Subscribe:

একটি সহজ সরল ভালোবাসার গল্প-২

প্রথম পর্বের পর...
###
চোখ মেলে কোথায় আছি, বুঝতে পারলাম না।খুব বেশি কিছু না হলে কবরেই থাকার কথা। চারপাশ অনেকটা অন্ধকার। সেটা হওয়াই স্বাভাবিক। কবরের মধ্যে নিশ্চয়ই আমার জন্য কেউ সি, এফ, এল লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকবে না। আচ্ছা, দু’জন ফেরেশতার না আসার কথা? মুনকার-নাকির নামের? তারা গেলেন কোথায়? তাদের তো প্রশ্ন করার কথা।এক ধরণের পরীক্ষা। সেটা ভেবে কবরের মধ্যে (!) থেকেও ঘামাতে লাগলাম আমি। জীবিত থাকতে কোনোদিন পরীক্ষার কথা শুনে খুশি হয়েছিলাম বলে মনে পরে না। কিরকম প্রশ্ন করবেন উনারা? চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম আমি। ধরা যাক, আমি তাদেরকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু অনুভব করতে পারছি । অনেকটা যেন ভালোবাসার মতো।


একজন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এতো দেরিতে আসলে কেনো?” যেহেতু দেখতে পাচ্ছি না, সেহেতু ধরে নিলাম, উনি আমার স্কুল লাইফের গোলাম মোস্তফা স্যারের মতো, ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ……
কি উত্তর দিবো , বুঝতে পারছি না। জীবিত থাকতে বহুবার আমাকে দেরিতে আসা বিষয়ক প্রশ্ন শুনতে হয়েছে। প্রতিবারই রাস্তার জ্যাম এর কথা বলে বেঁচেছি। এবার কি বলবো? আজরাইল দাদুর উপর দোষ চাপিয়ে দিবো নাকি? ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম। নাহলে বলা যায়, মরে পরে গেলাম!!!
এরপর যখন চোখ মেললাম, চারপাশে অনেক আলো। ভেবে পেলাম না, এতো আলো আসছে কোত্থেকে? চারপাশ সম্পূর্ণ সাদা। মাথা তুলে দেখতে গিয়ে মাথায় টান পরে ব্যাথা লাগলো। কবরে তো ব্যাথা বা সুখ থাকার কথা না… তাহলে? ঘাড় ঘুরিয়ে আমার পায়ের কাছে চারপাশ উজ্জ্বল করে সাদা জামা পরা এক মেয়েকে দেখতে পেলাম। মেয়েটাকে দেখেই বুঝে গেলাম, এইটা সাক্ষাৎ হুরপরী। কিন্তু ভেবে পেলাম না, কবরে প্রশ্নোত্তর পর্বের মুখোমুখী না হয়ে, সরাসরি বেহেশতে চলে এলাম কিভাবে? অটোপ্রমোশন নাকি?
আমার নড়াচড়া টের পেয়েই বোধহয় পরীটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো। কিছু একটা ঘাপলা আছে। হুরপরীদের থাকবে বড় বড়,দ্যুতিময় চোখ; কিন্তু এর দেখি চোখে সমস্যা । চশমাওয়ালী পরীর কথা কোনোদিন শুনি নি। কিন্তু এই পরীটা চশমা পরে বসে আছে। কিন্তু তাতে তার রুপের ঘাটতি পড়েনি। চশমাটা কি সুন্দর মানিয়ে গেছে। ঠিক যেনো আমার পরীটার মতো। দেখতেও সে রকমই লাগছে। আমি কিন্তু আমার পেত্নীর নাম বলে দিয়েছি। মরেই যখন গেছি, তাহলে এতো রহস্য করারই বা কি দরকার। হুম, ঠিক ধরেছেন। আমার পেত্নীটার নাম ‘পরী’।
চশমাওয়ালী হুরপরীটা আমার দিকে উঠে আসছে। কি হুকুম দেওয়া যায়? পৃথিবীর মানুষ দেখার ব্যবস্থা করা যায় নাকি , জিজ্ঞেস করতে হবে।
“আরনাফ…”
চোখ পিটপিট করে তাকাতে লাগলাম আমি। ভেবেছিলাম, স্যার বা বস টাইপ কিছু ডাকবে আমাকে; তা না বলে সরাসরি নাম ধরে ডাক? কন্ঠটাও পেত্নীর সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। জীবিত থাকতে পেত্নীর ঝাড়ির উপর ছিলাম। মরেও দেখি রেহাই পাচ্ছি না।
“জ্বী।” খানিকটা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম।
“আমাকে চিনতে পারছিস?”
“জ্বী, আপনি পরী।”
“আপনি আপনি করছিস কেন? ঠিক করে তাকা আমার দিকে, চিনতে পারছিস না?”
“আপনি… মানে, তুই পে…পে…পেত্নী।” পরীকে পেত্নী বলার অপরাধে বেহেশতে আসার পরও চড়-থাপ্পড় খাই নাকি, ভয় হতে লাগলো।
কিন্তু পরীটা দেখি খুশিতে লাফিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমো খেলো!!!এবার আমি পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, আমি বেহেশতেই আছি। বেচেঁ থাকতে পরী নামক পেত্নীটার হাত ধরেছি সবমিলিয়ে ছ’বার। আর প্রতিবারই অনেক বাহানা দেখাতে হয়েছে। আর এখন কি না, চুমো!!! এ শুধু বেহেশতেই সম্ভব। উত্তেজনায় হার্টবিট বেড়েই যাচ্ছে আমার। পরীটা আমাকে এখনো জড়িয়ে আছে, চুলের গন্ধ পাচ্ছি। আহ! বেহেশত যাপনের মজাই আলাদা।
আবারো ঝিমাতে শুরু করলাম আমি । দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ইংরেজীতে কি যেনো লেখা। বেহেশতেও এই বিদেশী ভাষাটা থেকে রেহাই পাবো না দেখছি।ঘুমিয়ে গেলাম……

৫ দিন পরের কথা।

আমার পুরোপুরি বুঝতে ২-৩ দিন সময় লেগেছিলো যে আমি মরে যাইনি। পৃথিবীতেই আছি। আর আমাকে বেহেশতের হুরপরী জড়িয়ে ধরেনি। সেটা আমার পেত্নীই ছিলো। গম্ভীর মুখ-চোখ করে মা’র হাতে খাবার খাই, আর টাইম পেলেই ঘুমাই। ডাক্তার এসে আমাকে ঘুমন্ত অবস্থায় পেতো বলে, বিরক্ত হয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করতো , আমি কি সারাদিনই ঘুমাই কি না। আমি জেগেই থাকতাম, ডাক্তার দেখলেই ঘুমানোর ভান করতাম। ডাক্তারদের আমার অনেক ভয়।
আমার ২ ব্যাগ রক্ত লেগেছিলো, বন্ধুরাই দিয়েছে।পেত্নী নাকি আমার সুস্থ হওয়ার জন্য রোযা মানত করেছিলো।ICU তে প্রায়, ৬০ ঘন্টা অজ্ঞান ছিলাম। এই সময়টুকুতে পেত্নীটা নাকি একবারও ঘুমায় নি। এই মেয়ে আমাকে গালাগাল ছাড়া আর কিছু করতে পারে, সেটা আমার কল্পনাতেও ছিলো না।প্রতিদিনই আমাকে দেখতে আসে, আর মা না থাকলে জোর করে খাইয়ে দিয়ে যায়। আর আমি লজ্জার মাথা খেয়ে মাথা নিচু করে পেত্মীর গালাগাল শুনি আর খেতে থাকি।
“ওষুধ খাইছিস?”
“সকালেরটা মিস গেলো কেন?”
“একা একা নামতে বলছিলো কে তোকে? আমাকে ডাক দেওয়া গেলো না?”
“তুই আজকেও ল্যাপটপ নিয়ে বসছিস?”
এরকম আরো হাজার ঝাড়ি হজম করছি প্রতিদিনই। সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবারের সাথে পেত্নীর ঝাড়ি খাওয়াও আমার নিয়মিত রুটিনে পরিণত হয়েছে।
তারপর কিছু ঘটনা ঘটলো । যা জানতে পারলাম, তা অনেকটা এরকমঃ
আমার দেওয়া এই পর্যন্ত যত ডায়রি পেত্নীটার কাছে রয়েছে, তার সবগুলো খুঁজে বার করা হলো। যা করলো আমার শ্যালিকা(এখনও হয়নি ,পেত্নীর বোনের কথা বলছি) । কয়েকটা ডায়রি আমাকে দেওয়া হলো। এমনি এমনিতে অবশ্যি পাওয়া যায়নি। পেত্নীর ছোট বোন জরিনা বেগম।(আসল নাম জরী।ও অবশ্য নিজেকে জরী বলে না। জরী নামটা নাকি ‘ব্যাকডেটেড’,তাই নিজেকে জারা বলে পরিচয় দেয়। আমি জারা,জরী কোনো নামেই ডাকি না, আমি ডাকি মিস জরিনা বেগম) এই মিস জরিনা বেগমকে দিয়েই আনাতে হয়েছে। জরিনাও বোনের থেকে কম যায় না। নগদ ১ ডজন সাফারি চকলেট কিনে দিতে হয়েছে আমাকে, এর জন্য। তারপর ডায়রির লেখাগুলো পড়ে আমার মাথায় বাঁশ। কিছু কিছু অংশ দিলামঃ
   “ শূন্যতার শোক সভা,
        শূন্যতার যত গান,
       দিলাম তোমার মুকুটে
       আমার যত অভিমান।
এটা আজকে আরুকে বললাম। আর ছাগলটা আমাকে বলে কি না,“হুমমম…বাংলাদেশে কাকের থেকে কবির সংখ্যা বেশী…বুঝলাম।” মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেলো। ওর জন্য আমি এতকিছু করি, আর আমাকে এইভাবে অপমান করে। কোনো মানে হয় এর? আমি আর পারছি না। ওকে বলতেও পারছি না। বোঝাতেও পারছি না , কতোটুকু ভালোবাসি, আমি ছাগলটাকে। মাথাটা খুব ধরেছে। খুব ইচ্ছে করছে ,আরুর কন্ঠটা একবার শুনতে। কিন্তু আমি কল দিবো না। আমি চাইনা, নিজে থেকে দুর্বল হতে। বুঝতেও দিতে চাইনা, কতোটা ভালোবাসি আমি ওকে। তার জন্য আমার যত কষ্ট হওয়ার, হোক।” 

“একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করে দেখলাম, আমি যেসব কাজগুলো বেশি অপছন্দ করি, আরু গর্দভটা সে কাজগুলো বেশি বেশি করে। হুমমম… আমিও ছাড়ছি না। দাঁড়াও চাঁন মানিক, তোমাকে পেয়ে নিই।”

  “হি হি হি। আজ পেয়েছি। লেমন কালারের শার্টটাতে পুরো নায়কের মতো লাগছিল আরুকে। গাধাটাকে বললাম, যে ওকে জঘন্য লাগছে। আমি শিওর, আরু ছাগলটা এখন থেকে এ শার্টটাই বেশি বেশি করে পরবে। হি হি হি, আস্তা গরু একটা। লাভ ইউ মাই ছাগলটা। হি হি হি।”

   “গাধাটাকে আজকে শুধুশুধু অনেক বকা-ঝকা করলাম। আমারই এখন খারাপ লাগছে। আরেফিন নামে কেউ কখনো নেই, ছিলো না। এই সহজ কথাটা কি করে বুঝাবো আমি এই ছাগলটাকে। বারবার বলে আরেফিন নাকি আমার এই-সেই। রাগের মাথায় আমিও বলে দিয়েছি। হ্যাঁ, আরেফিন আমার সব। যা আমার চোখের সামনে থেকে, কক্ষনো যেনো আর না দেখি, কল-মেসেজ কিচ্ছু দিবি না। ওকে আমি কেমন করে বলি যে, আরেফিনের নাটকটা না করলে যে তুই আমাকে কখনোই কিছু বলতি না। আমি মেয়ে হয়ে তোকে, ভালোবাসি কথাটা বলতে পারছিলাম না, দেখেই তো তোর ‘আরনাফ’ নামটাকে ‘আরেফিন’ করে বানিয়ে বানিয়ে কথাগুলো বলতাম। যাতে তুই আমাকে মিস করে ভালোবাসতে শুরু করিস। সেই কবে একবার ভালোবাসার কথা বলেছিলি। ছোট ছিলাম বলে রাজি হইনি। আর কি বলবি না? নাকি, শেষ পর্যন্ত আমাকে দিয়েই বলাবি? ধ্যাত্তেরি… কিচ্ছু ভালো লাগেনা। কিচ্ছু না। মিসিং ইউ আরু ।”

“ছাগলটা একবারের জন্যও কল করলো না। কি করে, কে জানে। রাগের মাথায় বলছিলাম, কল,মেসেজ না দিতে, আর গর্দভটা সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। মোবাইলটার দিকে তাকাতে তাকাতে তো চোখ ব্যাথা করে ফেলবো। আর নবাবজাদা বোধহয় নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। প্লীজ আরু, একবার কল কর , প্লীজ।”

এটুকু পড়েই তো আমার আক্কেল গুড়ুম। ৭ টা ডায়রি আছে টোটাল। সবগুলো পড়া সম্ভব না। আচ্ছা, আমি হাসপাতালে থাকার সময় পেত্নীটা কি করেছে, সে ডায়রিটা কি আছে? খুঁজতে লাগলাম।
পেয়েছি!!! নীল রঙের মলাট। ডায়রিটা খুলে পড়তে লাগলাম।
“কুত্তা, শয়তান, বদ আরু। বোকার মত কেনো রাস্তার মাঝে গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলি? জ্ঞানও ফিরছে না। ডাক্তার বলে দিয়েছে ৭২ ঘন্টার পরও যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে আর ……… আমি আর ভাবতে পারছি না। আল্লাহ, তুমি সহায় হও। আমার আরুকে সুস্থ করে দাও। আমি আর কিচ্ছু চাইবো না। কোনোদিন আমার এই আরুকে কষ্ট দিব না।”

“আজকে ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি অনেকক্ষন, আরু কে নিয়ে। ডাক্তার বললেন, আরুর যদি জ্ঞান ফিরেও, ওর এম্নেসিয়া হতে পারে। এতে করে মানুষ পুরনো স্মৃতি ভুলে যায়। আরুরও কি এমন হবে? ও কি আমাকে ভুলে যাবে? এই ছাগলটাকে ছাড়া আমি থাকবো কি করে? ওর জ্ঞান তো এখনো ফিরছে না। আল্লাহ, তুমি ওকে সুস্থ করে দাও, আমি আর কিচ্ছু চাইনা। কিচ্ছু না।”

“গাধাটার আজ জ্ঞান ফিরেছে!!!!!!! আল্লাহ তোমার দরবারে হাজার শুকরিয়া। আজ ভোরের দিকে গর্দভটার বেডের পাশে বসে কাঁদছিলাম, আর হঠাৎ দেখি গাধাটা আমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে আছে।আমার ডাক্তারের কথা মনে পড়লো । ও কি তাহলে আমাকে চিনতে পারছে না? কাছে এসে ডাক দিতেই, আমার সাথে আপনি আপনি করে কথা বলা শুরু করলো। খুব ঝগড়া না হলে আরু কখনো আমাকে আপনি বলে ডাকে না। আমার ভয় হতে লাগলো। তারপর ও আমাকে হঠাৎ করেই সেই পরিচিত “পেত্নী” বলে ডাক দিলো । আমি কক্ষনো এই নামটা সহ্য করতে পারতাম না। কিন্তু আজকের কথা আলাদা। আমি আমার এই আরনাফ নামক গাধাটাকেই জড়িয়ে ধরলাম। আমার একটুও লজ্জা করছিলো না। কেনো যেন এই খরগোশের মতো কানওয়ালা গর্দভটাকেই আমার স্বামী বলে মনে হচ্ছিলো। যাকে জড়িয়ে ধরলে পাপ হয়না। নিজেকে পুণ্যবতী বলে মনে হয়।”

ডায়রি বন্ধ করে চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কাঁদবো, নাকি হাসবো, বুঝতে পারছি না।
ডায়রির লেখাগুলো আন্টি (পেত্নীটার মা) পড়েছেন, নিশ্চয়ই । আমার মা ও জানেন। জরিনা তো জানেই। শুধু পেত্নীই জানেনা যে, আমরা সব জানি!!!
পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি। ডাক্তারদের তো এই সময় আসার কথা না। তাহলে কি পেত্নী? নাহ। পেত্নীও না। জরিনা বেগম এসেছেন।
“গুড আফটারনুন, জরিনা বেগম।”
“গুড আফটারনুন, জিজু।”
“কি বললি?”
“গুড আফটারনুন, বললাম।”
“শেষে কি বললি?”
“জিজু ডাকলাম, দ্যাট মিনস দুলাভাই।” বলেই হাসতে লাগল।
“হাসাহাসি বন্ধ কর। আর এইসব জিজু , ফিজু ডাকবি না। জিজু,ফিজু… হিজু টাইপ। হিজু মানে বুঝিস? হিজড়া। আমাকে কি হিজড়া মনে হয় নাকি?”
“তুই কি সারাজীবন এভাবেই কথা বলে যাবি নাকি, ভাইয়া?”
“নাহ, আরো ভয়ংকর হওয়ার খায়েস আছে।তোর আপু আসে না,কেন?”
“ওরে, না দেখে আর থাকতে পারছে না। রাধা বিনে কৃষ্ণ যেন একেলা!!!”
“আরিব্বাপরে , রাধা-কৃষ্ণ ও শিখে গেছিস? আমাদের বিয়ে না করে তো তোর আগে একটা বিয়ে দিয়ে দেওয়া দরকার। বেশি পেকে গেছিস।”
“এহ্‌ , আমি বিয়েই করবো না। আপু সারাক্ষন তোর কথা ভেবে কাঁদে। এইসব ঢং এ আমি নাই।”
“থাকবি, থাকবি। ফট করে একদিন প্রেমে পড়ে যাবি। আমার তো মনে হয়, অলরেডি প্রেমে পড়েই আছিস। মেয়েদের প্রেমে পড়ার প্রথম লক্ষন ‘আমি বিয়ে করবো না’ টাইপ কথা বলা। বাথরুমে গিয়ে দেখ , আয়না আছে। তুই লাল হয়ে গেছিস। তার মানে আমার ধারনা সত্য। এখন তোর আপু কেন আসছে না, সেটা বল। নাহলে আমাদের আগে তোর বিয়ে দিয়ে দিবো।”
“আপু, তোর জন্য স্পেশাল ডিশ বানাচ্ছে। এসে পড়বে, একটু পরই। এখন মাই ডিয়ার জিজু , আমাকে কি দিবি বল।”
“তোকে আবার কি দিবো?”
“না দিলে , সবাইকে বলে দিবো , কিন্তু।”
“কি বলে দিবি?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“আপু যে তোকে কিস করেছে, সেটা আমি দেখেছি। সবাইকে বলে দিবো,কিন্তু।” ষড়যন্ত্রকারীর মতো ভঙ্গি করে হাসছে,আমার ভবিষ্যত শ্যালিকা। স্লো ইয়র্কা মেরেছে। সামনে এগিয়ে সাকিব আল হাসান টাইপ সুপার স্কুপ মারতে হবে।
“বল জিজু কি দিবি?”
“তোর হিজু নাম ডাকা বন্ধ কর আগে।”
“ওকে… দুলাভাই কি দিবি,তুই?”
“দুলাভাই ও ডাকিস, আবার তুই তুই ও করিস। ফাইজলামি?ঠিক করে ডাক।”
“অউউউউউফফ…… ওকে… আমার একমাত্র আপুর,একমাত্র জামাই। আপনি আপনার বিয়েতে আমাকে কি দিবেন?”
“দু’গালে ২ টা করে টোটাল ৪ টা থাপ্পড় । তারপর তোর কোঁকড়াচুলো চশমা ওয়ালার কথা আন্টিকে বলে দিবো।” হাই তুলতে তুলতে আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম, এই ছেলেটার সাথে বেশ ক’দিন ধরেই কথা বলতে দেখেছি জরিনাকে। ঢিল জায়গামতোই লেগেছে, জরিনার মুখ পুরো সাদা হয়ে আছে।
“কি মিস জরিনা বেগম, গিফট পছন্দ হয়েছে?”
“ভাইয়া, প্লীজ কাউকে বলিস না কিছু,প্লীজ।”
“হুমমম…এরকম ব্ল্যাকমেইলিং প্ল্যান করলে আমিও কিন্তু ছাড়বো না। মনে রাখিস। কিন্তু ছেলেটা কিন্তু ভালোই। তোর পছন্দ ভালো।”
“হু, আর লাগবে না, পাম মারা।“
“তোর আপু আসে না কেন রে………”
“আহারে …বউ পাগলা দুলাভাই…”
এই সময় পরীর প্রবেশ।
“আরু ভাইয়া, নে, তোর নায়িকা হাজির। আমি গেলাম। নাহলে তোদের ‘প্রাইভেট’ কথাবার্তায় সমস্যা হবে।”
“জারা, বেশি বেশি বলছিস কিন্তু। বাসায় আয় আজকে, তোর খবর আছে। ”
“তোর খবর তো আরোও এক্সক্লুসিভ।” হেসে বের হয়ে যেতে যেতে জরিনা বেগম বলতে লাগল।
আমি চুপচাপ পেত্নীর দিকে তাকিয়ে আছি। ছয় বছর আগে যেমন অনুভূতি হতো, সেরকম লাগছে এখন। বুক কাঁপছে আমার। এতো জোরে হৃদস্পন্দন হচ্ছে যে, ভয় হচ্ছে পেত্নীটা শুনে ফেলতে পারে।
“ডাক্তার তোকে রেস্টে থাকতে বলেছে না? এতো বকবক করিস কেন? বিকালের ওষুধ খাইছিস? জানতাম, খাবি না। খেলে তো সুস্থ হয়ে আমার সাথে তোকে ঘুরতে হবে। সেটা তো আর তুই চাস না……”
 গোলাপি রঙ এর জামা তে আজ পেত্নীটাকে লাগছে গোলাপী পরীর মতো। ওর এতো ঝাড়ি শুনলে কেউ কি বুঝবে, কতোটা ভালোবাসা দিয়ে আমাকে ঘিরে রেখেছে মেয়েটা!
“আমাকে বিয়ে করবি?”
ঝাড়ি থেমে গেলো পেত্নীর।
“কি বললি?”
“তুই আমাকে বিয়ে করবি?”
“উষ্ঠা খাবি।”
“কেন?আমি খারাপ?”
“না তো, তুই বেশি ভালো। এইটাই সমস্যা।”
“তাহলে মা কে বলে বিয়ের কথা বলবো?”
“ছাগলা…ছাগলামি থামা…”
“এই না বললি , আমি ভালো। আসলে তোর মতো ১ টা বউই তো আমার দরকার। আমাকে রান্না করে খাওয়াবি, অসুস্থ হলে আমার সেবা করবি…”
“ও… কাজের বেটি পাইছিস আমাকে,না? তাহলে আমাকে কেন? আমার থেকে এসব কাজ ভালো পারে, আমাদের রহিমা’র মা। ওনারেই বিয়ে কর গিয়ে…যাহ।”
“তুই তো আমাকে ভালোবাসিস…তাই…”
“এহ…আমার তো ঠেকা পড়ছে…”
“না পড়লে … পড়বে…”
“যা ভাগ…”
এরকম করে কথা আগেও চলেছে…আজও চলছে, চলবেও। অসম্ভব মায়াবতী এই মেয়েটাকে পেয়ে আজ নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান বলে মনে হচ্ছে। এই মায়াবতী ‘পেত্নী’র মায়া কে অগ্রাহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অবশ্য তার দরকারও হয়নি।

এরপরের ঘটনা আর তেমন কিছু না।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার ২ সপ্তাহের মাথায় আমাদের দু’পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতে, আমাদের বাগদান হয়। আর বিয়ে হয় দু’বছর পর।

তারও দু’বছর পর…আবারও সেই হাসপাতালে আসতে হলো। না,না…আবারো কারো পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আশংকায় নয়। পৃথিবীর বুকে নতুন এক মুখের আগমনের জন্য আসা।

আমি আমার ছেলেকে কোলে তুলে নিলাম…পিট পিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে। চোখগুলো আমার মতোই হয়েছে দেখতে।
“ওর ডাকনাম তুই দিবি, ভালো নাম আমি দিবো। তবে যা ই রাখিস, কম্পিউটার পার্টস এর নামে নাম দিস না, প্লীজ।”
বিয়ের দু’বছর পরও আমরা এখনও তুই,তুই করেই কথা বলি। আমাদের ছেলে বড় হয়ে আমাদের অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই অবাক হয়ে যাবে। হলে হবে।
“কি? এখন কি নাম রাখতে ডিকশনারী খুলে বসবি?  বল।”
“এখনই?”
“তো, নয়তো কি? ওর বিয়ের সময় গিয়ে নাম রাখবি?”
আগামীকাল হরতাল… বাইরে মিছিল চলছে। হঠাৎ করেই নামটা মাথায় এলো।
“একটা নাম ভাবছি। কিন্তু তুই রাখবি নাকি, বুঝতে পারছি না।”
“ঐ গাধা, ছেলে কি আমার একার? তুই বাপ হয়ে ছেলের নাম দিতে পারবি না? তবে যা-ই রাখিস, কোনো সফটওয়্যার, পার্টসের নামে নাম রাখা চলবে না। আমার ছেলে কম্পিউটার না।”
“মিছিল।”
“ফান করে বলছিস, নাকি সিরিয়াসলি?”
“সিরিয়াসলি।”
“হুমমম… নামটা ভালো। আমার পছন্দ হয়েছে।”
“যাক, শান্তি।”
“কেন? তুই কি ভাবছিলি?”
“না…ভাবছিলাম,আমাদের ছেলেটার যদি আর একদিন পরে জন্ম হতো, তাহলে নাম রাখতাম ‘হরতাল’। সারাজীবন একটা পেইন নিয়ে থাকতে হতো। ওর বন্ধুরা ওর নাম নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতো। রাস্তায় দেখা হলে বলত, ঐ দেখ, হরতাল যায়। আজ স্কুল বন্ধ।”
এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে বিখ্যাত সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে কেবিন কাঁপাতে লাগলো, আমার পেত্নীটা।

মিছিলও হঠাৎ করে কাদঁতে লাগলো। ভয় পেয়ে, নাকি নিজের নাম নিয়ে বাবার করা রসিকতা শুনে, তা ঠিক বোঝা গেলো না।
                    --------------------------------------------------সমাপ্তি--------------------------------------------------------                                                                                                                                                                                                                                                                                 

লেখক  : সাকিব মাহমুদ
ফেসবুক আই.ডি. : Haru Mia

No comments:

Post a Comment