Subscribe:

কয়েকটি স্বপ্নের মৃত্যু(গল্প প্রতিযোগিতা,গল্প নং-৩)

“আমার মনে হয় তুমি বুঝতে পারছো যে আমি তোমাকে ভীষণ পছন্দ করি,” ওপাশ
থেকে মিঠুনের গলা শুনে দারুন চমকে ওঠে রাত্রি। কিছু বলার ভাষা খুজে পেল
না। মিঠুনের মুখে এ কথাগুলো শোনার আশায় কত রাত যে কেঁদে ভাসিয়েছে তার কোন
হিসাব নেই। শুধু মদু স্বরে বলল, “হুম”।


“তাহলে তোমার উত্তরটা শোনার অপেক্ষায় রইলাম। আগামিকাল সন্ধ্যায় কল
দিব,রাখছি,” লাইনটা কেটে গেল। রাত্রির মনে হচ্ছিল ও স্বপ্ন দেখছে।
কাজিনের জন্মদিনে বেড়াতে যেয়ে তার বন্ধু মিঠুনকে ভাল লেগে যায় রাত্রির।
একসময় সেল ফোনে কথা শুরু হয় ওদের। এভাবে কেটে যায় এক বছর। আজকের এই
প্রপোজালটার জন্য রাত্রি গত একটা বছর ধরে অপেক্ষা করে আছে। ওর ইচ্ছে করছে
এক্ষুণি মিঠুনকে কল করে বলে ফেলে যে সে কত্ত ভালবাসে মিঠূনকে! কিন্তু
পরক্ষণেই ইচ্ছেটা দমন করে সে। কোন ছেলেকেই সহজে পাত্তা দিতে নেই। একটু
বাজিয়ে নিতে হয়। রাত আটটা বাজতে না বাজতেই রিডিং পার্টনার কুহু এসে
হাজির। কিন্তু আজ কিছুতেই পড়তে বসতে ইচ্ছে করছেনা ওর। মনে হয় না কাল
সন্ধ্যার আগে আর পড়তে বসা হবে! “কিন্তু আর মাত্র দশ দিন পর ইয়ার ফাইনাল
পরীক্ষা”, কথাটা মনে করিয়ে দিল কুহু। রাত্রি করুণ স্বরে বলল, “আজ মাফ কর
দোস্ত। কাল রাত আটটার পর পড়াটা ঠিক শেষ করে ফেলব, দেখিস”।

রাতে মা ফোন করে বললেন, “কিরে, ভাত খেয়েছিস”। উত্তেজনার জন্য রাতে খাওয়ার
কথা একদমই মনে হয়নি ওর। মিথ্যে করে বলল, “হুম”, মা বললেন, “শোন, তোর বাবা
আজকে কিছু বই আর পরীক্ষার ফি এর টাকা ক্যুরিয়ার করে দিয়েছেন,কাল দুপুরে
কলেজ থেকে ফেরার পথে ওগুলো তুলে ফেলিস”। রাত্রি বাধ্য মেয়ের মত জবাব দিল,
“আচ্ছা”।

হোস্টেলের ছাদে রাতটা কাটিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। আকাশে বিশাল
পূর্ণিমার চাঁদ। হঠাৎ করে সেই চাঁদের মাঝে যেন মিঠুনের চেহারাটা দেখতে
পেল রাত্রি! নিজের অবাস্তব কল্পনায় নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। সারাটা রাত যে
আজ ঘুম হবে না সেটা জেনেই একবার ভাবল ওর সংগ্রহ করা কানের দুলগুলো গুছিয়ে
রাখতে বসবে কিনা? কত রকমের আর কত বাহারের কানের দুল যে ওর সংগ্রহে আছে
তার কোন হিসাব নেই! গতকাল মার্কেটে নতুন ডিজাইনের একটা কানের দুল দেখে
এসেছে। আগামিকাল টাকা তুলে মনে করে কানের দুলটা কিনে ফেলতে হবে।

এসব ভাবতে ভাবতে একসময় ভোর হয়ে এল। সারাদিন কলেজ থাকাতে খুব দ্রুত সময়
কেটে গেল ওর। ক্যাম্পাসের গেট থেকে তিন বন্ধুর সঙ্গে চেপে বসল অটোরিকশায়
এস,এ পরিবহনের উদ্দেশ্যে। ওখান থেকে টাকা তুলে মার্কেটে যেয়ে কানের দুল
কিনে রেস্টুরেন্টে খেয়ে তবেই হোস্টেলে ফিরবে ওরা। বাতাস থাকায় অটোরিকশায়
উঠে ওড়নাটা ভাল করে মাথায় জড়িয়ে নিল রাত্রি। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে
মিঠুনের পাঠানো ম্যাসেজগুলোতে চোখ বুলাতে লাগল।

হঠাৎ সেসময় মনে হল কে যেন পেছন থেকে রাত্রির গলাটা চেপে ধরেছে। নিশ্চয়ই
মুনতাহা মজা করে ওর গলাটা চেপে ধরেছে? কিন্তু কোনমতে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে
পেল, মুনতাহা ওপাশ ফিরে ফোনে হাসতে হাসতে কার সাথে যেন কথা বলছে! গলার
চাপটা যেন আর একটু বাড়লো। সামনের দুই বন্ধুর দিকে অসহায় চোখে তাকাল ও।
কিন্তু ওরা কেউই রাত্রিকে দেখছেনা। টিনা স্বভাবসুলভ দাঁত দিয়ে নখ কেটে
যাচ্ছে আনমনে। আর কুহু এনাটমি বই খুলে পড়ছে। এবার গলার চাপটা এতটাই
জোরালো হল যে ওর জিহ্বা বের হয়ে গেল! কুহু বই থেকে চোখ তুলতে তুলতে অনেক
দেরী হয়ে গেছে। অটোরিকশার চাকায় গলায় জড়ানো ওড়না পেঁচিয়ে ততক্ষণে রাত্রি
ঢলে পড়েছে মুনতাহার গায়ের ওপর! ব্যাপারটা বুঝতেই চিৎকার করে ড্রাইভারকে
অটোরিকশা থামাতে বলল ওরা।

তারপর কি হয়েছে তা রাত্রির মনে পড়ছেনা খুব একটা। শুধু ছাড়া ছাড়া ভাবে
বুঝতে পারছে, তার পাশে অনেক মানুষের হইচই,কান্নার শব্দ। গলায় প্রচন্ড
ব্যথা করছে। দূর থেকে শুনতে পেল কে যেন বলছে, “ SHE IS IN COMA. SPINAL
CORD DAMAGE হয়ে গিয়েছে!” COMA! কে COMA তে? রাত্রি? রাত্রির চিৎকার করে
বলতে ইচ্ছে করল, “আমি COMA তে নই, আমি ঠিক আছি! দ্যাখো।আমি তোমাদের সব
কথা শুনতে পাচ্ছি!” কিন্তু ওর মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হলনা। ধীরে ধীরে
চারপাশের কোলাহল যেন মিলিয়ে গেল দূর থেকে বহু দূরে।

এদিকে এস,এ পরিবহনে ঢাকা থেকে রাত্রির নামে টাকা আর বই এসেছে। এক সপ্তাহ
হয়ে গেল, কেউ নিতে এলনা ওগুলো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে মিঠুন কল দিয়ে
যাচ্ছে রাত্রির নাম্বারে সেই কাঙ্ক্ষিত উত্তর শোনার আশায়। কিন্তু ফোনটা
বন্ধ! ফোনটা কেন বন্ধ তা মিঠুন কিছুতেই বুঝতে পারছেনা। রাত্রি সম্পর্ক না
রাখতে চাইলে সরাসরি জানিয়ে দিলেই পারে। কেন প্রতিদিন মিঠুনকে কষ্ট দিছে?
ওকে অপমান করছে?

নিউ মার্কেটের কাঁচের শোকেসে আজও ঝুলছে বাহারি ডিজাইনের কানের দুল জোড়া।
অপেক্ষার প্রহর গুণছে— কখন কিনে নিবে তাকে স্বপ্নবিলাসী কন্যাটা।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় কেন যেন মনের ভুলে বই-খাতা নিয়ে কুহু চলে আসে রাত্রির
ঘরে। কেন যেন সে কুহুর অনুপস্থিতি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা। প্রতি
রাতেই আটটা বেজে যায় কিন্তু রাত্রি পড়তে আসেনা,আর কখনও আসবেওনা!

------------------------------
-- সুস্মিতা জাফর

No comments:

Post a Comment