Subscribe:

নিশীথরাতের বাদলধারা

গভীর রাতে মেয়ের কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল রাবেয়ার। ঘড়ির নিয়ন হাত জানান দিল বাজে রাত ১:৪৫। রাবেয়ার মেয়ে চিত্রার বয়স ১৫। এই বয়সটাই তো কান্নার বয়স। বুকের মধ্যে যে উথাল-পাথাল আবেগের বন্যা আছে তা যেন এই রাত বিরেতেই খরস্রোতা নদীর মত তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। রাবেয়া চেষ্টা করেন যতটা সম্ভব বন্ধুর মত থাকতে কিন্তু এই উঠতি বয়...সে মেয়ের নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি হয়েছে সেখানে হস্তক্ষেপ চিত্রা মোটেও পছন্দ করে না। রাবেয়াও তাই এগুলো নিয়ে বেশি ঘাটান না।



তবুও রাতের বেলার এই কান্নায় মায়ের মন বিচলিত হয়ে ওঠে। কেন কাঁদে চিত্রা? রাবেয়ার মনে পড়ে তার কৈশোরের কথা। মফস্বলে বড় হওয়া রাবেয়া হেঁটে স্কুলে যেতেন। প্রায়ই একটা ছেলেকে দেখা যেত কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে। একদিন ছেলেটা রাবেয়ার হাতে জোর করে একটা চিঠি গুঁজে দেয়। বাসায় এসে চিঠি খুলে দেখেছিলেন পুরো চিঠিতে অশ্লীল কথা ভরা। সেদিন রাতে অনেক কেঁদেছিলেন রাবেয়া। অনেকদিন পর্যন্ত রাবেয়া অনেকখানি হেঁটে অন্য পাড়া দিয়ে স্কুলে গিয়েছিলেন। পরে বাবা যখন বদলী হয়ে ঢাকায় চলে আসেন সবাইকে নিয়ে তখন রাবেয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। চিত্রাকেও এরকম কেউ রাস্তায় পিছু নেয় না তো! প্রায়ই তো পেপারে দেখা যায় “ইভটিজিং-এর যন্ত্রণা সইতে না পেরে স্কুলছাত্রীর আত্মহত্যা!” পরক্ষণেই মনে পড়লো চিত্রা স্কুলে যায় গাড়িতে করে। তবুও রাবেয়া পরে চিত্রাকে জিজ্ঞেস করবেন বলে ভেবে রাখলেন।


চিত্রার রুমের দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেলেন রাবেয়া। চিত্রাকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করলেও ও কিছু বলবে না। মেয়েটা যে কিভাবে এতোটা জেদী হল! অথচ ওর বয়সে রাবেয়া বেশ শান্তশিষ্ট আপোষী মনোভাবের ছিলেন। আর তাই যেদিন রাবেয়ার খালাতো ভাই তার বুকে হাত দেয় সেদিন রাবেয়া কাউকে কিছুই বলেন নি। চিত্রার মত সেদিনও গভীর রাতে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদেছিলেন। সে কি গ্লানি! সে কি লজ্জা! মেয়ে হিসেবে পৃথিবীতে পাঠানোর জন্য সেদিন বিধাতার ওপর যে কি প্রচন্ড রাগ হয়েছিল! নিজের অক্ষমতা দেখে আর কিছু করতে না পেরে সমস্ত পুরুষ জাতিকে মনে মনে গালি দিয়েছিলেন রাবেয়া। চিত্রার সাথে এমন কিছু হয়নি তো! অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে ওঠে রাবেয়ার। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন যেন এরকম অভিজ্ঞতা যেন চিত্রার কখনো না হয়।


এইসব ভাবতে ভাবতে বিছানা ছাড়লেন রাবেয়া। পাশের ঘরে মেয়েটা এখনও কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না নয়। কেমন যেন আর্তনাদ! রাবেয়ার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। এইটুকুন একটা মেয়ের কিসের এতো কষ্ট! হৃদয়ঘটিত কিছু নয় তো! এই বয়সটাই তো প্রেমে পড়ার। রাবেয়ার মনে আছে পাশের বাড়ির কণার বড় ভাই অন্তুদা যখন পড়ার জন্য আমেরিকা চলে গেল সেদিন রাতে রাবেয়ার যে কি কান্না! তখন রাবেয়ারও স্বপ্ন বোনার বয়স। রাজকুমারের ঘোড়ায় করে আসার সেই সব স্বপ্নতে তখন ছিল অন্তুদার আনাগোনা। কণা মেয়েটাকে একটুও পছন্দ না করলেও রাবেয়া প্রতিদিন বিকেলে হাজির হতেন ওদের বাসায়, শুধু অন্তুদাকে দেখার জন্যে। সেই অন্তুদা যেদিন চলে গেল সেদিন খুব কেঁদেছিলেন রাবেয়া। কেউ জানেনি সেই কান্নার কথা। অন্তুদার প্রতি তার সেই গোপন স্বপ্ন বোনার গল্প কেউ জানে না। চিত্রার স্বপ্নেও কি এরকম কেউ আসে!


আসুক! দেখুক যদি কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে চায়! যতদিন পারে স্বপ্ন দেখে নিক। একটা সময় সমাজ এইসব স্বপ্নের গলা টিপে ধরবে। তার আগ পর্যন্ত যদি মেয়েটা স্বপ্ন দেখুক। এটাই তো সময় স্বপ্ন দেখার। এটাই তো বয়স এইসব খেয়ালী আবেগকে প্রশ্রয় দেবার।


পা টিপে টিপে চিত্রার ঘরের সামনে এলেন রাবেয়া। কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়ছে। লাগোয়া বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন রাবেয়া। মাঝে মাঝে চিত্রাকে হিংসা হয়। চিত্রা এখনো কাঁদতে পারে। রাবেয়ার চোখে জল আসে না অনেক দিন। বুকের ভেতরটাকে গ্রীষ্মের দুপুর মনে হয়। রাবেয়ার বয়স হয়তো বেড়েছে কিন্তু মনটা এখনও চিত্রার বয়সেই আটকে রয়েছে। এখনও রাবেয়া একটু ভালোবাসার জন্য কতোটা কাঙাল তা তিনি নিজেই জানেন। মেয়ে বড় হয়েছে, তার সাথে দূরত্ব বেড়েছে, সাথে বেড়েছে রাবেয়ার একাকীত্বও। এখন আর আগের মত কাছে আসে না মেয়েটা। মাকে আর নিজের সমস্যাগুলো বলে না। তার বদলে রাতেরবেলা একা পড়ে পড়ে কাঁদে। এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বুঝতে চায় না ওদের বয়ঃসন্ধি শুধু ওদের নিজেদের না, সাথে সাথে ওদের মাদেরও কষ্ট দেয়। যেদিন রাতে চিত্রা কাঁদে সেদিন রাতে যে রাবেয়াও ঘুমাতে পারেন না তা কি চিত্রা জানে!


রাবেয়ার স্বামী বেশির ভাগ সময়ই ব্যবসার কাজে বাইরে থাকেন। যতটুকু সময় কাছে থাকেন তার মাঝে আর কটা কথাই বা হয়! একই ছাদের নিচে একই বিছানায় থাকলেও মানুষটাকে অনেক দূরের মনে হয়। রাবেয়ার হৃদয় আকুলি-বিকুলি করে একটু সময় কাছাকাছি থাকার। সময় হয় না। রাবেয়ার সময় কাটে এখন প্রার্থনা করে, যাতে তার মেয়ের যেন কখনো এরকম না হয়। না রাবেয়া কাঁদেন না। শুধু রাতের নীরবতায় একটি দীর্ঘশ্বাস চিৎকার করে রাবেয়ার একাকীত্বের কথা বলতে থাকে….

সিন্থিয়া ইসলাম

No comments:

Post a Comment