#১# জনাকীর্ণ এক পথের দিকে সে তাকিয়ে ছিল ছিন্ন পাতার মতো; যেন কেউ এসে মাড়িয়ে দিয়ে যাবে, যেন বাতাসের সাথে সঙ্গী হয়ে উড়ে যাবে, যেন তার কেউ নেই, কেউ নেই।
মানুষ চলে গেলে, হারিয়ে গেলে, দূরে সরে যাওয়ার খারাপ লাগা বোধটা যে সাময়িক তা কিছুদিন পরেই ইবু বুঝে ফেলে, সেই বুঝে ফেলাটা আবার তার মন খারাপ করে দেয়; বেঁচে থাকা, বেঁচে থেকে জীবনধারণ করে, সম্পর্ক তৈরী করে হারিয়ে ফেলার ভেতর কোনো চমক নেই বরং তা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম, এ থেকে বের হওয়ার কোনো রাস্তা নেই- ব্যাপারটি তাকে আরো বিষণ্ণ করে দেয়।
বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান, তাই বেড়ে ওঠা নিঃসঙ্গতায়। বাইরের পৃথিবী থেকে ঘরের দরজা বন্ধ কিন্তু জানালা খোলা পরিবেশ তার ভীষণ পছন্দের। তবে তার স্বপ্ন ছিল কিংবা আছে। সেই স্বপ্ন সে একা একা দেখতে, ভাবতে ভালবাসত। বন্ধু বলতে যাদের বোঝায় তেমন কাউকে ইবুর জীবনে দেখা যায়না। এ নিয়ে বাবা-মা’র দুঃশ্চিন্তার অন্ত নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা সাধারণত যেমন হয়, ইবু মোটেও তেমন না। বাবা-মা’র কোনো বাধা না থাকা স্বত্ত্বেও তার পরাধীনতাতেই তার যত আনন্দ।
বাবা, চল পার্ক থেকে ঘুরে আসি।
ভালো লাগে না।
বন্ধুদের সাথে খেলতে যাস না কেন?
আমার তো কোনো বন্ধু নেই।
সুতরাং ইবুর শৈশব চরিত্র সম্পর্কে আমরা একটি ধারনা পেয়ে যাই, তার চরিত্রের এই দিকটি যৌবনে এসেও খুব একটা বদলায় না সেই সম্পর্কেও আমরা ধীরে ধীরে জানতে পারব।
সন্তানের এই অবস্থায় শিক্ষিত অভিভাবক মাত্রই চিন্তিত হবেন, ইবুর বাবা-মা’র ক্ষেত্রেও তাই হলো।
একদিন তারা আলোচনায় বসে, ইবুর কী হলো?
বাবাকে তুলনামূলক কম উদ্বিগ্ন মনে হয়, বাবারা যেমন হয়। তিনি বলেন, তোমার ছেলে, তুমি জানবে না?
আমার ছেলে মানে? আলোচনা শুরু হতে না হতেই ঝগড়া শুরু হয়ে যায়, ঝগড়া শেষে ক্লান্ত হয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুমোনোর আগে ইবুকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা কেউ একজন বলে তারপর আগামীকালের জন্য রেখে দিতেই তাদের চোখ বন্ধ হয়ে আসে আপনাআপনি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে কতক্ষণ জেগে থাকা যায়? যেখানে দুজনেই চাকরি করে, তাদের আলাদা করে ছেলেকে সময় দেওয়া কিছুটা কঠিন হয়ে যায়। অন্যদিকে ইবু একটা কাকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলে। তার খোলা জানালার পাশে এসে কাকটি প্রতিদিন কা কা করে ডাকে। ইবু গিয়ে বলে,
তুমি স্কুলে যাও?
কাক বলে, কা কা।
কোন স্কুলে যাও?
কা কা কা।
কেউ দেখে বুঝবে না ইবু কাকের সঙ্গে কথা বলছে। মনে করবে এক বিষণ্ণ বালক দু চোখে রাজ্যের সৌন্দর্য নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, সেখানে হয়ত মেঘের ছুটে চলা দেখছে কিংবা সাহিত্যিক গোছের কেউ একজন দেখলে ভাববে নিজেকেই হয়ত মেঘ ভাবছে, ছুটে ছুটে যাচ্ছে পাখির পেছনে পেছনে।
কিন্তু সে কাকের সাথে কথা বলছে। কাক একবার কা করা মানে, না ; দু বার কা করা মানে হ্যা- এইভাবে সে কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছে।
আমি স্কুলে যাই, ইবু বলে।
ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার স্যার বলেছে, আমি খুব ভালো ছাত্র। চোখের পলকে অঙ্ক করে ফেলি। অবশ্য আমার পড়তে ভালো লাগে না। যদিও সবসময় ফাস্ট হই। তোমার রেজাল্ট কেমন?
কাক এবার কিছু বলে না।
আহারে! তোমার রেজাল্ট বুঝি ভালো না?
কাক চুপ করে থাকে। বাইরে তখন ভোরের নিঃস্তব্ধতা। তাই এই নীরবতা বড় বেশী কানে বাজে ইবুর।
এত সকালে কার সঙ্গে কথা বলিস? মা’র কন্ঠ শুনে ইবু জানালা থেকে সরে আসে।
কারো সাথে না, মা। ইবু ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে। সে ভেবে দেখেছে, তার মা-বাবা জানি কেমন। সবকিছুতেই দোষ খুঁজে বেড়ান। অথচ সে দেখেছে তার স্কুলের অন্য ছেলেদের মা’রা কেমন শাসনে রাখে, কোথাও যেতে দিতে চায় না, সারাক্ষণ খালি পড়তে বলে। ইবু ভাবে, আমি নিয়মিত পড়াশোনা করি, কোথাও যেতে চাই না, তবু মা কেন মাঝে মাঝে বকা দিবে? উল্টো তাকে বলে খেলতে যেতে বলে। একবারো ভেবে দেখেনা খেলতে তার এতটুকু ভালো লাগেনা। ভেবেছিল সকালে ওঠার জন্য ধমক দিবে মা। তাকে অবাক করে দিয়ে তিনি এসে বললেন, ঘুম ভেঙে গেছে কেন এত সকালে?
ইবু চুপ করে থাকে। বিছানায় গিয়ে বসে। সে ভেবে পায় না কী বলবে? ঘুম ভেঙে গেছে, এটা জানে। কেন, সেটা জানা নেই। কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেনি, শব্দ হয়নি, বিকট শব্দে বাজ পড়েনি। তাছাড়া এখন ভোর হচ্ছে, ঘুম ভাঙ্গতেই পারে। তাই এমন অর্থহীন প্রশ্নের উত্তর কী হতে পারে? সে কল্পনা করতে চেষ্টা করল প্রতিদিন স্কুলে তার পাশে যে ছেলেটি বসে সে কী জবাব দিত? খুব সম্ভবত ছেলেটির মা এ ধরনের কোনো প্রশ্ন করতেন না, বরং খুশী হতেন; এত সকালে উঠেছে, খুশী হওয়ার কথা। অথচ, তার মা এসে জানতে চাইলেন, ঘুম কেন ভেঙে গেছে?
মা ঘরে ঢুকে দেখেন পরিপাটি করে গোছানো রুম। বিছানার চাদর টানটান করে রাখা, যেন কেউ কাল রাতে এখানে ঘুমোয়নি, টেবিলের বইগুলো জায়গামতো চুপচাপ বসে আছে, যেন কতকাল কেউ সেগুলো স্পর্শ করেনি। দেখে মনে হয় বড় মানুষের ঘর। মা’র মনে চিন্তা আসে, তবে কি ইবু বয়সের আগেই বড় হয়ে গেছে? গতকাল রাতে মনিরের সঙ্গে ঠিকমতো কথা হলো না, এদিকে ছেলের অস্বাভাবিকতা সাত-সকালে তার মনকে বিষণ্ণ করে দিল।
চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই; সব ঠিক আছে, দু’টো হাত, দু’টো পা, মায়বী মুখ, ছোট দু’টো আয়তচোখ, পরিপাটি করে আঁচড়ানো চুল। অসীম মমতায় ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন এসে। মন খারাপ বাবা?
ইবু আবার বিরক্ত হয়।
না।
অন্য যে কেউ হলে, জবাব দিত মন খারাপ হবে কেন অথবা বলত, হ্যা মন খারাপ- আমাকে এটা কিনে না দিলে মন ভালো হবে না। ইবু এসব পছন্দ করে না। তাই এক কথাতে বলে, না। অথচ ইবু বলতে চেয়েছিল চলে যাও এখান থেকে, আমাকে একা থাকতে দাও। কিন্তু তার মনে হয় এভাবে বললে মা’র মন খারাপ হবে, কারো মন সে খারাপ করে দিতে চায় না, তাই সে অল্পকথায় উত্তর দেয়; ইবু স্বল্পভাষী, অমিশুক হলেও তার চরিত্রের দুরদর্শিতা এখানে প্রকাশ পায়, বোঝা যায় সে একেবারে স্বার্থপর না, যেটা তার ক্লাসমেটরা অনেকেই ভাবে, ওকে ঘৃণার চোখে দেখে। তবে তাদের ভেতর থেকেই একজন থাকে যে এমন ভাবে না, সে ভাবে হয়ত তারা মিশতে পারছে না, সে ইবুর কাছাকাছি হতে চেষ্টা করে এবং ইবুকে সে তার বন্ধু বানিয়ে ফেলে। ব্যাপারটা এতটাই অস্বাভাবিক যে শুনে ইবুর মা-বাবা অবাক হয়ে যায়, তার খুশী হয় এই ভেবে যে ডাক্তারের কাছে তাকে নেওয়া লাগল না, যদিও আদৌ নেয়া হতো নাকি সেই বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যায় না, আমরা ধরে নিতে পারি যে তারা নিয়ে যেত এবং আজ হোক আর কাল হোক ইবু সহজ স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করত।
ইবুর বন্ধুর নাম মিশু। মিশু, একেবারেই অন্যরকম- ছটফটে, খেলতে পছন্দ করে। তবে সে ইবুর সঙ্গে ইবুর মতো করেই মেশে, ইবু তার বন্ধুর আগমনকে সহজভাবেই নেয়।
সেই একমাত্র বন্ধু যখন চলে যায় ঢাকা, ইবুর মন খারাপ হয়ে যায়। জনাকীর্ণ রাস্তায় সে বিহবল হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার কয়েকদিন পরেই ইবু বুঝতে পারে- সম্পর্ক হবে, এরপর একসময় নাই হয়ে যাবে, মানুষ আসবে, চলে যাবে- এটাই পৃথিবীর স্বাভাবিক নিয়ম।
তখনো তার জানা ছিল না, এরচেয়ে অনেক ভয়ংকর, গায়ে গায়ে লেগে থাকা বাস্তব তার জীবনকে গ্রাস করে নিবে, ইবুর আবার মনে হবে- কেউ এসে মাড়িয়ে দিয়ে যাবে, যেন বাতাসের সাথে সঙ্গী হয়ে উড়ে যাবে, যেন তার কেউ নেই, কেউ নেই। এই অনুভূতি আসার আগেই অবশ্য সে জেনে যাবে, তাকে একসময় তার বাবা-মা’র মতো ছেলেকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতে হবে।
#২#
ইবুর আম্মু খুশী খুশী চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, মনির মিষ্টি কিনতে গেছে, ইবু কী করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? বউ এর পাশে যা।
অসুস্থ চোখে-মুখে অদ্ভুত প্রশান্তির ঝিলিক, কেমন লাগছে তোমার?
ঈর্ষা!
কেন?
আমি শুধু আনন্দটা পাচ্ছি, বেদনা পাইনি, আমি বেদনার্ত হতে চাই। সিরিয়াস ভঙ্গিতে ইবুর কথাগুলো শুনে মৌমিতা অবাক হয় না, জানে সে এমন। হাসতে হাসতে বলে, ধুর বোকা!
বাবুকে কোলে নিয়ে আসে নার্স। দেখেন কত সুন্দর! ইবুর মনে হয় পৃথিবীর সব আনন্দ তার চোখের সামনে, মনের সামনে, আশ্চর্য হয়ে দেখে ছোট্ট চোখ দু’টো পিটপিট করছে আর সমস্ত সত্ত্বা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ভালোলাগা, ভালোবাসা। মৌমিতার পাশে শুইয়ে দেওয়া বাবুকে।
আমি এর নাম রাখব মুগ্ধ।
তুমি যা বলবে তাই হবে।
কেন, রাখব জানো? ওকে দেখে তোমাকে যেভাবে মুগ্ধ হতে দেখেছি সেভাবে তোমাকে কোনোদিন দেখিনি।
ইবু কিংবা মৌমিতা কেউ জানত না, মুগ্ধতার আকাশে তখন কালো চাদর, শিশিরের মতো টুপটাপ করে ঝরে পড়ার অপেক্ষায়।
মুগ্ধ একেবারে তোর মতো, চুপচাপ থাকে, একা একা থাকে। ছোটবেলায় তুই এমন ছিলি,কারো সাথে মিশতি না। ইবু তখন জানতে পারে, ডাক্তারের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তার আগেই অবশ্য ঠিক হয়ে গিয়েছিল। ছেলের সাথে নাতির মিল পেয়ে ইবুর বাবা-মা যখন আনন্দিত তখন মুগ্ধের অস্বাভাবিকতায় ইবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে, মৌমিতার সাথে শেয়ার করে, বলে আমাদের ডাক্তার দেখানো উচিত; ইবুর বয়স তখন তিন বছর, অথচ তখন সে ঠিকভাবে বাক্য তৈরী করতে পারেনা, কারো সাথে কমিনিউকেট করতে পারেনা।
একটি খেলনা সাইকেল নিয়ে সারাদিন বসে থাকে, চুপচাপ।
আপনার ছেলে অটিসমে আক্রান্ত।
বেদনার শিশির ঝরা পাতার মতো পড়তে থাকে টুপটাপ করে। ওর এখন থেকে স্পেশাল কেয়ার লাগবে।
বাবা, কিছু লাগবে?
রাস্তা দিয়ে এক কিশোর সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। মুগ্ধ আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।
সাইকেল কিনে বাসায় ফিরে তারা। এবার আসল সাইকেল নিয়ে মুগ্ধ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
মৌমিতা আর মুগ্ধকে বাসায় পৌছে দিয়ে, ইবু বের হয় রাস্তায়। তার মনে হতে থাকে জেনেটিকাল কারণে মুগ্ধ’র এমন হয়েছে। হয়ত তার ভেতর পুরোপুরি প্রকাশিত হয়নি কিন্তু ছেলের ভেতরে হয়েছে। সে স্পষ্ট দেখতে পায় বুকের সমস্ত সত্ত্বা চুপচাপ কাঁদছে, সে থামানোর কোনো চেষ্টা করেনা। এই প্রথম বুঝতে পারে কিছু কিছু বেদনা আছে যা সময় দুর করতে পারেনা, পা টিপেটিপে এগোতে থাকে মানুষের সঙ্গে চাইলেও কেউ কিছু করতে পারে না।
ক্রিং ক্রিং। সাইকেলের বেল শোনা যায়।
আরে বাবা রাস্তা আটকে হাঁটছ কেন? ইবু দেখে মুগ্ধ বড় হয়ে গেছে। সাইকেল চালিয়ে পেছন পেছন চলে এসেছে। এই প্রথম মুগ্ধকে হাসতে দেখে সে। তার নিজের জীবন বাজি রেখে পৃথিবীকে জানিয়ে দিতে ইচ্ছে করে, এই হাসি থেকে সুন্দর পৃথিবীতে আর কিছু নেই।
বাইরে তখন চন্দ্রালোকিত রাত, আলোর ছিটেফোটা বর্ষণ ইবুকে ছুঁতে পারে না; সে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। এই বিশাল পৃথিবীতে ও আর মৌমিতা ছাড়া মুগ্ধর কেউ নেই, ওদের কেউ থাকে না! সাইকেলগুলো কেবল হারিয়ে যায়। সাথে থাকে কেবল বেদনার্ত শিশির, একটি মানুষ আর তাদের বাবা-মা।
লেখকঃ ময়ূখ রিশাদ ( আরিশ)
Facebook id:mahbub mayukh rishad
No comments:
Post a Comment