Subscribe:

শেষের কথা

রমনা পার্কে বসে বসে চানাচুর ভাজা খেতে খেতে একটা গান মনে পড়ে গেলো – তুমি আর নেই সে তুমি।আকাশে তখন ফুলমুন চলছে, আমি চানাচুর খাই আর চাদের দিকে তাকিয়ে হাসি।বেঞ্চে এভাবে বসে থাকতে থাকতে যখন একটু ঘুমের ভাব হলো, ঠিক তখন আফজাল এসে গায়ে একটা ধাক্কা দিলো।আফজাল রমনা পার্কের একজন বিশিষ্ট টোকাই।এইখানে গুড়ি টোকাইদের জন্য সে নেতাগোছের একজন মানুষ।১১ বছর বয়সী এই টোকাই বালকের বাবা মা সবই আছে।তার বাবা নিজের টাকায় কেনা রিকশা চালায়।তবুও কেন আফজাল টোকাইয়ের কাজ করে তা ভেবে আমি অনেক অবাক হই।আমি একদিন ওকে জিজ্ঞেস করে ঘটনা জানলাম।কষ্ট পেয়েছিলাম বেশ।


আফজালের বয়স যখন পাচ বছর, তখন সে তার বড় বোনকে শিরিনকে নিয়ে রাস্তায় আইসক্রিম খেতে বের হয়েছিলো।রাস্তা পার হওয়ার সময় বিশাল বড় একটা ট্রাক দুইজনকে ধাক্কা দেয়।রাতের বেলা মনে হয় ড্রাইভার সাহেব চোখে দেখেননি।শিরিন তার ভাইকে বাচাতে ট্রাকের সামনে থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।নিজে এরপর লাফ দেয়ার আগে ড্রাইভার সাহেব শিরিনের উপর গাড়ি চালিয়ে দেয়।আফজালের মাথায় তখন কিছুই ঢুকেনা।সে পা ভেঙ্গে রাস্তায় বসে কাদতে থাকে।ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে আফজালের ভাঙ্গা পায়ে জোরে একটা লাথি কষায়।মা বাপ তুলে গালি দেয়।শিরিনের লাশ নিয়ে পাশের ব্রিজে ফেলে দেয়।পানিতে ঝপাং শব্দ হয়।আফজালকেও ফেলে দিতে চেয়েছিলো, হেলপার সাহেবের অনুরোধে সেটা আর হয়নি।আরেকদফা আফজালের মা বাপ তুলে গালি দিয়ে ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে পলায়ন করে।নিশুতি জনশূণ্য রাতে এমন একটা ব্যাপার ঝটপট হয়ে গেলো, কেউ দেখলোনা।

আফজালের বোনকে কোথাও না পাওয়া গেলে ওদের বাবা মা রমনা পার্কে ঠিকই ওকে পেত।রমনা চাইনীজে ওর বোনের ভালোবাসার মানুষ বাস করতো।বাবা মা বকা ঝকা করলেই ওখানে এসে পড়তো, তার ভালোবাসার মানুষের সাথে গল্প গুজব করতো।ইয়াসিন খুব লাজুক ছেলে ছিলো।শিরিনকে বলতো, পালায় যায়া বিয়া করমুনা।তোমার বাপে মায়ে আমারে খুব পছন্দ করে।

আফজাল এখনো তার বোনকে খুজে।সে ইয়াসিনের পাশে বসে মাঝে মাঝে বোনকে নিয়ে গল্প করে।ইয়াসিন বিয়ে করেনি আর।তার পাকস্থলীতে ক্যানসার ধরা পড়লে রমনা চাইনীজ থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়।এখন সে নিজেও একজন টোকাই।আফজালের সাথে সাথে ঘুরে, কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায়।আজ অবশ্য সে আফজালের সাথে নেই।আমি আফজালকে জিজ্ঞেস করি, কিরে বেটা রাতে ডিনার করছোস?
আফজাল হাসে।আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “ভাইয়ু লাঞ্চ কইর‍্যা একটা বিশাল ভুড়ি বানাইছি।আইজ আর রাতে খামুনা”।
আমি জিজ্ঞেস করি, “ইয়াসিন কই?ওর শরীর কেমন?”
আফজাল আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে, “কাইল ওরে দাফন দিয়া আসছি।সিরাজগঞ্জ গিছিলাম”।
আমি কিছু বলিনা।মনে মনে একটা কবিতা আবৃত্তি করি –

“আমার তোমার আকাশে হাজার লক্ষ তারা
আমি তার আলো দেখতে পাইনা
ওই আলো কেড়ে নিয়েছে আধার নিশুতি
তারাগুলো তাই তোমাকে দিলাম, আমি কিছু চাইনা”

আফজাল আকাশের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুজে, আমিও খুজি।আমি খুজি আমার মাকে।আমার মা রাধানগর নামের একটা ছোট্ট গ্রামে হয়তো এখন মাথার ঘামে জর্জরিত হয়ে ভাত রাধছে।একবাটি ডাল আর একমুঠো ভাত পেলেই আম্মা খুশি।আমি এই শহরে আসার মূল কারণটা কিন্তু আমার মা।মার অনেক ইচ্ছা ছিলো আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে।বিশাল বিশাল পড়াশোনা করে আমি আমার বাবাকে সাহায্য করবো।তাকে আবার নতুন করে গান গাওয়ার অনুপ্রেরণা দেবো।আমার এসব মনে হলে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়।আমার মায়ের এই বড় বড় স্বপ্নের কাছে আমি নিতান্তই ক্ষুদ্র এক সত্ত্বা।

বাবার ব্যাপারে কিছু বলি।আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করার আগে ভয়ংকর সুন্দর গান গাইতেন।বাবার গান রেডিওতেও শোনা যেত।আমি যখন অনেক ছোট্ট বাবা কিভাবে যেন অসুস্থ হয়ে পড়লেন।বাবার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ বন্ধুরা কেউ উকি দিয়েও আমাদের দেখেনি।আমার কোমলমতি মা পুরো পরিবারের হাল ধরলেন।আমরা যে খুব দরিদ্র ঠিক তা না।পারিবারির সূত্রে পাওয়া সব সম্পত্তিগুলোর দেখাশোনা করে আমাদের বেশ ভালোই চলে যেত।আমার বোনকে বিয়ে দেয়ার পর থেকে আমি অনেকটা একা হয়ে যাই।পুনরায় একাকীত্ব বোধটা ফিরে আসে যখন কলেজ শেষ করে ঢাকা শহরে আসি প্রকৌশলবিদ্যা পড়ার জন্য।এম.আই.এস.টিতে আমার প্রথম ক্লাসে আশেপাশের অপরিচিত জ্ঞানী জ্ঞানী মুখগুলো দেখে ঘাবড়ে যাই।এক সপ্তাহ পর এই ছেলেগুলো আমার বিশাল বন্ধু হয়ে গেল।আমার একাকীত্ব কিছুটা কাটলো।আপু ঢাকার ধানমন্ডি শংকরে থাকে।মাঝে মাঝে আপুর শ্বশুরবাড়ি যেতাম।মাঝে একসময় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলাম ভয়ে।আমার আপুর ছোট ননদ আমাকে প্রেমপত্র দেয়ার পর থেকে সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকতাম দুলাভাই জেনে গেছে।

একদিন দুলাভাই আমাকে ডাকলেন তাদের বাসায়।দিনটা ছিলো শুক্রবার।আমি জুম্মাহর নামাজ পড়ে দুরুদুরু বুকে দুলাভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম।দুলাভাইয়ের বাসার মানুষজন তখন খেতে বসেছেন।আমাকে দেখে তাদের বাসায় হুলুস্থুল পড়ে গেলো।দুলাভাইয়ের মা আমাকে আদর করে খেতে বসালেন।নিজে গরুর হাড্ডিওয়ালা গোশত থালায় বেড়ে দিয়ে বলেন, “অভ্র তুমি এতো শুকিয়ে গেছো কেন বাবা?”
আমি খাওয়া দাওয়ার মাঝে হাচড় পাচড় করতে করতে বলি, “মাওইমা আমার ওজন গত তিনমাসে ৬ কেজি ২০০ গ্রাম বাড়ছে।এখন একদম ফিট আছি”।
পাশ থেকে সোমা, দুলাভাইয়ের বোন পিচিক করে হেসে দিলো।আমি সোমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাই।সে একটা কমলা রঙের জামা পড়ে আছে।আমার খাওয়া স্টপ হয়ে গেলো। আমি কোনরকমে হাত ধুয়ে ড্রইং রুমে যেয়ে বসলাম।দুঃখের ব্যাপার সোমাও আমার পিছু নিলো।আমার পাশে বসে বললো, “তুমি আমার চিঠিটা পড়ছো?”
আমি বললাম, “না।আমার এইসব পড়তে ভালো লাগেনা”।
সোমা মুখে হাত দিয়ে হেসে বলে, “আচ্ছা পড়তে হবেনা।আমাকে ফেরত দিয়ে দাও।আমি আরেকজনকে চিঠিটা দেবো”।
আমি পকেট থেকে চিঠিটা বের করে সোমার হাতে দিলাম।সোমা এরপর একটা অদ্ভুত কাজ করলো।আমাকে ঠাস করে একটা চড় মারলো গালে।আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম।ওর দিকে আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম, “মারলা কেন?”
সোমা ফুপিয়ে ফুপিয়ে বললো, “চিঠিটা ৫ বছর ধরে লিখেছি এটা জানো?তোমাকে ভাইয়ার বিয়েতে প্রথম দেখে সেদিন এই পাতাতে লিখেছিলাম প্রিয় অভ্র।আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা তোমাকে দিছি।আমি যখন কিছু বুঝতামনা ভালোবাসা কি তখন থেকে তোমাকে শুধু চাইছি।আর আজকে তুমি এমন করলা? আমার চিঠিতে তুমি তরকারীর ঝোলের দাগ ফালাইছো।কুচড়ে মুচড়ে এখন আমাকে ফেরত দিছো।আমার তোমাকে তো খুন করা উচিত।তুমি আমার সাথে এমন করলা কেন?”
আমার তখনও চড়ের দাপটে মাথা ঘুরছিলো।আমি কোনরকমে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “সরি”।
ও আমার গালে হাত দিয়ে রাখলো অনেকক্ষন যেখানে চড় মেরেছিলো।ওর চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি পড়ছে।আমি হতভম্ব হয়ে ছাগলের মত বসে বসে ভাবছি পাশের দরজা দিয়ে দৌড় দিবো নাকি।এখন যদি ওদের বাসার কেউ দেখে ফেলে।হায় হায় আমার কি হবে?
এভাবে কতক্ষণ কেটে গিয়েছিলো আমি জানিনা।আমি চোখ বন্ধ করে ভয়ে ভয়ে চুপচাপ বসে ছিলাম।একটা ঘোরের মত সময়গুলো চলে যাচ্ছিলো।আমার কি হয়েছিলো জানিনা।আমি হঠাৎ করে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ফেললাম।ও আমার একদম কাছে এসে কাধে মাথা রেখে বললো, “অভ্র তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেওনা”।
আমি ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলাম, “যাবোনা”।

আজকে অনেকদিন পর আবার আমার আর সোমার প্রিয় বেঞ্চে বসে ওকে মনে মনে বললাম, “প্রিয় সোমা আমি কথা রেখেছি।তুমি রাখোনি"।

সোমার কাল বিয়ে হয়ে গেছে ওর এক ক্লাসমেটের সাথে।সেদিন আমি ঘোরের মধ্যে ছিলাম, আজও আছি।ও এইতো মাত্র একটা বছর আগে হঠাৎ করে কেমন যেন হয়ে যেতে থাকলো।আমি ওকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি হয়েছে, আমায় বলো।ও কিছু বলতোনা।একদিন হঠাৎ করে শুধু আমাকে বললো, ওর জন্য ওদের ক্লাসের এক ছেলে হাত কেটে ফেলছে।ছেলেটা নাকি স্কুল জীবন থেকে ওর বন্ধু।এই কথাটা ও কিভাবে যেন বলছিলো।আমি বুকে একটা বিশাল ধাক্কা খেলাম।আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা আমার নেই।তারপর একদিন সোমা আমাকে বললো, ছেলেটার জন্য ওর খুব কষ্ট লাগে।ওকে নাকি ছেলেটা পাগলের মত প্রতিরাতে ফোন করে কান্নাকাটি করে।

তারপর আরো একদিন আমি ওকে বললাম, “সোমা তুমি চাইলে আমাকে মুক্তি দিতে পারি।এটা কোন ব্যাপার না”।

সোমা সেদিন একটা কথাও বলেনি।চুপ করে উঠে চলে গেলো।আমি ৩৬ ঘন্টা সেই একই বেঞ্চে বসে বসে সোমার জন্য কেদেছি।মনে মনে সুনীল সাহেবের কবিতা আবৃত্তি করেছি,

“ভালোবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাড়ের চোখে বেধেছি লাল কাপড়
বিশ্বসংসার তন্ন তন্ন করে খুজে এনেছি ১০৮টা নীল পদ্ম
তবুও কথা রাখেনি বরুণা, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে কোন নারী
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশটা বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনা”।

প্রিয় সোমা যেখানে থাকো ভালো থাকো।আমার তোমার প্রতি কোন দাবী নেই।

ও চলে যাওয়ার পর থেকে প্রতিদিন একা একা এই বেঞ্ছে বসে থাকি।আমি ওর কথা ভাবি।ওর সাথে সাড়ে তিন বছর ধরে আবর্তিত সব ঘটনাগুলো জট পাকিয়ে যায়।একসময় উঠে বসি।বাসায় ফিরতে হবে।আমি পাশ করে একটা ছোট্ট চাকরী পেয়েছি।একটা বাসাও ভাড়া নিয়েছি এক রুমের।মাকে আর বাবাকে নিয়ে আসবো শহরে।তাদের ছাড়া ভালো লাগেনা।আমার বোন মাঝে মাঝে ফোন করে।আমার কাছে ও বারবার ক্ষমা চায়।আমাকে বলে দুলাভাই নাকি এখন আমার সাথে কথা বলতে লজ্জা পায়।সে আমার কাছে ক্ষমা চাইতে বলছে।আমি ওকে বলি, “আপু তুই এইসব বলার জন্য আরেকবার যদি ফোন করিস ধানমন্ডি যেয়ে তোকে খুন করে আসবো”।

বাসায় ফেরার পর আমার কাছে ফোন আসে শাহী ভাইয়ের।আমার একটু মঞ্চনাটক করার অভ্যাস আছে।শাহী ভাই আমাকে দিয়ে প্রায়ই ছোটখাটো পার্ট করায়।বড় প্লে আমি করতে পারবোনা।একজন প্রোটাগনিস্টের যে সময়টা দিতে হয় সেটা দেয়ার মত ইচ্ছা বা ধৈর্য কোনটাই আমার নেই।আমি শাহী ভাইকে ফোন ধরেই বলি, “শাহী ভাই, মাফ চাই।আমার দ্বারা নাটক হবেনা”।

শাহী ভাই আমাকে ভয়ংকর গালি দিয়ে বললেন, “তোরে কেন তোর বউরে বাচ্চারে দিয়েও হবে”।

আমি কথা বাড়াইনা।শাহী ভাইকে কাল দেখা করবো বলে ফোনটা রেখে দেই।আজকে একটা বিশাল ঘুম দিতে হবে।ঘুম থেকে উঠে গোসল দিয়ে নামাজ পড়ে আবার একটা ঘুম দেবো।ঘুম আর ঘুম।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে প্রথম যেটা মনে হলো ঘরে খাবার কিছু নাই।আমাকে বাসা থেকে নিচে নেমে মনসুর ভাইয়ের দোকান থেকে ডিম কিনে ফ্রাই করে খেতে হবে।রুটি পরোটা আমি সকালবেলা কেন যেন কখনো খেতে পারিনা।মেজাজ খারাপ করে ডিম ফ্রাই করে বাসা থেকে বের হলাম।কেন যেন আবার ঘুমাতে ইচ্ছা করলোনা।

প্রগতি নাট্য সংঘের প্রধান নাট্য নির্দেশক শাহী ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে প্রথম যে কথাটা বললাম তা হলো ক্ষিদা লেগেছে।শাহী ভাই আমার পাশে এসে কাধে হাত দিয়ে বললেন, “অভ্র তুই যে কত ভালো একটা আর্টিস্ট এটা বুঝিস?একটু সময় দিতে চাস না কেন?এইসব নাটক আমি হাউসে চালাই কি পয়সার জন্য?এগুলা তো মনের খোরাক।নিজের মাঝে যে একটা মানুষ বাস করে ওটাকে বাচায় রাখতে হবেনা হা?”
আমি ভিলেন টাইপ একটা হাসি দিয়ে বললাম, “ভাইজান আমারে দিয়ে এইসব হবেনা।আমি এমনেই বেশ বেচে আছি”।
শাহী ভাই একটা ব্যঙ্গাত্বক হাসি দিয়ে পিছন ফিরে একটা মেয়েকে ডাকলেন।আমি যখন প্রথমবার মেয়েটাকে দেখলাম একটা ধক করা অনুভূতি হলো।খুব সাধারণ একটা মেয়ে।আমার যেটাতে ধাক্কা লাগলো তা হলো তার মাথার টিপ।ছোট্ট খয়েরি রঙের একটা টিপ একেবারে মাথার মধ্যখানে, ঠিক সোমার মত।শাহী ভাই মেয়েটাকে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন।আমি অন্য দিকে তাকিয়ে ছিলাম।মেয়েটার দিকে তাকাতে ইচ্ছা হচ্ছিলোনা।শাহী ভাই বললেন, “মেয়েটা আমার “শেষের কথা” নাটকে প্লে করবে।তোকে অভিনয় করতে হবে মেয়েটার বিপরীতে।করবি?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না করবোনা।আমি ঢাকার বাহিরে যাবো দুদিন পর।টানা দশদিন ঘুরে বেড়াবো রেমাক্রি আর তিন্দুতে।নীলগিরিতেও যাবো।স্যরি শাহী ভাই”।
শাহী ভাইয়ের এই প্রত্যাখান কেমন লাগলো জানিনা।কিন্তু মেয়েটার চোখের ভস্ম করা দৃষ্টি দেখে আমি সত্যি বললে ভয় পেলাম।মেয়েটা মেয়েটা করতে ভালো লাগছেনা।তার নামটা নাহয় বলি, অরুপা।অরুপা শাহী ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, “উনি বোধ হয় আমার সাথে কাজ করতে চাচ্ছেন না।আপনি নিতি আপুকে নেন”।

আমি একটু বিরক্ত হয়ে তাকে বললাম, “আগ বাড়িয়ে বলেন কেন?আমার কোন কথায় এমন মনে হলো?আপনি আমি নিতি, সবাই আর্টিস্ট।এখানে প্রেফারেন্স টাইপ কোন ব্যাপার নাই”।

অরুপা চুপ করে গেলো।নিজের একটু খারাপ লাগলো এভাবে কাউকে বলার জন্য।কেন যেন শাহী ভাইকে বললাম, “আমি নাটকটা করবো।আমাকে দুইঘন্টার মধ্যে পুরো নাটকের স্ক্রিপ্ট দেবেন।একটা দৃশ্যের জন্য একটা করে প্রিন্টেড পেজ।কম্পেন্ডিয়াম পরিষ্কার থাকে যেন, আমাকে কনফিউজড করবেন না”।
শাহী ভাই আমার দিকে ভ্যাবলা টাইপ একটা লুক দিয়ে বললেন, “ছাগলা যায়া নিজে স্ক্রিপ্ট বানায় নে।তোরে পার্ট দিচ্ছি এইটাই বেশি।দুইমাসের মধ্যে স্ক্রিপ্ট মুখস্ত করে কাজ শুরু করবি।আমার ১৪ই এপ্রিল নাটক নামাতে হবে।পল্টনে আবুল কালাম আজাদ ভাইয়ের নাট্য সঙ্ঘের সাথে কথা হয়েছে।উনাদের ব্যক্তিগত হলটা ভাড়া দেবে আমাকে অল্প টাকায়। আমার জীবনের বেস্ট একলেকটিক একটা শট দিবো এইবার”।

পরের দুই মাস আমার উপর দিয়ে ভয়ংকর ধকল গেল।প্রতিদিন অফিস শেষে আমি “শেষের কথায়” সময় দিয়েছি।গাধার মত আমার পার্ট মুখস্ত করেছি এবং বারবার ভুলও করেছি।অরুপা মেয়েটা আমার সাথে একদিনও ভালো ভাবে কথা বলেনি।আমাকে দেখলে সে মনে হয় যেন বিরক্ত হতো।নাটক নামানোর ঠিক দুদিন আগে এমন একটা ব্যাপার হলো যার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের একজন সম্ভাবনাময় ছাত্রীর কথা বলি শুনুন। তানজিনা আফিদ অরুপা, একটা চমৎকার মেয়ে।সে লিখালিখি করতো, কবিতার ছন্দ খুজে বেড়াতো।হালকা পাতলা গান গাইতো।সে সত্য বলতে দ্বিধা করতোনা, তাই মাঝে তার কলমে আগুন ফুটে উঠতো।দেশের একটা বিখ্যাত দৈনিকে মাঝে মাঝে সে লিখতো।তার শেষ প্রতিবেদন ছিলো, দুটো শিশুকে নিয়ে।এই শিশু দুটির একজনের নাম ছিলো আফসা আরেকজনের নাম ছিলো বুবুন।এরা পোস্তগোলা আরসিন গেটের সামনে এক দোকানে ঝুলানো রুটির টুকরা চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছিলো।বিবেকবান জনগণ এদের ধরে ফেলে।তারা তাদের শিক্ষা পেয়েছিলো।আফসা এখন আজিমপুর গোরস্থানে ঘুমিয়ে আছে।বুবুন ঢাকা মেডিকেলে পড়ে আছে।অরুপার চোখের সামনে ওই নিঃশংস ব্যাপারটা হয়েছিলো।সে শিশুগুলোকে বাচাতে এগিয়ে এসেছিলো এবং নিজেও বিবেকবান জনগণের নিঃশংসতার শিকার হয়েছিল।হাসপাতালে বসে বসে সে সেই শিশুগুলোকে নিয়ে লিখে, পত্রিকায় তা প্রকাশ পায়। আমরা সবাই সেই লিখাটি পড়ি।কারো চোখে পানি আসে, কারো মনে ঘৃণা।এতিম দুই পথশিশুর কিছু হয়না।
শাহী ভাই যখন অরুপার ঘটনা শুনলেন তখন তার মাথায় হাত।আমি তার সাথে কথা না বলে হাসপাতালের ঠিকানা নিয়ে অরুপাকে দেখতে গেলাম।আমার মনে তখন বিশাল ঝড়।নিজের ওপর ঘেন্না হচ্ছে।আমি মানুষ এটা ভাবতে ঘেন্না হচ্ছে।৯ বছরের আফসার মুখের কথা বারবার মনে হচ্ছে।আমি ওকে দেখিনি, কিন্তু আমি জানি রাস্তায় প্রায়ই যে মলিনমুখ ভুখা শিশুদের দেখা যায় তাদের থেকে ওর চেহারা খুব একটা পার্থক্য করবেনা।
আমি হাসপাতালে যখন পৌছাই তখন অরুপা ঘুমাচ্ছিলো।শতশত রোগী আশেপাশে, মাঝে একটা মলিন চাদর বিছানো বেডে ও শুয়ে আছে।ওর পাশে ওর থেকে একটু বড় একজন বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো।আমি তার কাছে গেলাম।তাকে জিজ্ঞেস করলাম “আপনি কে হোন ওর?”
তিনি শুষ্ক মুখে হেসে বললেন, “বোন ছাড়া কারো সাথে কারো চেহারার এমন মিল দেখা যায়?”
আমি হাসলাম।উনি এবার জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে?ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু”।
আমি মাথা নাড়ি।তাকে আমার পরিচয় দেই,অরুপাকে কিভাবে চিনি তাও বলি।সাথে এটাও বলি যে অরুপা আমাকে দুচোখে দেখতে পারেনা।
অর্পা আপু খুব চমৎকার একজন মানুষ।উনি আমার সাথে অনেকক্ষণ অনেক কিছু নিয়ে গল্প করলেন।অরুপার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানতে পারলাম।অরুপার কবিতার খাতাটা পর্যন্ত আমাকে দিলেন।এরপর আমাকে বসতে বললেন অরুপার পাশে।উনার নিচ থেকে কিছু ওষুধ আনতে হবে।আমি কথা দিলাম উনি না ফেরা পর্যন্ত পাশে বসে থাকবো।আমি অরুপার খাতাটা হাতে নিয়ে কবিতাগুলো পড়তে থাকি।একটার পর একটা পড়ি আর অরুপার ভিতরের নারীত্ব ও এর হাহাকারটা চোখের সামনে ভেসে উঠে আমার সামনে।আমি গুনগুন করে আবৃত্তি করি ওর একটা কবিতা,
“নীল সমুদ্রের জলে আমার পায়ের পাতা ভিজিয়েছি
আমার মনে তখন তোমার জন্য অজানা অনুভূতি
আমি তোমার হাতটা ধরে আমার মনটা আর্দ্র করেছি
কান পাতো আমার বুকে, শুনেছো কি তোমাকে পাবার আকুতি?”

অরুপা জেগে ওঠে, “আমাকে বলে আপনি এত সুন্দর করে কবিতা আবৃত্তি করেন?”
আমি একটু অবাক হই।অরুপার মুখে আমার জন্য ভালো কথা আসতে পারে ভাবিনি।আমি ওর কথার প্রত্যুত্তর দেইনা।ওকে জিজ্ঞেস করি, “আপনি কেমন বোধ করছেন?”
অরুপা মাথা নাড়ে।আমাকে বলে, “বুবুন ১১ নং বেডে আছে।ওর কাছে যেয়ে একটু বসেন।ছেলেটা ঠিকমত শ্বাস নিতে পারেনা।ওর বুকে যখন লাথি মারে সবাই, জানেন আমার মনে হচ্ছিলো আমি দোজখে আছি এখন।৭ বছরের একটা ছেলেকে কেউ এভাবে মারতে পারে?”
অরুপার চোখ পানিতে টলটল করছে।বিড়বিড় করে কি যেন বলছিলো, ঠিক তখন অর্পা আপু এসে পড়ে।আমি বুবুনকে দেখতে যাই ১১ নং বেডে।টুকুনের মুখের একপাশে ব্যান্ডেজ করা, মাথায়ও ব্যান্ডেজ করা।ছেলেটা আসলেও শ্বাস নিতে পারছেনা, বুক ধড়ফড় করে উঠানামা করছে।আমি ওর মাথায় হাত রাখি।ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে।ওর মাথার একপাশের চুল দেখি উঠে গেছে।মানব জাতির একজন সদস্য হওয়ার সুবাদে আমার চোখে তার জন্য পানি এলো।মনে প্রচন্ড ঘৃণা এলো।মনে হলো যেই জানোয়ারগুলো এই অবুঝ শিশুকে একটা রুটির জন্য এভাবে মারতে পারে তাদের প্রত্যেকের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেই।

আমি সেখানে বসে থাকতে পারিনা।উঠে চলে আসি।অরুপার কাছে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে যাবো। এই অশ্লীল নগরীর সকল বাস্তবতা নিষ্ঠুরতা শ্বাপদসংকুলতা থেকে আমি এখন মুক্তি চাই।জাগরণে আমার আগুন বাড়বে, আমি নিজেই তাতে দগ্ধ হবো।ভীতু ইদুরের মত আমি আমার মাটি খুড়ে করা গর্তে আশ্রয় নিবো, নিজের আগুন ঢাকবো।আজ হোক আবার একটা ভীতু আত্নার বাচতে চাওয়ার জ্বলজ্বলে অন্ধকার প্রয়াস।
অরুপার পাশে দুতিনজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।তার মধ্যে একজন লাল পাঞ্জাবী পড়ে আছে।দূর থেকে তার কথা শুনে মনে হলো, পুরনো ঢাকার মানুষ।পান চিবোতে চিবোতে অরুপাকে বলছে, “আম্মাজান যা হইছে তা নিয়ে এত লিখালিখির কি আছে?”

অরুপা চোখ বড় বড় করে ওই লোকের দিকে তাকিয়ে আছে।আমাকে দেখে মনে হয় একটু সাহস পেলো।লোকটাকে বললো, “তুই সেই জানোয়ার না আসিফার গলা টিপে ধরছিলি?তোর জুতার দোকান না আমাদের গলিতে?”
ঢাকাইয়া লোকটা মুখটা কুৎসিত করে একটা বাজে গালি দিলো অরুপাকে।অশ্লীল ভাষায় কি যেন বললো।আমি যা বুঝলাম তা হলো, লোকটা একজন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ।সমাজ সেবা করা তার কাজ।আসিফা আর টুকুনের মত ভবিষ্যৎ ক্রিমিনালদের ট্রিটমেন্ট দিয়ে সমাজ পরিষ্কার করা তার লক্ষ্য। অরুপার মত এরকম দুই একটাকে দিয়ে সে তার পানের পিক মুছায়।এবার লোকটা আমার দিকে তাকায়।আমাকে বলে, “এই বেডিরে বুঝা বেশিকথা না কইতে।এমন হাল করমু, আল্লাহও ভি না আর দরদ করবো”।

আমি কাছে আগাই।হাতের সর্বশক্তি প্রয়োগ করে লোকটার ডান গালে একটা চড় দেই।অরুপার বেডের পাশে থাকা ফোরসেপটা হাতে নিয়ে জানোয়ারটার পাশের দুইজনের দিকে আগাই।দুটোই  ভয়ে পালিয়ে যায়।আমি মনে হয় এই সময়টায় খুন করতেও পিছ পা হতামনা।চড় খাওয়া জানোয়ারটা তখন মাটিতে পড়ে ছিলো হতভম্বের মত।আমি ওর দিকে ফোরসেপটা নিয়ে আসি।ওর চোখে আঘাত করতে চাই।কিন্তু নাহ, পারি না।ভিতরের মানুষটা বাধা দেয়।লোকটার দিকে তাকায় বলি, “তোর মত জানোয়ারকে মেরে ফেলা উচিত।কিন্তু এই জন্য যে জানোয়ারটা হওয়া দরকার আল্লাহ শুকরিয়া কর সেটা আমি না। আমি মানুষ, তোর মত জানোয়ারকে ভয় পাইনা”।

অরুপার সুস্থ হতে এক সপ্তাহ লেগেছিলো।বুবুনকে বাচানো সম্ভব হয়নি।একদিন আমি আর অরুপা বুবুনের কবর দেখতে আজিমপুরে গেলাম।নিজ হাতে এখানেই দুদিন আগে ওকে কবর দিয়েছি।মা বাবাহীন একটা পথশিশু, ওদের দিকে আমরা তাকাইওনা।দুটো টাকা চাইলে আমরা তাদের হাতে হয়তো তা ঠিকই দেই।কিন্তু একবারো ভাবিনা এমন ভিক্ষাবৃত্তি থেকে তাদেরকে কিভাবে মুক্ত করা যায়।বুবুন আর আসিফার মত এমন কত শিশু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আমরা এই দেশে অনেক বড় বড় নিষ্ঠুরতা হজম করে ফেলি, এই ব্যাপারটাও করে ফেলেছি।

অরুপাকে ওর বাসায় যখন পৌছিয়ে দিতে যাচ্ছি তখন অরুপা আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি?”
অরুপা আমাকে বললো, “আপনি কি আমাকে ওইভাবে পছন্দ করেন?”
আমি মাথা নাড়ি, “না।সোমা নামে একটা মেয়েকে খুব ভালোবাসতাম।ও তোমার মত করে মাথায় টিপ দিতো।ঠিক মাথার মধ্যখানে”।
অরুপা আমার থেকে চোখ সরায়না।আমাকে বলে, “আমাকে ভালোবেসে লাভ নাই।আমি সারাদিন নিজের এই সেই কর্মে ব্যস্ত থাকি।আমার পরিবার জিনিসটা ভালো লাগেনা।একটা আবদ্ধ আবদ্ধ ভাব।ভাবছি বিয়ে শাদী করবোনা।আপু আর দুলাভাইকে বুঝানো যাবে নাহয় পরে”।

আমি মাথা নাড়ি।আমার তখন ওর কথার দিকে খেয়াল ছিলোনা।কি যেন ভাবছিলাম।হঠাৎ করে রিকশাটা দুলে উঠলো।আমি খপ করে অরুপার হাত ধরলাম।অরুপাও আমার হাত ধরে থাকলো।এভাবে কিছুক্ষণ পার হওয়ার পর আমি ওর হাত ছেড়ে দিলাম।ওর বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি ঠিক করলাম মেয়েটার সাথে আর কথা বলবোনা।কেন বলবো?আবার ধাক্কা খাওয়ার জন্য?

শহীদ মিনারের সামনে আমি নীল পাঞ্জাবী পড়ে বসে আছি।হাতে একটা বিশাল সাইনবোর্ড, এখানে যারা আছে তাদের সবার থেকে বড়।একটু পর একটা বিশাল ট্রাক এলো।আমি ট্রাকের উপর উঠে দেখি বিশাল বিশাল আম কাঠালের ডালি।আজ আমরা যাবো রাঙ্গামাটির পাহাড়ি অঞ্চলে।বিশাল দূরত্ব।কিন্তু আমি জানি যখন পাহাড়ি ঝর্ণার পাশ দিয়ে তার প্রবাহিত হবার শব্দ শুনতে পাবো, সবুজ টিলার ঘ্রাণ আমাকে যখন উদ্বেলিত করবে তখন আমি মহাকালে আটকে যাবো। আমি সেই রহস্যময়তার খোজে পাড়ি দেব দূর বহুদূর।

পরেরদিন খুব ভোরবেলা যখন আমরা হাতভরা বিশাল বিশাল আম কাঠাল নিয়ে রাস্তায় নেমে আসলাম তখন আমাদের মনে অজানা আনন্দ।রোদ উঠি উঠি করছে, আমরা কিছু অবুঝ তারুণ্য তখন ভালোবাসার চকচকে চোখ নিয়ে পাহাড়ি শিশুদের ডাকছি।প্রথম প্রথম সবাই একটু ভয় পেলো,কিন্তু একটু পর সব কচিকাচা তাদের বিশাল বাহিনী নিয়ে আমাদের কাছে উপস্থিত হলো।আমরা তাদের হাতে একটা করে ফল দেই। তারা আনন্দে সেই ফল নিয়ে তাদের গালে লাগায়, টস করে কামড় দেয়।একটু বড় সড় যারা তাদেরকে কাঠাল দেয়া হলো।আমরা একের পর এক প্রত্যন্ত অঞ্ছলে ছুটে বেড়াই।আমি তখন বারবার বুবুনকে খুজি।বুবুনের মত মুখগুলো দেখলে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে রাখি।মনে মনে বলি, বুবুন বাবা সামান্য একটা রুটির জন্য তোমাকে হায়েনারা হত্যা করলো।তোমার ওই ক্ষুধার কসম, তাদের আমি ক্ষমা করবোনা।

একটা মাঝারী উচ্চতার টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছি।হাত বাড়িয়ে না ছুতে পাওয়া সূর্যাস্তের অপরূপ মোহময়তা আমাকে বারবার গ্রাস করে, কোন এক অদ্ভূত জগতে নিয়ে যায়।খুব টিলার উপর থেকে পড়ে যেতে ইচ্ছা করছে।যখন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি লাফ দেবো ঠিক তখন ফোন এলো অরুপার।আমি বিরক্ত হয়ে ওর ফোন ধরি।অরুপা ফোন ধরার সাথে সাথেই বললো, “আপনাকে দেখতে ইচ্ছা করে অভ্র”।
আমি জিজ্ঞেস করি, “কেন”?

অরুপা কিছু বলেনা, আমি ওর দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই।একটু পর বলে, “আজকে বুবুন আর আফসার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।আপনার কথা খুব মনে পড়ছিলো।সেইদিনের পর আপনি প্রতিদিন হাসপাতালে যেয়ে বসে থাকতেন।বুবুনের পাশে কিছুক্ষণ, আমার পাশে কিছুক্ষণ।কেন এমন করতেন?”

আমি অরুপাকে কিছু না বলে ফোন কেটে দেই।আমার অণুর কথা মনে পড়ে। অণু আমার থেকে দু বছর ছোট ছিলো।হঠাৎ করে একদিন ও হারিয়ে যায়।একেবারে হারিয়ে যায়।আমি ওকে অনেক খুজেছি, সবখানে খুজেছি।কোথাও পাইনি।বুবু এখনো কাদে অণুর কথা ভেবে।মা যে আড়ালে প্রায়ই বাবার পাশে বসে অণুর জন্য কাদে আমি সেটাও জানি।আমি কখনো কাদিনা।আমার মনে হয় এইতো অণু এখনই আমার কাছে দৌড়িয়ে এসে কিল ঘুষি দেবে।বুবুনকে দেখে আমার অণুর কথা মনে পড়ে, অণুর মত বুবুনও হারিয়ে গেছে।আমি এই কথাগুলো অরুপাকে এভাবে বলতে চাইনা।আমি একদিন ওর হাত ধরে ভরা পূর্ণিমা দেখবো, ওকে আমার ভিতরের অসহায় মানুষটার গল্প শুনাবো।আমি ওকে যে কষ্টগুলো নিজেকেও বলিনি বুঝায়নি সেগুলো সবটুকু জানাবো।আমি জানিনা অরুপা আমার কবিতা শুনবে কিনা, কিন্তু আমি আমার সবগুলো কাব্য শুধু ওর জন্য লিখবো।কারণ আমি যে তাকে কখন থেকে, কেমন করে কতটা ভালোবেসে ফেলেছি নিজেও যে জানিনা।অরুপা তুমি অপেক্ষা করো।



******************************************************************

গল্পটা শুধুই তোমার জন্য।



-সাদ আহাম্মেদ

1 comment:

  1. osadharon lekha…………parhaps,eitai,aam utsob er ekta part………onk valo laglo………r ektu kosto o………jototuku shamortho,thik tototuku krte partc na………:(

    ReplyDelete