Subscribe:

ভালোবাসা এখানে অন্য উচ্চতার

আপনার বাবা-মা, যাদের জন্য আপনি দেখেছেন এই পৃথিবীর মুখ। আপনার জন্য রাতের পর রাত জেগেছে, আপনার সামান্য ঠাণ্ডা-কাশিতে ছুটে গিয়েছে ডাক্তারের কাছে , কাটিয়েছে অনেক নির্ঘুম রাত আপনার বিছানার পাশে। স্কুলে ভর্তি করিয়েছে, বসে থেকেছে স্কুলের গেইটের বাইরে কখন তার সোনামনির ছুটি হবে। নিজে না খেয়ে পূরণ করেছে আপনার শখ-আললাধ । অপূর্ণ রাখনে নি কোনো আশা , বুঝতে দেননি কোনো অভাব ।


কখনো লাগতে দেননি একটি আচর আপনার গায়ে। এভাবে আস্তে আস্তে আপনি বড় হলেন , আজ আপনার আছে অনেক বড় বড় ডিগ্রি। সময় থেমে থাকে না, আপনার বাবা-মা সময়ের সাথে ছুটতে ছুটতে এখন ক্লান্ত। বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। আপনি বিয়ে করেছেন, আপনি অনেক আধুনিক তাই বউ-বাচ্চা নিয়ে আলাদা বাসায় থাকেন অথবা আপনার স্ত্রী আপনার বৃদ্ধ বাবা-মা এর সাথে থাকতে চায় না !! তাই তাদের শেষ আশ্রয়স্থল হলো বৃদ্ধাশ্রম !

নচিকেতার গানটি খুব মনে পরে যায় ,


ছেলে আমার মস্ত মানুষ মস্ত অফিসার
মস্ত ফ্ল্যাটে যায় না দেখা এপার-ওপার।

নানা রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি
সবচেয়ে কম দামি ছিলাম এক মাত্র আমি
ছেলে আমার, আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।




আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না
এসব নাকি খুব পুরোনো ফ্ল্যাটে রাখা যায় না।

ওর বাবার ছবি ঘড়ি ছড়ি বিদেয় হলো তাড়াতাড়ি
ছেড়ে দিল, কাকে খেল পোষা বুড়ো ময়না
স্বামী স্ত্রী আর এলসেসিয়ান জায়গা বড় কম
আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।




একটা গল্প , হয়ত আমরা অনেকেই শুনেছেন। ছোট একটা সংসার। বাবা, মা, ছোট ছেলে এবং ছেলেটার দাদা।

দাদার অনেক বয়স হয়ে গেছে। কোন কাজ করার শক্তি নেই। সারাদিন এক বিছানায় পড়ে থাকে।

একদিন ছেলেটার বাবা একটা ঝুড়ির উপর বুড়োকে বসিয়ে জঙ্গলের উদ্যেশ্যে রওনা দিল। যাচ্ছে , যাচ্ছে। বেশ কিছুদুর যাওয়ার পর ছেলেটা হঠাৎ তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,

"বাবা, তুমি দাদুকে ঝুড়িতে করে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?"

"তোমার দাদুকে আমরা এখন জঙ্গলের ভেতর রেখে আসবো", বাবা উত্তর দেয়।

"কেন?", ছেলেটা অবাক হয়।

"কারন তোমার দাদুতো বুড়ো হয়ে গেছে, কোন কাজ করতে পারেনা। আমাদের কোন উপকারেও লাগেনা। শুধু খায় আর ঘুমায়। কি লাভ তাকে বাসায় রেখে? তাই তাকে আমরা জঙ্গলে রেখে আসতে যাচ্ছি। "

"ওহ!", কিছুক্ষন কি যেন ভাবে ছোট ছেলেটা, তারপর বলল, "ঠিক আছে বাবা, কিন্তু দাদুকে রেখে আসার সময় আমরা কিন্তু অবশ্যই ঝুড়িটা নিয়ে আসবো।"

"কেন", একটু অবাক হয় বাবা।

"কারন, যখন আমি বড় হব, তুমি তো তখন বুড়ো হয়ে যাবে, দাদুর মত। তখন তুমি কোন কাজই করতে পারবানা। শুধু খাবা আর ঘুমাবা। তখন তো তোমাকে বাসায় রেখে আমার কোন লাভই হবে না। শুধু শুধু তখন টাকা খরচ করে নতুন ঝুড়ি কিনতে যাব কেন? এই ঝুড়িতে করেই না হয় তোমাকে জঙ্গলে রেখে যাব।"

ছেলের কথায় চমকে উঠলো বাবা। হঠাৎ করেই নিজের ভূল বুঝতে পারলো। বুঝতে পারলো সে যখন ছোট ছিল, যখন কোন কিছু করারই ক্ষমতা ছিলনা, তখন তার বাবা মা-ই তাকে যত্ন করে বড় করেছে। আজ তার বাবা বুড়ো হয়ে যেন শিশু হয়ে গেছে। ছোটবেলায় যেমন তার বাবা তাকে বুকের মধ্যে আগলে রেখেছিল, এখন তেমনি তার দায়িত্ব হলো তার বাবাকে আগলে রাখা। এই সময়ে তার বাবার প্রতি তার সেবা, হয়ত কিছুটা হলেও তার বাবার প্রতি ঋন শোধ করা হবে।

আজকাল আমরা "আধুনিক" , "প্রগতিশীল" হতে ব্যস্ত । তাই ভাঙছে পারিবারিক বন্ধন। এককালের যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেছে সেই কবে ! বাবা-চাচা ভাইবোনসহ একান্নবর্তী বড় পরিবার এখন দুর্লভপ্রায়। স্বার্থান্ধতার বৃত্তবন্দি জীবন কেড়ে নিয়েছে সন্তান আর বাবা-মার আমৃত্যুর বন্ধনটুকুও। আমরা তো অনেক "সোশাল" তাই বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছি বৃদ্ধাশ্রমে ! কিন্তু, বৃদ্ধাশ্রম থাকার মানে এই নয় যে আমরা সোশাল । আমরা অসামাজিক দেখেই বৃদ্ধাশ্রমের জন্ম। শহুরে জীবনে আমাদের সময়ের অনেক অভাব। আমরা নিজের জীবনের জন্য এতটাই স্বার্থপর হয়ে যাই যে নিজের জন্ম দাতা-দাত্রীর কথা, তাদের অবদানই ভুলে যাই ধীরে ধীরে ! তাদের কবরের পূর্বের শেষ জায়গা হয় বৃদ্ধাশ্রম !

এই যে জনাব , একবারও কি ভেবেছেন , আপনার বাবা-মা কে দেখবে কে ? তাদেরকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে না ? তাদের সেবার প্রয়োজন নেই ?  প্রয়োজন যার ফুরিয়েছে-আশ্রয় কি তার বৃদ্ধাশ্রম ? যে সন্তানকে হাতধরে হাঁটা শিখিয়েছিলেন, মুখে তুলে খাবার খাইয়েছেন, গোসল করিয়েছেন, স্কুল-কলেজ পার করে জীবনে প্রতিষ্ঠার শেষ সিঁড়িতে পৌঁছে দিয়েছেন, সেই সন্তানদের সময় নেই জীবন সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া বৃদ্ধ মা-বাবাকে দেখার ? একদিন যে সংসার আর সন্তানদের তিল তিল করে পরম যত্নে আর মমতায় গড়ে তুলেছিলেন তারা, এখন সেই সন্তান আর সংসারে এই বয়োবৃদ্ধরা অপাঙক্তেয় ?

সেই সব বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর জীবনগাঁথা সর্বদাই রয়ে যায় অপ্রকাশিত। একবার কোন এক চ্যানেলে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে রিপোর্ট দেখেছিলাম। এক মহিলা বলছিল, "তার ছেলে তাকে এখানে রেখে গেছে।" রিপোর্টার জানতে চাইলো আপনার ছেলের নাম কি, পেশা কি ?? ঐ মহিলা বলল, "ছেলে বিশিষ্ট সমাজকর্মী , গার্মেন্টস এর বিজনেস আছে, নাম প্রকাশ করবে না !!"

নাম প্রকাশ করবে না কারণ যদি কেউ জানতে পারে কোন এক বিশিষ্ট সমাজকর্মীর বাবা-মা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে তাহলে তার সন্তান যে সমাজের কাছ ছোট হবে !! একবার চিন্তা করুন বাবা মার ভালবাসা কতটুকু !


এক বৃদ্ধা তার পঙ্গু ছেলেকে নিজ হাতে খাওয়াচ্ছে।



নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো না তো খোকা

বলতাম আমি না থাকলেরে কি করবি বোকা
ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে
খোকা বুঝি আর কাঁদেনা, নেই বুঝি আর মনে।



মা বাবা কখনো তার সন্তানকে ভুলে যেতে পারেন না । নিচের ছবিটা অনেকেই দেখেছেন । জাপানের ভুমিকম্পের পর উদ্ধারের সময়ের একটা ছবি । উদ্ধারকারীরা একটি মহিলাকে দেখতে পায়। মহিলাটি একটা কম্বল জড়িয়ে রেখেছিলেন। মহিলার অঙ্গভঙ্গি ছিল অন্যরকম। উদ্ধারকর্মীর সবাই ভেবেছিল মহিলাটি বেঁচে আছে কিন্তু মহিলাটি বেঁচে ছিল না। কিন্তু তার অঙ্গভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছিল সে কম্বলের ভিতর কিছু একটা আঁকড়ে ধরে আছে। অনেক কষ্টে তার শক্ত মুঠ করা শরীরটাকে খোলার পর কারো চোখের পানি কেউ আটকে রাখতে পারে নি। পারবে কিভাবে ? ৩ মাসের একটা ছেলে যে সেই কম্বলের ভিতর তখনও বেঁচে ছিল। মহিলাটির পাশেই একটা মোবাইল ফোন এ text লিখা ছিল , "If you can survive, you must remember that I love you." একবার ভাবুন , কত বড় ত্যাগ স্বীকার করলেন একজন মা । নিজের মায়ের কথা ভাবুন । তারাও আপনার জন্য ঠিক এইভাবে নিজের জীবন ত্যাগ করতে পারবে । আপনারা সেই মা-বাবাকে কত কষ্ট দেন তা ভেবেছেন ?




ছোট বেলা স্বপ্ন দেখে ঊঠত খোকা কেঁদে

দু হাত দিয়ে বুকের কাছে রেখে দিতাম বেধে

দু হাত আজও খোঁজে, ভুলে যায় যে একদম
আমার ঠিকানা এখন বৃদ্ধাশ্রম।



প্রায়ই টিভিতে বৃদ্ধাশ্রম নিয়ে বিভিন্ন ডকুমেন্টরী দেখায়। প্রত্যেকটা বৃদ্ধ, বৃদ্ধার চোখে দেখি পানি টলমল করছে। অনেকেই সাক্ষাৎকার দেয়, শোনায় তাদের দু:খের কাহিনী। তাদের প্রতি তাদের ছেলে বউয়ের অত্যাচারের কথা। যে ছেলেকে মানুষ করতে তারা তাদের জীবনের বেশীরভাগ সময় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে, সেই ছেলে তার পরিবার নিয়ে আজ মহাসুখে আছে, আর বাবা মা-কে পাঠিয়ে দিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, জীবনের শেষ কটা দিন ধুকে ধুকে মরার জন্য।

সেই সব ছেলে বউয়ের প্রতি শুধু এতটুকুই বলতে চাই, আজ থেকে ৩০ বছর পরে হয়ত অন্য কোন অনুষ্ঠানে, অন্য কোন বিদ্ধাশ্রম নিয়ে করা ডকুমেন্টরীতে হয়তো আপনাদেরও দেখা যেতে পারে। কেমন লাগবে আপনাদের, কোন এক বৃদ্ধাশ্রমের সদস্য হিসেবে, ঐ অনুষ্ঠানে বসে, পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে কেঁদে বুক ভাসাতে?

কেমন লাগবে যখন মনে পড়বে, যে ছেলে মানুষ করার জন্য জীবনে অমানুষিক কষ্ট করেছেন, সেই ছেলে মেয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছে আর আপনাকে ফেলে গেছে বৃদ্ধাশ্রমে, ধুকে ধুকে মরার জন্য?



খোকার ও হয়েছে ছেলে দু বছর হলো

আর তো মাত্র বছর পঁচিশ, ঠাকুর মুখ তোল
একশ বছর বাঁচতে চাই এখন আমার সাধ
পঁচিশ বছর পরে খোকার হবে উনষাট।


আশ্রমের এই ঘরটা ছোট, জায়গা অনেক বেশি
খোকা আমি দু'জনেতে থাকব পাশাপাশি
সেই দিনটার স্বপ্ন দেখি ভীষন রকম
মুখোমুখি আমি খোকার বৃদ্ধাশ্রম।


এখনও সময় আছে। যারা তাদের বাবা-মাকে এখনও অবজ্ঞা করছেন, যারা তাদের বাবা-মাকে ফেলে রেখেছেন বৃদ্ধাশ্রমে ধুকে ধুকে মরার জন্য, তারা এখনও তাদের ভুল শুধরে নিতে পারেন। এখনও পেতে পারেন বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া দোয়া। বাবা-মার সেবা করুন, তাদের প্রতি আন্তরিকতা দেখান। হাদিসে আছে, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেস্ত , তাদের সেবা করুন । আরো আছে , আপনি যতক্ষণ আপনার মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন ততক্ষণ আপনার গুনার মাফ হতে থাকবে । যদি আপনার মা বাবা বেচে থাকে তবে আপনি সৌভাগ্যবান , তাদের সেবা করার সুযোগ পেলেন । এই সুযোগকে নষ্ট করবেন না । মনে রাখবেন বাবা-মা বুড়ো হলে, তারা আর বাবা-মা থাকে না। তারা আপনার সন্তানে পরিনত হয়। আপনিই তখন তাদের বাবা-মা। তাদের দেখাশুনা করার দায়িত্বতো আপনার হাতেই অর্পিত।

বাবা-মার সেবা করুন।

যদি তা করেন, মনে রাখবেন জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভালো কাজটি আপনি করেছেন।



- অপ্রকাশিত -

No comments:

Post a Comment