Subscribe:

স্যাক্রিফাইস

আমরা চার বন্ধু। আমি, রাশেদ, হায়দার আর খোকা।ক্লাসমেট। হলে থাকি।
একরাতে পড়াশোনা করতে ভালো লাগছিল না, তাই হঠাৎ আমার মনে হল, এখন অন্ধকার ছাদে গেলে মন্দ হত না।
আমি অন্য রুমগুলো থেকে বাকি তিনজনকে ম্যানেজ করলাম। তারপর চারজন মিলে গেলাম ছাদে।
একটা ফাঁকা জায়গা দেখে বসলাম সবাই। তারপর শুরু হল আড্ডা।


আড্ডা মানেই যা হয়, প্রথমে আমরা ব্যাচের কয়েকটা মেয়েকে পচালাম। তারপর মেয়েভাবাপন্ন কয়েকটা ছেলেকে পচালাম। তারপর আমাদের কয়েকজন বন্ধুকে পচালাম। পরস্পরকে পচালাম কিছুক্ষণ। তারপর আবিষ্কার করলাম, আমরা কথা বলার নতুন কোন টপিক খুঁজে পাচ্ছি না।
হঠাৎ খোকা বলে উঠল, একটা গল্প হোক।
সবাই হই হই করে উঠল। হ্যাঁ হ্যাঁ, হোক গল্প।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কে বলবে গল্প?
আমরা কেউ কথা বললাম না।
হঠাৎ রাশেদ বলে উঠল, দোস্তরা, আমি একটা গল্প বলতে চাই।
আমি বললাম, কি গল্প? অশ্লীল?
চাঁদের আলোর নিচে অশ্লীল গল্প জমত ভালোই, কিন্তু শালা রাশেদ বলে উঠল, না ব্যাটা, ঐসব কিছু না। অন্য গল্প।
হায়দার বলল, কি গল্প?
আগে শোনই না। শুরু করব?
খোকা বলল, করে দে।
রাশেদ একটা গলা খাকারি দিয়ে তার গল্প শুরু করল।

                                     *********

ধরি এক দেশে দুই ভাই ছিল। ধরি তাদের নাম জনি আর রনি।
জনি ছিল বড়। আর রনি ছিল ছোট।
জনির রেজাল্ট ছিল অস্বাভাবিক ভালো। সে ফাইভে বৃত্তি পেল, এইটে বৃত্তি পেল। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড, ইন্টারে স্ট্যান্ড। তারপর সে বড় একটা ভার্সিটিতে খুব ভালো সাবজেক্টে চান্স পেয়ে গেল।
আর রনির রেজাল্ট ছিল খুবই খারাপ। সে প্রতি ক্লাসেই ন্যূনতম পাস মার্কের কিছু বেশী পেয়ে কিভাবে কিভাবে পাশ করে যেতে লাগল। আর ওদিকে ক্রিকেট আর ফুটবলে পাড়ায় সুনাম ছড়াতে থাকল তার।
তাদের বাবা মা ছিলেন অশিক্ষিত। তারা বেশী কিছু বুঝতেন না, শুধু বুঝতেন, বড় ছেলে তাদের জন্য সুনাম বয়ে আনছে। আর ছোট ছেলে বয়ে আনছে শুধু দুর্নাম আর অভিযোগ।
বড় ছেলে পাস করে বিদেশ চলে গেল। ভালো চাকরি পেয়ে ওখানেই বসবাস করতে লাগল সে।
আর “ওর মত হ” আর “ওর পা ধুয়ে পানি খেলেও তুই কিছু হইতে পারতি” গালি শুনতে শুনতে এদিকে ইন্টার পাশ করল ছোট ছেলে। পড়াশোনা তার জন্য নয়, এই বিশ্বাসে স্বল্পপুঁজির ব্যবসায় নেমে পড়ল সে।
প্রতিমাসে বড় ছেলের চিঠি আসে, ছোট ছেলে সেগুলো বাবা মাকে পড়ে শুনায়। বাবা মা শুনে মাথা নাড়েন আর বলেন, “গরু, ওর মত হতে পারলি না তুই”।
বড় ছেলে ছয়মাস পর থেকে বাসায় নিয়মিত টাকা পাঠানো শুরু করে। বাবা মা পুরনো গান নতুন সুরে গাওয়া শুরু করেন, ”গাধা, ওর মত হতে পারলি না তুই”।

এটুকু বলে রাশেদ বলল, গল্প শেষ।
খোকা লাফিয়ে উঠল। গল্প শেষ মানে? ফিনিশিং কই?
আমিও তাল মিলালাম, হ্যাঁ, গল্পের তো কোন ফিনিশিং হয় নি। ফিনিশিং কই?
হায়দার বলল, কাহিনীটা শেষ কর হারামজাদা।
রাশেদ নাটকীয়ভাবে বলল, এই দায়িত্ব আমি তোদেরই দিলাম। দেখি, তোরা কেমন গল্প বানাতে পারিস।
আমি বললাম, আমাদের? আমাদের গল্প বানাতে হবে?
রাশেদ বলল, হ্যাঁ। এই গল্পটা শেষ করতে হবে। যে সবচেয়ে সুন্দরভাবে গল্পটা শেষ করতে পারবে তাকে আমি নিজে চায়নিজ খাওয়াব।
আমরা চিন্তাভাবনা করতে লেগে গেলাম। না হলাম সাহিত্যিক, ফ্রি চায়নিজ তো ছাড়া যায় না।
দশ মিনিট পর আমি বলে উঠলাম, বলব?
খোকা বলল, বল।
আমি বললাম, এর পর বড় ছেলে জনি নিজেই একদিন দেশে ফিরে এল। সে ছোট ভাই রনিকে একটা দোকান করে দিল, আর বাবা মাকে বড় করে একটা বাড়ি করে দিল। তারপর বিয়ে করে ওখানেই সুখে শান্তিতে সংসার করতে লাগল সে।
অন্যরা ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ কেউই কিছু বলল না।
তারপর হায়দার বলে উঠল, এইটা হইল কিছু? এত সহজ?
আমি ব্যঙ্গ করে উঠলাম, ওরে আমার সাহিত্যিক আসছে রে! নে, এবার তুই শেষ কর তো দেখি!
হায়দার আগুনে চোখে আমার দিকে তাকাল। ওরে বাবা, যেন ভস্ম করে দেবে এখনই। আমি অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলাম।
হায়দার শুরু করল, বাবা মায়ের এই অনাদর আর সহ্য করতে পারল না রনি। সে বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেল। তারপর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দশ বছরের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হল সে। অতঃপর বাসায় ফিরে সে দেখল, বাবা মা তার আগেই মারা গেছেন।
চুক চুক করে একটা সহানুভূতির শব্দ করল কেউ একজন।
আমি ভাবলাম, হায়দার হারামিই তাহলে চায়নিজ পাচ্ছে।
হঠাৎ খোকা বলে উঠল, তোর গল্প ঠিক আছে, তবে আমিও একটা ফিনিশিং ভেবেছি। বলব?
আমরা বললাম, বল।
খোকা শুরু করল, রনি তার অপমান আর সহ্য করতে পারল না। একদিন আত্মহত্যাই করে বসল সে। আর তার মৃত্যুর পরপরই দেখা গেল, ভালো একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরি পেয়েছে সে, বা ব্যবসায়ে খুবই ভালো একটা লাভ করেছে।
আবারও চুক চুক শব্দ করে উঠল কেউ একজন।
নাহ, খোকা আর হায়দার, দুই শালাই ভালো গল্প বলেছে। কে পাবে চায়নিজ?
আমি বললাম, তো রাশেদ, তুইই বল, কে তাহলে আজকে চায়নিজ পাচ্ছে?
রাশেদ বলল, আমাকে তো চান্সই দিলি না।
আমি হেসে বললাম, তুইও কম্পিটিটর নাকি? জানতাম না তো!
খোকা বলে উঠল, হ, শালা নিজেই নিজের পকেটের টাকা দিয়ে চায়নিজ খাবে। আচ্ছা, বল তোর গল্প।
রাশেদ বলতে শুরু করল, আসলে বড় ছেলে জনি বাবা মাকে কোন টাকাই পাঠায় নি। এমনকি কোন চিঠিও সে লেখে নি। চিঠিগুলো আসলে ছোট ছেলে নিজেই লিখেছে। আর যে মাসে মাসে টাকার কথা শুনলি, সেগুলোও সে নিজে ব্যবসা করে জমায় আর বিদেশের ঠিকানা লিখে নিজেই নিজের বাসায় পাঠায়।
আমরা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বললাম, কেন? রনি এরকম করল কেন?
কারণ, রাশেদ বলল, সে চায় নি তার বড় ভাইয়ের প্রতি বাবা মায়ের এতদিনের ভালবাসা নষ্ট হয়ে যাক। বাবা মা সারাজীবনই ভেবে এসেছে তাদের বড় ছেলেই সবসময় তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে, সেই বিশ্বাসটা কোনভাবেই ভাঙতে চায় নি ছোট ছেলে রনি।
তারপর? বলে উঠল হায়দার।
তারপর, বলল রাশেদ, ঐ বিশ্বাস নিয়েই তাদের বাবা মা বাকি জীবন পার করে দিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্তও তাদের মুখে একটাই কথা ছিল, “তোর ভাইয়ের পায়ের যোগ্যও তুই হতে পারলি না”।
কেন? আমি বললাম, রনি কি বাবা মাকে পুরো ঘটনাটা বলে দিতে পারত না? কি সমস্যা ছিল তাতে?
কোন সমস্যা ছিল না। রনি শুধু চাইত, বাবা মায়ের এতদিনের বিশ্বাস যেন না ভাঙে। সারা জীবন ধরে তারা বড় ছেলেকে নিয়ে যে গর্ববোধ করেছেন, আশার যে পাহাড় গড়ে তুলেছেন, স্বর্গীয় স্নেহে বড় ছেলেকে যেভাবে আপ্লুত করেছেন, রঙ্গিন যে পৃথিবী গড়ে তুলেছেন তা যেন এক নিমিষে ধোঁয়া হয়ে উড়ে না যায়। বড় ছেলের মধ্যে যে নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি, যে স্বপ্নের হাতছানি তারা এতকাল ধরে মনের মধ্যে গড়ে নিয়েছেন, তা যেন হঠাৎ করে ধুলো হয়ে ঝরে না পড়ে। একটা মানুষের সবচেয়ে বড় নির্ভরতা তার বিশ্বাস, সেই বিশ্বাসই যদি ভেঙ্গে যায়, তবে আর বেঁচে থাকার সার্থকতা কি? বলতে পারিস, বাবা মায়ের বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করত রনি।

এটা কোন গল্প হইল? হঠাৎ বলে ওঠে খোকা, হইল কোন গল্প? কি ভুয়া ফিনিশিং...রনি চরিত্রটা তো পুরাই ফাউল লাগছে।
রাশেদ অবাক হয়ে তাকাল। কেন?
আমি বললাম, আসলেই রাশেদ, রনি চরিত্রটাকে তুই যেভাবে দেখালি...সেটা আসলেই অসম্ভব।
রাশেদ আরও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তুইও...?
হায়দার বলে উঠল, আসলেই ফাউল। রনি চরিত্রটা নিজে টাকা পাঠায় এটা নাহয় বুঝলাম, কিন্তু বড় ভাইয়ের কথাটা সে ফাঁস করে দেবে না এটা তো আমার বিশ্বাস হয় না। সারাজীবন তো সে বড় ভাইয়ের জন্য নিজে গালি গালাজ খেয়ে এসেছে, এখন সেই বড় ভাইয়ের জন্য সে এত বড় স্যাক্রিফাইস করবে এটা আমার বিশ্বাস হয় না। টাকা পাঠানো ঠিক আছে, কিন্তু রনির বলা উচিৎ ছিল যে এটা সে-ই পাঠাচ্ছে। তাহলে অন্তত বাবা মায়ের চটকা ভাঙত আর যে ভালোবাসা থেকে তারা রনিকে এতদিন বঞ্চিত করে রেখেছিলেন সেটা রনি পেয়ে যেত।
রাশেদের মুখে কেন যেন হাসি ফুটে উঠল। সে হাসিতে মাখানো ছিল বিষণ্ণতা। আচ্ছা ধর যদি রনির নিজের সুখের চেয়ে বাবা মায়ের বিশ্বাস বড় হয়?
খোকা বলল, ওসব গল্প দিস না, ওইগুলা খালি বাংলা সিনেমাতেই পাওয়া যায়। এই কাহিনী নিয়ে শাকিব খান আর অপু বিশ্বাস কত হিট সিনেমা বানাইতে পারবে জানিস? এই বলে হা হা করে হাসতে লাগল সে।
রাশেদ বলল, তার মানে আমার গল্পটার মত কখনও বাস্তবে হতে পারে না?
আমরা একসাথে বললাম, না।
তোরা শিওর?
শিওর।
রাশেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, যাহোক, গল্প প্রতিযোগিতায় তাহলে জয়ী হচ্ছে...হঠাৎ রাশেদের মুখ দেখে বুকের মধ্যে ধড়াস করে উঠল আমার।
সেই মুখে কি যেন ছিল...
আমি বলে উঠলাম, রাশেদ, এটা কি আসলেই গল্প, নাকি সত্যি?
রাশেদ হাসতে শুরু করল।
আমি আবার বললাম, দোহাই তোর, রাশেদ, বল, এটা কি শুধুই একটা গল্প নাকি সত্যি?
রাশেদ তবুও হাসতেই থাকল।

পরিশিষ্টঃ

যার যার রুমে ফিরে গেল চারজন। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুয়ে পড়ল তারা।
তিনজন ঘুমিয়ে গেল, কিন্তু একজনের ঘুম এল না। সেই একজনের নাম রাশেদ।
রাশেদের রুমে কেউ যদি জেগে থাকত, তাহলে দেখতে পেত, রাশেদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছে, বাবা, তোমার কাহিনীটা আমার বন্ধুদের শুনিয়েছি। ওরা কেউ বিশ্বাস করে নি। কেন করবে বল বাবা, এত স্যাক্রিফাইস কি কোন মর্ত্যের মানুষের পক্ষে করা সম্ভব?
কেমন করে পারলে বল তো বাবা? কেমন করে পারলে? তোমার কি বড় চাচার প্রতি একটুও ক্ষোভ ছিল না? একটুও রাগ ছিল না তার উপর? তোমার কি কখনও একটুও ইচ্ছা করে নি সব বলে দিতে? দাদাজান তোমাকে কখনও স্নেহ করে নি, প্রশংসা করে নি, মাথায় হাত বুলিয়ে ভাত খেতে পাশে বসায় নি...সব বড় চাচার জন্য...তোমার কি একটুও রাগ হয়নি? একটুও না? বল বাবা, তুমি মানুষ না ফেরেশতা?
না না তুমি ফেরেশতা নও...তোমার মনে মায়াদয়া কিছুই নেই...নাহলে কিভাবে পারলে আমাদের একা ফেলে এভাবে চলে যেতে...আমাকে আর আম্মুকে একা ফেলে চলে যেতে...কিভাবে পারলে...বাবা!...বাবা!!
তখন হয়তো রাশেদের কোন রুমমেট রাশেদের কান্নার আওয়াজ পেয়ে ধড়ফড় করে জেগে উঠত। তারপর হয়তো সে আস্তে করে রাশেদের পাশে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করত, কি হয়েছে তোর?
তখন হয়তো বরাবরের মতই রাশেদ সুন্দরভাবে সামলে নিত এবং বলত, কিছু হয় নি। চোখে পোকা ঢুকেছে। একটু পানি এনে দিবি?
                                                      (সমাপ্ত)


সালেহ তিয়াস

No comments:

Post a Comment