Subscribe:

কেন মিছে নক্ষত্রেরা জেগে থাকে...

১.
দুপুরের শেষ বেলা প্রায়। রোদ মরে যেতে শুরু করেছে। মাসুদের খুব ঘুম ঘুম লাগছে। বার পাঁচেক সে হাই ও তুলে ফেলেছে। কিন্তু ও খুব ভালো করেই জানে যে আর একবার হাই তোলার চেষ্টাও যদি ও করে তবে ওকে বেদম মার খেতে হবে। রেস্টুরেন্টে আজকে তারা সব বন্ধুরা একসাথে হয়েছে বেশ অনেক দিন পর। হীরক টেবিল বাজিয়ে গান গাচ্ছে...ওপাশে তৃষা বসে ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে। সাকিব আর কামরুল জয়িতার সাথে গল্প করছে। আজকে জয়িতা তার জন্মদিন উপলক্ষে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে।


জয়িতাকে আজকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে, কালচে নীল পোষাকে তাকে দেখে মনে হচ্ছে সমুদ্রের গভীর জল। তার মাঝে চোখের কাজলটা কেমন যেন মায়া মায়া ভাব এনে দিয়েছে। আপনমনেই মাসুদ চোখ সরিয়ে নিলো জয়িতার দিক থেকে। এই মেয়েটা কে সে অনেক দিন থেকেই মনে মনে অসম্ভব পছন্দ করে, কিন্তু তা প্রকাশ করেনা। ঢাকার সব চেয়ে অভিজাত এলাকায় থাকা জয়িতাকে তার রূপকথার রাজকন্যা মনে হয়। যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা যায় কিন্তু বাস্তবতায় মেলানো যায়না। আজ পকেটে মাত্র ১২৭ টাকা আছে মাসুদের। মাসের শেষ প্রায়, কোচিং থেকে টাকা পায়নি সে এখনো। কবে পাবে তারও ঠিক নেই। জয়িতার জন্যে সবাই গিফট এনেছে। কিন্তু সে আনে নাই। আনার মত আসলে চিন্তাও ছিলনা। সে গত এক ঘণ্টা ধরে শুধু হাই তুলছে আর সবগুলো বন্ধুর হাসি হাসি চেহারা উপভোগ করছে। তার কাছে মনে হচ্ছে এইভাবেই অনন্তকাল কেটে যাক। এমন চিন্তাহীন থাকার দুঃসাহস সে এই মানুষগুলো সাথে থাকলেই শুধু করতে পারে।

আড্ডা জমে উঠেছে চরমভাবে, এমন সময় বিকট শব্দে মাসুদের সেলফোনটা বেজে উঠলো। হীরক টেবিল বাজানো বন্ধ করে চোখের ইশারাতে বলল এখন কোন ফোন না ধরতে। মাসুদ সেলফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আম্মা ফোন করেছে গ্রামের বাড়ি থেকে। সাত পাঁচ ভেবে সে ফোনটা ধরে-


-মাসুদ, তুই কি বাবা বাইরে? অনেক চিন্তিত আর ক্লান্ত শোনায় মাসুদের মায়ের কণ্ঠ।
-কি হইসে আম্মা?
-তুই কি কালকে একটু বাড়ি আসতে পারবি?
-কিছু হইসে তোমার? আব্বার শরীর কি আরও খারাপ হল নাকি?
মাসুদের কণ্ঠে অস্থিরতা ঝরে পড়ে। তার মা অনেক ঠাণ্ডা একজন মানুষ, অতীব জরুরী কিছু না হলে তিনি কখনোই ভার্সিটি খোলা থাকা অবস্থায় বাড়িতে আসতে বলেন না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।
-আমাকে আজকে রুমার রুমমেট ফোন করসিলো হোস্টেল থেকে, রুমার নাকি কোন বখাটে ছেলের সাথে সম্পর্ক হইসে, আগামীকাল নাকি ওই ছেলে তাকে হোস্টেল থেকে তার সাথে পালাতে বলছে। ছেলেটা নাকি ভালো না। তাই ওর রুমমেট আমাকে সাথে সাথেই ফোন করে জানাইসে। আরও আগেই জানাইতো কিন্তু ভয়ে পারে নাই।

মাসুদের হৃৎস্পন্দন ধপ করে বেড়ে যায়। তার একমাত্র আদরের ছোট বোন রুমা। মাস ছয়েক আগেই সবাই ধরে বেঁধে ওকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল। বাগড়া দিয়েছিল মাসুদ আর বলেছিল গ্রাজুয়েশন না করিয়ে তার বোনকে বিয়ে দিবেনা। তার বোন হবে তাদের এই পরিবারের প্রথম মেয়ে, যে কিনা অল্প বয়সে বিয়ে করে স্বপ্ন বিসর্জন দিবে না বরং শিক্ষিত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সগর্বে। নিজেকে কোনক্রমে শান্ত করে ও বলে- ছোট চাচাকে বলো ওকে হোস্টেল থেকে নিয়ে আসতে, আমি কাল ভোরেই বাড়ি আসছি।
-তাড়াতাড়ি আসিস বাবা বলেই মাসুদের মা ফোন রেখে দেন।

Are you okey? মাসুদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে জয়িতা। মাসুদের ভাবনার সূতা কেটে যায়। একগাল হেসে সে ধপ করে চেয়ারে বসে পরে। আর আড্ডা দিতে থাকে সবার সাথে।

সন্ধ্যার শুরু হবার সাথে সাথেই সবাই যার যার মত চলে যাবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। হীরক কামরুলের সাথে রিকশা নিয়ে চলে যায়। সাকিব একপাশে দাঁড়িয়ে সিগারেটে নির্বিকার ভাবে টান দিতে থাকে। জয়িতা কে নিতে গাড়ি চলে এসেছে, ও বলে ওঠে- মাসুদ আর তৃষা চল আমি তোদেরকে ড্রপ করে যাই। আমার কোন কাজ নাই আসলে এখন। মাসুদ কিছু বলার আগেই তৃষা বলে- আজকে না। আমি এখন বাসায় যাচ্ছিনা আমি অন্য একটা কাজে যাব। মাসুদ তুই কি আমাকে একটু আগায় দিতে পারবি? মাসুদ একগাল হেসে বলে- তোকে কি কারো আগায় দিতে হয়? তুই হলি লেডি মাফিয়া। তোকে কে না ভয় পায়? জয়িতা হেসে গাড়িতে উঠে পরে, জানা কথা এখন তৃষা আর মাসুদ ঝগড়া করবে কিছুক্ষণ তারপর ঠিকই চলে যাবে।


২.
রিকশায় ওঠার পর থেকে মাসুদ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। বার বার রুমার চেহারাটা চোখ ভাসছে। সেইদিনের ছোট্ট বোনটা তার। এত বড় হয়ে গেছে! কাউকে ভালোও বাসে? সবাই কে ছেড়ে তার সাথে চলেও যেতে চায়? মাত্র তো কলেজের গণ্ডি শেষ করে ভার্সিটি লাইফে আসলো ও। এখনো তো পৃথিবী দেখেইনি। সেদিনও তো আম্মা তার পছন্দের খাবার রান্না করেনি বলে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল। সে ঢাকা আসার আগে আবদার করেছিল ওর জন্যে কিছু গানের সিডি আনতে। মাসুদ কিছুতেই কিছু মেলাতে পারেনা। কেমন যেন এক শূন্যতা কাজ করে তার মাঝে।

তৃষা বকবক করেই যাচ্ছে। মাসুদ যে কথা শুনছে না বা হু হা ছাড়া কিছুই বলছে না তা নিয়ে তৃষার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। এই মেয়েটা এত্ত কথা বলে কিভাবে? মাথা ধরে যাচ্ছে মাসুদের। আবারো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছে সে। তার রুমমেট ছেলেটা গত দুইদিন ধরে জ্বরে ভুগছে, কাকে রেখে যাবে সে এই ছেলেটার কাছে! বাড়িতে যাবার টাকাও নেই। ও ভেবেছিল কালকের দিনটা সারাদিন বাসায় থেকে পরশু কোচিং থেকে কিছু টাকা তোলার চেষ্টা করবে। কিন্তু কাল ভোরে বাড়িতে গেলে আজ রাতেই তার টাকা ধার করতে হবে কারোর থেকে। কি করবে সে? কার কাছে টাকা থাকতে পারে? এইভাবে কারোর থেকে টাকা চাইতে মোটেও ভালো লাগেনা তার। অথচ...


রিকশা তৃষাদের শান্তিনগরের পুরনো বাসার সামনে চলে এসেছে। মাসুদের নড়েচড়ে বসে। তৃষা এখনো কথা বলে যাচ্ছে। এত কথাও একটা মানুষ বলতে পারে!- শোন, আমি বাসাতেই চলে যাচ্ছি, সন্ধ্যা হয়ে গেসে অন্যদিন কাজ সামলাব। এই নোটের ফাইলটা তোর কাছে রাখ তো। নেক্সট ক্লাসে নিয়ে আসিস।
-ক্যান? আজকে তুই নিয়ে যা, আমাকে দিচ্ছিস কেন? গাইগুই করে মাসুদ।
-আরে ধুর এই নোটখাতায় জরুরি কিছু নোট আছে তুই ফটোকপি করে আমাকে দিয়ে দিস। যা এখন ভ্যানভ্যান করে আমার মাথা না খেয়ে বিদায় হ। এই রিকশা নিয়েই বাস স্ট্যান্ড যাবি?
- না রিকশায় থাকতে ভালো লাগছে না রে। আমি হেটেই যাব।
-ও আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম তুই তো পঙ্কজ উদাসের ছোট ভাই, কবি মানুষ। যা হেঁটেই যা। দূর হ।
তৃষা হনহন করে বাড়ির দিকে হেটে চলে যাচ্ছে। ও কখনোই কাউকে বিদায় দেয়না। আর যাবার সময় কখনোই পেছনে তাকায় না। কারো সাথে সৌজন্যমূলক দু একটা কথা বলাও তার কাছে নাকি বিরক্তিকর। সেন্টিমেন্টস জিনিসটা তৃষা একদম সহ্য করতে পারে না।

মাসুদ হাঁটতে শুরু করেছে। নিজেকে কেমন যেন বোধ শক্তিহীন লাগছে। ক্লান্ত লাগছে কেন জানি তার। আর কোথায় যেন চাপা একটা কষ্ট কাজ করছে। টুনটুন করে সেলফোনের মেসেজের শব্দ হল। মাসুদ দেখে তৃষা মেসেজ দিয়েছে, তাতে লেখা- “নোটখাতার ভিতরে ১৫০০ টাকা আছে। ফোনের কথা শুনে মনে হল তুই কোন ঝামেলায় পড়েছিস, তাই দিলাম। কাল বাড়িতে চলে যাস তাড়াতাড়ি। আর এই টাকা কিন্তু ধার দিসি, আগামী মাসে সুদে আসলে ফেরত চাই। ভালো থাক।”

মাসুদ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল। নোটখাতার মাঝ থেকে কচকচে ৩টা ৫০০টাকার নোট বের হয়ে এসেছে। ওকে আর কারো কাছে টাকা চাইতে হবে না। তৃষা এতকিছু কখন লক্ষ্য করে ফেলছে? পুরা সময়ই তো আড্ডা দিচ্ছিল ও সবার সাথে। কেমন যেন খারাপ লাগা কাজ করছে মাসুদের। মনে হচ্ছে পুরাটা পথে সে তৃষার একটা কথাও মন দিয়ে শুনে নাই বা পাত্তা দেয় নাই। উলটা বিরক্ত হয়েছে। এখন কেমন যেন একটা অপরাধ বোধ কাজ করছে ওর মনের মধ্যে। নিজেরকে স্বার্থপর মনে হচ্ছে খুব। আসলেই তো, বেশিরভাগ মানুষ এত স্বার্থপর হয় কেন এই পৃথিবীতে!!!


৩.
পরের দিন খুব ভোরে নিজের গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হয়ে গেলো মাসুদ। বাড়ি যাওয়ার পরিচিত পথটুকু স্বর্গের রাস্তা মনে হয় মাসুদের। ছোটবেলা থেকেই নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে তার বড় হতে হয়েছে। তারপরেও তার অল্প শিক্ষিত মা, বদমেজাজি, অসুস্থ বাবা, তার একমাত্র ছোট বোন আর তাদের ভাঙ্গাচোরা পুরনো বাড়িটাকে তার বড় আপন মনে হয়। পুনর্জন্ম বলে পৃথিবীতে কিছু থাকলে সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করত এই গ্রামে, এই বাড়িতে আর এই সাধারণ পরিবারের মাঝেই জন্মগ্রহণ করার জন্যে। তাও একবার নয় বারবার।

দীর্ঘ বাস জার্নির পরে বাড়ির কাছের বাস স্ট্যান্ডের কাছে এসে থামে মাসুদ। সেলফোনে কাল রাতে চার্জ দেয়নি বলে সেটা কোন সময় বন্ধ হয়ে গেছে তা লক্ষ্যও করেনি সে। শেষ যখন আম্মার সাথে কথা হয়েছিল তখন জেনেছিল রুমাকে বাসায় নিয়ে এসেছে ছোট চাচা। মাসুদ সবাইকে মানা করে দিয়েছে। কেউ যেন রুমাকে কোন কিছু নিয়ে কথা না শোনায়। সে বাড়ি আসার পর রুমার সাথে কথা বলা হবে। নিজের বাড়ির সামনে আসতে আসতে অস্থির হয়ে যেতে থাকে ও। এই ভাঙ্গা একতলা বাড়িটার নাম রুমা দিয়েছে “সুস্বনি” মানে হল- সুন্দর স্বপ্নময় নিবাস। প্রায় মাস দুয়েক হল রুমার সাথে দেখা হয়নি তার। ঢাকা থেকে আসবে আসবে করেও কোচিংয়ের কারণে বাড়ি আসার সময় করতে পারেনি ও। শেষবার এসে রুমাকে কৃষন চন্দরের শ্রেষ্ঠ গল্প পড়তে দিয়েছিল সে। নিজের বোনটাকে মেয়ে কম মূলত মানুষ করে গড়ে তুলতে চেয়েছিল সে। মাহফুজ স্যর বলতেন- “তোমরা স্বপ্নভুক হও। দুর্দান্ত স্বপ্ন দেখার সাহস কর। নিয়ম আর প্রথার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে থেমে যেওনা। একা না এগিয়ে চারপাশে সকল কে নিয়া আগাও। দেখবে স্বপ্ন বাস্তব হচ্ছে...দেখবে জয় তোমাদেরই...” তাই তো করছিল মাসুদ। স্বপ্নভুক হয়ে গিয়েছিল।

বাড়ির ভেতর থেকে গোঙ্গানো কান্নার শব্দ আসছে। মাসুদ কাঁধের ব্যাগটা ফেলে দৌড়ে আব্বার রুমে চলে যায়। গিয়ে দেখে আম্মা কাঁদছেন চিৎকার করে।আব্বা বিছানায় শুয়ে প্রচণ্ড ক্রোধে মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন। আম্মার কাছ থেকে জানা গেলো ভোরে তিনি যখন ওযু করে নামায পড়তে বসেছেন তখন নাকি রুমা বাসা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। পাশের বাড়ির মতিন চাচা তার পিছু নিয়েছিল কিন্তু খুঁজে পায় নাই। বিলাপ করছে আম্মা, কেন মাসুদের ফোন বন্ধ ছিল? কেন তার এই অভিশপ্ত জীবন? মাসুদ দ্রুত আম্মার সেলফোনের ব্যাটারিটা তার ফোনে লাগিয়ে নেয় আর ছুটে বের হয়ে যার বাসস্ট্যান্ডের কাছে। মূল শহরের কাছে। বার বার ফোন করতে থাকে রুমার মোবাইলে। নাম্বার বন্ধ। রুমার হোস্টেলে চলে যায়। ওর রুমমেটের কাছ থেকে ছেলেটার খবর নিতে চেষ্টা করে। রাস্তার মানুষের মাঝে একটু পর পর চমকে যায় এই বুঝি রুমার ছুটে এসে “ভাই” বলে তার হাত চেপে ধরবে। কোত্থেকে যেন তার মাঝে একটা অন্ধ বিশ্বাস কাজ করে, একবার রুমা ফোন ধরে তার সাথে কথা বললেই বাড়ি ফিরে আসবে। মাসুদ পাগলের মত ফোন করতে থাকে। সেলফোনের যান্ত্রিক কণ্ঠটি তাকে বার বার দুমড়ে মুচড়ে দিতে থাকে। বেলা গড়াতে থাকে মাসুদ চেনা, অচেনা সব যায়গায় পাগলের মত খুঁজতে থাকে রুমাকে। জয়িতা আর তৃষা ফোন করে ওকে কিন্তু মাসুদের কিচ্ছু ভালো লাগেনা, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করেনা। তীব্র রোদে আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না ঠেকাতে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে সে। রুমা তুই কোথায়?


৪.
বিখ্যাত এক রাশিয়ান দার্শনিক বলেছিলেন- সব মানুষের ভালোবাসার বা সম্পর্কের অনুভূতি নাকি অনেকটাই সুগন্ধির মত শিশি বন্দি। যতই এই অনুভূতি বা ভালোবাসাকে প্রকাশ করে উন্মুক্ত করা হবে, ততই তা উবে বাতাসে মিলিয়ে যাবে। এইসব অনুভূতি ক্রমহ্রাসমান। আর যদি এই অনুভূতিগুলোকে ছিপি দিয়ে শিশি বন্দি রাখা যায় আর মাঝে মাঝে তার সুগন্ধ নেওয়া যায় তবেই নাকি জীবন হবে আনন্দময় ও সুন্দর। তৃষা এই কথাটিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। ঠিক পিঠাপিঠি ভাই ছিল তার একমাত্র ছোট্ট ভাই তনয়। মাত্র ১৫ মাসের তফাৎ ছিল তাদের বয়সের। অসম্ভব দুরন্ত ছিল তনয়। আর অনেক চটপটে আর বুদ্ধিমান ছিল বলে তারা দুই ভাইবোন একই ক্লাসে পড়ত। সে যখন ক্লাস টুতে পড়ে তখন দাদু বাড়ির পুকুরে পরে পানিতে ডুবে মারা যায় তনয়। তারপর থেকে তৃষা বড্ড একা।

দিন দিন সে যত বড় হয়েছে তনয়ের বয়সী বিভিন্ন ছেলের মাঝে সে তার ভাইকে খুঁজে গেছে। তার মনে হত তনয়ও বুঝি তার সাথে বড় হচ্ছে। একেক বছর একেক বয়সী ছেলেকে দেখে সে ভাবতো, তনয় থাকলে নিশ্চয় তাকে দেখতে এইরকমই লাগত। মাসুদের সাথে যখন তৃষার পরিচয় হয়, তৃষা অনেক অবাক হয়ে আবিষ্কার করে মাসুদের বাম চোখের কোনে ঠিক তনয়ের মতই ছোট কালো একটা তিল। মাসুদও অনেক পছন্দ করা সত্ত্বেও আইসক্রিম খেতে পারেনা। টনসিল ফুলে যায় ওর। তৃষা একসময় অন্যসব ছেলেদের মাঝে তনয় কে খোঁজা বন্ধ করে দিল। মাসুদের জন্যে তার অদ্ভুত এক মমতা কাজ করে। তার মনে হয় তনয় বুঝি ফিরে এসেছে। কিন্তু তৃষা কখনোই তা প্রকাশ করেনা। সে অনুভূতি শিশি বন্দি রাখতে চায়, এই সুগন্ধি যেন কোন ক্রমেই শেষ না হয়ে যায়।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তৃষা ফোন করছে মাসুদ কে। প্রথমে ফোন বন্ধ পেয়েছে আর এখন তো ফোন অন থাকার পরেও মাসুদ ফোন ধরছে না। তৃষার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে। না জানি মাসুদের বাসায় আবার কি সমস্যা হয়েছে।


কারা কবে কথা বলেছিল
ভালোবেসে এসেছিল কাছে,
তারা নেই তাদের প্রতীক হয়ে তবু
প্রাচীন কয়েকটা গাছ আছে...
তারা ছিল, তারা কেউ নেই;
মনে করে জীবন তবুও তার নিবিড় বিনয়ে
নিজেকে আগুনে ক্ষয় করে জেগে থাকে
স্থির¬¬—আরও স্থির আলোকের মত হয়ে...

বিড়বিড় করে আপনমনেই আবৃত্তি করে তৃষা। মুঠোফোনটা হাতে নিয়ে আবারো ফোন করে মাসুদ কে। নাম্বারটা বন্ধ...


৫.
রাত প্রায় ৩টা। তৃষা অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখছে একটা পাহাড় বারবার ভূমিকম্পে থর থর করে কাঁপছে...তৃষা পাহাড়টায় কি যেন উন্মাদের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে...কিন্তু খুঁজে পাচ্ছেনা... বেশ কিছুক্ষণ পর তৃষা ঘুমের মাঝেই বুঝতে পারে তার সেলফোনটা vibration এ কাঁপছে। অনেকক্ষণ থেকে ফোনটা বেজে যাচ্ছে। তৃষা ঘুমের ঘোরে জড়ানো গলায় ফোন ধরে-হ্যালো... ওপাশ থেকে কোন শব্দ নেই। তৃষা আবারো বলে-হ্যালো। গুমরে গুমরে কান্নার শব্দ ভেসে আসে ওপাশ থেকে। তৃষার ঘুমের ঘোর কাটতে থাকে। সেলফোনটা চোখের সামনে নিয়ে দেখে মাসুদের ফোন।– কি হয়েছে তোর মাসুদ? কাঁদতেছিস কেন? ওপাশ থেকে ঝরঝর করে কেঁদে উঠে মাসুদ। -রুমা কে খুঁজে পাই নাই রে...ও চলে গেছে দোস্ত। আমার আসতে অনেক দেরী হয়ে গেলো...আর আমাদের কে ফেলে পালায় গেসে ও। আমার সাথে দেখা না করেই পালায় গেসে। আমি সকাল থেকে ওকে খুঁজছি। ফোনটাও বন্ধ। আমার সাথে ওর শেষ দেখা ২মাস আগে...আমি আর পারতেছিনা...কান্নার তোড়ে কথা আটকে যায় মাসুদের।

তৃষা শক্ত করে ফোনটা কানে চেপে ধরে। তার মনে হচ্ছে কেউ তার আঙ্গুলগুলো হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে অথচ সে কোন আর্তনাদ করতে পারছে না। কি বলবে সে বুঝতে পারছেনা। ওপাশ থেকে মাসুদ কথা বলে যাচ্ছে, যেন সারাদিনের চেপে রাখা কষ্টের এখন বাঁধ ভেঙ্গেছে... পাহাড় থেকে আছড়ে পড়া ঝর্ণার মত কষ্টগুলো ছিটকে যাচ্ছে...আমি বাড়িতে আসলে রুমা আমাকে সব সময় ভাত খাওয়ায় দিত। জানিস সকাল থেকে আমি কিচ্ছু খেতে পারছি না...আমার বোনটা কেমনে এত বদলায় গেলো... ওকে তো আমি অনেক পড়ালেখা করাইতে চাইছিলাম...হু হু করে কাঁদতে থাকে মাসুদ। বার বার রুমার নাম নিয়ে কাঁদতে থাকে। রুমা তার আগলে রাখা রুমা, ছোট্ট রুমা...

সত্যিই মানুষ খুব বিচিত্র। ছোট্ট এই মানুষগুলো এক সময় কেন এত্ত বড় হয়ে যায়? ছোট্ট হাতের মুঠোয় একদিন সে যাদের হাত ধরেছিল তাদেরই হাত ছাড়াতে প্রয়োজন বোধ করে! তার কাছের মানুষগুলো, মা-বাবা কখনো বা ভাই কখনোবা বোন চেয়ে চেয়ে দেখে তাদের সেই ছোট্ট বাবুটি কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে। একসময় বাবুটা কেমন অচেনা হয়ে যায়। কাছের মানুষগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এই অশ্রু অভিমানের অশ্রু...ভালোবাসার অশ্রু...

তৃষা ফোনটা শক্ত করে ধরে রেখে একটু পর পর বলছে- কাঁদিস না ভাই...কাঁদিস না... তৃষার আজ অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করছে মাসুদ কে...কি হবে এত হিসাব করে? ভাবনাগুলো জমিয়ে রেখে? আজ তার কোন অনুভূতির সুগন্ধিকে শিশি বন্দি করে রাখতে মন চাইছে না। বরং শিশির ছিপিটা খুলে অনেক দূরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছে..

*************************************************************************
মাঝে মাঝেই গভীর রাতে শরত কালের কালচে নীল আকাশ খুব পরিষ্কার হয়। আর তাতে থাকে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র। ছোট একটা গ্রাম ঘুমিয়ে আছে...আর অন্যদিকে বিশাল এক শহরের বাতিগুলোও একটা দুইটা করে নিভে যাচ্ছে...এরমাঝেও কিছু মানুষ জেগে আছে আর তাদের জেগে থাকার সাক্ষী হয়ে জ্বলজ্বল করছে এক আকাশ নক্ষত্র...
***গল্পে দেওয়া কবিতাটি জীবনানন্দ দাসের লেখা "কারা কবে" কবিতার কিছু অংশ।


-একুয়া রেজিয়া

No comments:

Post a Comment