Subscribe:

বাবা

আমার সাথে আমার বাবার সম্পর্কটা ফেইসবুকীয় ভাষায় - “ইটস্ কমপ্লিকেটেড”। ঠিক সাউন্ড না, আবার ঠিক সাইলেন্ট-ও না।

বাবার সাখে আমি ঠিক মতো মিশতে পারি না। কখনো মনে হয় মনের সব গোপন কথাগুলো বাবাকে বলে দিই, কিন্তু বলার সাহস হয় না। বাবার সাথে রাগারাগি করি, অনেক সময় বেয়াদবির পর্যায়ে চলে যায়। অনেক সময় ফ্রী-মুডে বাবাকে আচ্ছামতো্ পঁচাই। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর আবার সেই সাইলেন্ট মুড। বাবাকে নিজের প্রয়োজনের পারসোনাল জিনিস গুলো কেনার টাকা চাইতেও ভয় লাগে। মা বাবাকে বলে - আমার কি কি লাগবে।


মজার ব্যাপার হলো, বাবা বলেন - “ নবাব হইছে। ওর মতো বয়সে আমি চাকরী করে সংসার টানছি। নিজে তো বাবার হোটেলে পায়ের উপর পা তুলে খাইতেছে, একদিন বাজার করতেও পাঠানো যায় না। নবাব আবার ফোম-জেল দিয়ে, জিলেট ভিক্টর প্লাস ব্লেড দিয়ে শেভ করবেন। তারপর আফটার শেইভ লোশন দেবেন, চুলে জেল মেখে ছাগলের লেজের মতো চুল নাচাতে নাচাতে ভার্সিটি যাবেন। আর রেজাল্ট করবেন গোল্লা। হবে না, ও সব হবে না। আমি দুই টাকা দিয়ে ব্লেড কিনে ক্রিম দিয়ে শেভ করতে পারি, ছেলে হয়েছে তোমার লাট-পুত্তুর”।
এইসব বলে বাবা বাইরে যাবেন।

বাসায় যখন ফিরবেন তার হাতে আমার বলে দেয়া জিনিসগুলোই থাকবে, বোনাস একটা বডি স্প্রে-ও থাকবে।

আবার যখন বাইরে যাবেন, চুপিচুপি আমার ঘরে এসে টুক করে একটু বডি স্প্রে মেখে চলে যাবেন। রেজর ব্লেড এর বক্স থেকে ব্লেড-ও গায়েব থাকবে। বাবা বাথরুম থেকে বের হবার পর উনার কাছ থেকে আফটার শেভ লোশনের গন্ধ আসবে। লাজুক মুখে তিনি আমার বাথরুম থেকে বেরিয়ে যাবেন।

আমি একবার দেশের বাইরে যাব। আগে একবার যাবার প্ল্যাণ হলেও প্রস্তুতির জন্য যেতে পারিনি। পরের বার প্ল্যাণ হলো, কিন্তু বাবা কোনভাবেই রাজি নন। তার অমতেই একা একা সব প্রসেসিং করলাম। বাবা কোন টাকা পয়সা দিলেন না। মা নিজের বেতন-বোনাস-হাবিজাবি মিলিয়ে পাসপোর্ট-ভিসা প্রসেসিং এর টাকা দিলেন, আমাকে যাবার সময় পাঁচ হাজার টাকা হাত খরচের জন্য দিলেন। থাইল্যান্ড যাবো, এগার দিন থাকবো। থাই বাখে দুই হাজার বাথ। চূড়ান্ত অপ্রতুল। আবার আমার মতো গৌরি সেন হলে তো কথাই নেই। যেইদিন গেলাম, তার পর দিনই ষোলশো বাথ শপিং করলাম। আবার ঘন্টায় পাঁচটা সিগারেট খাই। সিগারেটের পেছনেও অনেক গেছে। সাথের কেউ বাকী দিনের জন্য সাহায্য করতে রাজী হলো না। কোনরকমে ভয়ে কেঁদেকেটে ঢাকায় এসএমএস করলাম  - “আমার টাকা শেষ”। বাবা ভীষণ বকলেন। তিনি বললেন - তার পক্ষে সম্ভব নয় ওখানে টাকা পাঠানো। অনেক ঝামেলা। কিন্তু ঘন্টা চারেক পরই ফোন এলো থাইল্যান্ডের এক লোকাল আমাকে 3000 বাথ পৌছে দেবে।

আমি চলে যাবো। বাবা আসবেন না ঢাকায়। রাত বারোটায় ফোন করে বললাম, আপনার ঢাকা আসতে চার ঘন্টা লাগবে। আমারক সি-অফ করে আবার চলে যাবেন। সারা বছর ই তো অফিস করেন, একদিন ছুটি নিতে পারেন না? বাবা এসেছিলেন, ভোর সাড়ে পাঁচটায় এসে পড়ে আবার দুপুরে খুব সম্ভবত চলে গিয়েছিলেন কর্মস্থলে।

সেবার বাবার জন্য একটা টাই এনেছিলাম। বাবা খুব টাই সৌখিন। লাল বাবার পছন্দের রঙ। বাবার জন্য একটা লাল টাই নিয়ে আসলাম। টাই দেখে তিনি রেগে কাই। - ‘তোমাকে কষ্ট করে টাকা পাঠিয়েছি আমি শপিং করার জন্য? টাই আনার জন্য? যে কাজে গিয়েছিলে তার তো কিছুই করে আসতে পারো নি, খালি লম্বা লম্বা অকেজো বক্তৃতাই দিতে পারো।”

বাবা জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে থাকেন। সেদিন রাতেই তিনি চলে যাবেন, মাকে ফিসফিস করে বললেন -   ‘ও যে নতুন টাইটা আনলো, ওটা কই? দাও দেখি, পড়ে দেখি আমার ছেলেটা টাই কেমন কিনেছে? ভালো টাই চিনতে পারে নাকি?’
আমি যখন আইএসএসবি-তে যাই, বাবা নিজের হাতে আমাকে টাই পড়ানো শিছিয়েছিলেন।

ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবার সময় ঐ ইউনিভার্সিটিতে পড়াতে বাবা রাজি ছিলেন না। আমার জোড়াজুড়িতে তিনি সেখানে আমাকে ভর্তি করান। তিনি জানতেন, আমি যে সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছি, তার বেসিকে আমি দূর্বল। আমি বায়োলজি খুব ভালো জানায় তিনি চেয়েছিলেন, আমি ডাক্তার হই। আমি যাইনি ও পথে। তবে মেডিকেল কোচিং আর ফরম ফিলাপে ভালো অঙ্কের টাকা আমি নষ্ট করেছি আর ভর্তি পরীক্ষায় উল্টাপাল্টা অ্যানসার করেছি। বাবা মেডিকেল ওরিয়েন্টেড জবে যুক্ত থাকায় আর বেশ সুপরিচিত থাকায় তিনি আমার সব খবরেই পেতেন। কিন্তু, তিনি পারেননি আমাকে মেডিকেলে ভর্তি হতে রাজি করাতে। আমার চোখে বরং স্বপ্ন ছিল তখন আর্মি অফিসার হবো। কিন্তু তাতে বাবার সায় ছিল না।

দুবার আইএসএসবি দিয়েও আমি পারিনি আর্মি অফিসার হতে, পারিনি ইউনিভার্সিটিতে আমার পছন্দের সাবজেক্টে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে। বাবা বকেছেন-মেরেছেন। তিনি বলেছেন, আমাকে পড়াশুনা করাবেন না। কিন্তু তিনি ঠিকই আমাকে নিজের পছন্দের অন্য একটা  ইউনিভার্সিটিতে, উনার পছন্দের সাবজেক্টে আবার ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন। আল্লা্হ্ এর রহমতে আর বাবার দোয়ায় ভালো জিপিএ নিয়ে দুই সেমিস্টার শেষ করে তিন নম্বর সেমিস্টার শেষ করতে যাচ্ছি। ইনশাল্লাহ্ জিপিএ এবারও ভালো হবে।

এই রকম একটা বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা কমিপ্লিকেটেড কেন, বুঝতে পারি না।

বাবাকে অসম্ভব ভয় কেন পাই?

আমার শৈশবে বাবা দেশের বাইরে ছিলেন, কৈশোরে মা অসুস্থ থাকায় বাবার সবসময় কুঞ্চিত মুখ দেখেছি, তাই বলে?

বাবার হাতে এই সেইদিন-ও মার খেয়েছি। একবছরও হয়নি। ইউনিভার্সিটি চেঞ্জ করার কথা বলায় মেরেছিলেন।  মেরেছেন-বকেছেন, ইউনিভার্সিটি থেকে ইউনিভার্সিটি আমাকে নিয়ে ঘুরেছেন। সবার সমানে অপমান করতেন। কিন্তু আমাকে নিজের কাছ ছাড়া কোনদিনই করেন নি। নিজে দেখে তার সুপিরিয়রদের পরামর্শ নিয়ে নিজের পরিচিত ইউনিভার্সিটি ডিরেক্টর এর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করালেন।

আমার বাবা সেই বাবা, যিনি নিজে প্রতি মাসে অন্তত একবার ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে ডিরেক্টরের সাথে, ফ্যাকাল্টিদের সাথে নিজে গিয়ে কথা বলবেন, আমার পড়াশুনার স্ট্যাটাস জানবেন। আর ফ্যাকাল্টিদের ধমকে আসবেন, তারা কি করে চার মাসে কি পড়িয়ে এক একটা সেমিস্টার শেষ করে, কিংবা লাইব্রেরী বন্ধ কেন,কিংবা ফ্যাকাল্টি ক্লাস নেয়নি কেন?

আমার ফ্যাকাল্টিরা আমার বাবাকে ”মাস্টার পিস” বলে ডাকে। তিনি ইউনিভার্সিটি ডিরেক্টর দিয়ে আমাকে ডাকিয়ে ডিরেক্টরের ধমক খাওয়ান, ডিরেক্টর স্যার পড়াশুনা ভালো করার সাজেশন দেন, অথচ আমার ক্লাসেরই অন্যদের ডিরেক্টর স্যার তার রুমেই ঢুকতে দেন না।

(বলে রাখা ভালো, বাবা প্রায় প্রত্যেকটা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। কিছু কিছু ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবেও কাজ করেন)

মাঝে মাঝে খুব আফসোস হয়- ‘আমি আমার বাবার মতো হতে পারলাম না’। প্রচন্ড রাগী - বদরাগী, অথচ চিন্তাভাবনাগুলো অনেক ঠান্ডা। কাউকেই কিছু বুঝতে দেন না, নিজের মনের ভেতর কি আছে। সুদর্শন - তেপ্পান্ন বছর বয়সেও নিজের আকর্ষণীয়তাটা ধরে রেখেছেন। ব্যাপক বান্ধবী বাবার। চার বছর বিদেশ থাকবার সুবাদে আর যে পেশায় আছেন, তাতে নারীদের প্রাধান্য থাকে বলে সংখ্যাটা অগণিত। অথচ, লোকটার কোন স্ক্যান্ডাল নেই।  পঁচিশ বছর সরকারী চাকরী করেছেন, এখন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, তার অসাধারণ ব্যক্তিত্ব তাকে সবার কাছে থেকে আলাদা করে রাখে।

বাবার বদ রাগটা পেয়েছি, কিন্তু কেন যেন বাবার স্থিতি-বুদ্ধি আর ব্যক্তিত্বটা পাইনি। (তাই বলে আমার স্ক্যান্ডাল কিন্তু নেই আবার। আমার নারী বন্ধুদের সংখ্যা গুনতে সবার লজ্জাই লাগবে।)

আসলে বাবাটাকে কোনদিন বুঝিনি, টোটাল আন-প্রেডিক্টেবল ম্যান। সত্যি বলতে কি আসলে বোঝার চেষ্টা-ও করিনি। শত অন্যায় মেনে নিয়েও তিনি আমাকে কতখানি ভালোবাসেন, তার পরিমাপ আমার জানা নেই। কিন্তু এইটুকু জানা আছে, বাবা আমাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। তবে গোপনে। উনার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বোঝা কঠিন ব্যাপার।

এই একটা মানুষ, যার সাথে আমার সম্পর্ক কোন দিন গুছিয়ে আনতে পারি নি, যার প্রতি সব সময় আমার একটা ক্ষোভ জমা থাকে। যাকে আমি কোনদিন বুঝতে পারিনি, যার কোন কথা আমি সহজে শুনি নি, কিংবা শুনতে চেষ্টা-ও করি নি। যার সাথে আমি প্রায়ই বিনা কারণে রাগা-রাগি করি কিংবা তাকে আমি অসম্ভব ভালোবাসি।

তার রক্ত দিয়ে-ই গড়া আমি, কিন্তু তার মতো হতে চেষ্টা করিনি - আমার বাবা।

এই মানুষটার জন্য কোথায় আমার ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা জমা আছে, তা আমার জানা নেই।

আমি যতই যা করি না কেন আব্বু, দিন শেষে আপনাকে আমি ভালোবাসি - কতটুকু তা কোনদিন-ও আমি বুঝতে পারি নি।

আপনাকে-ও কোন দিন বুঝতে দিব না...................


-পাথুরে শঙ্খচিল

No comments:

Post a Comment