Subscribe:

অনুভূতিহীন মেয়ে

¤¤আমি এখন ছাদে।আমাদের স্যাঁতস্যাতে হোস্টেলের ততোধিক স্যাঁতস্যাতে ছাদের পশ্চিম কোণে শেষ বিকেলে একফালি রোদ এসে পড়ে,তার কাছে উষ্ণতা ধার চাইতে এসেছি।আর মনের ডায়রীতে "ওর" সাথে কথা বলছি..আজ সারাদিন না অনেক ধকল গেছে।একটানা ক্লাস শেষে tired হয়ে সবাই ঘুমাতে গেল।আর আমি কফির মগ হাতে নিয়ে সোজা ছাদে..mobile আনিনি..ওটার আর তেমন প্রয়োজন হয়না এখন-আব্বু আম্মু রাতে ফোন করবে,আর বিকেলে..আচ্ছা এই বিকেলবেলাটাই না, কি ভীষণ সুন্দর ছিল..এইতো কয়েক মাস আগেও...


একটা মানুষের আওয়াজ,তার গলার স্বরের ওঠানামা,হাসির শব্দ..আর সারাক্ষণ শাসন "এটা করবেনা,ওটা করবেনা..মাফলার ছাড়া সকালের ক্লাসে যাবেনা।আবার ঠান্ডা লাগাবে,আরেক কোর্স antibiotic খেতে হবে তখন.."উফফ..বড্ড জ্বালাতো ছেলেটা।শীতকাল এলেই বুঝি সারাক্ষণ এস্কিমো সেজে থাকতে হবে!২/১টা আইসক্রীম খেলে কি হয়!তবু...ভাল লাগত। ভাল লাগত এটা ভেবে যে কেউ আমাকে নিয়ে ভাবছে-আমার ভাল থাকায় তার সুখ মিশে আছে-ভাল লাগত তার সাথে বসে আমার অসম্পূর্ন স্বপ্নগুলো জোড়া লাগাতে।

ফোনের ওপ্রান্তে বসে থাকা আমার রূপকথার রাজপুত্তুরটা এইসব ন্যাকা ন্যাকা কথা বলত আর আমি বলতাম.."খবরদার,অন্যসব  boyfriend দের মত একদম ন্যাকামী করবে না আমার সাথে..এইসব কথাবার্তা আমার মোটে ভাল্লাগে না"
- "কেন,তুমি কি অনুভূতিহীন?"
- "হ্যাঁ,পুরোপুরি"
- "ঠিক আছে।কিন্তু আমার ভাল লাগে,তাই আমি বলব।এবং সন্ধার আগে তুমি অবশ্যই ছাদ থেকে নেমে যাবে।কারণ,সারাবছর সর্দি লাগা মেয়ের সাখে আমি ঘর করতে পারবনা..বিয়ের পর দেখা যাবে কথা নাই বার্তা নাই,তুমি আমার শার্টের হাতায় নাক মুছে ফেলছ..!"
- "ইয়াক্,ছিঃ..আমার টিস্যুপেপার নাই বুঝি..আর তোমাকে কে বলল যে আমি তোমাকে বিয়ে করব?!"
- "বলে কি মেয়ে!রাজি না হলে কিন্তু স্রেফ উঠায়ে নিয়ে আসব!!"
- "আবার..আবার শুরু হল তোমার প্রেমের ডায়লগ..সারাদিন কি বসে বসে বাংলা সিনেমা দেখ?".....ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল,হঠাত্‍ কফির কাপে টুপ করে পড়া জলের শব্দে।কি আশ্চর্য!আমি কাঁদছিলাম..আমি না অনেক শক্ত মনের মেয়ে..অনুভূতিহীন?..


সেই বিকেলগুলো হারিয়ে গেছে আজ ২মাস ১৭দিন।মুহিনের সাথে কথা হয়না আমার।তো কি হয়েছে..মানুষ কি single থাকেনা?প্রেমই কি সব?আমার এত্তগুলো বন্ধু আছে..আব্বু আম্মু আছে-যারা আমাকে অনেক অনেক ভালবাসে..আর একটা লক্ষীছাড়া ভাইও আছে।মুহিনকে ছাড়া কি চলবে না আমার?খুব চলবে..ব্যাটার বিয়ে করার সখ হয়েছে,করুক গে।ওর হবু বউ শুনবে ওর যত ন্যাকা ন্যাকা কথা..ওকে নিয়ে ভাববে..আমার বোধয় এখন সে অধিকারটুকুও নেই।ঠিক আছে,আমি এভাবেই থাকতে পারব।

ভাল আছি আমি..খুউব ভাল আছি...


¤¤মুহিনের সাথে আমার break up এর ব্যাপারটা বোধয় হলের পাঁজী মেয়েগুলো ধরে ফেলেছে।অবশ্য ওদেরই বা দোষ কি,অনেক চেষ্টা করেও তো normal থাকতে পারিনি।class test গুলো খারাপ হচ্ছে..আড্ডার এক কোণে চুপচাপ বসে থাকি..প্রায়ই অন্যমনস্ক হয়ে যাই..রাতের বেলা কাঁদতে কাঁদতে বালিশ ভিজিয়ে ফেলি,আর পরদিন লাল লাল,ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে ঘুরে বেড়াই....
এতোটা ছিচকাঁদুনে ছিলাম না আমি মুহিন।তোমার মত ন্যাকার সাথে প্রেম করে করে,এখন মহিলা দেবদাস হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি!

তবে তুমি বোধয় ভালই আছ তাইনা?হবু স্ত্রীর সাথে বন্ধুত্ব করছ..বিয়ের পর প্রেমও হয়ে যাবে..সুখের সংসার...তবে আমার স্মৃতি ভুলেও এনোনা তোমাদের মাঝে,আর যদি আসেও তবে তা প্রার্থনা হয়ে আসুক তোমাদের জন্য।তোমার কপালে যেন একটা ভাল মেয়ে জোটে-যার সারা বছর অসুখ বিসুখ হয়না..যার ভেতরটা আমার মত নিরস না..তোমার ন্যাকা ন্যাকা কথা শুনে যে আবেগে আপ্লুত হয়ে তোমাকে 'জানপাখি' type কিছু একটা ডাকবে!এই দেখ আমার আবার হাসি পেয়ে যাচ্ছে..মনে আছে-ভাইয়ার সাথে যেদিন প্রথম আমাদের বাসায় এলে..তোমার নতুন লেখা একটা কবিতা শুনিয়েছিলে,তাও আবার প্রেমের কবিতা..তুমি যাবার পর সেদিন হাসতে হাসতে আমার অবস্থা কাহিল।ভাইয়াকে বললাম-"কি অদ্ভূত বন্ধু গো তোমার!"ভাইয়া তো ভীষণ serious,"খবরদার,মুহিনের নামে কিচ্ছু বলবিনা।ছেলেটা অনেক ভাল।একটু পাগলাটে আছে..কিন্তু খুবই ভাল লেখে"

তোমার গল্প-কবিতার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল ভাইয়া।আর বন্ধুর বোন হিসেবে মাঝে মাঝে আমাকেও শুনতে হত।প্রথম প্রথম তো শুধু ফাজলামী করার জন্য,তুমি আসলে চা-টা নিয়ে যেতাম..পাশে গিয়ে বসতাম.."কি মুহিন ভাই,নতুন কিছু লিখেছেন নাকি?!"
আর তুমিও মহা উত্‍সাহে তোমার নীল,মোটা খাতাটা বের করে পড়া শুরু করে দিতে!কিন্তু কিছুদিন পর,কিভাবে যেন এই আধপাগল কবিরই প্রেমে পরে গেলাম...আমি!ভীষণ practical,অনুভূতিহীন একটা মেয়ে-এমন আবেগী একটা ছেলেকে কিভাবে এতোটা ভালবাসলাম,বলতো??

তুমি তখন চাকরী খুঁজে বেড়াচ্ছ,আর আমি 1st year medical student..আর্থিক ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির দিক দিয়ে দুটো পরিবারে ছিল আকাশ পাতাল তফাত্‍..এইসব কিছু ভুলে গিয়ে..
"কখনো বিয়ে করব না।কোন ছেলে আমাকে dominate করতে পারবে না"-এজাতীয় নারীবাদী শপথ টপথ সব উড়িয়ে ফেলে..একদম ধুপ্ করে তোমার প্রেমে পরে গেলাম?!



¤¤কি করে ভুলে গিয়েছিলাম যে আমাদের ভালোবাসার পরিনতি আসলে কি হবে?নিজেদের পরিবারকে কষ্ট দেয়া তো দুজনের কারো পক্ষেই সম্ভব ছিলনা।তার উপর তোমার আমার বয়সের এই ব্যবধান..সব দিক থেকেই এত বাধা ছিল,তবু তুমি বলতে দুজনে মিলে,বাসার সবার সাথে কথা বলব..যুগ বদলেছে প্রেমের কাছে এখন অনেক কিছুই হার মানে..
ওরে আমার বোকাচাঁদ!এই জন্যই তো তোমাকে বাস্তবে টেনে আনতে চাইতাম আমি।কিন্তু তোমার স্বপ্নে ভাসা ঠেকায় কে..
কেউ মানেনি দেখলে তো?
প্রেম আজও হার মানে..স্বপ্নরা বারবার হার মানে...

তবে তুমি ভাল করেছ,uncleএর কথা মেনে নিয়ে।cancer patient উনি,মৃত্যুর আগে একমাত্র ছেলের বউ দেখতে চাওয়াটা কি অন্যায় বল?আর আমিও তো কত চেষ্টা করলাম,কিন্তু আব্বু আম্মুকে রাজি করাতে পারলাম না।আসলে আমি চাইনি তুমি জীবনভর অপেক্ষা করে থাকো আমার জন্য।তাইতো হঠাত্‍ করেই সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম..তোমাকে promise করিয়েছিলাম,যেন আর কখনো আমাকে ফোন না কর।

কিন্তু সব বুঝেও আমি এটা বুঝিনি যে এই মনকে বোঝানো কতটা কঠিন-তোমার সাথে কথা না বলে থাকা কতটা কঠিন-তোমাকে দেখতে না পাওয়া..তোমার স্পর্শ হারিয়ে ফেলা কত কঠিন--

সেবার আমার জ্বর হল,তুমি ভাইয়ার সাথে দেখা করার অযুহাতে বাসায় এলে..আমার তপ্ত কপালে একটা শীতল হাতের স্পর্শ..চোখের সামনে তোমার উদভ্রান্ত দৃষ্টি!মনে হচ্ছিল যেন আর কিচ্ছু চাইনা আমার।
আচ্ছা আর কখনো তোমাকে ছুঁতে পারবনা,না??


অনেক বেশী miss করছি তোমাকে মুহিন..অ-নে-ক..


¤¤না,বন্ধুদের কাছে আর কিছু লুকাইনি।সব খুলেই বলেছি।আসলে একটা support দরকার ছিল..ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম।প্রথমে তো ওরা সবাই মিলে solution খোঁজার চেষ্টা করল।কেউ বলে "আমরা মুহিন ভাইয়ের সাথে কথা বলি.."কেউ বলে "তার চেয়ে বরং uncle-aunty কে বোঝানোর চেষ্টা করি.."অনেক কষ্ট হয়েছে ওদের বোঝাতে যে এখন আর কিছু করা সম্ভব নয়।সত্যিই অনেক দেরী হয়ে গেছে..১সপ্তাহ পর তোমার বিয়ে।তোমার সাখে কখা না বললেও তোমার সব খবরই রাখি আমি..আর শুনেছি মেয়েটাও খুব ভাল।এক কাজ করনা,বাসর রাতে বউকে শোনানোর জন্য একটা কবিতা লিখে ফেল..

বেচারী!!

এই দেখনা,কান্নার মাঝেও হাসছি আমি..


¤¤আমি নাকি অনেক শুকিয়ে গেছি..উফফ এই মেয়েগুলোকে নিয়ে আর পারিনা।আমাকে cheer up করার জন্য নিত্যনতুন planning করে।ওদের next plan হচ্ছে,তোমার বিয়ের দিনটাতে আমরা সবাই মিলে ঘুরতে যাব..ছোটখাট একটা পিকনিক করব এবং পিকনিকের রান্নার দায়িত্ব আমার!বোঝ অবস্থা..কাজ করলে নাকি আমার মন ভাল হবে!তারপর পিকনিক শেষে আমরা সবাই মিলে গান গাইব..আনন্দ করব..নব দম্পতির জন্য প্রার্থনা করব এবং সবশেষে পুরো ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে হোস্টেলে ফিরব।

আমি কিছু বলিনি।হেসেছি শুধু।সবকিছু ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ? শুধু এই স্মৃতিগুলোই..কোন অধিকার তো চাচ্ছিনা..আমার প্রথম এবং শেষ প্রেমের স্মৃতি,তোমাকে বলা না বলা যত কথা..থাকনা আমার ডায়রীর পাতায়..ওদের নিয়েই থাকব আমি।

তবে হ্যাঁ,ওইদিনটাতে সত্যিই অন্য কোন কাজে ডুবে থাকতে চাই..তাই পিকনিক ই সই..


¤¤ আচ্ছা তোমার সমস্যা কি?cinematic কিছু একটা না করলে তোমার হয় না, না?অযথাই scene create..তাও আবার আমার ফাজিল বান্ধবীগুলোর সামনে.. কালি ঝুলি মেখে রান্না করছিলাম..হঠাত্‍ সামনে এসে উপস্থিত হলে,পাগল পাগল চেহারা নিয়ে..

ভীষণ অবাক হয়েছিলাম আমি।বললাম,
- "তুমি!তুমি এখানে কেন,আজ না তোমার বিয়ে?!"
- "করব না।আমি তোমাকে বিয়ে করব।"
- "কি আশ্চর্য!আমরা তো দুজনে মিলেই ঠিক করলাম,যে বাসার অমতে..."
- "না।আমরা আজই বিয়ে করব।এক্ষুণি.."

বলেই দু'হাতে আমাকে কোলে তুলে  নিলে-

- "মুহিন কি কর! নামাও আমাকে,please.."
- "কেন,বলেছিলাম না রাজি না হলে স্রেফ উঠায়ে নিয়ে যাব!"
- "মনে হয় পুরাই পাগল হয়ে গেছে!!"
- "উফফ..তুমি না romance এর পুরা ১২টা বাজায়ে দাও।আরে বাবা,তোমার আব্বু আম্মু মত দিয়েছেন.. আমি আর তোমার ভাই,মানে আমার শালা..."
- "শালা না সম্বন্ধী"
- "হ্যাঁ হ্যাঁ,সম্বন্ধী..আমি আর আমার সম্বন্ধী দুই জনে মিলে অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে..বহু কষ্ট করে উনাদের রাজি করিয়েছি.."
- "আর..আর uncle,মানে তোমার বাবা..উনি কি বললেন?"
- "বাবা বলেছেন,উনার কথার যেন কোন এদিক সেদিক না হয়।যত দ্রুত সম্ভব উনার পুত্রবঁধূকে তাঁর সামনে হাজির করা হোক।মানে তোমাকে..আর আমি সেই চেষ্টাই করছি,তবে পুত্রবঁধূ সামান্য ভারী বলে সুবিধা করতে পারছিনা!!.."


তারপর আমি..না থাক।তারপর আমি কি কি করেছিলাম সেগুলো তোমার মনে না রাখলেও চলবে।জাননা,আমি অনুভূতিহীন মেয়ে-এসব কান্নাকাটি,ন্যাকামী,জড়িয়ে ধরা টরা আমি একদম পছন্দ করিনা..ওইদিন ভুল করে একটু করে ফেলেছিলাম আরকি...!!


-রাহনুমা কুমকুম

No comments:

Post a Comment