Subscribe:

অমিতের ফিরে আসা

লাইব্রেরীতে বেতের সোফায় একটা বই হাতে বসে আছে অমিত। আমি এগোতে থাকি ওর দিকে। হঠাৎ চারিদিক কুয়াশায় ঢেকে গেল। কোথায় অমিত? আমি অমিতের হাসি শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু অমিতকে আর দেখতে পাচ্ছিনা। ঘন ধুসর কুয়াশা এক সময় আমাকে জাপ্টে ধরে চারিদিক থেকে, আমি অমিত অমিত বলে চীৎকার করতে থাকি, কিন্তু আমার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়না। ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। ধাতস্থ হতে খানিকক্ষণ সময় লাগে। পুরো গা ঘামে ভিজে ছপছপে হয়ে গেছে।স্বপ্নের কান্নার রেশ এখনো বুকের ভিতর দলা পাকিয়ে ওঠে আবার।


অমিত আমার কাছে নেই, আমার পাশে নেই, আমি আর কোন দিন ওকে হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারব না। রাত কেটে যাবে, আরেকটা দিনের শুরু হবে কিন্তু অমিত আর ফিরে আসবে না। পৃথিবী চলবে তার নিজস্ব নিয়মে, কিন্তু আমার অমিত আর কখনো আমাকে ভালবেসে কাছে টেনে নেবেনা। বিছানা থেকে কোন রকমে উঠে দাড়ানোর চেষ্টা করি আমি, পাশেই টেবিলের উপর পানির গ্লাস রাখা, কিন্তু সে পর্যন্ত আর পৌছাতে পারিনা। আবার একরাশ কুয়াশা গ্রাস করে নেয় আমাকে।


যখন ঘুম ভাঙ্গে তাকিয়ে দেখি অলীন ভাই বসে আছে বিছানার পাশের চেয়ারটিতে। শারমীন আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করি। পারিনা। আপু সাহায্য করে, এক গ্লাস পানি মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। দুধ কর্নফ্লেক্সের বাটি নিয়ে ব্যর্থ সাধাসাধি করে, আমি কিছু মুখে তুলতে পারিনা। আমি অলীন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষন, অলীন ভাইও তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। আমাদের দুজনের চোখেই পানি। এক সময় কিছু না বলেই অলীন ভাই উঠে দাঁড়ায়, শারমীন আপু দরজা খুলে এগিয়ে দিতে যায়। এই ভাবেই বিষন্ন আরেকটা দিন শুরু হয়। এই দিনটাতেও সন্ধ্যা ঘনাবে, রাত আসবে কিন্তু আমার অমিত আসবে না। এই কষ্টের কোন শেষ নেই, এই কষ্টের কোন সীমা নেই।


যখন আমার বাবা মা রোড আক্সিডেন্টে মারা যান, তখন আমি একেবারেই ছোট্ট। আমরা থাকতাম মেরীল্যান্ডে। ভার্জিনিয়াতে আমার চাচা তখন একটা মিলিটারি কোর্সের জন্য ছিলেন মাস ছয়েক। চাচাই আমাকে দেশে নিয়ে আসেন। আর মায়ের আদর দিয়ে বড় করে তোলেন চাচী। শারমীন আপু আর আমার ভিতর কখনো কোন তফাৎ রাখেননি। চাচা রিটায়ার্ড করার পরে ডিওএইচএসেই আমরা সেটল করি। শারমীন আপু ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ত। অলীন ভাই ওর ক্লাসমেট। অলীন ভাইয়ের বাসায় আমি আপুর সাথেই প্রথম যাই একদিন। বনানীতে বাসা। আমাদের বাসা থেকে বেশি দুরের পথ না। ওদের একটা লাইব্রেরী রুম আছে, আমি আচ্ছন্নের মত সেই রুমে ঢুকে পড়ি। থরে থরে সাজানো বই। ঘরের দুদিকের দেয়াল জুড়ে বইয়ের আলমারী।

কি সুন্দর সুরুচীর ছাপ ঘরটি জুড়ে। খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকছে, সেই সাথে মাধবীলতার মাতাল করা ঘ্রান। আপু যাওয়ার জন্য তাগাদা দেয় কিন্তু আমার এক্টুও উঠতে ইচ্ছে করেনা। হয়ত আমার মনের কথা বুঝেই আন্টি বলেন, “শারমীন, তোমার এই মিষ্টি ছোট বোনটাকে কোন এক ছুটির দিনে পাঠিয়ে দিওতো, ও মনের সাধ মিটিয়ে বই পড়ুক। আমারো ভাল লাগবে, সারা দিন একা একাই থাকি”। শারমীন আপু ভদ্রতা করে সাঁয় দেয়। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি আবার যাই ওই বাসায়। লাইব্রেরীটা আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মত টানে। বইয়ের প্রতি এই আকর্ষন আমি আমার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছি খুব সম্ভবত। অধিকাংশ বইগুলোর প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা একটা নাম, “অমিত”।

বইয়ের মালিকের সাথে আমার দেখা হয়না, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে বইগুলো আমি দেখতে থাকি। মাঝে মধ্যে আন্টি এসে বসেন আমার পাশে, টুকটাক নানান গল্প করেন। আঙ্কেল ব্যাবসার কাজে অনেক ব্যাস্ত থাকেন। আন্টির বড় ছেলে অমিত আর্মি অফিসার। খাগড়াছড়িতে পোস্টিং, বছরখানেক হল ক্যাপ্টেন হয়েছে। আর ছোট ছেলে অলীনতো অধিকাংশ সময়ই হোস্টেলে থাকে।আপু আর অলীন ভাই দুজনেই ইন্টার্নশীপের জন্য অনেক ব্যস্ত থাকে।আমিও আমার গল্প শোনাই। সেকেন্ড সেমিস্টারের সেকেন্ড টার্ম ফাইনাল শেষ, ক্লাসের পড়ার চাপ কম। আমার শুক্রবার দুপুর গুলো আন্টির সাথে গল্প করেই কাটে, লাইব্রেরীর বইগুলো পড়ি আয়েস করে। এক শুক্রবারের অলস দুপুরে আমার দেখা হয়ে যায় অমিতের সাথে। লাইব্রেরীতে ঢুকেই দেখি আমার চেনা ঘরটিতে অচেনা একজন বসে আছে!

আমাকে দেখা মাত্রই উঠে দাড়ালেন। আমিতো লজ্জায় বাঁচিনা! “আমি অমিত, আপনি নিশ্চয়ই সূচনা” বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি একজন নিশ্চল শ্রোতা হয়ে গেলাম। আজ সকালেই আন্টির সাথে কথা হয়েছিল, আন্টিতো তখন বলতে পারতেন অমিত এসেছে, তাহলে আমি আজ আসতাম না। ট্রেতে করে চা নিয়ে আন্টি হাজির। এই প্রথম আমার আন্টির উপর অনেক রাগ হল। কি দরকার ছিল আমাকে এরকম বিব্রত করার। মনে হচ্ছে আমি পারিবারিক একটা ছবির ফ্রেমে অযাচিত ভাবে ঢুকে পড়েছি।তাড়াহুড়া করে আমি কোন রকমে বাসায় চলে আসি। সেদিন রাতেই আমি স্বপ্নে দেখি অমিত আর আমি মিলে বই আলমারীতে বই গুছিয়ে রাখছি। ঘুম ভেঙ্গে যায়, বাইরে ফজরের আযানের ধ্বনি। ঢাকা এখনো জেগে ওঠেনি। আমার বুকের ভিতর কান্না গুমরে ওঠে, বুঝে উঠতে পারিনা এটা কিসের কান্না। ভোরের ম্লান আলোয় সেই মুহুর্তে আমার খুব ইচ্ছে করে অমিতের ঘুমন্ত মুখটা দেখতে।

সুর্য পুরোপুরি ওঠার আগে আমি নিশ্চিত হয়ে যাই আমি প্রেমে পড়েছি। প্রথম দেখাতেই আমি অমিতের প্রেমে পড়েছি। পরে আমি অমিতের কাছেও শুনেছিলাম, আমাকে লাইব্রেরীতে ঢুকতে দেখে ওর ও নাকি একি রকম কিছু একটা মনে হয়েছিল। পঁচিশের পৌরষ আর একুশের তারুণ্য আমাদের বেধে ফেলে পৃথিবীর শ্রেষ্টতম বাঁধনে।আমরা ভুবন ভুলানো প্রেমে পড়লাম।এই ভালবাসার একটা বছর আমাদের জীবনের শ্রেষ্ট বছর। অমিত পার্বত্য চট্টগ্রামে আর আমি ঢাকায়। দেখা সাক্ষাত এক প্রকার হতই না বলা চলে। কিন্তু দিন দিন আমাদের ভালবাসা গভীর হতে থাকে। আমি অসহায়র মত দেখতে থাকি আমি আর আমার নেই। পুরোটাই অমিতের হয়ে গেছি।

তবে এই আত্মসমর্পনেও আনন্দ, নিজেকে হারিয়ে ফেলেও সুখ। ওর ওখানে নেটওয়ার্ক খুব খারাপ, কিন্তু এর ভিতরেই কথা হত। আমার বইপ্রেমী অমিত, কেন যে ও আর্মি অফিসার হতে গেল! তাও আবার এমন দুর্গম জায়গায় পোস্টিং। আমার অস্থির মন আর মানতে চাইত না, ওকে ছুটি নিতে বলতাম। কিন্তু চাইলেই কি এত সহজে ছুটি মেলে? অমিতকে হঠাৎ করেই ঢাকায় চলে আসতে হল। মিশনে নাম এসেছে ওর। হাতে একটুও সময় নেই। অমিত ঢাকায় কিন্তু আমার সাথে দেখা হয়না। আণ্টি আমাকে যেতে বলেছেন সন্ধ্যা বেলায়, ব্যাগ গুছাতে সাহায্য করতে হবে। দুজনের বাসার সবাই জানে আমাদের কথা, শারমীন আপুর বিয়ে হয়ে গেছে এর মাঝে, আমারও এক বছর পর ব্যাচেলর জীবন শেষ হবে।কোথাও কোন বাঁধা নেই। শুধু আমি আমেরিকান সিটিজেন এই কারনে ওর অফিস থেকে কিছু অনুমতি নেওয়ার ব্যাপার আছে হয়ত। ও দুমাস পরেই কঙ্গো থেকে ছুটি নিয়ে আসবে দেশে, তখন এই সব সমস্যার সমাধান হবে। এইভাবেই ভবিষ্যতের ভাবনা, বর্তমান ব্যস্ততার ইতিবৃত্ত, এই সব কথা ফোনে ফোনেই চলতে থাকে । ব্যস্ত অমিতের নাগাল আমি পাইনা সহজে। অমিতের ফোন আসে দুপুরে, অস্থির কন্ঠ


         :সূচী তুমি জাননা আমি কত্ত ব্যস্ত

         :হুম, আমি জানি, সারা পৃথিবীর জন্য তোমার সময় আছে, আমার জন্য বাদে

         :প্লীজ এভাবে বলোনা, কাল আমার ফ্লাইট। তুমি আমার উপর রাগ করে থাকলে আমার খুব কষ্ট লাগে

         :না আমি রাগ করিনি। তবে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।

         :চাচা চাচী কোথায়?

         :চাচা চাচী দুজনেই গেছেন চাচীর মায়ের বাড়ি। নানীর শরীর টা ভাল না। তবে সন্ধ্যা বেলায় তোমাদের বাসায় সবাই এক সাথেই যাব।


         :আশা করি আজ সন্ধায় দেখা হবে।


পাঁচ মিনিট পরেই কলিং বেল বেজে ওঠে। দরজা খুলে দেখি দাঁড়িয়ে আছে অমিত। আমার অমিত, আমাকে ছেড়ে যাচ্ছে যুদ্ধের দেশে। আমার শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আমি আঁকড়ে ধরি ওকে। বাইরের গনগনে রোদের তাপ আমাদের ভালবাসার উত্তাপের কাছে হার মানে। আমার সব মান অভিমান, উৎকন্ঠা মোমের মত গলে যায় অমিতের তীব্র ভালবাসার কাছে। সেই আমার অমিতের সাথে শেষ দেখা। সেইদিন সন্ধ্যাতেই নানী মারা যান।শারমীন আপু এসে আমাকে নিয়ে যায় নানাবাড়ি। রাতে সবার সাথে ওইখানেই থেকে যাই, অমিতকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে আর যাওয়া হয়না।


বাংলাদেশ থেকে কত আর্মি অফিসার প্রতি বছর মিশনে যাচ্ছে, আবার হাসি মুখে বাড়িও ফিরে আসছে, কিন্তু আমার অমিত মাত্র এক সপ্তাহের মাথা নিস্প্রান এক দেহ হয়ে ফিরে আসল। আমি প্রানহীন অমিত কে দেখতে চাইনি। যে প্রানচাঞ্ছল্য নিয়ে ও আমার জীবন কে ভরিয়ে রেখেছিল আমি সেই অমিতকেই মনে রাখতে চাই আজীবন। শুধু মনে হয় আর একটা বার যদি দেখতে পেতাম ওকে। শুধু একবার। অমিত চলে গেছে, সেই সাথে চলে গেছে আমার বেচে থাকার কারন, আমার জীবনীশক্তি, আমার আনন্দ ,হাসি,গান। এই দুটো মাস আমি জীবন্মৃতের মত পড়ে আছি বিছানায়। একটা বার যদি ওকে চোখের দেখাটা দেখতে পেতাম!


আপুর অনুসন্ধানী দৃষ্টি, কয়েকটা প্রশ্ন আর একটা প্যাথলজি রিপোর্ট, সন্ধ্যা হতেই আমি জানতে পারি সেই সংবাদ। অমিত একেবারে চলে যায়নি।ওর একটা অংশ রেখে গেছে আমার ভিতর। আমাদের দুজনের ভালবাসায় এক নতুন প্রানের সৃষ্টি হয়েছে, কয়েক মাস পরেই সে পৃথিবীতে আসবে। অমিত আমার সাথেই আছে, আমি প্রান ফিরে পাই আবার। উঠে বসি। খাবারের বাটিটা কাছে টেনে নেই। আমাকে ভাল থাকতে হবে, সুস্থ থাকতে হবে। কে কি বলবে সেই কথা ভাবার সময় নেই আমার। আমার অমিতের ভালোবাসা ফিরে আসছে আবার। আমি নিজেকে প্রস্তুত করি।  



-সুমনা রহমান

No comments:

Post a Comment