Subscribe:

রৌদ্রালোকে-২

ধ্রুব আর তিতিরের গল্পের পরের অংশ-
৫.
ধ্রুব তিতিরকে এরপর আর কিছু বলেনি। এমনকি নিজের বন্ধুদের ও কিছু বলতে বা করতে নিষেধ করেছে। কিন্তু ওর পাগলামি কমেনি বৈ বেড়েছে। প্রতিদিন কয়েকবার করে তিতিরের ক্লাসের সামনে হেঁটে যায় তিতিরকে এক নজর দেখার জন্য। একদিন তিতিরের রিক্সার পেছন পেছন গিয়ে দেখে আসলো ওর বাসা কোথায়। মাঝে মাঝে বাসার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তিতিরকে কখনো দেখা যায় না,কিন্তু ধ্রুব ওর হলেও হতে পারতো শ্বশুরবাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে অনেক শান্তি পায়।


ঠিক কিসের জন্য এসব করে ও নিজেই বুঝেনা। শুধু এটা বুঝে যে ওর ভাল লাগে। ওর প্লে লিস্ট ''im so lonely broken angel'' আর ''মেয়ে আমি বখাটে নই'' টাইপের গানে ভর্তি হয়ে গেছে । মাঝে মাঝে বেসুরো গলায় গাইতেও চেষ্টা করে ''আমিতো প্রেমে পড়িনি ,প্রেম আমার উপরে পড়েছে'' আর বলে ক্লাসিক একটা গান দোস্ত,ক্লাসিক গান।

আতিক ওর অবস্থা দেখে বলেই দিল একদিন ''তোরে পাগল রোগে পাইসেরে'' ধ্রুব কিছু বলেনা। ও যে পাগলের সাথে সাথে ছাগলেও রুপান্তরিত হচ্ছে তা নিয়ে ওর নিজেরও আর সন্দেহ নাই। আগে ওর ইচ্ছা ছিল ভালো একটা চাকরি করবে। এখন দৈনিক ওর ইচ্ছা পরিবর্তন হয়। আজকে মনে হচ্ছিল ফুচকা বিক্রির পেশাটা খারাপ না( তিতিরকে খুব শখ করে ফুচকা খেতে দেখেছে আজকে ),আগের দিন মনে হয়েছিল রিক্সা চালালে কিবা এমন ক্ষতি হবে( তিতির রিক্সা করেই আসা যাওয়া করে )...

ধ্রুব খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছে এভাবে কিছুই হবেনা। প্রতিদিন সে অপেক্ষা করে আজকে হয়তো খারাপ কম লাগবে, খুব বেশী সৌভাগ্যবান হলে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে আর অ্যাম্নেশিয়া হয়ে তিতিরের কথা ওর মনেই থাকবেনা...কিন্তু ফলাফল শূন্য। প্রতিদিন আগের দিনের চেয়ে বেশী খারাপ লাগে। এভাবে চলতে থাকলে দেখা যাবে একসময় তিতিরের বিয়ে হয়ে গেছে আর সে মজনুর মতো সারাজীবন দাড়িগোঁফের জঙ্গল নিয়ে বিরহে কাতর হয়ে জগৎসংসারের উপর বোঝা হয়ে পড়ে আছে। নিজের এত সাজানো গোছান লাইফ কোন বোকা লোকই নষ্ট করবে। আর ধ্রুব বোকা না। পাগলামি করছে ঠিকই কিন্তু ওর চিন্তা ভাবনা একদম স্পষ্ট । তাছাড়া এখনকার মজনুরা অনেক ডিজিটাল। এত সব দুঃখ কষ্টের মাঝেও সে ভালোভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছে তিতিরের কোনও বয়ফ্রেন্ড নেই (উপরঅলাকে অশেষ ধন্যবাদ ) ।

ওদের দুই বোন এক ভাই এর মাঝে বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ভাই বাইরে পড়াশোনা করে...যেহেতু তিতির সবার ছোট তাই পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগে তিতিরের বিয়ে হবার কোনও সম্ভাবনা নেই।


৬.

সারারাত জেগে এখন খুব খিদা লেগেছে ধ্রুবর। কিন্তু মায়ের সামনে তো অনেক বড় গলায় ''এইসব আমি খাবোনা'' '' আমার কথা কেউ ভাবে না'' বলে চলে এসেছিল। এখন আবার যেতে লজ্জা লাগছে। মায়ের সামনে লজ্জা লাগার কোনও কারন নেই যদিও। ছোটকালে কোন কিছু দিবে না বললে বিচ্ছুর মত মায়ের সাথে লেগে থাকতো ধ্রুব। না দিয়ে যাবে কই। আর এখন একবার না শুনলেই আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যায়। নাহ! পিচ্চিকালের বেহায়া ধ্রুবই ভালো ছিল। মনে মনে ভাবে সে। এমন সময় মায়ের চিৎকার শোনা গেলো
''ধ্রুব...বাইরে আয় জলদি। খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর ''

বাইরে এসে ধ্রুব দেখল টেবিলে ওর জন্য নাস্তা অপেক্ষা করছে আর তাও ওর পছন্দের!! কখন বানালো মা এসব? যাই হোক,আগে পেট পুজা তারপর অন্য কথা।
খাওয়া শেষে মনে হল এবার চিন্তা করা যায়। পেট ঠাণ্ডা হলে মাথা চমৎকার কাজ করে। উঠে চলে আসবে তখনি মা ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন। ''কোথায় যাচ্ছিস?''
বিরক্ত হলনা ধ্রুব। খেয়ে দেয়ে ওর এখন বেশ একটা ফুর্তি ফুর্তি ভাব এসেছে। জবাব দিল ''বাইরে যাবো''
''তোর কি হয়েছে আমাকে বলে তারপর যা''
''সর তো মা,আমার কিছুই হয়নি'' বলে মাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল সে।

মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল ওর। মহিলা বড়ই চালাক। সব সময় বুঝে ফেলে যে ওর মনে কি চলছে। ধ্রুব একদম সিওর যে সে মায়ের মতই হয়েছে। ওর বাবা এমন খামখেয়ালি যে সামনে দিয়ে চলে গেলেও ভালমত দেখেন না। ধ্রুব দ্রুত হাঁটতে লাগলো। খুব জরুরি কাজ আছে আজকে। ওর জীবন মরনের প্রশ্ন জড়িত এর সাথে। গত কয়েকদিন ধরে ও নিজের সাথে যুদ্ধ করেছে এটা নিয়ে।


৭.

তিতির সে কখন থেকে অপেক্ষা করছে সবার জন্য। ভেবেছিল ওই লেট করেছে। কিন্তু এসে দেখল আর কেউই আসেনি তখনো। ফ্রেন্ডদের কল দিয়ে যাচ্ছে অনবরত কিন্তু ওরা ফোন ধরছেনা। মনে মনে ভাবল সে ''আর ১৫ মিনিট থাকব,এর পর চলেই যাবো''

আনমনে নিজের কোকের গ্লাসে চুমুক দিল তিতির। না আসাই ভাল ছিল। কয়েকদিন ধরে এমনিতেই ওর কিছু ভালো লাগছেনা। লাগবেই বা কেন? যেখানেই যায় সেখানেই ধ্রুবকে দেখছে ও। ক্লাসের বাইরে তাকালে বারান্দায় ধ্রুব। লাইব্রেরীতে গেলে সেখানেও ধ্রুব । একই ডিপার্টমেন্টেই যেহেতু পড়ে,দেখা যেতেই পারে। কিন্তু সেদিনের ঝাড়ি দেয়ার পর থেকে মনে হয় একটু বেশীই দেখা যাচ্ছে ধ্রুবকে।

ঝাড়ি দেয়ার পরে তিতিরের একটু খারাপ লেগেছিল এভাবে কথা শুনানোর জন্য। একটু বেশীই কড়া কথা বলে ফেলেছিল সেদিন। কিন্তু কি করবে সে? সবার কাছে ধ্রুবর ব্যাপারে যা যা শুনেছে...ওর এমন ছেলে একদম পছন্দ না। প্রথমদিন কথা বলে খারাপ লাগেনি তিতিরের। কিন্তু ওর বন্ধুরাই পরে ধ্রুবর সব কাহিনী ওকে বলেছে। এরপর থেকেই ধ্রুবকে দেখলে ও দূরে দূরে থাকে। ধ্রুব যখন নিজের মোবাইল থেকে ওকে কল করতে বলল তখনো সে এড়িয়ে গেছে। উদ্দেশ্য ছিল ছেলেটাকে বোঝানো যে তিতির ওকে এক পয়সার পাত্তাও দেয়না। নবীন বরনের দিন ধ্রুব উপস্থাপনা করেছিলো। তিতির দেখল আসলেই খুব সুন্দর করে কথা বলে সে,আর এটা দিয়েই মেয়ে পটায়!

ওর ফ্রেন্ডরা সবাই ''ইশ!! ধ্রুব ভাইয়া কি সুন্দর করে কথা বলে!!!'' আর '' ইশ!! ধ্রুব ভাইয়া কি হ্যান্ডসাম!!!'' বলে বলে ওর কান ঝালাপালা করে দিয়েছে।

তবে তিতির চিন্তাও করতে পারেনি ধ্রুব ওকেই এসে আবার প্রপোজ করবে। আর প্রপোজালের কি ছিরি! ''আমি চাই তুমিও আমাকে ভালবাসো''...কথাটা মনে পড়তেই আবার রাগ উঠে গেলো তিতিরের। বেশ করেছে সে কথা শুনিয়ে।


আবার ঘড়ি দেখল সে। ৫ মিনিট আছে। কে যেন দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতেই তিতির দেখল সেটা ধ্রুব।

ধ্রুব তিতিরের সামনে এসে দাঁড়াল। তিতিরও দাঁড়িয়ে গেলো । ৫ মিনিট জাহান্নামে যাক,ও এখনি বের হয়ে যাবে। তিতিরের রুদ্রমূর্তি দেখে ধ্রুব তাড়াতাড়ি বলল ''প্লীজ রাগ কোরোনা,আমি কয়েকটা কথা বলেই চলে যাবো। আর কখনই তোমাকে বিরক্ত করবোনা...প্লীজ প্লীজ প্লীজ''
ধ্রুবর গলায় এমন কিছু ছিল যে কারনে তিতির ওকে কোন কটু কথা বলতে পারলনা। আবার নিজের চেয়ারে বসে গেলো।

ধ্রুব ওর সামনের চেয়ারে বসলো। আজকে ধ্রুবকে একদমই নার্ভাস লাগছেনা। ঠিক উদ্ধত না,ওর চোখে কেমন অন্যরকম একটা আভা দেখল তিতির।
''তোমার বেশী সময় নষ্ট করবনা আমি। ক্যাম্পাসে কথা বলতে চাওনা বলে এখানে এসেছি।'' ধ্রুব পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজ বের করলো।
''সামনাসামনি বলতে গেলে অনেক কিছু বলা হয়না। এর আগেরবারও গোলমাল করেছি। তাই চিঠির চেয়ে বেস্ট কোনও উপায় খুজে পেলাম না। এটা তোমার জন্য '' চিঠিটা বাড়িয়ে দিল ধ্রুব।


প্রিয় তিতির,

জানি প্রিয় ডাকার অধিকার তুমি আমাকে এখনো দাওনি,এবং ভবিষ্যতেও দিবে বলে মনে হয়না। কিন্তু তুমি চাও বা না চাও তুমি আমার কাছে সবসময় প্রিয় থাকবে। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখেছিলাম তোমাকে অনেক ন্যাকা মনে হয়েছিলো। যার জন্য আমি দুঃখিত। এরপরের ঘটনা গুলো বলে তোমার সময় নষ্ট করতে চাইনা।

আমার গানের গলা খুব খারাপ। কিন্তু তুমি এত সুন্দর গান গাও দেখে আমি ঠিক করেছিলাম গান গাইতে না পারি কিন্তু তোমাকে সঙ্গ তো দিতে পারি। তাই একটা গীটার কিনেছি আমি। আমার খুব ইচ্ছে তুমি যখন গান করবে আমি তখন গীটার বাজাবো। এখনো শিখতে পারিনি কারন যার জন্য শিখব সেই যদি না থাকে তাহলে খামোখা নিজের নখ ভেঙ্গে,হাত ছিড়ে আর কি লাভ? তাই বলে বলছিনা যে আমার প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দেয়ার জন্য তুমি আমাকে হ্যাঁ বল। কিন্তু এরকম আরও অনেক প্ল্যান করেছি আমি যা একমাত্র তোমার সাথেই সম্ভব হতে পারে।

আসল কথায় আসি। যদি বলি তুমি আমার জীবনের প্রথম নারী তাহলে ডাহা মিথ্যা হবে। কিন্তু এটা সত্যি যে তুমি আমার জীবনের শেষ নারী যাকে আমি সারাজীবন পাগলের মতো ভালবেসে যাবো। আমার নামে হয়তো অনেক কিছুই শুনেছ কিন্তু এটা কেউ বলতে পারবেনা যে আমি মিথ্যাবাদী।

আজকে নাহয় কালকে তুমি বিয়ে তো করবেই। আর যেহেতু পাত্র তুমি এখনো ঠিক করনি তাহলে আমাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো। পাত্র হিসেবে আমি খারাপ না। কথা দিচ্ছি ঠকবেনা।
আমি এটাও বলবনা যে আমি তোমাকে ছাড়া মরে যাবো। আমার জীবনে আগে আমার বাবা মার অধিকার,এর পরে আমার। তাঁরা আমাকে অনেক আদর ভালবাসা দিয়ে বড় করেছেন যার মূল্য শোধ করা এ জীবনে অসম্ভব। তবু সারাজীবন এই চেষ্টাই থাকবে যাতে ওদের জন্য কিছু করতে পারি। তাই আমাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কোনও কারন নেই।

জানি জীবনে অনেক ভুল করেছি। এবং ভুলতেও সময় লাগেনি। কিন্তু এবার প্রথম মনে হল তোমাকে পাওয়ার জন্য যদি আরেকবার চেষ্টা না করি তাহলে সেটাই হবে আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল। নিজেকে আরেকটা চান্স দিতে খুব ইচ্ছা হল। কিন্তু আমি এও জানি জোর করে আর যাই হোক ভালবাসা পাওয়া যায়না। তাই আজকের এই চিঠি সে চেষ্টার শেষ অধ্যায়। তুমি এর জন্য আমাকে ইচ্ছা মতো গালাগাল করতে পার।আমি কিচ্ছু মনে করবোনা। আমি এখন বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি যদি বের হয়ে চলে যাও আমি ধরে নিব এ গল্প এখানেই শেষ।
এবং কথা দিলাম এর পর আর কক্ষনো তোমাকে বিরক্ত করবোনা।

আর যদি আমার সাথে কথা বল তাহলে বুঝে নিব যে.........বাকিটা লেখার সাহস আমার হচ্ছেনা। লিখতে গিয়ে যদি আমি বিশ্বাস করে ফেলি??


-একান্তই তোমার হতে চাওয়া ধ্রুব


৮.

শীতকালের রোদ ধ্রুবর অনেক ভালো লাগে। সারাদিনের রঙচংহীন কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ হঠাৎ যেন উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। ধ্রুবর মনে হল এই আকাশের সাথে ওর জীবনের অনেক মিল আছে। এখন দেখার বিষয় যে ওর আকাশ কি তিতির নামের রৌদ্রালোকে আলোকিত হবে? না এমনি বিমর্ষ কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকবে... তবে একটা কথা ধ্রুব জানে,একবার যদি তিতির ওর ভালবাসা গ্রহন করে নেয় আর ওকে দূরে যেতে দিবেনা ধ্রুব। সময় কাটানোর জন্য একটা সিগারেট জ্বালালো সে। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে ও এখানে অপেক্ষা করছে...

সিগারেট যখন প্রায় শেষের দিকে তখন দেখল তিতির বের হচ্ছে। সিগারেটটা ফেলে দিল ধ্রুব। এবং মন খারাপ করে দেখল তিতির ওকে অতিক্রম করে সামনে চলে গেছে।সামনে গিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করলো। তারমানে এখানেই শেষ সব। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করছে ওর। চোখ কেমন যেন জ্বালা করছে। মাথা নিচু করে ধ্রুব হাঁটতে শুরু করলো।
''এই যে, রিক্সায় উঠে আসেন।''
ধ্রব শোনেনি প্রথমে। ওর মাথায় এখন একটাই চিন্তা,তিতির বিহীন এই জীবন সে কিভাবে কাটাবে? আবার ডাক শুনে পাশে তাকিয়ে দেখে রিক্সায় তিতির বসে আছে!
''আমাকে বলছ?''
''আপনার পাশে আর কেউ আছে যে তাকে বলব? উঠে আসেন''
ধ্রুব উঠে বসলো তিথির পাশে। ওর এখনো কিছু বোধগম্য হচ্ছে না। তিতিরই বলল
''আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল বাসায় যেতে পারবেন না। বাই চান্স কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হলে আমাকেই দোষ দিতেন। আপনাকে বাসায় ড্রপ করে দিব''

কিছু বললোনা ধ্রুব। বলার মতো আসলে ওর অবস্থাই নেই। তবুও মস্তিস্কের এক কোণে এটাই মনে হল এই সময়কে উপভোগ করাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আর কখনও তো তিতিরের সাথে ও কথা বলবেনা। তিতির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল
''আমাকে আপনার ন্যাকা মনে হয়?''
হায়রে নারী!!! পুরো চিঠিতে কিছু যদি চোখে পড়লো তাও সেই ন্যাকা শব্দটাই?
''প্রথমে মনে হয়েছিলো। কিন্তু তার জন্য সরি বলেছি না?''
আবার চুপ। ধ্রুবর মনে হচ্ছিল এ মুহূর্তে তিতিরের মনের কথা জানার জন্য যদি ওকে বিনিময়ে নিজের সব বিসর্জন দিতে হয় তাও সে হাসতে হাসতে দিয়ে দিবে। শুধু একবারের জন্য যদি মেয়েটার মন বুঝতে পারত সে!
তিতির এবার ব্যাগ থেকে চিঠিটা বের করে ধ্রুবর হাতে দিল '' নিন''

ধ্রুবর আসলেই খুব কষ্ট পেল। সারারাত জেগে চিঠিটা লিখেছিল। কত কাটাকুটি করেছে। ওর শেষ স্মৃতি হিসেবে চিঠিটা রাখতেও তো পারত মেয়েটা। নাহ,মেয়েরা আসলেই অনেক নিষ্ঠুর হয়। অনেক কষ্টে হাত বাড়িয়ে নিল চিঠিটা। রাগ করে ফেলে দিতে যাবে তখনি তিতির চিৎকার করে উঠল
''কি করছেন আপনি?''
''ফেলে দিচ্ছি,রেখে কি করবো?'' এবার ঝাঁঝ দেখিয়ে বলল ধ্রুব
''আমি তো আপনাকে ফেলে দেয়ার জন্য চিঠিটা দেইনি।''
''তাহলে কেন দিয়েছ? এটা কি আমি এখন বাঁধাই করে রেখে দিব প্রমান হিসেবে যে আমি ছ্যাঁকা খেয়েছি?''
''আপনি চিঠিটা শেষ করবেন।''
''মানে?''
''মানে হল আমার চিঠির শেষটা পছন্দ হয়নি। আপনি বলেননি যদি আমি আপনার সাথে এসে কথা বলি তাহলে আপনি কি বুঝে নিবেন''

খুব নরম ভাবে বলল তিতির। ধ্রুব তাকিয়ে আছে তিতিরের দিকে। ওর চোখের পলক পড়ছে না। আবার বলল তিতির
''আপনি শেষের কথা গুলো কিভাবে লিখেন তার ওপর সব নির্ভর করছে।'' ধ্রুব এবার একটু নড়ে বসলো যেন।
''তোমার কাছে কলম আছে?''
''আছে।'' ব্যাগ থেকে কলম বের করে দিল তিতির। ধ্রুব কলমটা নিল। চোখটা কুঁচকে কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ। এরপর রিক্সায় বসে ঝাকুনি খেতে খেতেই কাগজে কি কি যেন লিখল। তিতির খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিল ওর কাজ কারবার।
পাঁচ মিনিট পর ধ্রুব ওর হাতে কাগজ দিল। চিঠির একদম নিচের খালি জায়গায় কিছু লিখেছে ধ্রুব। অনেক একে বেঁকে গেছে,তবুও কষ্ট করে পড়া যায়।
''আপনি কালকেও কিন্তু দিতে পারতেন ''
''পারতাম । কিন্তু কালকে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলে আমি মরেও যেতে পারি। '' ধ্রুব অনেক গম্ভীরভাবে বলল।

তিতির আর কিছু না বলে পড়তে শুরু করলো...

''তিতির,

আমরা দুজন মিলে নতুন একটা গল্প লিখব,যেখানে তুমি হবে আমার রাজকন্যা...আর আমি হবো রাজকন্যার ইচ্ছা পুরক ।আজ থেকে তোমার সব স্বপ্ন আমার,তোমার সব দুঃখ কষ্ট আমার...আর আমার সুখ,আনন্দ আর ভালবাসা সব শুধুই তোমার। তুমি পাশে থাকলেই হবে। তোমাকে ছাড়া আমার আর কিচ্ছু লাগবেনা।

আমার খুব পছন্দের কয়েকটা লাইন শুধুই তোমার জন্য। অনেক আগে কোথাও পরেছিলাম। খুব ভালো লেগেছিল,কিন্তু বিশ্বাস করিনি...এখন সত্যি মনে হচ্ছে
আমি একা হলেই বুঝি তুমি ছাড়া আমি কত একা
আমি ঘুম হারালেই বুঝি তোমায় ছাড়া হয়না স্বপ্ন দেখা
আমি খণ্ডিত এক জীবন স্বপ্নচারী,শুধু তুমি এলেই পূর্ণ হতে পারি
ভুলগুলো সব ভুলে গিয়ে ভালবাসার গল্প হতো লেখা...!! ''

ধ্রুব অবাক হয়ে দেখল তিতিরের চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ও তো কান্না করার মতো কিছুই লিখেনি। তিতির বড়জোর হাসতে পারে খুশিতে,অথবা বকতে পারে রাগ করে...কিন্তু কাঁদছে কেন? কেউ কাঁদলে ধ্রুবর খুব বিরক্ত লাগে। কিন্তু এ মুহূর্তে খুব অদ্ভুদ একটা অনুভুতি হলো ওর। কাঁদছে তিতির,কিন্তু কষ্ট হচ্ছে ধ্রুবর! কিছু না ভেবেই হাত বাড়িয়ে তিতিরের হাতটা ধরল সে। ওর রাজকন্যার হাত।



-নাজমুন নুসরাত

No comments:

Post a Comment