Subscribe:

ভালবাসা যেখানে প্রতিধ্বনিত হয় …

ছোটবেলা থেকেই আমি ছোটখাটো সাইজের একজন পাগল । মানে অর্ধপাগল যাকে বলে আর কি ! কিন্তু আমার পাগলামিটা যে এইভাবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, সেটা অবশ্য আমি নিজেও ভাবিনি । তবে সমস্যা নেই । মাত্রা যদি নাই ছাড়ানো হল, তাহলে মাত্রা থেকে লাভ কি ! আর মাত্রার দামটাই বা থাকলো কোথায় !


তো মোটামুটি সেই মাত্রা ছাড়ানো পাগলামির তাড়নায় উঠে বসেছি যে বাসটিতে, সেটা এখন সমতল ছাড়িয়ে পাহাড়ি রাস্তা ধরেছে । আমি পাহাড় দেখছি । পাহাড় ! আমি খুব ভালোবাসি পাহাড় দেখতে !

ঠিক দুই বছর পর আমি আবার এই অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি শহরটিতে এলাম । এটাই সেই শহর ! যে শহরটি আক্ষরিক অর্থেই বদলে দিয়েছিল আমার জীবনটা ! ওলটপালট করে দিয়েছিল আমার সবকিছু ! আর আমার মাত্রা ছাড়ানো পাগলামিটারও উৎপত্তি এখান থেকেই !

প্রতিটি শহরে যেমন অলিগলি থাকে, ঠিক তেমনিভাবে কিন্তু মানুষের মনের ভেতরেও অনেক অনেক অলিগলি থাকে ! কিন্তু একজন মানুষের মনের এই অলিগলিগুলোতে কি আর ইচ্ছে করলেই কেউ ঢুকতে পারে ! পারেনা । আর আমার সমস্যাটাই হল ঠিক এইখানে ! আমার ভেতরটা যে কেন এতো ভারী ভারী লাগে ! কিছুতেই বুঝতে পারতামনা প্রথম দিকে ! তারপর সন্দেহ হল নিশ্চয়ই কেউ একজন চুপি চুপি ঢুকেছে আমার মনের গলিতে ! তাই শেষমেশ বাধ্য হয়ে নিজেই নিজের ওপেন হার্ট সার্জারিটা করে ফেললাম ! এবং আমার সন্দেহটাই অবশেষে সত্যি প্রমাণিত হল !

একটা সাদা পরী আমার মনের মাঝে ঢুকে মুখে হাত দিয়ে চুপটি করে বসে আছে !

এই মহা দুষ্টু পরীটার সাথে আমার দেখা হয়েছিল মাত্র একটিবারের জন্য । এই শহরে । ঠিক দুই বছর আগে । আমি পরীটাকে দেখেছিলাম শেষ বিকেলের এক চিলতে মায়াবী রোদে ! সবুজে ঘেরা এই পাহাড়ের কোলে, নির্জন এক রাস্তায় ! ডানাকাটা পরী ! ডানাকাটা সাদা একটা পরী ! যার ভেতরে অদ্ভুত কি যেন একটা ছিল ! কি যেন ! আমি জানিনা সেটা কি । আমি শুধু জানি, সাদা জামা পরা বাচ্চা বাচ্চা টাইপ একটা পরীকে, আমি সেই অদ্ভুত সুন্দর সময়ে দেখেছিলাম ! যার দিক থেকে আমি চোখ ফিরিয়ে নিতে পারিনি ! আমি অনুভব করেছিলাম তাকে সেই অল্প একটু সময়ের মাঝেই ! আর গ্রহন করেছিলাম অনেক বড় একটা আক্ষেপ । মানুষ কেন সময়কে ধরে রাখতে পারেনা ! যদি পারতাম, তাহলে সেই সময়টাকে ধরে রাখতাম আমি । আর নিস্পলক চোখে দেখে যেতাম আমার পরীটাকে !

পরীটাকে কিছু বলার সুযোগ আমি পাইনি । ওকে দেখার পরেরদিনই আমাকে ফিরে আসতে হয় । কিন্তু ফিরে আসার পরও প্রতিটি দিন, প্রতিটি সময় আমি ভয়ানকভাবে অনুভব করতাম পরীটাকে । প্রথম প্রথম ভাবতাম এটা মনে হয় একটা মোহ । সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু না ! যতই দিন যেতে থাকলো, পরীটা আরও বেশি করে আমাকে জ্বালাতে লাগলো ! কতভাবে চেষ্টা করলাম ! কিন্তু কিছুতেই কিছু হলনা । পরীটা পিছু ছাড়লনা আমার ।

 

বুঝলাম । অতি আতঙ্কের সাথে বুঝলাম যে, আমার সমস্ত জারিজুরি এবার শেষ ! এই আমি, জনাব ইনান কোনরকম পূর্বাভাস না দিয়ে, না বলে কয়ে ভয়ানকভাবে একজন সম্পূর্ণ অচেনা, অজানা মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছি ! শুধু পড়িনি ! রীতিমত আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ধপাস করে পড়েছি !

এবং ঠিক এভাবেই পাল্টে গেল অনেককিছু । অনেককিছু । সেই থেকে শুরু আমার জীবনের এক অন্যরকম অধ্যায়ের । নিসচুপ ভালোবাসার অধ্যায় ! অধ্যায়ের নায়ক আমি । আর নায়িকা অচেনা সেই সাদা পরী । আর আমার প্রেম কাহিনি ? সেটাও কি কম অদ্ভুত !

আমি প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াতাম । তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে পরীটাকে শুভ সকাল জানাতাম । ঠিক একইভাবে প্রত্যেক রাতে ওকে শুভ রাত্রি জানাতাম । ওকে চোখ বন্ধ করে অনুভব না করলে একটা দিনও আমার ঘুম আসতো না ! এছাড়া আরও কতকিছু যে করতাম ! যখন আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে করত, তখন আমি চুপ করে একটা জায়গায় বসতাম । পরীটাকে ডাকতাম । তখন আমার পরীটা উড়ে চলে আসতো আমার কাছে । তারপর আমার সামনে পা গুটিয়ে মুখে হাত দিয়ে চুপটি করে বসতো । তারপর ইয়া বড় বড় চোখ করে আমার দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো ! আমি তখন ওকে আমার যত রাজ্যের গল্প আছে, সেগুলো শোনাতাম । যদি আমার মন খারাপ থাকতো, তাহলে পরীটাও খুব মন খারাপ করতো । আর আমাকে খুশি দেখলে তিনিও সব কটা দাঁত বের করে একটা হাসি দিতেন ! এছাড়াও আমি পরীটাকে ডায়েরি লিখতাম । প্রতিদিন ! কত কথা যে ওকে আমি লিখেছি ! আমি নিজেই ওগুলো দেখলে মাঝে মাঝে আশ্চর্য হয়ে যাই !

 

এইভাবেই চলতে থাকে আমার অদ্ভুত এই ভালবাসা । একা একা, নিসচুপভাবে । আমার বন্ধুরা আমাকে কত যে বুঝিয়েছে ! ওরা বলতো যে, এটা কখনোই সম্ভব না । তুই ওকে চিনিস না জানিস না । কোনদিন খুঁজেও তো পাবিনা ! এভাবে জীবনটা নষ্ট করার কোন মানে হয় ! কিন্তু আমি ওদের কথাতে কখনোই পাত্তা দিতাম না । আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞাটা অন্যরকম । কাউকে ভালবাসলেই কি তাকে পেতে হবে ! না । ভালোবাসা মানে পাশে থাকা । সে জানুক না জানুক, তবুও চুপ করে প্রতিটি সময় তার পাশে থাকা ! তাকে অনুভব করা ! প্রতিটি মুহূর্তে ! আর সেটাই আমি করে গেছি এতোটা দিন । এটাই আমার ভালোবাসা । যার ইচ্ছা সে হাসুক না এটা দেখে ! পাগল বললে বলুক না ! কিন্তু আমি আমার মত করে ভালোবাসি ! আর আমার ভালোবাসাটা এমনই !

আর সেই ভালোবাসাটাকেই একটুখানি খুঁজে দেখার জন্য, আমার পরীটাকে দেখতে পাবার এক অসম্ভব আশাকে বুকে নিয়ে আমার আবার ফিরে আসা । এই শহরে ।

আমি জানি, পরীটাকে খুঁজে পাবার আর সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই । আমি তো ওর সম্পর্কে কিছুই জানিনা ! কিচ্ছু না ! এভাবে কি কখনো খুঁজে পাওয়া সম্ভব ! তবুও কি এক অদ্ভুত আশা মনে নিয়ে আমি ওকে খুঁজে বেড়াতে থাকি । পথে পথে । কেটে গেল চারটা দিন । কিন্তু পরীর খোঁজ মেলেনি । আমি চুপচাপ পাহাড়ি রাস্তা ধরে হেঁটে চলি । পরীটার কথা খুব বেশি মনে পড়লে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়াই পরীর জন্য লেখা আমার কবিতা,

 

“তুমি অস্পর্শী হয়ে এসেছিলে,

কিছু নিষ্পাপ মুগ্ধতা

আর ভালোবাসার অদ্ভুত সুবাস নিয়ে !

 

স্বপ্নের অলি গলিতে,

নির্ঘুম রাতজাগা আকাশের বুকে,

তুমি ছড়িয়ে দিয়েছিলে,

অর্থহীন স্বপ্নের বুনন ।

 

তুমি স্বপ্নকন্যা !

তুমি স্বপ্নে, অনুভবে

হৃদপিণ্ডের প্রতি স্পন্দন !

 

তুমি আমারই স্বপ্নকন্যা !

অস্পর্শী স্বপ্নকন্যা !”

 

পৃথিবীর জানালায় সূর্যটা উঁকি দেয়, তারপর আবার বিদায় নিয়ে চলে যায় । চাঁদের আলোতে মায়াবী প্রকৃতি আসে মরীচিকার মত । দূরের পাহাড়গুলো নীল থেকে ধূসর হতে হতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় কোথায় যেন ! আমি অবাক চোখে মহান সৃষ্টিকর্তার এই অদ্ভুত সৃষ্টি দেখি । আর আমার পরীটাকে খুঁজে ফিরি । ফিরে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসে । তবু সে অধরা থেকে যায় !

তবে সবচেয়ে সত্যি কথাটা কি, মানুষ যদি কোনকিছু একদম মনের গভীর থেকে চায় তাহলে সেটা সে একটা না একটা সময়ে ঠিক পেয়ে যায় ! আর আমি যে ওই মেয়েটাকে মনের অন্তঃস্থল থেকে অন্তত আর একটিবার দেখতে চেয়েছিলাম, সেটা আমি বুঝতে পারি অবশেষে আমার পরীটাকে দেখতে পেয়ে ! কি আশ্চর্য ! কি অদ্ভুত ! এটাও কি সম্ভব ! কিভাবে সম্ভব !

কিন্তু এটাই সত্য ! এটাই বাস্তব !

 

আমার সাদা পরীটা সেদিন নীল জামা পড়েছিল । নীল পরী ! আমি দৌড় শেষ করে পরীটার সামনে পৌঁছে রীতিমতো হাঁপাচ্ছিলাম । লম্বা একটা শ্বাস ফেলে পরীটাকে বললাম, “এই যে পরী ! দেখ বাপু ! আমাকে অনেক জ্বালিয়েছ । এবার একটু দয়া কর । শোনো, আমি ইনান । এবং আমি তোমাকে ভালোবাসি । আর তুমি আমাকে ভালোবাসো না বাসো, গ্রহণ কর না কর, সেটা নিয়ে আমার একটুও চিন্তা নেই । আমি যে ভালোবাসি এটাই যথেষ্ট ! বুঝেছ ? আর এই ডায়েরীটা নাও । এটা একটু কষ্ট করে পড়ে দেখো প্লিজ ! আমি আসি । টা টা !”

আমি বাজি ধরে বলতে পারি, ওইদিন পরীটার হা করা মুখ দিয়ে কমপক্ষে পাঁচ ছয়টা মশা তো ঢুকেছিলই ! আর পাহাড়ি মশা বলে কথা ! এ কি যে সে মশা ! বাবা রে !

এরপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন । আমি এখন ইউরোপে থাকি । পড়াশোনা করি । ইস ! এই পড়াশোনাটা যে কে আবিষ্কার করেছিল ! ব্যাটাকে যদি একবার পেতাম !

আমার পরীটার নাম হৃদি । হৃদিতা । ওরা এখন ঢাকাতে বদলী হয়ে এসেছে । উফফ ! মেয়েটা যে কি পরিমান বকবক করতে পারে ! ওনার জ্বালাতনে আমার কান দুইটা ঝালাপালা ! এই খাইছ, গোসল করছ, তুষারপাতের মধ্যে বাইরে কেন গেছো ! আরও কত্ত কিছু ! মেয়েটা পরীর রুপ ধরে আগে তো আমাকে জ্বালিয়েছেই, এখন আমার ভালোবাসার মানুষটা হয়েও আমাকে জ্বালাচ্ছে ! এইজন্য ওর নাম দিয়েছি জ্বালানী ! আমার সুইট জ্বালানী ! জ্বালানী পরী !

একটা সুখকর ব্যাপার কি, আমি যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ি সেটা একটা অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি শহরে অবস্থিত । আমার খুব প্রিয় কয়েকটা জায়গা আছে এখানে । যখন বাবা মায়ের কথা, হৃদির কথা খুব বেশি মনে পড়ে, তখন আমি আমার প্রিয় জায়গাগুলোর কোন একটাতে যাই । বরফ ঢাকা চূড়াগুলোর দিকে চুপ করে তাকিয়ে থাকি ।


আমার হৃদিকে আমি পেয়েছি । তাই বলে কিন্তু আমার সেই অন্যরকম ভালোবাসাটা হারিয়ে যায়নি ! ওটা যেভাবে ছিল, ঠিক সেইভাবেই আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি । আমি এখনও সকাল বিকাল আমার সাদা পরীটার খোঁজ নিই ! মনে মনে । কল্পনাতে । আকাশের দিকে তাকিয়ে গল্প করি, কথা বলি ওর সাথে । পাহাড়চূড়ার দিকে তাকিয়ে কবিতা শোনাই ওকে । আর আমার চিৎকার করে বলা “ভালোবাসি” কথাটা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে । হোক না এগুলো পাগলামি মার্কা কাজ ! তাতে কি হয়েছে ! আমার ভালোবাসাটা যে এইরকমই !

আমার ভিনদেশী বন্ধুরা মাঝে মাঝে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে, আমি এভাবে পাহাড় আর আকাশের দিকে তাকিয়ে মাতৃভাষায় কি বলি ! আমি ওদেরকে বলি, জানো ! পৃথিবীর ওই প্রান্তে একটা খুব সুন্দর দেশ আছে । বাংলাদেশ ! ওইখানে বাস করে একটা পরী ! সাদা পরী ! খুব দুষ্টু ! ওকে আমি আকাশপথে কথা পাঠাই, গল্প শোনাই । আরও কি কি করি জানো ……”

ইসস ! ভালবাসা জিনিসটা কেন যে এত সুন্দর !

 

 Minhazul Abedin

 FB ID : miinhaz rabbii

No comments:

Post a Comment