Subscribe:

পুরানো সেই দিনের কথা

সাল ১৯৮১,সিলেট

¤¤"সিলেটের বাতাসে আজ সকাল থেকেই বৃষ্টির ঘ্রাণ..বর্ষার নতুন দিনে সুপ্রভাত সবাইকে।
সিলেট বেতার কেন্দ্র থেকে খবর পড়ছি আমি শাগুফতা জাহান...."
খবর শেষ হলে রেডিওর নব ঘুরিয়ে দিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সায়েম।


শাগুফতা।ওদের মেডিকেলের 2nd year student।একটুখানি অদ্ভূত আর অনেক অনেক
ভাল একটা মেয়ে..নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে একটা হাসি চলে আসে
সায়েমের-আবার পরক্ষণেই মুখ ভার,কপালে ভাঁজ।অনেক চেষ্টা করেও,কিছুতেই যেন
বলা হচ্ছেনা মেয়েটাকে-সেই কথাগুলো..
যতবার সামনে যায়,লম্বা করে শ্বাস নিয়ে সবধরনের mental preparation শেষে
বলা শুরু করে..এবং মিনিট পাঁচেক পর আবিষ্কার করে তার মুখ দিয়ে আদৌ কোন
শব্দ বের হচ্ছেনা!!
দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের উত্‍সাহী মুখে কালি মেখে দিয়ে ফিরে আসে
বেচারা।ভাল রকম বকাঝকাও হজম করতে হয়-
*"কি,আজও বলতে পারলিনা?তোকে দিয়ে শালা কিচ্ছু হবেনা।junior একটা
মেয়ে-simple,নরম-সরম;

confidently তাকে বলবি তোর ভাললাগার কথা..তা না
ভ্যাবলার মত গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস,বোকা একটা হাসি ঝুলিয়ে..ওই মেয়েই পটর পটর
করে আর তুই,যথারীতি কিচ্ছু না বলে ফিরে আসিস।"
সায়েম ~"আরে সে শুরুই করে সায়েম 'ভাই' দিয়ে.."
*"তো কি?এখন তো ভাই-ই বলবে।আর তুই যদি এভাবেই চুপ থাকিস,তাইলে দেখবি বাকী
জীবন ও ভাই ই থেকে যাবি!"
~"আরে এতো innocently ভাই বলে,তার উপর আমার ছোট বোনের ব্যাচমেট..তাকে
কিভাবে বলি যে..."
*"আচ্ছা,তুই তো সোপানকে দিয়েও ওকে বলতে পারিস।"(এখানে বলে রাখি,সোপান হল
সায়েমের আপন ছোটবোন এবং শাগুফতার ব্যাচমেট;একই মেডিকেলে পড়ে)
~"আরে সোপান থেকে একদিন শাগুফতার ব্যাপারে একটু খোঁজ-খবর নিচ্ছিলাম।এমন
গোয়েন্দাগিরী শুরু করল যে..."
*"বুজছি,তোকে দিয়ে কিসসু হবেনা!"...

সায়েম চিন্তা করুক কিভাবে শাগুফতাকে বলা যায় তার সেই special কথা।আমি
ততক্ষণে শাগুফতার একটা short introduction দিয়ে দেই--

শাগুফতা জাহান।শিক্ষক বাবা-মা'র বড় মেয়ে।বাড়ী চট্টগ্রাম।সিলেট ওসমানী
মেডিকেলে chance পেয়ে এক রাতের ট্রেনে চেপে আসল সিলেট নামক অচেনা
শহরটাতে।যুগটা mobileর ছিলনা,এমনকি সাধারণ মধ্যবিত্তদের বাড়ীতে landphone
আসাও শুরু হয়নি তখন।মাসে-দেড়মাসে ২/১টা চিঠি।আর জরুরী দরকারে
টেলিগ্রাম।সেই সময়ে বাবা-মাকে ছেড়ে এতো দূরে থাকতে আসা মেয়েটা প্রথমে খুব
ভেঙে পড়েছিল।কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সামলে নেয় নিজেকে।কারণ ওর একটা
আশ্রয় ছিল,ভালোবাসার জায়গা ছিল-'গান'।গানের মাঝেই নিজেকে উজাড় করে দিত
সে।আর সেই গানই তাকে একদিন নিয়ে যায় সায়েমের কাছে।


¤¤সায়েম তখন উদীচীর cultural secretary,ছাত্র রাজনীতির সাথেও কম-বেশী
জড়িয়ে থাকত।সবার মাঝে পরিচিত ছিল ভাল ব্যবহার এবং দক্ষ সংগঠন ক্ষমতার
কারণে।সাথে  থাকতো একটা সস্তা গীটার আর কণ্ঠে বাজতো মান্না,হেমন্তের
জনপ্রিয় সব আধুনিক গান,যে গানগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যেত তার প্রিয়জনদের।
আদর্শবান,সত্‍ এবং মধ্যবিত্ত ডাক্তার বাবার ছয় ছেলেমেয়ের বড়
ছেলে।সাদামাটা এক তরুণ..যার প্রধান কাজ ছিল cultural programme arrange
করা,বন্ধুদের সাথে আড্ডা,টুকরো রাজনীতি আর card/term কিংবা profএর আগে
দরজা বেঁধে পড়াশোনা।এক চান্সে পাশ করে পরিবারকে financially support
করাটাও ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।

আড্ডাবাজ সায়েমের প্রতি মাসের নির্ধারিত টাকা প্রায়ই সপ্তাহ দু'য়েক আগেই
শেষ হয়ে যেত।তখন তার সহায়,ছোটবোন সোপান।হাসতে হাসতে hall এর gaitএ আসতো
সোপান.."দাদা,টাকা শেষ হয়ে গেছে না?অসুবিধা নাই।তোমার জন্য আমি মাসের
প্রথমেই কিছু টাকা আলাদা করে রাখি।"


¤¤সায়েমের introductionও হয়ে গেল।এখন শাগুফতার সাথে ওর প্রথম দেখার
গল্পটা বলি..বিজয় দিবস উপলক্ষে কলেজে সাংস্কৃতিক আয়োজন হবে।নতুন ব্যাচের
ছেলেমেয়েরাও গাইবে।তাদের select করার দায়িত্ব সায়েমের।

কিছুদিন ধরে আবার মুরগীর মাংস দিয়ে পরোটা খাওয়ার খুব ইচ্ছে হচ্ছে,কিন্তু
টাকার ভান্ডার শুন্যের কোঠায়।বোনটা বোধয় তার পাগল ভাইয়ের জন্য কিছু জমিয়ে
রেখেছে..তাই কারো ঘাড়ে selection এর দায়িত্ব চাপিয়ে আপাতত কেটে পড়তে
চাচ্ছিল সায়েম।কিন্তু হঠাত্‍..এক কিন্নর কন্ঠ শুনে থামতে হল তাকে।কে
গাইছে?না,পরিচিত কেউ তো না;may be 1st year এর..

মোটা কালো ফ্রেমের চশমা পরা,লম্বা বেনী দুলানো,ফর্সা,ছিপছিপে,ভীষণ সাধারন
এক মেয়ে।এতো মিষ্টি গলা!
সায়েম গলা খাঁকারী দিল"এই ইকবাল,একটা চেয়ার আনতো..selectionটা করেই যাই"!!


¤¤তারপর..বিভিন্ন প্রোগ্রামে দেখাদেখি..
*"স্লামালিকুম সায়েম ভাই,কেমন আছেন?"
~"হ্যাঁ,হ্যাঁ,ভাল।তারপর,রেওয়াজ টেওয়াজ করছ তো ঠিকমত,তোমরা তো আবার
classically trained।আর আমরা হলাম বাথরূম singer।"
*"কি বলেন ভাইয়া,জানেন last প্রোগ্রামে আপনার 'কফি হাউসের সেই আড্ডাটা'
গানটাতে দর্শকদের তালি তো থামছিলইনা।"
~"আরে ওইগুলা তো.."লাজুক হাসে সায়েম।

আচ্ছা problemটা কি!আর সবার সামনে তো কোন সমস্যা হয়না,শুধু এই মেয়েটার
সাথে কথা বলতে গেলেই কেন এমন হচ্ছে?গলা শুকিয়ে যাচ্ছে..বুক
ঢিপঢিপ..মাঝেমাঝে পেটেও কেমন কেমন করে-এতোসব অদ্ভূত symptom!
আর,ওকে না দেখে বেশীদিন থাকতেও পারেনা।যদি ক্যাম্পাসে চলতে ফিরতে দেখা
নাহয়,ওদের class ছুটির সময় ক্যান্টিনে গিয়ে বসে থাকে।দূর থেকে দেখে।এটাই
কি তবে..
Oh my God!প্রেমে পড়েনি তো আবার!বাসার কড়া নির্দেশ সিলেটি মেয়েই বিয়ে
করতে হবে-অন্য districtএর মেয়ে আসলে নাকি ঘর ভেঙে যাবে-বড় ছেলেকে আলাদা
করে দিবে।আর সে কিনা..কপালে আবার ভাঁজ পড়ল সায়েমের।সমস্যা গুরুতর!


¤¤শাগুফতার মন খারাপ সকাল থেকেই।prof চলছে।৪মাস ধরে বাসায় যাওয়া
হয়না।বাসার সবার কথা যে কি পরিমান মনে পড়ে..অবশ্য এমনিতে সিলেট শহরটা
খারাপ না।কিন্তু চিটাগাং যে বড্ড আপন..ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল লীনার কথায়।
*"এই শুনছিস,কলেজে নাকি মারামারি হইসে গতকালকে।কারোর তেমন কিছু হয়নাই
শুধু সায়েম ভাই আছেনা,মারামারি করতে গিয়ে উনার একটা পা ভেঙ্গে গেছে।"
হঠাত্‍ বুকে একটা ধাক্কা মত লাগল শাগুফতার।"কি?serious কিছু??"
*"না,তেমন serious না।তবু কিছুদিন plaster পরে থাকতে হবে,এই আরকি।"
~"ও"
*"শোন্ আমরা Hospital যাচ্ছি উনাকে দেখতে।যাবি?"
~"হুমম.."
*"তাইলে dress change কর্।"
~"dress change করা লাগবেনা,চল্।"
এই অযাচিত উত্‍কন্ঠা সেদিন কেন এসেছিল সাদাসিধে শাগুফতা ব্যাপারটা ঠিক
বুঝে উঠতে পারেনি..


¤¤মাঝে না ২টা বছর কেটে গেল।final prof আর internship নিয়ে ব্যস্ত সায়েম
এখনো বলতে পারেনি কথাগুলো।শাগুফতার সাথে দেখাও ইদানীং কম হয়।তবে যখনই
দেখা হয়,শাগুফতাও যেন আগের মত নেই।বেশী বেশী কথা বলেনা,সায়েম ভাই সায়েম
ভাই করেনা।চুপচাপ থাকে।চোখে চোখে বেশীক্ষন তাকায় না।নিশ্চয়ই সব বুঝে
ফেলেছে..জানতো,ঠিক জানতো সায়েম-এমনটাই হবে।এতো nervousness কি আর লুকানো
যায়?কিন্তু শাগুফতা তো তাকে avoidও করেনি।বরং সেদিন চলে যাবে
বলেও,অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।যেন কিছু বলার বাকীঁ,কিছু কথা যেন
এখনও শোনা হয়নি..
তবে কি শাগুফতাও তাকে..
নিজেকে একটা  coward মনে হচ্ছিল সায়েমের।কেন?কেন এতোদিনেও বলতে পারলনা ওকে?


¤¤আজ কলেজে last দিন।চলে যাবে সায়েম।বুকপকেটা একটা ছোট্ট,নীল খাম।দোয়া
করছে যেন শাগুফতাকে সামনাসামনি পেয়ে যায়।চোখ বন্ধ করে খামটা ধরিয়ে দিয়েই
চলে যাবে।তারপর যা হয় হোক।এখন আল্লাহ ভরসা।

সেইদিনই বিকাল ৫টা।
সাগুফতার হাতে নীল খাম।ছাদে ও এখন।একা।চোখের স্বপ্নীল আলো ঝরে পড়ছে কিছু
অশ্রু হয়ে..পৃথিবীর পবিত্রতম জল,অথচ কি সহজলভ্য..
সায়েম ভাই তখন চোখমুখ শক্ত করে চিঠিটা ধরিয়ে দিল।তারপর ধুপধাপ করে বিশাল
ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল।
না।চিঠিটা এখনো পড়েনি ও,কিন্তু জানে-কি লেখা আছে এতে।অনেক আগেই বুঝতে
পেরেছিল আর এতোদিন ধরে মনে মনে নিজের উত্তরটা ঠিক করছিল।পারবে কি,অচেনা
এই শহরটাকে,সম্পূর্ন ভিন্ন একটা cultureকে নিজের জীবনের একটা অংশ করে
নিতে?না-শুধু মেডিকেলের ৬বছর না,গোটা জীবনের জন্য?ওদের বিশাল পরিবারের বড়
বৌ হয়ে অনেক মমতায় আগলে রাখতে পরিবারটাকে?পারবে কি,তাদের বিশ্বাস জয়
করতে?

"হ্যাঁ"

জলভরা চোখে হাসি নিয়ে খামটা খুলল শাগুফতা..


¤¤সায়েম-শাগুফতার বিয়ে হয়েছিল ১৪ডিসেম্বর,১৯৮৯,চিটাগাংএ।আর বাসর
রাত,সিলেট-চিটাগাং আন্তঃনগর পাহাড়ীকায়;বগিভর্তি বরযাত্রীসহ!সবাই চুটিয়ে
আড্ডা মারছে,শুধু শাগুফতার মুখ অস্বাভাবিক ভার।একটাই সখ ছিল তার-একটা
টিকলীর।গত ৫ বছরের চিঠি চালাচালিতে কমপক্ষে ১০বার সায়েমকে বলেছে সে এই
কথাটা।কিন্তু উনি?শুধু পারেন ধুমধাম ক্যাম্পাসে চলে আসতে-"সোপানকে দেখতে
আসছি"
ইশশ..মানুষ যেন আর বোঝেনা!পরে উনি চলে গেলে সোপান সহ বাকী সব বন্ধুদের
টিকাটিপ্পনী তো তাকেই সহ্য করতে হত।বগির শেষ মাথায় কোনাকুনি বসা সায়েমের
দিকে আড়চোখে তাকায় সে।দেখ অবস্থা,এদিকেই তাকিয়ে আছে।বাকীরা দেখলে কি
বলবে..!!


¤¤ডিসেম্বর২০১১
আব্বুর সাথে দোকানে দোকানে ঘুরছি।উদ্দেশ্য:একটা টিকলী কেনা।এখনই কিনে
রাখব কিন্তু দেয়া হবে আব্বু-আম্মুর ২৫তম বিবাহবার্ষিকীতে।আমি tired
কিন্তু আব্বুর ধৈর্য্য অসীম।দেখাদেখি চলছে..
আমি-"আব্বু,দেখবা আম্মু তোমাকে বকা দিবে।এই বয়সে কি আর কেউ টিকলী পড়ে!"
মুচকি হেসে আব্বু উত্তর দেয়-"আরে না না।অনেক খুশী হবে.."


[এই গল্পটা কিন্তু সত্যি।যদিও সেই নীল চিঠিটা এখন আলমারির গোপন কুঠুরীতে
তোলা থাকে।প্রেমের গল্পটা-হোকনা যতই সাধারন,কিছুতেই বের করা যায়না গল্পের
লাজুক পাত্র-পাত্রীর মুখ থেকে..কিন্তু ভালবাসার গল্প লিখতে শিখে গেছি
আমি,বুজছ?..
যে ভালবাসার পরিণতি আমি,তাকে না লিখে কি থাকতে পারি!!

ছুটিতে বাসায় গেলে কোন কোন তারাভরা রাতে আব্বু-আম্মুর মাঝখানে শুয়ে
থাকি,গুটিসুটি মেরে,সেই ছোট্টবেলার মত..হঠাত্‍ আব্বু গেয়ে ওঠে-
"তুমি আর আমি আর আমাদের সন্তান
এই আমাদের পৃথিবী..
তুমি সুর আমি কথা-মিলেমিশে হই গান
এই আমাদের পৃথিবী..."
love u,আব্বু-আম্মু।আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাদের দুজনকে এভাবেই দেখতে
চাই,একসাথে-
জীবন নামক ভালোবাসার গল্পে..]


রাহনুমা কুমকুম

No comments:

Post a Comment