Subscribe:

স্বপ্নচারিণী

মেডিকেলের ছাত্ররা সাধারণত তিন ধরণের হয়। মহা আঁতেল, মধ্যম মানের আঁতেল এবং নন-আঁতেল। রনি, যে কিনা আমাদের আজকের গল্পের নায়ক, কে নির্দ্বিধায় নন-আঁতেলদের দলে ফেলে দেয়া যায়।
রনির ক্লাস প্রতিদিন সকাল সাতটায় শুরু হয়। ওগুলোকে ক্লাস ছাড়াও আঁতেলদের মহাসমাবেশ বলে নির্বিঘ্নে চালিয়ে দেয়া যায়। দুইটা ক্লাসের পর ওয়ার্ড শুরু হবার কথা নয়টায়, রনি চোখ ডলতে ডলতে কলেজে যায় সাড়ে নয়টায়। আর যেদিন ওয়ার্ড মিস যায় সেদিন যায় সাড়ে এগারোটায়। আইটেম থাকলে মাঝে মাঝে সাড়ে বারোটায়, এমনকি আগের রাতে ঘুম না হলে সে কলেজেই যায় না মাঝে মাঝে। ঘুম থেকে আড়াইটায় ওঠা হয় সেদিন।


প্রত্যেক মানুষকে সময় কাটানোর কিছু একটা করতে হয়। নাহলে সে সারাদিন বসে বসে করবেটা কি? কিছু একটা তো করতে হবে!
যারা টিপিক্যাল আঁতেল, তারা সময় কাটানোর জন্য বেছে নেয় পড়াশোনাকে। সবসময় বই, লেকচার আর গাইডই তাদের কল্পলোক অধিকার করে থাকে। তাদের মূল্যবান সময় ক্লাস, খাওয়া, ঘুম আর পড়াশোনার মাধ্যমেই কেটে যায়। খেলাধুলা ও টিভি দেখার মত অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যাপারগুলো তাদের কাছে “বেহুদা সময় নষ্ট” বলে প্রতীয়মান হয়।
মধ্যম মানের আঁতেলরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, প্রেম ইত্যাদিতেও আনন্দ খুঁজে পায়। তারা পড়াশোনাও করে, সাথে সাথে অন্যান্য অনেক কিছুও করে। তাদের জীবনটা হয় ব্যালান্সড। মজার। তাদের ভাগ্যে ভালো মেয়ে জোটার একটা ভালো সম্ভাবনা যুক্তির নিয়মে সবসময়ই থেকে যায়।
আর রনির মত মানুষরা সময় কাটানোর অন্য কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে নানাবিধ উল্টাপাল্টা কাজে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা করে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের সামনে তাদের প্রায়ই হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়, খেলার মাঠে মূল্যবান সময়কে অর্থহীন কাজে ব্যয় করতে দেখা যায়, নিজের ক্লাস বাদ দিয়ে বিভিন্ন কোচিঙে ক্লাস নিতে দেখা যায়, নিজের পড়ার খোঁজখবর না রেখে বিভিন্ন জায়গায় প্রাইভেট পড়াতে দেখা যায়। তাদের ভাগ্যে সাধারণত ভালো মেয়ে জোটে না, কারণ ভবিষ্যৎ অন্ধকার এরকম কাউকে অন্তত সচেতন মেয়েরা ভালবাসে না। অবশ্য কথায় বলে প্রেম নাকি অন্ধ। অন্ধ প্রেমের ক্ষেত্রে উপযুর্ক্ত নিয়মের ব্যতিক্রম খুঁজে পাওয়া বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিক নয়।
তো রনি একদিন ভাবল, নাহ, কিছু একটা করা দরকার। সময় কাটছে না। কি করা যায়?
রনি অনেক ভেবে একটা পত্রিকা প্রকাশনার সিদ্ধান্ত নিল। পত্রিকাটি নির্দলীয়, এবং তাতে মেডিকেল কলেজের সব ব্যাচের যে কেউ লেখা দিতে পারবে।
প্রাথমিক প্ল্যানপ্রোগ্রাম করা হল। কারা কারা কাজ করবে ঠিক করা হল। এখন প্রথম কাজ, পোস্টারিং করতে হবে। খুব সুন্দর করে দু তিনটা পোস্টার লেখা দরকার। সেগুলো কলেজে ও হলে বিভিন্ন জায়গায় দেয়া হবে। তাতে মানুষজন আকৃষ্ট হবে, পত্রিকার জন্য লেখা দেবার ব্যাপারে উৎসাহিত হবে।
এখন খুব সুন্দর করে পোস্টার লেখা কোন ছেলের পক্ষে একটু কষ্টকর। ওর চেয়ে একটা মেয়ের পক্ষে কাজটা সহজ। কারণ তাদের “নান্দনিক সৌন্দর্যবোধ” ছেলেদের চেয়ে অন্তত এই একটা ব্যাপারে কিছুটা হলেও বেশি। তাছাড়া মেয়েরা যেকোনো কাজ একটু বেশি যত্ন নিয়ে করে। ছেলেদের মত অগোছালো নয় তারা।
কাজটা কাকে দেয়া যায়? ভাবতে ভাবতে রনির মাথায় এলো উপমার নাম। উপমা রনির ক্লাসমেট। উপমা মেয়েটা অসাধারণ ছবি আঁকে, এর আগেও ব্যাচের ম্যাগাজিনে সে ডিজাইন করেছে। বলা বাহুল্য, ডিজাইনগুলো অসাধারণ হয়েছে।
রনি এর আগে জীবনেও উপমার সাথে কথা বলে নি। সে পড়ে গেল টেনশনে। উপমাকে কিভাবে পোস্টার লেখার জন্য অনুরোধ করা যায়? আর করলেও, সে রাজি হবে তো?
রনি আরেকজনের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে উপমার কাছে ফোন করল।
হ্যালো উপমা, আমি রনি। চিনেছ?
না।
চেননি?
না। কে বলছেন প্লিজ?

রনির একটু আশাভঙ্গ হল। দুই বছর হবার পরও ব্যাচের একটা মেয়ে তাকে চিনবে না এটা আসলেই একটু কষ্টের।
চেনা লাগবে না। আমি তোমার ক্লাসমেট। আমরা একটা পত্রিকা বের করছি।
হ্যাঁ শুনেছি।
তোমার একটু হেল্প দরকার ছিল।
বল।
আমাদের খুব সুন্দর তিনটা পোস্টার লেখা দরকার ছিল। তাতে আমরা লেখা আহবান করব। পোস্টারগুলোর একটা দেব কলেজে, একটা ছেলেদের হলে, আর একটা তোমাদের হলে।
তো?
তুমি একটু কষ্ট করে পোস্টারগুলো এঁকে দেবে, প্লিজ?
আমি? ইতস্তত করে উপমা, আমি তো অত ভালো আঁকতে পারি না।
রনি বলে, “অত ভালো” লাগবে না। “ভালো” হলেই হবে। আর তোমার আঁকার হাত যে অসাধারণ সেটা তো আমরা জানিই।
প্রশংসায় একটু হলেও কাজ হয়। উপমা বলে, কি দিয়ে আঁকব?
রনি বলে, আমি আজকে জিনিসপত্র কিনে সন্ধ্যায় তোমাকে হলে দিয়ে আনব। ওকে?
পোস্টারগুলো কখন লাগবে?
কালকে হলে ভালো হয়।
কালকেই?
হুম। কেন, কষ্ট হয়ে যাবে?
না...আচ্ছা কিছু মনে কোর না, তোমাকে এখনও চিনতে পারি নি। সত্যিই কি তুমি আমাদের ব্যাচের?

***

প্রায় অপরিচিতা একটা মেয়েকে এত সহজে ম্যানেজ করা যাবে এটা হয়তো রনি স্বপ্নেও ভাবে নি। তার মনে হয়েছিল মেয়েটাকে অনেক সময় ধরে তেল মারার ও অনেক ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ করার পর সে হয়তো রাজি হলেও হতে পারে। কিন্তু এত সহজে মেয়েটা সাহায্যের হাত এগিয়ে দেবে তা কে জানত?
অসাধারণ তিনটা পোস্টার আঁকে উপমা। সেগুলো দুদিন পরেই শোভা পায় কলেজ ও হলের বিভিন্ন জায়গায়। মানুষজন পোস্টার দেখে আকৃষ্ট হয়। অনেকেরই লেখার জন্য হাত নিশপিশ করে। লেখা পাঠানোর জন্য যাদের নাম পোস্টারে লেখা আছে তাদের চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। লেখা পাঠানোর ইমেইল আইডিটা মুখস্থ করার চেষ্টা করে। আবার অনেকে ওদিকে তাকায়ও না, পড়া মনে করতে করতে চলে যায়। কেউ কেউ হয়তো একবার তাকিয়েই “নতুন আবার কোন বেহুদা নোটিশ” ভেবে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
আস্তে আস্তে লেখা জমা পড়তে থাকে। অনেক লেখা হয়ে যায়। সেগুলো থেকে কোনগুলো দেয়া হবে সেটা ভাবতে ভাবতে কালঘাম ছুটে যায় রনি ও পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্যদের।
একসময় পত্রিকাটা আলোর মুখ দেখে। রনির অসম্ভব ভালো লাগে। প্রথমবারের মত মেডিকেল লাইফটা উপভোগ্য মনে হয় তার। নাহ, ব্যাচে এতদিন তাকে কেউ ভালো হিসেবে চিনত না। খালি আঁতেলদেরই চিনত। এখন সবাই তাকেও চিনবে।
ছেলেরা অনেকেই রনিকে বলে, দোস্ত চরম হইসে। মেয়েদের মধ্যেও কেউ কেউ বলে ভালো হইসে। কিন্তু রনি ভিতরে ভিতরে দুর্বোধ্য একটা ছটফটানি টের পায়। উপমার কাছে তো তার নাম্বার আছে, সে তো ফোন দিল না! একবারও তো বলল না ভালো হয়েছে কি না!
এর ব্যাখ্যা কি? এই ঘটনায় ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাবার কি আছে? উপমার সাথে তো তার এমন কিছু খাতির নেই যাতে সে রনিকে ফোন দিয়ে এই কথা বলবে।
কেন? ঐ একটা মেয়ের ফোন পাবার জন্য রনির এই দুরন্ত আশা কেন? ছেলেদের প্রশংসা তার যথেষ্ট মনে হচ্ছে না কেন? তবে কি রনি লু...? মেয়ে দেখলেই পটে যাওয়া ভ্যারাইটির নতুন রিক্রুট? নাকি অন্য কিছু? কে জানে?

পত্রিকা প্রকাশ হবার তিন দিন পর রাতে ঘুমের মধ্যে রনি একটা স্বপ্ন দেখে। সে দেখে যে একটা মেয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরে আছে তার হাত। রনিও তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙ্গে জেগে ওঠে রনি। বেশ কিছুক্ষণ থ হয়ে বিছানায় বসে থাকে সে। এই স্বপ্ন যে সে দেখেছে এটা কিছুতেই তার বিশ্বাস হয় না। কিছুতেই না। এমন স্বপ্ন কিভাবে দেখল সে? কেন দেখল?

স্বপ্নে দেখা মেয়েটির নাম উপমা।

***

কলেজে ব্যাচের একটা অনুষ্ঠান হবে। ব্যাচের ছেলেমেয়েরা সবাই যাবে সেখানে। রনি শার্ট প্যান্ট পরে রেডি হয়।
এরই ফাঁকে কলেজ থেকে তার বন্ধু পল্টু ফোন দেয়। দোস্ত তুই কই?
আসতেছি।
তাড়াতাড়ি আয়। সব মেয়েরা প্ল্যান কইরা নীল শাড়ি পইরা আসছে। মনে হইতাছে ব্যাচ প্রোগ্রাম না, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড প্রোগ্রাম চলতেছে।
তাই?
যে ফাটাফাটি লাগতেছে না সবাইরে...
রনি ফোন রেখে দেয়। তার কেন যেন ভালো লাগে না। উপমাকে নীল শাড়ি পরা অবস্থায় অন্যরা দেখবে এই চিন্তা তাকে গোপনে পীড়া দেয়।
সে শার্ট প্যান্ট খুলে আবার লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে। ব্যাচের অনুষ্ঠানে যাবার সব আগ্রহ নিমেষেই উবে যায় তার। রনির কেন যেন মনে হয়, উপমার নীল শাড়ি পরা চেহারা দেখে সে ফিট হয়ে পড়ে যাবে।

***

মেডিকেল কলেজে বিভিন্ন সাবজেক্টে OSPE পরীক্ষা হয়। এতে সাধারণত জোড় রোলরা একসাথে পরীক্ষা দেয়, আর বিজোড়রা একসাথে। মাঝখানে কেউ না থাকলে অবশ্য সিরিয়াল ব্রেক হয়, তখন এই জোড় বিজোড়ের নিয়মটা থাকে না।
রনির দুই রোল আগের মানুষটা হচ্ছে একটা মেয়ে। সে রনির OSPE পার্টনার। দুজনেই দেখাদেখি ও শোনাশুনিতে ওস্তাদ। এ পর্যন্ত সকল OSPE পরীক্ষায় তারা পরস্পরের সাহায্য নিয়ে কৃতিত্বের সাথে পাশ করে গেছে।
সেই মেয়েটার নাম টুম্পা। টুম্পার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সে উপমার রুমমেট। এটা অবশ্য রনি জানত না।
পাঠকদের আগ্রহ হতে পারে, তাই বলছি, টুম্পা কালো। খাট। বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার অধিকারী সে।
রনি তার স্বপ্নের কথা কাকে বলবে ভেবে পেল না। আব্বু? নাহ। আব্বু মনোযোগ দিয়ে শুনবেই না।
আম্মু? নাহ। আম্মু কি না কি মনে করে নিজে নিজে টেনশন করবে।
ভাইয়া? নাহ। ভাইয়াটা খালি খোঁচায়।
তার কোন রুমমেটকে বলবে? নাহ, তার দুই রুমমেট খুবই ফাজিল। সম্প্রতি ব্যাচের মেয়েদের কাছ থেকে তারা ইভটিজার নাম্বার ওয়ান আর টু খেতাব পেয়েছে। খেতাব পেয়ে তো তারা মহাখুশি। খেতাব পাওয়ার পর তাদের চিল্লাপাল্লা দেখে মনে হয়েছে তাদের এইমাত্র কোন কারণে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হল।
তাহলে কাকে বলা যায়?
আচ্ছা, মেয়েঘটিত সমস্যা, মেয়েরাই হয়তো ভালো বুঝবে। কোন মেয়েকে বলা যায় কি? আর গেলেও, কাকে বলা যায়?
অনেক ভাবনাচিন্তা করে রনি সিদ্ধান্ত নিল, টুম্পাকেই সে তার সমস্যার কথা বলবে। এই একটা মেয়ে ছাড়া তার আর কোন স্বল্পপরিচিত মেয়েও বলার মত নেই। অবশ্য উপমা আছে, কিন্তু তাকে বলা তো আর সম্ভব না।

রনি একদিন ক্লাস শেষে অনেক সাহস করে টুম্পাকে বলল, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।
টুম্পার কাছে ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক ঠেকল না। রনি একটা মেনিমুখো ছেলে, সে সাধারণত মেয়েদের সাথে কথা বলতে সাহস পায় না। আর সেখানে আজ হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই একটা কি না কি সমস্যা নিয়ে রনি তার সামনে দাঁড়িয়েছে এটা টুম্পার কাছে কেমন কেমন যেন ঠেকল।
তবুও এসেছে যখন, একটু ভদ্রতা তো করতেই হয়। টুম্পা বলল, কি সমস্যা?
আমি...রনি ভাষা হারিয়ে ফেলল। ইতস্তত করতে লাগল সে। তার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না। মেয়েদের সামনে সে জীবনে হাতেগোনা কয়েকবার এসেছে, আর প্রতিবারই এমন হয়েছে।
কি হয়েছে, বল।
আমি...মানে...
টুম্পা ধৈর্য ধরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। কিন্তু রনি কিছু বলতে পারে না। সে হঠাৎ কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
টুম্পা অনেক কষ্টে হাসি থামায়। হায় হায়, এ কি বিড়ালমার্কা ছেলে রে বাবা! কি বলবে বলে দিলেই তো হয়। এত ভয় পাবার কি আছে। হায় হায়, ছেলেটার কপাল দেখি ঘামে ভিজে গেছে। এত ঘামার কি আছে?
রনি মুখ মোছে। তার কেন যেন এক দৌড়ে পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে।
টুম্পা ব্যাপারটা উপভোগ করে। একজন শক্তসমর্থ পুরুষের এমন রূপ দেখে মেয়েদের মজা পাবারই কথা।
কি হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল, আমার কাজ আছে। একটু ঝাড়ির স্বরেই বলে টুম্পা।
ঝাড়ি খেয়ে পুরো চুপসে যায় রনি। আর একটা কথাও না বলে সোজা হাঁটা দেয় সামনের দিকে।
টুম্পা জোরে জোরে বলে ওঠে, কি হল? বল না!! আরে কই যাচ্ছিস!!! তারপর নিজের মনেই হেসে ওঠে সে। ছেলেটা যা ভীতু না!

***

রুমে ফিরে রনির খুব লজ্জা লাগে। এটা সে কি করল? পুরো জিনিসটা ভণ্ডুল করে ফেলল!
অনেক প্রতিজ্ঞা ও সাহস সঞ্চয় করে সে পরেরদিন ক্লাসে গিয়ে আবার টুম্পাকে বলল, আসলে আমি...
টুম্পা বলল, কি তুই?
আসলে কালকে একটু সমস্যা ছিল...বলতে পারি নি...
কি বলতে পারিস নি?
মেয়েটার গলার স্বর শুনে রনি আবারও চুপসে যায়। মেয়েটা তো তার সাথে ঝাড়ির সুরে কথা বলছে! আজকেও মারব নাকি দৌড়?
নাহ, প্রেস্টিজ ইস্যু। একটা মেয়ের সামনে থেকে হেঁটে চলে যাওয়া এক কথা, আর দৌড় মারা আরেক কথা। মেয়েমহলে জানাজানি হলে প্রেস্টিজ পুরা পাঙ্কচার। অলরেডি কিছু জানাজানি হয়েছে কিনা আল্লাহ মালুম।
গলা পরিষ্কার করে রনি বলল, তোকে বলেছিলাম না, আমি একটা সমস্যায় পড়েছি।
তা আমি কি করব? একটু ঝাঁঝের স্বরে বলে টুম্পা।
রনির ভিতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, যা, দৌড় দে। পালা। যা। তোকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। যা।
কিন্তু রনি কোনভাবে সামলে নেয়। ভিতরের ভীতু সত্ত্বাটার কথা শুনলে তার কাযর্সম্পাদন হবে না। মেয়েটা যেভাবে কথা বলছে তাকেও সেভাবে কথা বলতে হবে। তাহলেই মেয়েটাকে সামাল দেয়া যাবে।
আসলে...আমি এমন একটা সমস্যায় পড়েছি যে...কাউকে বলতে সাহস পাচ্ছি না...
তো?
তুই একটু শুনবি? মানে...বেশি সময় লাগবে না...একটু শুনবি?
টুম্পা এবার একটু নরম হয়। ছেলে আস্তে আস্তে লাইনে আসছে। আচ্ছা বল।
রনি একটু ভেবে বলে, আমি আসলে...একটা স্বপ্ন দেখেছি।
কি স্বপ্ন?
মানে...স্বপ্নে দেখেছি যে...
কি দেখেছিস?
একটা মেয়ে।
মেয়ে?
হুম।
কাকে দেখেছিস?
সেটাই তো সমস্যা।
মানে?
মানে আমি এমন একজনকে স্বপ্নে দেখেছি...যাকে স্বপ্নে দেখার কোন কারণই নেই...কোন ব্যাখ্যাই নেই।
তা দেখেছিসটা কাকে?
আসলে...ও...রনি চুপ হয়ে যায়।
কাকে?
...এখন না শুনলে হয় না?
আশ্চর্য! বললে সমস্যা কি?
সমস্যা আছে। তুই বুঝবি না।
আমি বুঝব না? তাহলে আমাকে বলছিস কেন?
না মানে...আচ্ছা পরে বলব। আমাকে একটু সময় দে প্লিজ।
টুম্পা মুখ ঈষৎ বাঁকায়। এই ছেলে তার সাথে ঢং করছে। সময় নিচ্ছে। লক্ষণ কোন দিকে যাচ্ছে বোঝার কোন উপায় নেই।
আচ্ছা পরেই বলিস।

ঐদিন রনি রুমে এসে মনে মনে ভাবে, নাহ, অবশেষে বলতে পারলাম। মেয়েদের সাথে এত ভয় পাবার কি আছে?
আর টুম্পা মনে মনে ভাবে, ও কাকে স্বপ্নে দেখেছে? আমাকে? এজন্যেই তো এত লজ্জা পাচ্ছে...ছি ছি, হায় খোদা, আমি এসব কি ভাবছি!
ও আমাকেই এসব কথা বলবে কেন? নিশ্চয়ই আমাকে স্বপ্নে দেখেছে।...ছি ছি টুম্পা, তুমি এসব কি ভাবছ?
আচ্ছা, ও আমাকে স্বপ্নে দেখবে কেন?...হায় টুম্পা, তুমি এসব কি ভাবছ?

***

পরদিন টুম্পাই ক্লাসের শেষে রনিকে পাকড়াও করে। এই শোন।
কি?
কি মানে? তোর কথা তো শেষ করলি না।
ও আচ্ছা...
মেয়েটা কে?
শুনবি?
হ্যাঁ।
রনি একটু হেসে বলে, এত আগ্রহ কেন? কি ব্যাপার?
টুম্পা ভয়ানক লজ্জা পায়। লজ্জা তো তারই দেবার কথা, আর ছেলেটাই কিনা তাকে লজ্জা দিয়ে দিল!
সে সামলে নিয়ে বলে, আগ্রহ তো হবেই। তুই তো কথা অর্ধেক বলে চলে গেলি। মিনমিন করতে করতে মেয়ের নামটাই বলতে পারলি না।
তাই? বললাম তো পরে বলব।
পরে মানে কখন?
পরে। যখন ইচ্ছা হবে।

ঐদিন রুমে গিয়ে রনি খুবই আনন্দে থাকে। সে জীবনে প্রথমবারের মত মেয়েদের সাথে আমতা আমতা না করে কথা বলতে সক্ষম হয়েছে।
আর টুম্পা ভিতরে ভিতরে খুবই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। রনি ছেলেটা বাইরে বাইরে এরকম হলেও ভিতরে ভিতরে তো পুরা মাল। খুবই চালাক। তাকেও লেজে খেলাচ্ছে। আচ্ছা, দাঁড়া  তোকে দেখাচ্ছি মজা!

***

বল না কাকে দেখেছিস?
এখন না।
প্লিজ বল।
পরে বলব।
আরে বল না।
পরে বলব।
আরে বল না।
জ্বালাইস না তো টুম্পা।

ঐদিন রাতে রনি হাসি হাসি মুখে ঘুমাতে যায়। আহ, জীবনে প্রথম কোন মেয়েকে ঝাড়ি মারলাম।
আর টুম্পা তার হৃদয়ের কোথায় যেন একটা চিনচিনে ব্যথা টের পায়। ছেলেটা এমন করলে তার কি? তবুও।
ছি টুম্পা ছি। দুঃখ পাচ্ছিস কেন? ছেলেটা কে তোর?

***

এই শোন।
কি?
মেয়েটা আমার ক্লাসমেট।
তা আমি কি করব?
কি করব মানে? তুই শুনতে চেয়েছিলি না?
তুই বলবি আমাকে?
অবশ্যই বলব। কেন বলব না?
তাহলে বল।
রনি খুব ফাজিল ফাজিল মুখভঙ্গি করে বলে, একবারে তো বলা যাবে না। ক্লু দিতে হবে।
আবার ফাইজলামি?
মেয়েটা লম্বায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি হবে। ক্লু নাম্বার ওয়ান। দেখি বের করতে পারিস কি না।

এই রাতেও রনিকে হাসি হাসি মুখে ঘুমিয়ে পড়তে দেখা যায়। সে চরম মজায় আছে। একটা মেয়েকে লেজে খেলিয়ে এত মজা সে আগে বোঝে নি।
আর টুম্পা? টুম্পা ওয়ার্ডের যন্ত্রপাতির সাথে যে মাপার ফিতা কিনেছিল সেটা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত মাপে। বারবার মাপে। কিন্তু কোনবারই চার ফিট এগার ইঞ্চির বেশি হয় না। তার লম্বা রুমমেট উপমা তাকে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে তোর?
টুম্পা বলে, জামা বানাব তো, তাই মাপছি। তুই ঘুমা।

***

ক্লু নাম্বার টু। মেয়েটার ব্যাগের রঙ কালো।
এই তুই কি পাইছিস রে? একবারে বললে হয় না?
না। ব্যাগের রঙ কালো।

রনির আনন্দ দেখে রুমমেটরাও অবাক হয়ে যায়। কি রে, কি হইসে তোর?
কিছু না, শালা ইভটিজারের দল।
কি বললি? ধর শালাকে। আরে শালা তো দৌড় দিসে। আচ্ছা ওর কি হইসে বল তো?
শালা মনে হয় প্রেমে পরসে।
আচ্ছা ওর মোবাইলটা পরে চেক করে দেখমুনে।

টুম্পা ঐ রাতে অনেকক্ষণ ধরে তার ব্যাগের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার ব্যাগ অ্যাশ কালারের।
আচ্ছা, ছেলেটা কি কালার ব্লাইন্ড হতে পারে না? কালার ব্লাইন্ডরা কি অ্যাশ কালারকে কালো দেখে?

***

ক্লু নাম্বার থ্রি।
তোর ক্লু আমি শুনব না। গেলাম।
মেয়েটা গত বুধবার নাদিম স্যারের ক্লাসে সাদা স্কার্ফ পরে গিয়েছিল।
শুনি নাই। গেলাম।

কি হইসে রে তোর রনি? আজকাল তোর মধ্যে এইরকম চেঞ্জ আসলো কিভাবে?
কিছু হয় নাই।

টুম্পার প্রচণ্ড মাথা ধরে। গত বুধবার সে কলেজে যায় নি।
আচ্ছা, এমন কি হতে পারে না, যে ছেলেটা গত বুধবার নয়, তার আগের বুধবারের কথা বলেছে? এমন কি হতে পারে না, ছেলেটা সাদা স্কার্ফের কথা বলে নি, তার আকাশী রঙের স্কার্ফটির কথা বলেছে?

***

ক্লু নাম্বার ফোর। গত টার্মে সে ফিফথ হয়েছিল।

টুম্পার কান গরম হয়ে যায়। কেমন কেমন যেন লাগে তার। ফিফথ তো দূরের কথা, সে জীবনে প্লেসও করে নি।

ঐ রাতে উপমা টুম্পাকে জিজ্ঞেস করে, কি ব্যাপার? তোর কি হয়েছে?
কিছু হয় নাই।
আরে বল না।
বললাম তো কিছু হয় নাই।
সম্পাদক সাহেব কিছু বলেছেন?
মানে?
সম্পাদক সাহেবের সাথে তো তোর ভালোই খাতির হয়েছে।
তুই কার কথা বলছিস?
বুঝতে পারছিস না? তোর দুই রোল পরে হিসাব করে দেখ।

টুম্পা ভয়ানক লজ্জা পায়। এসব কথা উপমা জানল কিভাবে?

***

সেই রাতে উপমা ঘুমিয়ে যাবার পর তার মোবাইলটা নিয়ে আনমনে গুঁতাগুঁতি করতে করতে মেসেজ INBOX এ ঢুকে একটা আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার করল টুম্পা।
অনেক দিন আগের একটা মেসেজ এখনও INBOX এর কোণে পড়ে আছে।

Tomake onek kosto dilam. Kichu mone koro na plz.

আপাতদৃষ্ট নিরীহ মেসেজটার সেন্ডারের জায়গায় লেখা “RONY clsmate”।

টুম্পা তার ফিতা দিয়ে ক্লাসে লম্বু নামে পরিচিত ঘুমন্ত উপমার হাইট মাপল। উপমার কালো ব্যাগটার ভিতর থেকে মাইক্রোবায়োলজি খাতা বের করল। খুঁজে খুঁজে বুধবারের লেকচার বের করে ওটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইল সে। ফেসবুকে ব্যাচের গ্রুপ থেকে গত টার্মের রেজাল্টের ছবিটা বের করে ফিফথ যে হয়েছে তার নামের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল সে। তার মনেই পড়ল না আজ সে আইটেমের পড়া পড়ে নি, গোসলও করে নি, খায়ও নি।

***

সুখ ভাগাভাগি করলে তা দ্বিগুণ হয়। আর দুঃখ ভাগাভাগি করলে হয় অর্ধেক। টুম্পা তার  মনের দুর্বোধ্য দুঃখটা উপমার সাথেই শেয়ার করার সিদ্ধান্ত নিল।
উপমা সব কথা শুনল। তারপর বলল, তুই বলতে চাচ্ছিস হাঁদারামটা আমাকেই স্বপ্নে দেখেছে?
হ্যাঁ। তার কথাবার্তা শুনে তো তা-ই মনে হচ্ছে।
তাহলে চল, হাঁদারামকে একটা টাইট দিয়ে দিই।
টাইট? কিভাবে?
আরে দেখবি কিভাবে দিই। এখন একটু হাস তো। অনেকক্ষণ ধরে গম্ভীর হয়ে আছিস।

***

পরের দিন টুম্পা রনিকে বলল, তোর জন্য একটা নিউজ আছে।
কি নিউজ?
উপমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।
তাই? রনির মনে হল তার হৃদপিণ্ডটি গলার কাছে উঠে এসেছে। দম আটকে যাচ্ছে। ছি রনি, উপমার বিয়ে হোক আর ইয়ে হোক তাতে তোর কি? তোর এই অবস্থা কেন?
কার সাথে?
সেটা জেনে তুই কি করবি?
কবে বিয়ে?
তোর কি দরকার? বলে টুম্পা চলে গেল।

রনির মনে হল তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। যেন সে ক্রমান্বয়ে মাটির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে।
সে উপরের দিকে তাকাল। তিনতলা কলেজ বিল্ডিঙের ছাদের দিকে চোখ গেল তার।
তার ভিতর থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল, যা, ঐটার উপর উঠে লাফ দে। যা। তোর আর বেঁচে কি হবে?
রনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। একটা মেয়েকে একবার পছন্দ হয়ে গেলে তার জন্য খালি পাগলামি করতে ইচ্ছা করে। মনে হয় পাগলামি করলেই হয়তো মেয়েটা বেশি পছন্দ করবে। বাস্তবে যা হয়তো কিছুটা হলেও পুরোটা সত্যি নয়।

***

পরের দিন রনি বারবার টুম্পাকে জিজ্ঞেস করল, কার সাথে বিয়ে? কবে? কোথায়?
কিন্তু টুম্পা তার কথার কোন উত্তর দিল না। বলল, আগে তুই তোর সিক্রেট বল, তারপর আমি আমারটা বলব।
কিন্তু উপমার বিয়ের কথা শোনার পর এই কথা কি আর বলা যায়? রনি কোনোভাবেই তার স্বপ্নচারিণীর পরিচয় বলতে পারল না। সে শুধু উপমার বিয়ের বৃত্তান্ত জানার জন্য টুম্পাকে জ্বালাতে লাগল। জ্বালানো মানে ভয়াবহ জ্বালানো।
কাহাতক আর সহ্য করা যায়? একসময় বিরক্ত হয়ে টুম্পা বলে বসল, কালকে বিয়ে। দুইটার সময় কলেমা। সেনাকুঞ্জে। ছেলে আর্মি অফিসার। হইসে?
পরের দিন উপমা কলেজে এলো না। রনির ভেতর থেকে কে বলে উঠল, গাধা, যা দৌড় দে, তোর ভালবাসা আরেকজন নিয়ে গেল রে গাধা।
রনি ক্লাসের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে স্যারকে বলল, স্যার আমার আম্মু অসুস্থ। আর্জেন্ট যেতে হবে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই এক দৌড়ে ক্লাসের বাইরে চলে গেল সে।
টুম্পা ক্লাসেই ছিল। ব্যাপারস্যাপার দেখে ফিক করে হেসে দিল সে। উপমার নাম্বারে মেসেজ পাঠাল,

Gadha ta class theke dour dise. Cinema dekha ses? Tor proxy diye disi.

***

রনি ঘড়ি দেখল। একটা বিশ।
দৌড়াতে দৌড়াতে কলেজ গেটের সামনে এসে একটা রিকশা পেয়ে গেল সে। বলল, শাহবাগ মোড়। বলেই রিকশায় উঠে বসল সে।
রিকশাওয়ালা তাকে নিয়ে শাহবাগ মোড়ে নামিয়ে দিল। বলল, পঁচিশ টাকা।
রনি পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোট বের করে বলল, ভাংতি দেন।
ভাংতি নাই।
রনি বাকি টাকা না নিয়েই দৌড় দিল।

বারডেমের সামনে চৌরাস্তার মোড়ে এসে অধৈর্য হয়ে চারদিকে তাকাল সে। গাড়ি চলাচলের ঠেলায় রাস্তা পার হবার কোন উপায় নেই।
ঠিক এক মিনিটের মাথায় রাস্তা একটু ফাঁকা দেখে সে দৌড় দিল, এবং কখন যে পিছন থেকে একটা বাস এসে তাকে ধাক্কা দিল এবং অজ্ঞান হবার আগে যে সে কি বলছিল বা কি ভাবছিল সেসব কিছুই তার মনে নেই।

***

রনি চোখ খুলল। অনেক আলো, চারপাশে সাদা আর সাদা।
তার নাক দিয়ে একটা নল ঢুকানো। শিরা দিয়ে দেয়া হচ্ছে স্যালাইন। তার পালস ও বিপি দেখা যাচ্ছে একটা কম্পিউটার মনিটরে।
চারপাশে ফিসফিস। কোলাহল। কিন্তু কোন মানুষ নেই।
সে কোথায়?
রনি মাথা ঘুরিয়ে তাকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু অনেক রকম আধুনিক যন্ত্রপাতি দেখে তার মাথা আর কাজ করল না।
একটু পরে হন্তদন্ত হয়ে কয়েকজনকে তার ঘরে প্রবেশ করতে দেখা গেল। তাদের সবার পরনে অ্যাপ্রোন।
তাদের মধ্যে বুড়োমত একজন, যাকে কিনা ডাক্তার মনে হচ্ছিল, উনি এসে অবস্থা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। একজন নার্সের উচ্চকণ্ঠী গলা শোনা গেল, জ্ঞান ফিরেছে! জ্ঞান ফিরেছে!
কিছুক্ষণ পর একগাদা মানুষ প্রবেশ করল ঘরটিতে। রনি চিনতে পারল, এরা তার ক্লাসমেট। এদের মধ্যে কি উপমা আছে? উপমার কি বিয়ে হয়ে গেছে? উঠে বসার একটা পৈশাচিক ইচ্ছা অধিকার করে নিল অসহায় রনির সমস্ত অন্তর।
রনির রুমমেট কবির ওরফে ইভটিজার নাম্বার ওয়ান এসেই রনির হাত ধরে মোচড়ামুচড়ি শুরু করল। শালা তুমি বেঁচে আছ তো? যে ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে...
আরেক রুমমেট ইভটিজার নাম্বার টু ওরফে সিরাজ বলল, তুই কই যাচ্ছিলি বল তো? আম্মুকে দেখতে তো অবশ্যই না...উনি তো আর ঢাকায় নাই...
আরও কয়েকজন বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল তো তুই ওভাবে তাড়াহুড়ো করে কই যাচ্ছিলি?
রনির নাক থেকে নল খুলে নেয়া হল। অনেকক্ষণ পর সে মুক্তভাবে বাতাস নিয়ে বুক ভরাতে সক্ষম হল।
আমি...কথা বলতে খুবই কষ্ট হয় তার।
চোখের আড়াল দিয়ে রনি দেখল, টুম্পা দৌড়ে তার দিকে ছুটে আসছে। আর তার সাথে...আরে, এটা কে? এ তো...নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে এলো রনির, এটা তো উপমা!

টুম্পা এসেই সবাইকে সরিয়ে রনির পাশে এসে বসে পড়ল। কান্নাভেজা গলায় বলল, সরি। আই অ্যাম রিয়েলি সরি। আমি বুঝতে পারি নাই...
রনি জিজ্ঞেস করল, ওর...বিয়ে...আর কিছু বলতে পারল না সে।
টুম্পা কেঁদে ফেলল। আমি মিথ্যা বলেছিলাম...শুধু দেখতে চেয়েছিলাম তুই ওকে আসলেই...মানে ভালবাসিস কিনা...আমাকে ক্ষমা করে দে ভাই...অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল টুম্পা।
রনি অন্যদিকে তাকাল। তার কেন যেন কাউকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছে না। ইস, একটু একা থাকতে পারলে ভালো হত।
উপমা এসে দাঁড়াল রনির পাশে। আমাকে আগে বল নি কেন?
রনি কিছু বলল না।
বল নি কেন?
রনি তবু নিশ্চুপ রইল। কিছু কিছু সময় নীরবতা কথার চেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
কবির রনির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, আমাদের তো অন্তত বলতে পারতি। আমাকে তো অন্তত বলতে পারতি। আমি ইভটিজার বলেই যে তোর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনব না তা তো আর না, তাই না?
রনি জিহ্বা চাঁটে। কথা বলতে তার মোটেও ইচ্ছা করে না।
আচ্ছা রনি, বলে কবির, তুই বলিস নি বলেই আজ এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার সাক্ষী হতে হল আমাদের, ঠিক না? আগে থেকে বলে দিলে এই পাগলামিটাও তোকে করতে হত না, তাই না?
রনি মাথাও নাড়ায় না। একমনে ছাদের দিকে চেয়ে থাকে। টুম্পার বিরক্তিকর কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। মেয়েদের হাসি যেরকম মুক্তোঝরা, মেয়েদের কান্না সেরকম বিরক্তিকর। মেয়েদের কাঁদতে দেখলে মনে হয় এই মুহূর্তে ক্রন্দনরতা সুন্দরীর মুখটা একটা টেপ দিয়ে আটকে দিই।
সুতরাং, এখন বল, সবাইকে সাক্ষী রেখে বল, বলে কবির, তুই কাকে স্বপ্নে দেখেছিস?
সিরাজ বলে, হ্যাঁ, এখনই বল, তুই কাকে স্বপ্নে দেখেছিস?
রনি কিছু বলে না।
কবির বলে, ঠিক আছে, আমরা সবই জানি। তোর পোস্টার আঁকানো থেকে শুরু করে মেসেজ পাঠানো পর্যন্ত সব জানি। স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটাও জানি। তবু তোর মুখ থেকে শোনা প্রয়োজন। তুই নিজের মুখে বল কাকে তুই স্বপ্নে দেখেছিস?
সিরাজ বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ বল। কার জন্য তুই এরকম পাগলামি করতে গেলি?

রনি টুম্পার দিকে তাকাল। মেয়েটা কাঁদছে। ভয়াবহভাবে কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজ ক্রমেই সহ্যশক্তির বাইরে চলে যাচ্ছে।
টুম্পা মুখ তুলে রনির দিকে তাকাল। বলল, বল ভাই, নিজের মুখে তাকে বল, কাকে তুই স্বপ্নে দেখেছিস? কাকে তুই ভালবাসিস? বল।
অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে উপমার দিকে একটা ইঙ্গিত করে সে।
উপমা নরম চোখে তাকিয়ে থাকে রনির দিকে। এগিয়ে গিয়ে রনির হাত ধরে সে। বলে, সবাই একটাই কথা শুনতে চাচ্ছে। সবাই।
রনি চুপ থাকে।
আমার বিয়ে হয় নি। সব ছিল বানানো।
রনি তবু চুপ থাকে।
তোমাকে আমার বিয়ের কথাটা বলা আমারই প্ল্যান ছিল। কিন্তু তুমি আমার জন্য এতটা করবে জানলে...হঠাৎ অশ্রুসিক্ত হয় উপমার অসাধারণ চোখদুটি।
রনি উপমার চোখের দিকে তাকায়। মেয়েটা এত সুন্দর! আর তার চোখ! এই চোখের দিকে তাকিয়ে অনন্তকাল কাটিয়ে দেয়া যায়। অনন্তকাল।
বল, তুমি স্বপ্নে দেখেছিলে ...

রনির মনোযোগ আবার বিচ্ছিন্ন করে টুম্পার কান্না। মেয়েটা অস্বাভাবিকভাবে কাঁদছে। আচ্ছা, সে কাঁদছে কেন?
রনি, তোমাকে অসুস্থ দেখে একটা মেয়ে কাঁদছে কেন?
তোমাকে মিথ্যা বলে একটা মেয়ে অনুশোচনায় ভুগছে কেন?
তোমাকে দুঃখ দিয়ে সে কাঁদছে কেন?

রনি উপমার দিকে তাকিয়ে বলতে যায়, আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তোমাকেই। শুধু তোমাকেই। কিন্তু কেন যেন বলতে পারে না। কে যেন তার ভিতর থেকে বাঁধা দেয়। কে যেন তার গলা চেপে ধরে।
কে যেন তাকে বলে, তাকে চেয়ো না যাকে তুমি সারাজীবন ভালবাসতে পারবে, তাকে চাও যে তোমাকে সারাজীবন ভালবাসতে পারবে।
কে যেন তাকে বলে, ফিস ফিস করে বলে, এত বড় হয়েও ভালোবাসার এই বুঝলি হাঁদারাম? কে তোকে ভালবাসে সেটা এখনও বুঝিস নি?

রনির চোখদুটো চকচক করে ওঠে। সে চার ফিট এগার ইঞ্চি, কালো, বৈশিষ্ট্যহীন চেহারার অধিকারী, অ্যাশ কালারের ব্যাগঅলা, আকাশী স্কার্ফ পরা, কখনও প্লেস না করা টুম্পার গাল স্পর্শ করে বহুকষ্টে আস্তে আস্তে বলে, পাগলী, আমি তোকে স্বপ্নে দেখেছিলাম। তোকে। তুই আমার স্বপ্নচারিণী হবি?

(সমাপ্ত)

বিঃ দ্রঃ এই গল্পের সাথে কেউ যদি বাস্তব কোন চরিত্রের বিন্দুমাত্র মিল খুঁজে পান তাহলে তিনি নিজেই দায়ী থাকবেন।


সালেহ তিয়াস

No comments:

Post a Comment