Subscribe:

“আজ দুটো মায়ের ঈদের দিন”

-সাফা মণি , তোমরা ক’ভাই বোন ?
-আমরা এক ভাই দু বোন ।
প্রশ্নের উত্তর শুনে যে কেউ হা করে অন্তত দশ সেকেন্ডের জন্য রুপার দিকে তাকিয়ে থাকত । তারপর মুখ ঘুরত আমার দিকে । এই ব্যাপারটা আমি খুব উপভোগ করতাম । আর খালি খিল খিল করে হাসতাম । কারন , যারা আমাদের পরিবারকে আগে থেকে চিনত , তারা আমার উত্তর শুনে খুব অবাক হত আর মনে মনে ভাবত “কিছুদিন আগেও দেখলাম এক ভাই এক বোন , আজ হঠাৎ করে আরেকটা মেয়ে কোথা থেকে আসলো ?”


এখানেই শুরু রুপার গল্প । রুপা , আমার বোন । রক্তের সম্পর্ক ব্যতীত কোন সম্পর্ক যে এত গাঢ় হতে পারে , সেটা বিরুদ্ধ ভাবনা আমার আর রুপার কাছে নস্যি । রুপা ছিল ছোটবেলা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত আমাকে দেয়া বিধাতার শ্রেষ্ঠ উপহারগুলোর একটি । রুপার সৃতি আজ আমার রক্তে বইছে , প্রতি মুহুর্তে রুপাকে অনুভব করছি আমার ছেলেটার মাঝে । যে কারো মনে প্রশ্ন হতে পারে রুপাকে নিয়ে আজ আমার এত মাতামাতি কেন ? উত্তরটা সহজ । কারন –
আজ রুপার ঈদের দিন.....................

          রুপাকে যেদিন আমি প্রথম দেখি , তখন আমি ক্লাস ফোরে পড়ি । মাত্র স্কুল থেকে আসলাম । মেজাজ খুব খারাপ । আমার একটা খেলনা আজ ম্যাডাম নিয়ে গেছেন , তাই । বাসায় আসা মাত্রই মার কোলে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম । মা জিজ্ঞেস করলেন –
-সাফা মণি , কি হয়েছে মা ?
-আম্মু(ফোপাতে ফোপাতে) , বিনু ম্যাডাম আমার রেলগাড়ি নিয়ে গেছে ।
-ও তাই নাকি ? আচ্ছা ম্যাডামকে ফোন করে বলে দেব কাল ।
-না না না  , আজকেই বলে দাও । আমি খেলবো ।(আবার কান্না)
          তখন আস্তে করে মা ফিসফিস করে কানের কাছে এসে বললেন “সাফা , তুমি না অনেক বড় হয়েছ । ওই দেখ , তোমার একটা ছোট বোন । তোমাকে কাদতে দেখে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে ।”

তখন খেয়াল হল আমি আর মা ছাড়াও আরো দুটো প্রাণী বাসায় উপস্থিত । একজন মায়ের চেয়ে একটু ছোট , আরেকজন হল সেই মেয়েটি যাকে দেখিয়ে মা আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন । দুজনকেই আমি আজ প্রথম দেখছি । মা পরিচয় করিয়ে দিলেন-
-এটা তোমার খালা সালেহা আর ও সালেহার মেয়ে , রুপা । রুপা তোমার ছোট ।
          আমি মেয়েটিকে ঠিকমত দেখতে পারছিলাম না । কারন তার মুখ ছাড়া শরীরের পুরো অংশটাই তার মায়ের পেছনে । শুধু চোখ দুটো ঠিকমত দেখা যাচ্ছে । ঘন মায়াবী চোখ , একটু ভয় মেশানো । আমি নিজেও তখন ছোট । কি বলব বুঝতে পারছিলাম না । কাত হয়ে একটু কাছে গিয়ে বললাম “আমার সাথে খেলবে ?” সাথে সাথে তার মায়ের পেছনে পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটা । আমার মা হেসে দিলেন , আমিও খিল খিল করে হেসে দিলাম ।
          সেদিনের পর ভাইয়ার কাছে জানতে পারলাম রুপার মা আমার দুঃসম্পর্কের খালা হন । তারা আমাদের নানুবাড়ী থেকে এসেছেন । রুপারা অনেক গরিব । নানুবাড়িতে বাবারা গেলে সালেহা খালা তাদের খুব যত্ন নিতেন । বাবা নাকি তাকে বোনের মত দেখতেন । তাই মা তাদের আমাদের বাসায় থাকতে দিয়েছেন । রুপার মা আমাদের বাসায় থাকবেন আর মার সাথে বাসার দেখাশোনা করবেন । আর শুনলাম মা নাকি রুপাকে একটা স্কুলে পড়াবেন । শুনে খুব ভাল লাগল । ভাবলাম বাসায় একজন সাথী পাওয়া গেল । কারন আমি ছোট বেলা থেকেই বাসায় একা একা খেলতাম । ভাইয়া কখনোই আমাকে তেমন একটা ঘাটাত না । সে সময়ে রুপার মত একটা খেলার সাথী পাওয়া আমার জন্য অনেক ছিল ।

          পরেরদিন সকালে উঠেই রুপার কথা মনে হল । বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠলাম । দৌড়ে “আম্মু আম্মু” করতে করতে নিচে আসলাম । নেমে দেখি মা সালেহা খালাকে বাসার সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছেন , কোনটা কি , কোনটা কিভাবে রাখতে হবে , কিভাবে ব্যবহাত করতে হবে ইত্যাদি । সেখানে সালেহা খালার সাথে সাথে রুপাও গুটিসুটি মেরে হাঁটছে । এখনো তার ভয় কমেনি । আমি আস্তে আস্তে পেছন থেকে গিয়ে জোরে চিৎকার করে উঠলাম “ভাউ” । হায়রে কপাল , সে চিৎকারে রুপা আর কি । মা আর খালা দুজনেই লাফ দিয়ে উঠলেন । আর রুপা ? সে তো ভয়ে কেদেই দিল । মা সাথে সাথে আমাকে ধাওয়া করলেন । আমি তো তখন হাওয়া । তখন স্কুলে যাবার সময় হয়ে গিয়েছে , রেডি হয়ে নিচে খেতে এসে দেখি রুপা এখনো ফোপাচ্ছে । দেখে আমি একটু হাসতে যাব , তখন দেখি বাবাও খাবার টেবিলে । আমি সাথে সাথে একদম সটান হয়ে খেতে বসলাম । আড়চোখে একবার রুপাকে আরেকবার বাবাকে দেখি । হঠাৎ -
-সাফা
-(প্রচন্ড ভীত স্বরে) বলো আব্বু
-তুমি মাকে ভয় দেখিয়েছ ?
-হুম
-গুড , ভেরি গুড ।
-খালাও ভয় পেয়েছেন ?
-হুম
-আরো গুড
বাবার কথা শুনে মনে হল আমি কি যেন সওয়াবের কাজ করেছি । কিন্তু আমার ভাবনা শেষ হতে না হতেই-
-কিন্তু রুপাকে ভয় দেখিয়েছ কেন ? ও কি তোমার মত বড় ? হ্যা ?
আমি চুপ ।

-এরপর যেন না শুনি যে তুমি রুপাকে কাদিয়েছ । ও তোমার ছোট বোন । ওকে ?
আমি আহত স্বরে বললাম “ওকে” । বাবা রুপাকে কোলে নিয়ে বললেন “রুপা মণি । সাফা আপু তোমাকে আর ভয় দেখাবেনা ।” রুপা আস্তে করে মাথা নাড়ল । আর ভয়ে ভয়ে আমার দিকে তাকাল । নতুন মেহমান এবং হবু খেলার সাথীকে এভাবে দেখে খারাপ লাগল । স্কুলে চলে গেলাম । ফিরে আসার সময় রুপার জন্য অনেকগুলো চকলেট নিয়ে আসলাম । তারপর খুজে বের করলাম রুপাকে , তখন মায়ের সাথে আটকে ছিল । আমি কিছু না বলে আস্তে করে রুপার হাতে চকলেটগুলো গুজে দিয়ে চলে আসলাম । সেদিন সন্ধ্যায় আমি বাগানে খেলছি । হঠাৎ ভাইয়া এসে ফুল্গাছের পাতা ছিড়ে আমার জামার ভেতর ঢুকিয়ে দিল আর “পোকা পোকা” বলে চিল্লাতে লাগল । আমি তো দিগুনহারে লাফাতে লাগলাম , কারন আমি পোকামাকড় সহ্য করতে পারিনা । যখন বুঝলাম ভাইয়া হাসছে , তখন আমার রাগ দেখে কে । ভাইয়া ধাওয়া করে ছাদে নিয়ে এলাম । তারপর কিছুখন কুস্তাকুস্তি চলল । বরাবরের মতই আমি জিতলাম । তারপর যখন বাসায় আসলাম , তখন সন্ধ্যা । আমার খেলনাগুলো তখন্ব বাগানে । কি করব ? আমি কান্না জুড়ে দিলাম খেলনার জন্য । মা বলল কাল এনে দেবে , এখন সাপ থাকতে পারে । কিন্তু আমি খেলনার দুঃখে শেষ । রুপা এতক্ষন আমাকে আড়াল থেকে দেখছিল । কান্না শেষ না হতেই দেখি রুপা ঠাশ করে বাগানে চলে গেল । আমি তো ভয়ে চিৎকার করে পুরো বাড়ী অস্থির করে ফেলেছি । একটু পরেই রুপাকে দেখা গেল আমার খেলনাগুলো হাতে আসছে । মুখে একটু লজ্জা । কাছে এসে খেলনাগুলো আমার হাতে দিয়ে হাটা ধরল তার মায়ের দিকে । আমি খপ করে রুপার হাত ধরে বললাম “চলো , আমার সাথে খেলবে । ” রুপা চুপ করে আমার পেছন পেছন আসল ।  

          সেদিন থেকে শুরু আমাদের সম্পর্ক । তখন থেকে যে কেউ জানত রুপা আমার বোন । আমি প্রতিদিন রুপার সাথে খেলতাম । রুপাকে একটা প্রাইমারি স্কুলে দেয়া হল । আমরা দুজন একসাথে গাড়িতে যেতাম , একসাথে আসতাম । চকলেট কিনলে জোড়া কিনতাম । টেডি বিয়ার কিনতাম একটা রুপার , একটা আমার । মাকে বলে রুপাকে আমার ঘরে শোবার ব্যবস্থা করলাম । রুপা আমাকে “বু” বলে ডাকত । কোথাও ঘুরতে গেলে আমি যেটা খাব , রুপাও তাই খেত । আমার সবগুলো ছবিতে রুপা থাকত আমার পাশে । প্রতি ঈদে আমরা একই জামা কিনতাম , রঙ বদলে । একবার আমার এক আঙ্কেল আমাকে সেলামি দিলেন , কিন্তু রুপাকে দিলেন না । আমি সেদিন চেচামেচি করে সবার কান নষ্ট করে দিয়েছলাম । তার পর থেকে বাসায় কেউ আস্লেই আগে থেকে মা বা বাবা তাদের বলে দিতেন আমার আ রুপার কথা । আমি ব্যাপারটা খুব উপভোগ করতাম , আর রুপা খালি হাসত ।   
          এভাবে পার হয়ে গেলো সাত বছর । তখন আমি SSC পরীক্ষার্থী । রুপা তখন অনেক বড় হয়ে গেছে , কিন্তু পড়াশোনা বাদ দিয়েছে অনেক আগেই । আর আমি ? পড়তে পড়তে মাথা নষ্ট । রুপা প্রতিদিন সকালে উঠে আমার জন্য ডিম সিদ্ধ আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকত আর আস্তে করে ডাকত “বু , উইঠে পড় । সকাল হয়া গেসে ।” আমি গড়িমসি করে উঠতাম । সারাদিন রুপা আমার খোজ নিত , কিছু লাগবে কিনা , কিছু দোকান থেকে আনতে হবে কিনা , সরীর খারাপ লাগছে কিনা ইত্যাদি । রাতে আমি না ঘুমানো পর্যন্ত আমার টেবিলের পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকত । আমি ঘুমানোর পড়ে তারপর ঘুমাত । এভাবে পরীক্ষা গেল । আমি খুব ভালো রেজাল্ট করলাম । টিভিতে আমার সাক্ষাৎকার নেবার সময় একমাত্র আমিই বললাম “আমার প্রেরনার মূল উৎস ছিল আমার বোন রুপা । ” বাসায় রাতের খবরে সেটা দেখাল । খবর দেখে রুপা আমাকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না । আমিও কান্না করলাম । তারপর রুপাকে নিয়ে যে কত জায়গায় ঘুরেছি , হিসাব নেই । দিনগুলো ছিল অনেক সুন্দর ।  

একসময় কলেজে ভর্তি হলাম । তখন রুপার দৈনিক কাজ বাসা দেখাশোনা করা আর আমি এলে আমার সাথে গল্প করা । আজ কে কে বাসায় এসেছে , কি করেছে সব । এমনকি কে বেশি কথা বলেছে , কে রুপার দিকে আড়চোখে চেয়েছে , কে সুন্দর সেন্ট দিয়ে এসেছে , কাকে নায়ক সালমান খানের মত লেগেছে ইত্যাদি । আমিও রুপাকে দিনের পুরো কাহিনি শোনাতাম । রাতে একসাথে ছাদে গিয়ে চা খেতাম , গান শুনতাম আর গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম । আমি কোনদিন খুব খুশি থাকলেই রুপা বলত “বু , আইজ তো তোমার ঈদের দিন ।” কথাটা অনেক ভাল লাগত ।  
          তখন আমি ইন্টারে পড়ি । নতুন কলেজ , নতুন বন্ধু , নতুন নতুন সব গল্প । সে সময় আড্ডার বিষয় হয়ে গেল নতুন কিছু টপিক যেমন – প্রেম করলে কি হয় , ভালবাসা কি জিনিস , কলেজে জোড়া ছেলে মেয়ে কিভাবে টাইম পাস করে , আমরা তাদের দেখে কি কি টিটকারি মারি ইত্যাদি । আমি তখন ছিলাম নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত একজন মানুষ । ভালই চলছিল । কলেজে ভর্তির আগে আমি আর রুপাই ছিলাম আমাদের দুনিয়ার দুজন সদস্য । কিন্তু বেশিদিন না যেতেই আমার আর রুপার চিন্তার মাঝে ঠাই করে নিল আরেকটি সত্ত্বা ।

       সেদিন শুক্রবার । বিকেলে আমি আর রুপা চা খাচ্ছি আর ছাদে বসে গান শুনছি । হঠাৎ রুপার খোচা খেয়ে চমকে উঠলাম । রুপার দিকে তাকিয়ে দেখি ওই ছাদে কিছু একটার দিকে তার চোখ । আমিও তার দৃষ্টিকে ফলো করতে গিয়ে দেখলাম পাশের বাসার ছাদ থেকে একটা ছেলে হা করে এদিকে তাকিয়ে আছে । তাকে আগে কখনো দেখিনি এটা আমরা দুজনেই সিওর । আমি ঠিকমত খেয়াল করে দেখলাম ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে । লজ্জাকর অবস্থা । আগে কখনো এমন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়নি তাই কি করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না । ঠিক তখনই আমাকে চমকে দিয়ে রুপা চিৎকার দিল “অই মিয়া , কি দেখতিছ ? হা ?” রুপার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ছেলেটা ঠাশ করে উত্তর দিল –
-পেত্নী দেখি ।
কি ? এত বড় সাহস পেত্নী বলে আমাকে ? আমি ক্ষেপে গেলাম ।
-এইযে
-শুনছি , বলুন
-এটা কি বললেন আপনি ?
-কেন ? শুনতে পাননি ? কানে প্রবলেম ?
কত্ত বড় সাহস আমাকে বলে কানে প্রবলেম !!! আমি দ্বিগুন জ্বলে উঠলাম –
-অই , তুই জানিস আমি কে ???
-কে আবার , পেত্নী
-কি !!! কোন কলেজে পড়িস তুই ? এই পাড়ায় নতুন , না ? ইমরুল , মিনহাজ এদের চিনিস ? এরা আমার দোস্ত । হাত পা সব ব্যাগে ভরে বাসায় দিয়ে আসবে ।
আমার ঝাড়িতে কিচ্ছু হল বলে মনে হলনা । তখনও হাসছে ।
-আচ্ছা । তুমি তাহলে কলেজে পড় । গুড । নাম কি তোমার ?
-নাম কি মানে ? তোর এত্ত বড়...............

আমি কথা শেষ না করতেই “আমার ফোন এসেছে” বলে হাত দিয়ে আমকে থামিয়ে দিল । পকেট থেকে ফোন বের করে হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে নেমে গেল । আমি আর রুপা অপমানের জ্বালায় অস্থির । এভাবে চলে গেল ? কত্ত সাহস ! ভাবতে না ভাবতেই আবার সিড়ির পাশ দিয়ে মুখটা বের করে “এই পেত্নী , আবার দেখা হবে ” বলে হাওয়া হয়ে গেল । আর আমি ? পেত্নীর মত মুখ করে বসে থাকলাম ।
রাতে খাবার পর রুপার সাথে আলাপে বসলাম । রুপা পাশের বাড়ির দারোয়ান চাচার কাছ থেকে জানতে পেরেছে ছেলেটা কয়েকদিন হল ভাড়া এসেছে । নাম কাব্য । ভার্সিটিতে পড়ে । এক ভাই এক বোন । বোন ছোট , ক্লাস সেভেনে পরে । নাম মিলা ।

ভার্সিটিতে পড়া ছেলেকে এভাবে হুমকি দিয়েছি ভাবতেই কেমন লাগছিল । যাই হোক , ছেলেটাকে উচিত শিক্ষা দিতেই হবে । আমাকে অপমান ? এগুলো ভাবতে না ভাবতেই মা ডাকলেন “সাফা মণি , একটু নিচে এস তো” ধুর এই সময় কেউ ডাকে ! অনিচ্ছা সত্তেও নিচে গেলাম । রুপা আমার পেছনে । সিড়ি দিয়ে নামতে না নামতেই দেখলাম লিভিংরুমে সেই ছেলেটা বসে । আমার আর রুপার চোখ রসগোল্লা হবার মতন । মা আমাদের দেখে বললেন “কি হল ? ভয় পেয়েছিস নাকি ?” আমি যতটা সম্ভব নরমাল হলাম । দেখলাম ছেলেটা হাসছে । কি যে রাগ উঠল , মনে হল প্লায়ারস দিয়ে দাতগুলো একটা একটা করে তুলি । তো , মা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন । আমি আর রুপার ঠায় হয়ে বসে রইলাম । পরিচয় পর্ব শেষ হবার সাথে সাথেই আমি “মা আমার কাজ আছে” বলে উঠে রুমে দৌড় । এখানে আর মুহুর্ত থাকেল সত্যি ছেলেটার দু একটা দাত শহীদ হতো । মা খুব অবাক হলেন । তাই কিছু বললেন না । কিছুক্ষন পর ছেলেটা চলে গেল । আমিও রাগ কমিয়ে আনলাম । মনে মনে ভাবলাম আজকে ছাড়া পেয়ে গেছে তো কি , আরেকদিন হাতের কাছে পেলে ঠিকই মেরে বসব ।

রুপা গত দুদিন ধরে খালি বলে যাচ্ছে ছাদে যেতে । কিন্তু আমি যাইনা । কারন জানি ছাদে সেই ছেলেটা থাকবেই । কিন্তু এক ছাদ থেকে অন্য ছাদের কাউকে শায়েস্তা করা যায়না , তাই আমি তার সামনে যেতে রাজি নই । রুপা বলেছে  সে নাকি প্রতি বিকেলে আমাকে খোজে । ছাদে তাকিয়ে থাকে । থাকুক তাকিয়ে তাতে আমার কি ।
তার দুদিন পরের ঘটনা । আমি স্কুলে যাবার জন্য রিকশা খুজছি । একটা খালি রিকশা দেখে ডাক সিলাম “এই খালি” ডাকটা কেন জানি দিগুন হয়ে গেল । বামে তাকিয়ে দেখি ছেলেটা আমার পাশে দাঁড়িয়ে হাসছে । তারপর আমার দিকে ঘুরে –
-আরে , পেত্নী ! কি খবর ?
আমি কটমট করে তাকালাম ।
-আহহারে কি হয়েছে , লেগেছে কথাটা ? আচ্ছা সরি । এই নাও রিকশা । যাও । তোমার স্কুলের সময় হয়ে যাচ্ছে ।
-আমি স্কুল না , কলেজে পড়ি । 

আমি রাগে, লজ্জায় আর কিছু বলতে পারলাম না । তার কথায় যেন কি আছে , ভাল লাগে । উঠে বসলাম রিকশায় । যেই রিকশা চলা শুরু করবে , তখন আবার ছেলেটা বলল “আচ্ছা , সাফা । আমি কি তোমার সাথে যেতে পারি ? আমারো দেরি হয়ে যাচ্ছে ।” আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । কি বলব বুঝতে পারছিলাম না । আরো লজ্জা লাগছিল । কলেজে তো আমার ছেলে বন্ধুর অভাব নেই । তবু কেন তাকে দেখে এমন লাগছে । ভাবতে গিয়ে খেয়াল করলাম রুপা গেটে দাঁড়িয়ে সব দেখছে । আমি আরো লজ্জা পেলাম । হঠাৎ “না , যেতে পারেন না ” বলেই রিকশাওালা মামাকে চালাতে বললাম । রিকশা চলতে শুরু করল । খুব পেছনে তাকাতে ইচ্ছে করছিল । কিন্তু রুপার কাছে ধরা পড়ে যাব বলে তাকাইনি ।

ধরা শেষপর্যন্ত পড়তেই হল । সেদিন আমি বাসা থেকে বের হয়েছি মার্কেটে যাব বলে । রিকশা খুজে পাচ্ছিলাম না । সেদিনও একই কাহিনি । ছেলেটা রিকশা ডাকল , আমিও ডাকলাম । কিন্তু এবার দুজনেই একসাথে উঠলাম । মার্কেটে নামলাম । তখন বৃস্টির সিজন । রাস্তায় কাদা । নেমে কাদা পেরিয়ে যাচ্ছি , তখন ছেলেটা ডাক দিল “এই পেত্নী , কবি খাবে ? কফির ক্ষুধা লেগেছে আমার । ” কফির ক্ষুধা বলে যে একটা ব্যাপার আছে , সেটা প্রথম জানলাম । আমি মাথা নাড়লাম , না । কারন তার দাত না ভেঙ্গে কফি খাবনা । আবার পেছন থেকে ডাকল “পেত্নি , পেত্নী............” নাহ , আর সহ্য করতে পারলাম না । হাতে ছিল ভ্যানিটি ব্যাগ , ভাবলাম সেটা দিয়েই মাথাটা গুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দেব । উলটো ঘুরে যেই তেড়ে মারতে গেলাম , আমার পা আমাকে অমান্য করে পিছলে গেল............ধপাশ !

রাস্তার সব মানুষের চোখ সাই করে ঘুরে আমার দিকে । আর আমি ? রাস্তায় ফ্ল্যাট হয়ে বসে আছি । খুব ব্যাথা করছে পা টা । কিন্তু ব্যথার চেয়েও লজ্জা লাগছে বেশি । হঠাৎ দু একজন হাসতে শুরু করল । তারপর সবাই । শুধু একজন বাদে । আর আমি ? নিউটনের তৃতীয় সূত্র মোতাবেক ভ্যা করে কেদে দিলাম । মানুষের হাসির মাত্রা বাড়ে , আমার ভ্যা-র মাত্রাও বাড়ে । কয়েক সেকেন্ড যেতেই হুঙ্কার শুনলাম “কি হচ্ছে এসব ? আপনাদের কোন কাজ নেই ? নির্লজ্জের মত হাসছেন কেন ? এখানে যদি আপনার মা বা বোন থাকত , হাসতেন কেমন করে ? ” কথাটা শুনে অধিকাংশ মানুষ চুপ করল । কিন্তু কিছু চ্যাঙরা টাইপ পোলাপান হাসতেই থাকল । একজন বলে উঠল “তাইলে উনি ক্যাডা আপনের ?” বলেই হেসে উঠল তারা ।
-“আমার বৌ”
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি অবাক হয়ে গেলাম । কথাটা বলার সময় তার গলা এতটুকু কাপেনি । একদম ঠান্ডা মেজাজের মনে হল তাকে । আমি হতবাক হয়ে বসে রইলাম । আমাকে উঠানোর সময় ছেলেটা খেয়াল করল আমার পা মচকে গেছে । আমিও ব্যাথায় কাঁদছি । তখন পারছিলাম না উঠতে , পারছিলাম না বসে থাকতে । বাজে অবস্থা । যদিও এই অবস্থায় বেশিক্ষন পড়ে থাকতে হয়নি ।
রিকশায় বাসার সামনে এসে দেখলাম রুপা পাগলের দাপাদাপি করছে । বাসায় ফোন করে রুপাকে শুধু জানিয়েছিলাম । আমাকে দেখে দৌড়ে আসল “বু , ব্যাথা কি বেশি লাইগছে ?” আমি বোঝালাম ঠিক আছি । রুপা তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল “ভাইজান , আপনে আমার বু-রে বাচাইসেন । ভাইজান ।” রুপার অবস্থা কাহিল । ছেলেটা একগাল হেসে বলল “এখনো বাচানো বাকি আছে ।” বলেই আমাকে দ্বিতীয়বারের মত কোলে নিয়ে নিল । আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম । আর রুপা ? হা করে আমার গালের দিকে তাকিয়ে থাকল । মনে হল শয়তানটা যতনা টেনশনে ছিল , এখন তার চেয়ে বেশি মজায় আছে । যাই হোক , আমাকে ভেতরে দিয়ে আসা হল , একদম বিছানা পর্যন্ত । আমাকে বসিয়ে রেখে টেবিল থেকে কাগজ ছিড়ে কি যেন লিখে দিল । দিয়েই সে হাওয়া ।
দেখলাম কাগজে তার নাম্বার , সাথে লেখা “সুস্থ হয়ে জানিও , পেত্নী”
আবারো লজ্জা পেলাম । রুপা এসে সবকিছু দেখে আস্তে করে বলল “বু , আইজ তো তোমার ঈদের দিন”
এক সপ্তাহ লাগল ঠিক হতে । এ কয়দিন কলেজে যাইনি । বাসায় থাকতাম আর মুভি দেখতাম । বিকেলে ছাদেও যেতাম না । লজ্জায় । জানতাম সে ছাদে আমার জন্য অপেক্ষা কছে । প্রতিদিন সন্ধ্যায় রুপা এসে বলত “বু , আইজ ও তোমারে দেখতে আইসিল । তারপর বইয়া বইয়া কি যেন ল্যাখতাছিল । ল্যাখা শেষ কইরা মাত্র গেলগা । প্রত্যেকদিন কি জানি ল্যাখে ।” আমি শুধু শুনতাম আর ভাবতাম – কি হচ্ছে এটা আমার সাথে ? আমি তো এই অনুভুতির সাথে পরিচিত নই ।
এক সপ্তাহ পর ছাদে উঠলাম । উঠেই দেখি ছেলেটা বসে কি যেন লিখছে । আমি আস্তে ছাদের কিনারে গিয়ে দাড়ালাম ।
-কি লিখছেন ?
-(অবাক) আরে ! পেত্নী যে ! পা ঠিক হয়েছে তো ?
-সেটা জেনে আপনার কি ?
এভাবেই চলতে থাকে পরিচয় । তারপর থেকে প্রতিদিন ছাদে উঠতাম । রুপা পাহারা দিত কেউ ছাদে আসে কিনা । ফোনেও কথা হত । কোনদিন ছাদে না উঠতে পারলে চিঠি লিখে দিতাম । সেটা রুপা মারফত তার কাছে পৌছে যেত । আর রুপা , আমাকে খোচানোর চান্স পেলে তো কথাই নেই । রুপাকে খোচানোর আরো সুযোগ দিয়ে তাকে ভালবাসার মানুষ করে নিলাম । সেদিন সে আমাকে একটা কাগজ ধরিয়ে বলল “এটা তোমাকে যেদিন রাস্তা থেকে উদ্ধার করলাম , সেদিন লিখেছিলাম ”

চিন্তায় ছেদ পড়েছে আজ
ভাবনার মহলে লেগেছে আগুন
চোখের কোনা দিয়ে পালিয়েছে লজ্জা
প্রাণ ভরে গন্ধ নিয়েছে তোমার কাজলকালো চুলের
কানের পাশ দিয়ে হেসে গেছে জোড়া নুপূর
সাড়া পেয়ে চমকে উঠেছে প্রেমের দেবতা
খুজে ফিরেছে তোমায় , তোমার পদধ্বনি
চলতে চলতে পথের শেষে এসে হারিয়েছে তোমাকে
আমি চিৎকার করে কেদেছি
হাতজোড় করে চেয়েছি তোমাকে একটিবারের জন্য
হন্যে হয়ে খুজেছি আবার-
গোপনব্যাথার ফাকে
বকুলফুলের ভাজে
কিংবা কবিতাগুলোর মাঝে
হতাশায় যখন মুষড়ে পড়েছি
ঠিক তখন মনের ভেতর হতে উকি দিলে
একগাল হেসে বললে-
“সেই কখন থেকে অপেক্ষায় আছি
কোথায় ছিলে এতদিন?”

কবিতাটা পড়ে কেদে দিয়েছিলাম । বুঝছিলাম ও কত্ত ভালবাসে আমাকে ।
সেই থেকে আমার দিনগুলো ছিল স্বপ্নের সমান । সারাক্ষন খুব আনন্দে থাকতাম । বৃষ্টিতে আমি , রুপা , কাব্য আর মিলা একসাথে ভিজতাম , দুই ছাদে । কোনদিন ঘুরতে গেলে রুপাকে বলে যেতাম । রুপা টিটকারি মার্কা হাসি দিয়ে বলত “বুঝি তো , ঈদের দিন” । কাব্যও মিলাকে বলে যেত । মিলা আমাকে ভাবি ডাকত । কি যে ভাল লাগত আমার , বোঝানো যাবেনা ।
সে ভালো লাগাটাকে সত্যি করতে আমি ইন্টার পাশ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম । সেকেন্ড ইয়ারে ও বের হয়ে চাকরি নিল । এখন শুধু ফ্যামিলিকে জানানো বাকি । কিভাবে সম্ভব ? এই ভাবনায় আমার আর রুপার রাতের ঘুম হারাম । শেষমেষ রুপা একটা বুদ্ধি বের করল । খোদার উপর ভরসা রেখে রুপাকে মিশন শুরু করার পারমিশন দিলাম ।
কাজ হয়ে গেল । বাবা আমার পছন্দের কথা জানতে চাইলেন । আমিও দেরি করলাম না । তারপর.........আমাদের বিয়ে । আমার বিয়েতে রুপা সবচেয়ে বেশি খুশি ছিল । এখনো মনে পড়ে , যেদিন বাবা মা রাজি হলেন সেদিন আমি আর কি খুশি হব , রুপা খুশিতে কান্না করে দিল । মনে হচ্ছিল তার বিয়ে হবে ।
ধুমধাম করে বিয়ে হল । বিয়েতে আমার আর কাব্যর নাক গলানো নিষেধ ছিল , রুপার আদেশ । সে সবকিছু করতে চায় । বাবা মাও মেনে নিলেন , তারা জানেন রুপা আমার আপন বোনের চেয়েও বেশি । রুপার কাজ ছিল আমাদের অবাক করা । এবং সত্যি বিয়েতে একের পর এক কিছু অবাক করা উপহার পেয়েছিলাম আমরা । আমাদের বিয়ের সব ছবিতে আমার সাথে রুপা ছিল । এমনকি জামাই বৌয়ের ছবিতেও রুপা । সেটা ছিল কাব্যর ইচ্ছা । কারন শুধু আমি না , কাব্যও রুপার কাছে ঋণী ।
বিয়ের পর কাব্য একটা ফ্ল্যাট কিনল । আমরা সেখানে উঠি , সাথে রুপা । কাব্য অফিসে যেত , আমি আর রুপা সারদিন এটা ওটা করতাম , রাতে একসাথে খেতাম , আড্ডা মারতাম । বিয়ের ক’মাস পর একদিন রাতে সবাই মিলে টিভি দেখছি । আমি টিভি বন্ধ করে উঠে দাড়ালাম । বাকি দুজন আমার উপর বিশাল ক্ষ্যাপা । উঠে বললাম “আপনাদের জন্য সুখবর আছে ।” শুনেই তাদের চোখ বড় বড় । আস্তে করে বললাম-
 “আমি মা হব” 
সারা ঘরে দু সেকেন্ড শব্দ ছিলোনা । তারপর , দুজনেই আমার উপর ঝাপিয়ে পড়ল । সেদিন আমরা তিনজন পাল্লা দিয়ে কাদলাম । শুরু হল আমার যত্ন । উফফ...আমাকে কিচ্ছু করতে দিতোনা রুপা । কাব্য অফিস থেকে দৌড়ে বাসায় আসত । নিয়মিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ হত । সে কি অবস্থা ।
বছর শেষে আমাদের একটা মেয়ে হল । রুপা সেদিনও বলছিল “বু, আইজ তো তোমার ঈদের দিন” । আমরা তিনজন মিলে মেয়ের নাম রাখলাম “অধরা” ।
অধরাকে নিয়ে শুরু হল নতুন জীবন । সারাদিন রুপা মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকত । এই করত , সেই করত । খাওয়াত , গোসল করাত । দোকান থেকে অজস্র পরিমাণ খেলনা কিনে আনত , যেগুলো আমাদের মেয়ে ধরতেও শিখেনি । আমরা অধরার উপর দায়িত্ব পুরোটাই রুপার হাতে দিয়েছিলাম , আর সে খুশিমনে সেটা পালন করত । অধরা ঘুমিয়ে গেলেও রুপা গল্প শোনাত রুপা , থামত না । সকালে উঠেই একবার অধরাকে দেখতে আসত , তারপর হাত-মুখ ধুতে যেত । আমি কিছু বলতাম না , শুধু হাসতাম । মাঝে মাঝে বলতাম “রুপা , মেয়ে তো মনে হয় আমার না , তোর” । রুপা হাসত ।
দেখতে দেখতে আমাদের মেয়ের দু বছর হল । তখন সে হাটে , কথা বলে । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল অধরা আমাদের দুজনকেই মা বলত । একবার হাসপাতালে গিয়ে অধরা দুজনকেই মা মা বলে ডাকছিল । ডাক্তার পুরোই কনফিউসড হয়ে গেলেন কে আসল মা । মনে পড়লে এখনো হাসি ।
একরাতে কাব্য রুপার কথা তুলল । বলল “রুপার বিয়ে দেয়া দরকার” । ব্যাপারটা আসলেই ঠিক । রুপা বেশ বড় হয়েছে । বিয়ের বয়স ও হয়েছে । আমি কাব্যকে বললাম ব্যাপারটা দেখব ।
পরের কয়েকদিন রুপাকে খুচিয়ে খুচিয়ে বিয়ের কথা তুললাম । বললাম ওর কোন পছন্দের কেউ থাকলে বলুক । রুপা একটু লজ্জা পেল । বুঝলাম রিসপন্স পজিটিভ । রাতে তিনজনে বসলাম । রুপাকে কাব্য ব্যাপারটা আরেকবার বলল । শেষে বলল “রুপা , তোর যদি পছন্দের কেউ না থাকে তাহলে আমরা খোজা শুরু করি” শুনেই রুপা নড়েচড়ে বসল । আমি মুখ টিপে হাসলাম । আস্তে করে বললাম “রুপা , দারোয়ান চাচার বড় ছেলে জামিলকে কেমন লাগে তোর ?” প্রশ্ন শুনে রুপা লাল হয়ে থাকল । আমাদের বুঝতে আর বাকি রইল না । কদিন ধরেই দেখছিলাম রুপা আর জামিল সময় পেলেই গল্প করে । কাব্যকে জানিয়েছিলামও । যাক , ধারণা যেহেতু সঠিক , সেহেতু আর দেরি না করে বিয়ের কথাবার্তা সেরে ফেললাম । দারোয়ান চাচা তো রুপাকে দেখে একপায়ে খাড়া , আর জামিল......ওর কথা নাই বা বললাম ।
রুপার বিয়ে হয়ে গেল । আবার সব কিছু করলাম আমি আর কাব্য । বিয়ের পর ওদেরকে নিচের তলায় একটা রুম দেয়া হল ।
বিয়ের পর স্বামীকে নিয়ে যত যা কথা সব শোনাত রুপা । রাত পর্যন্ত আমার সাথে থাকত , স্বামী ডাকলে লজ্জা পেয়ে চলে যেত । একদিন রুপাও এসে বলল সে মা হতে যাচ্ছে । শুনে আমি আর কাব্য অনেক খুশি , সাথে অধরাও না বুঝে লাফালাফি শুরু করল । সেদিন থেকে ঘরের কাজ থেকে রুপাকে অব্যাহতি দেয়া হল । আমি সারক্ষন ওর খেয়াল নিতাম । এভাবে কাটে গেল আরো আট মাস ।
একদিন সকালে রুপাকে নিয়ে জামিল হাসপাতালে রওনা দিল । হাসপাতাল বাসা থেকে রিকশায় বিশ মিনিটের পথ । সাবধানে যেতে বলে বাসায় এসে ঢুকলাম । দশ মিনিট যাবার পর রুপার ফোন আসল –
-বু...
-কিরে ? কিছু বলবি ?
-(হাসতে হাসতে) আচ্ছা বু , আমার ছেলে না মেয়ে হইব ?
-আমার তো মনে হয় ছেলে
-ছেলে হইলে নাম দিমু “স্বপ্ন” , কেমন হইল বু ?
-খুবি সুন্দর , তোর মত । কিরে , খুব আনন্দে আসিছ বোধহয় ?
-হ বু , আইজ তো আমার ঈ..................
প্রচণ্ড শধে কানা তালা লেগে গেল আমার । কিছুই শুনতে পারলাম না । একটু পর রাস্তার মানুষের চিৎকার ভেসে আসল । আমি ফোন রেখেই রাস্তার দিকে দৌড় দিলাম ।
হাসপাতালে বসে আছি । কাব্য আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে । কাদতে কাদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি । অধরা আমার দিকে তাকিয়ে আছে , বুঝতে পারছেনা মামনির এটা কোন চেহারা । এর সাথে একদমই পরিচিত নয় আমার ছোট্ট মেয়েটা । আমিও ছিলাম না , কিন্তু এখন আছি । ওদের রিকশাটা বাসের ধাক্কা খেয়ে উলটে যায় । জামিল স্পটডেড । রুপাকে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয় ।
ডাক্তার বের হলেন অপারেশন রুম থেকে । চেহারা দেখেই বুঝে গেলাম খারাপ কিছু ।
“পেশেন্টের ছেলে হয়েছে । ছেলে সুস্থ , কিন্তু মাকে বাচানো......”
আর কিছু শুনতে পারলাম না , দৌড়ে ঢুকলাম রুমে । রুপা শুয়ে আছে , পাশে রুপার স্বপ্ন । ডাক্তার ইশারায় বললেন আর বেশিক্ষন সময় নেই । আমি রুপার হাত ধতে বসে থাকলাম । কাব্য এসে ঢুকল । ওর চোখে পানি এই প্রথম দেখলাম । আমার কিছু বলার ছিলোনা । রুপাই সব বলল –
“”বু , কাইদতেছ ক্যান ? দেখ , আমার ছেলেই হইসে , তুমি বইলসিলে । ও নাম স্বপ্নই রাইখ । বু , আমি বাচবোনা , তাইনা ? জানি । কি করব কও , ওপরওয়ালা আমারে যা সুখ দেওয়ার দিয়ে দেসেন , আর কত ? আমি তোমার মত বোন পাইয়ে অনেক খুশি । আর দুলাভাই , তুমি তো মাটির মানুষ । আমার বোনরে দেইখে রাইখ । অধরা মা রে , কাছে আয় । তোরে অনেক ভালবাইসছিলাম । মা রে ভুইলে যাইসনে । বু , আমার ছেলেটারে নিয়ে যাও । তোমার কাছে রাইখে দিয়ো । আমি ওর ভিতর থেইকে তোমারে দেখবনে । জানো বু , আইজ আমার একটুও হইতেসে না , আইজ তো আমার ঈদের দি......ন ”
আস্তে করে নিস্তেজ হয়ে গেল রুপা । চোখের দু ফোটা বেয়ে জল নেমে এল ।
কাব্য হু হু কাদল । আমার অধরা মামনিটাও কাদল । শুধু মা মা করতে থাকল । কাদলাম না শুধু আমি ।
তখন কেবল সন্ধ্যে হয়েছে । কাব্য গাড়ি চালাচ্ছে , ওর কোলে অধরা ।
আর আমার কোলে স্বপ্ন , রুপার স্বপ্ন ।
রুপা ,
আজ তোর ছেলে , আমাদের ছেলের দু বছর হল । ও দেখতে ঠিক তোর মত হয়েছে । কিছু হলেই ঠোট ফুলিয়ে বসে থাকে , তখন ঠিক তোর মত লাগে দেখতে । তুই চলে গেছিস , কিন্তু স্বপ্ন তোর হয়ে বেছে আছে আমার মাঝে ।
এখনো বিকেল হলে ছাদে যাই , তোকে কল্পনা করে কথা বলি , হাসি । তোর ছেলে তখন আমার কোলে বসে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে । আমার মনে হয় , তুই তাকিয়ে থাকিস ।
এখনো রান্না ঘরে গেলে তোকে বলি মরিচের বাসনটা এগিয়ে দিতে , আবার সম্বিৎ ফিরে পাই । আমাকে অবাক করে দিয়ে অধরা মরিচের বাসনটা আমার দিকে এগিয়ে দেয় । ভাবি , তুই এগিয়ে দিস । 
এখনো তোকে দেখি আমার পাশে । আমার স্বত্তার ভেতর , নিজের মাঝে ।
__________________________________________________________________________________
ডায়েরি লিখে মাত্র কলমটা পাশে রাখে সাফা । বিকেল প্রায় শেষ । ছাদে আজ অল্প বাতাস , ঠান্ডা । পেছন থেকে অধরা আর স্বপ্ন দৌড়ে এসে সাফার কোলে ওঠে । অধরা মায়ের চোখে পানি দেখে জিজ্ঞেস করে –
-মা , তুমি কাদছ কেন ? কোথাও ব্যাথা পেয়েছ ?
-(হেসে ওঠে সাফা) না মা , আজ আমি অনেক খুশি । তাই ।
স্বপ্ন চুপচাপ তাকিয়ে থেকে বলে-
-মা , আজ কি তোমার ঈদের দিন ?
সাফা অবাক হয়ে স্বপ্নকে দেখে , ওর গভীর কাল চোখের ভেতর থেকে রুপা খিলখিল করে হেসে ওঠে ।
সাফা চোখ বুজে থাকে , আকাশের দিয়ে মুখ তুলে বড় শ্বাস নেয় , আর বলে –
-না রে সোনা , আজ শুধু আমার একার নয়............
আজ দুটো মায়ের ঈদের দিন ।
অধরা আর স্বপ্ন মায়ের কোলে পড়ে থাকে । সন্ধ্যে ঘনিয়ে আসে । রাত আরো গভীর হয় , অনুভুতিগুলো ছড়িয়ে পড়ে আকাশে বাতাসে ।

***************************************************************আমাদের বাসায় একজন কাজ করতেন । আমার মা তাকে ডাকতেন খালা বলে । আমি ডাকতাম দাদি । দাদি বয়সে মায়ের চেয়েও ছোট । আমার মা দাদির সাথে সারাদিন এটা ওটা নিয়ে গল্প করতেন আর কাজ করতেন । দাদি গরীব মানুষ ছিলেন , তাই আমার মায়ের ভালো ব্যবহারটাই তার কাছে অনেক ছিল । একদিন দাদি আমাদের সবাকে ফেলে অসময়ে চলে যান , রেখে যান দুটো মেয়ে আর একটি ছেলে । শিল্পী , ফারজানা আর মাহমুদুল । দাদি মারা যাবার পর থেকেই আমার মা প্রায় রাতে আমাকে পাশে রেখে কাদতেন । আমি এই ছোট্ট জীবনে কাজের লোকের প্রতি কারো এত ভালবাসা দেখিনি ,যেটা দেখেছি আমার মায়ের চোখে । প্রতি ঈদে দাদি আসতেন তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে , ঘুরতেন আমাদের বাসায় । দাদি মারা যাবার পর আমার মা শিল্পীর দায়িত্ত্ব নিলেন , ওকে লেখাপড়া শেখালেন । শিল্পী এখন প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমাদের বাসায় আসে , মাকে রুটি বানাতে সাহায্য করে , এটা ওটা বলে আর “বু বু” বলে ডাকে । আমি মাঝে মাঝেই ভাবি - রক্তের সম্পর্কের ছিটেফোটাও নেই , এত কিসের টান ?
বুকের ভেতর হতে উত্তর আসে “এটাই ভালবাসা”

By : Blockhead Hasnat(গল্পটি ভালো লাগলে Comment মাধ্যমে আপনার রায়টি জানাতে ভুলবেন না...)

No comments:

Post a Comment