Subscribe:

অপরাজিতা এবং অরিন্দমের চতুর্থ কথোপথন

‘একটা ফোন সে করবেই’- কথাটা অরিন্দম ভাবছে গত সাত মাস ধরে। কিন্তু হয়ে উঠছে না। এভাবে বললেও আসলে বোঝা যায় না- সে আসলে অনেকটা জোর করেই ফোনটা করছে না। শেষবার যখন কথা হয়, বেশ দম্ভের সাথেই বলেছিল- ‘ঠিক আছে, আর তোমায় ফোন করবো না।’ কিন্তু ভেতরের মানুষটাকে সে কখনোই সে কথা শোনাতে পারেনি সে। অপরাজিতা ওর জীবনের কোন এক নিমেষের ঝড় হয়ে এসেছে, সেটা অবশ্য অপরাজিতার অজান্তেই। কিন্তু আজকের অরিন্দমের ভাবনায়, চেতনায় অপরাজিতা এক প্রাত্যহিক বাস্তবতা।


মেয়েদের সাথে কখনোই সহজ হয়ে উঠতে না পারা অরিন্দমের মনের কথা আর মুখের কথা একই সুরে কখনোই গাঁথা পড়েনি। প্রায়ই সে ভাবে, প্রথম তিনবার তাদের মাঝে যে কথা হয়েছে সেখানে শ্রোতা আর বক্তার ভূমিকা বদলে গেলে সে নিজে কী করতো। উত্তরটা ভয়াবহ- হয়তো অপরাজিতার চেয়েও দুর্ভেদ্য হয়ে উঠতো সে। ভালোবাসা যে অভিব্যক্তির মুখাপেক্ষী- সেটার প্রতি আস্থা না রাখাটা হয়তো নিজের এই দুর্বলতাকে আড়াল করারই একটা দার্শনিক কৌশল। হৃদয়ে সে বিশ্বাস করে- তার ভালোবাসার কদর আরও বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু মস্তিষ্কের কীট তাকে সাফ জানিয়ে দেয়- অভিব্যক্তিহীন অনুভূতির কোন দাম নেই। অপরাজিতার কাছে সাত মাস আগেও সে যেমন একজন আগন্তুক ছিল, আজও সে তেমনই একজন আগন্তুক।

অবশেষে মুঠোফোনের  ডায়াল বাটনটায় চাপ দিলো অরিন্দম। প্রচণ্ড টেনশনে থাকলে অরিন্দমের হাত  ঘামতে থাকে, কথা বলতে গেলে গলা আটকে আসে। তবে এগুলো ছাপিয়ে ভেতরের জড়তার সাথে দ্বন্দ্বটা তাকে সবচেয়ে বেশি অস্বস্তিতে রাখে। কিন্তু অরিন্দম জানে- আজ তাকে কথা বলতেই হবে। নতুবা যে অনুভূতিটাকে সে ভালোবাসা বলে দাবি করে সেটার অনেক বড় একটা অপমান হয়ে যাবে। ভালোবাসে বলেই ভালোবাসার মানুষের জীবনে এতটুকু অনধিকার চর্চা করাটা তার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে- এটা তাকে করতেই হবে।

মুঠোফোনের ওপারের প্রতিটা বিপ বুকের ভেতরটায় একেকটা বড়সড় ভূমিকম্প ঘটিয়ে যাচ্ছিল। ফোনের বিপের চেয়ে হার্টের বিটটাই যেন বেশি জোরে শুনতে পাচ্ছিল সে। বাঁ হাতটা একদম ঘেমে গেছে, এরকম অস্থিরতা ওকে মানায় না। এত বিশাল শরীরের মানুষটাকে এভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে দেখলে অনুকম্পা নয়, অধিকাংশের জন্যই সেটা বিদ্রূপের বিষয়।

চারটা বিপ  কেটে গেছে, ‘অপরাজিতা ব্যস্ত আছে হয়তো’- এটা ভেবে সে ফোনটা যখনই কেটে দিতে যাবে তখনই ওপার থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠ ভেসে এলো- ‘হ্যালো’

অপরাজিতার কণ্ঠ সে ভোলেনি। সেই সাথে ‘হ্যালো’ শব্দটার সাথে বিরক্তির সেই ক্লাসিকাল মিশেল বলে দিচ্ছিল সেটা অপরাজিতারই কণ্ঠ। তবুও নিশ্চিত হতেই সে জিজ্ঞেস করলো- ‘হ্যালো, অপরাজিতা বলছো?’

- হ্যাঁ
- চিনতে পেরেছো?
- হ্যাঁ

- এটা অবশ্য  আশা করিনি।

- ফোন কেন  করেছেন?

- তোমার সাথে  কথা বলবো, সেজন্য।

- কী প্রয়োজনে?

প্রয়োজন শব্দটা খুব খটমটে লাগলো অরিন্দমের। আগেরবার যেটা বলেছিলো, এবারও সেটাই বলতে চাইলো সে- প্রয়োজনটা তো ব্যক্তির উপর নির্ভর করে। কিন্তু পদার্থবিদ্যার আপেক্ষিকতাবাদের মতো মনস্তত্ত্বের আপেক্ষিকতাবাদ এতটা জনপ্রিয় নয়- সেটা সে এতদিনে বুঝে গেছে।  

- সুবিশেষ  কিছু নয়, কিছুটা সময় কাটানো, কিছুটা কথা বলা

- আমি এখন  ব্যস্ত আছি

- খুব বেশি  সময় নেবো না, তোমার সাথে  অনেক কথা বলার অধিকার  এখনো জন্মায়নি

- ঠিক আছে  বলুন

- কেমন আছ?

- ভালো

- নতুন সেমিস্টার কেমন যাচ্ছে?  

প্রশ্নটা  হাস্যকর না হলেও নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক, অন্তত কারো মনে দাগ কেটে রাখবার মতো  কিছুতো একেবারেই নয়। সময় আর শব্দের স্বল্পতায় থাকা অরিন্দমের জন্য একদম বাজে খরচ। কিন্তু টেনশনে অস্থির হয়ে পড়া অরিন্দম শুধু চাইছিলো কিছু একটা কথা বলে যেতে, কথাটা মুখ ফস্কেই বেরিয়ে গেলো। উত্তরটাও এলো, সাথে সেই চিরন্তন শীতলতা-

- ভালো

- আমার সাথে  কথা বলতে কি বিরক্ত  লাগছে?

- সমস্যা নাই, যা বলার বলেন

- তোমার কণ্ঠস্বরের  ভাষা অবশ্য অন্যরকম, মনে  হচ্ছে শুধুই ভদ্রতার  খাতিরে ফোনটা ধরে রেখেছ

- বুঝতেই যখন  পারছেন তখন ফোনটা রেখে  দিলেই পারেন

- সেটা করাটা  একটু কষ্টের

মুঠোফোনের ওপারে অপরাজিতা কিছু বললো না। অরিন্দমের মনে হতে লাগলো ওর কথাগুলো শূন্যতার হাহাকারে হারিয়ে যাচ্ছে। এতটা নিস্পৃহা, এতটা নির্লিপ্ততার কোন প্রত্যুত্তর খুঁজে পাচ্ছিলো না সে। কথাটা চালিয়ে যাবার খাতিরেই প্রসঙ্গ বদলালো অরিন্দম-

- আচ্ছা, তোমার  প্রিয় শখ কী?

- সেটা জানার  দরকার কী?

- এটা একটা  নৈর্ব্যক্তিক জিজ্ঞাসা, যে কাউকেই জিজ্ঞেস করা যায়। বল, তোমার প্রিয় শখ কী?

- অ্যাকুয়ারিয়াম

কাঁচের ঘরে  মাছের বন্দিত্বকে অরিন্দম  কখনোই মেনে নিতে পারেনি।  তবে ওর মায়ের শখেই ওদের ঘরেও একটা অ্যাকুয়ারিয়াম  আছে। অ্যাকুয়ারিয়ামের দর্শন  নিয়ে বিতর্ক করার সময় এটা  নয়, সেটা জেনেই অরিন্দম বললো-  

- বাহ, সুন্দর  তো। তো তোমার প্রিয় মাছ কোনটা?

- গোল্ডফিশ।

- হুম, এই মাছটাই মনে হয় সবচেয়ে সুন্দর। আমারও বেশ ভালো লাগে। আমাদের ঘরের অ্যাকুয়ারিয়ামেও দুটা গোল্ডফিশ আছে। মাছগুলোকে কী খেতে দাও?

প্রশ্নটা  করেই বুঝলো অরিন্দম, বোকার  মতো আরেকটা প্রশ্ন হয়ে  গেল।

- আপনার ঘরে  তো অ্যাকুয়ারিয়াম আছেই, জানেন নিশ্চয়ই

- হুম, সেটা  জানি। প্রশ্নটা অবান্তর  ছিল। (একটু থেমে) একটা কথা বলতে পারি?

- বলেন

- তোমার সাথে  কখনো কখনো কথা বলতে  চাই

- আপনাকে তো  আগেও বলেছি, এটার কোন  মানে নাই। আমার উত্তর  বদলাবে না।

- প্রশ্নোত্তরের  ছলনাটা থাক, সেটা অন্য  সময়ের জন্য অপেক্ষা করুক। শুধু কথা বলার অনুমতিটা চাইছি

- আপনার জন্য  তো উত্তরটাই মুখ্য, তাই  না?

- সত্যি বলতে  কি, তাই। তবে সেটা এখন গৌণ থাকবে, তোমার সাথে কথা বলার মধ্যে যে ভালোলাগাটুকু আছে শুধু সেটা পাওয়ার দাবি করতেই পারি।

উপেক্ষার  ছলনায় আরও একটি নীরবতা যুক্ত হলো।

- কিছু বললে না যে?

- মনে হয়  আপনার কথা শেষ হয়েছে,  রাখছি।

অরিন্দমের আর কিছু বলার অবকাশ ছিল  না। উপেক্ষাটাই যেখানে চিরন্তন  সেখানে আবেগের বালখিল্য অর্থহীন। স্তব্ধতা  যেখানে নিয়তি  অনুনাদের আকাঙ্ক্ষা সেখানে বিলাসিতা। চিরন্তন মধ্যবিত্তের বিলাসিতা মানায় না, অরিন্দমের নির্বাক থাকাটাই হয়তো শ্রেয়।


-avik roy

No comments:

Post a Comment