Subscribe:

"তখন আমি সুখ চিনেছি"

"রাশেদ না? কেমন আছ?" প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে দেখি নাজমুল স্যার। স্যারঅনেক বুড়িয়ে গেছেন। আমি প্রথমে চিনতেই পারিনি। স্যার একে একে সব ছাত্রেরকথা জিজ্ঞেস করলেন। হামিদ কোথায় আছে? শিশিরের সাংবাদিকগিরি কেমন চলছে?আসিফ কি এখনো আগের মত মোটাই আছে? নাকি শুকিয়েছে? মালিহার নাকি বিয়ে হয়েগেছে? হেনতেন হেনতেন কত কথা। বিদায় নিয়ে যাবার সময় জানতে চাইলেন নীলারকথা। মনে পড়ল নাজমুল স্যারের বাসাতেই নীলার সাথে প্রথম কথা হয় আমার।


আমি কখনোই মেয়েঘেষা ছিলাম না। উল্টো মেয়েদের কাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায়রাখতাম। স্যারের বাসায় একদিন কলম আনিনি। সব ছেলের কাছে চেয়েও ব্যর্থহয়েছিলাম। কারো কাছেই দুটো কলম ছিল না। নীলা হয়ত খেয়াল করেছিল। আমাকেএকটা কলম এগিয়ে দিয়েছিল। বাহ!! মেয়েটাতো বেশ সুইট। আগে ভালভাবে খেয়াল করিনি। আস্তে করে বললাম, "থ্যাঙ্কস।" নীলা কিছু না বলে হাসল শুধু। সেই হাসিইকাল হল। তখন বুঝিনি। বুঝেছিলাম পরে। কলমটা ছিল পার্কার পেন। বেশ দামিকলম। খাতায় লেখার সময় মনে হচ্ছিল লিখছি না; ছবি আঁকছি। স্যার লেকচার শেষকরে উঠে গেলেন। প্রায় সবাই চলে গেল। আমি কলমটা নীলার দিকে বাড়িয়ে ধরেবললাম, "খুব সুন্দর কলম।" ও কলমটা আমার হাত থেকে নিয়ে আবার বাড়িয়ে ধরল।"এটা তুমি নাও। তোমাকে উপহার দিলাম।" আমি ইতস্তত করছিলাম। কেন যে কলমেরতারিফ করতে গেলাম। "আমার কাছে আরেকটা আছে। এটা তুমি নাও।" অগ্যতা বাধ্যহয়ে নিতেই হল। তখনো বুঝিনি কত বড় ভুল করলাম।

আস্তে আস্তে নীলার ওই একটুকরো হাসি মনের উঠোনে নেচে বেড়াতে লাগল। যেদিকেইতাকাই মিষ্টি একটা চেহারা ভাসে। ধীরে ধীরে নিজের দেহে আরেকজনের আত্নাজায়গা করে নেয়। আস্তে আস্তে। শেষে এমন অবস্থা যে- নিজের আত্নাই কোনমতেটিকে আছে। এমন অনুভূতির সাথে আমার কোন পূর্বপরিচয় ছিল না। কলমটা ছুঁয়েদেখতাম মাঝে মাঝে। তাতে তিনি আমার সামনে আসতেন আরো জীবন্ত হয়ে; আরোকঠিনতর রূপে। পাঁচমাস দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করলাম এই অত্যাচার। শেষেএকদিন.....কোনদিন যেন......হু...... দিনটা ছিল ৫ সেপ্টেম্বর। আমি রোগাএকটা গোলাপ নীলার দিকে এগিয়ে দিলাম। চোখ ছিল মাটির দিকে। ভেবেছিলাম কড়াএকটা ধমক খেতে যাচ্ছি। মনে হচ্ছিল বুকের মধ্যে টিপু ভাই ড্রাম পেটাচ্ছেন।ও হাত বাড়িয়ে গোলাপটা নিল। তারপরই পিনপতন নীরবতা। যেন আমরা কোন শোকসভায়যোগ দিয়েছি। একটুপরই মোনাজাত হবে। এভাবে কাটল দু-তিন মিনিট। আমি আর থাকতেনা পেরে নীলার দিকে চোখ তুলে তাকালাম। একী!! চোখ থেকে অশ্রু গড়াচ্ছে ওর।অথচ মুখে আলতো হাসি। ফিসফিস করে বলল, "এতদিন সময় লাগল তোমার?"

তারপর.....তারপরের কথা মনে করলেই সুখগুলো দখিনা বাতাসের মত পরশ বুলিয়েযায়। চিৎকার করতে ইচ্ছা করে- "তখন আমি সুখ চিনেছি"। সময় যায় আর সুখেরাচক্রবৃদ্ধির সূত্রমতে বাড়তে থাকে। দুই জোড়া হাত এক করে ঘন্টার পর ঘন্টাবসে থাকা। বেইলী রোডে ফুচকা খাওয়া। মধুমিতায় সিনেমা দেখে ওর চোখের কাজলনষ্ট হওয়া। আরো কত কি! কিন্তু হাওয়ার বেগ একটু কমলেই প্রবল শূন্যতা গ্রাসকরে বুকের ভেতরটা। বিশ্বসংসার খালি খালি লাগে। হতাশার ব্ল্যাকহোল আমাকেগিলে খায়। ঘড়ির কাঁটা মনে করিয়ে দেয়- বিশাল এই সৈকতে তুই একা- সব হারিয়েনিঃস্ব, রিক্ত, সর্বস্বান্ত একজন।

সবতো ঠিকঠাক মতই চলছিল। বেশ ছিলাম দুজন। একদিন কি যে হয়ে গেল। ঐদিনের কথামনে পড়লেই আমার মাথায় ভীষন যন্ত্রনা হয়। সাক্ষাৎ নরক যন্ত্রনা। সেযন্ত্রনার উৎপত্তিস্থল এই পৃথিবী নয়। সকাল সকাল ফোন করেছিল নীলা।-হ্যালো, তুমি তাড়াতাড়ি আসতো।-কোথায় আসব?-ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে।-কখন?-কখন মানে? আমি বের হয়ে গেছি। আধাঘন্টার মধ্যে আসো।-ওকে। একঘন্টার মধ্যে আসতেসি।-আচ্ছা যাও পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতর আসো।-ওকে।মুখে ওকে বললেও কাজে ওকে হওয়া গেল না। পঁয়তাল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেল। আমিতখন নীলক্ষেত মোড়ে রিক্সায়। ভাবছিলাম আজকেও দেরী হয়ে গেল। সম্ভাব্য খেতেযাওয়া ঝাড়ির লিস্ট বানাচ্ছিলাম মনে মনে। আমি সবসময়ই দেরী করি। কিভাবে যেনদেরী হয়ে যায়। 'নাহ। অভ্যাসটা খুব বাজে।' ঠিক করলাম জীবনে আর কখনো ওকেঅপেক্ষায় রাখবো না। কখনো না। এমনও হতে পারে নীলা রাগ করে চলে গেছে।অবশেষে বৃদ্ধ রিক্সাওয়ালা আমাকে ব্রিটিশ কাউন্সিলের সামনে নিয়ে এল।রিক্সা থেকে নামলাম; কিন্তু কাউকেই তো দেখছি না। আমার দেরিতে নিশ্চয়ই রাগকরে চলে গেছে। কিন্তু আমার অনুমান ভুল ছিল। নীলাকে আবিষ্কার করলাম কাছেই;একটা ভীড়ের মধ্যে। রক্তে ভিজে নীল শাড়িটা গাঢ় খয়েরি রঙের হয়ে গেছে। একটুনা হয় দেরীই হয়েছিল.......

সেদিন থেকে রাস্তায় নামলেই রাগে আমার পা থেকে মাথার তালু পর্যন্ত কাঁপতেথাকে। মন চায় সব গাড়িটাড়ি মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলি আর ড্রাইভারগুলোকেব্রাশফায়ার করে মারি।.......একমনে রাস্তার সব মানুষের চোদ্দগোষ্ঠি উদ্ধারকরতে থাকি। এজন্যই হয়ত নাজমুল স্যারের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে খেয়ালকরিনি। স্যারই ডাক দিলেন, "রাশেদ না?? কেমন আছ?"



-ইমরান নিলয়

No comments:

Post a Comment