments:

Post a Comment