Subscribe:

উদার হতে চাইনা খুব সাধারণ একজন হতে চাই

সে আমাকে ভালবাসত বিয়ের আগে থেকেই,কিন্তু আমার তাকে কখনো ভাল লাগেনি । প্রতিবার তার ভালবাসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গেছি, তবু আমাদের বিয়ে হল খুব সাধারণ একটা দিনে,খুব সাদামাটাভাবে। কথা ছিল বছর শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে নেবে। বিয়ের চার দিনের মাথায় আমাকে রেখে সে চলে গেল ঢাকায়, তার কর্মস্থলে।

ধীরে ধীরে আমি শিখলাম, তার কাছেই শিখলাম-ভালবাসা কি, কেমন করে ভালবেসে ডুবে থাকা যায় ভালবাসার মানুষের মাঝে। কেমন করে ভালবেসে ভুলে থাকা যায় নিজের অস্তিত্বকে। কাজের ফাঁকে একটু সময় পেলেই ও ফোন করত আমাকে। আমি ফোন রেখে পারতাম না ও আবার কল দিত। ওর জন্য খাওয়া গোসল কোনটাই ঠিকমত হতনা আমার। যদি বলতাম দেরি হচ্ছেতো গোসল করতে হবেনা, খেতে হবেনা? ও বলত একটু পরে যাও, বলতাম ক্ষুধা লাগছে তো। ও তখন বলত তাহলে গোসল করতে হবেনা তুমি খেতে খেতে কথা বল, আমার এখন ফোন রাখতে ইচ্ছা করছেনা, আমি এখন তোমার সাথে কথা বলব। ওর বন্ধুরা পাশ থেকে টিপ্পনী কেটে বলত- তুমি যেভাবে বউয়ের সাথে প্রেম করা শুরু করছ দুইদিন পর তো ব্যবসা বাণিজ্য ছেড়ে তোমাকে গুলশানের ফুটপাতে বসতে হবে। যেদিন খুব বেশি ব্যাস্ত থাকত সেদিন শত কাজের মাঝেও একটু পরপর ই এসএমএস দিত। ওর সীমাহীন ভালবাসায় আমার সাদাকালো পৃথিবী তখন রংধনুময়। আদর করে ওর নাম দিলাম বাবুই।

এক দেড় মাস পরপর আমার বাবুই আমার কাছে আসত। একবার দেরিতে রওনা দেয়ায় সে চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির শেষ গাড়ীটাও মিস করল। চট্টগ্রাম পৌঁছাতেই রাত প্রায় দশটা বেজে গিয়েছিল। ওকে বললাম ওখানেই রাতটা থেকে যেতে। ও বলল না আজ রাতে আমি তোমার কাছে আসবই, যেভাবেই হোক। প্রয়োজনে পায়ে হেঁটে রওনা দিব। শেষ পর্যন্ত একটা সিএনজি রিজার্ভ করে নিজের জীবনের রিস্ক নিয়ে রাত প্রায় বারটায় এসে পৌঁছাল। আমার বাবুই কথা রেখেছিলো সে রাতে সে আমার কাছে এসেছিল,যেভাবেই হোক। আমার চেয়ে সুখি তখন পৃথিবীতে দ্বিতীয়টা নেই। ওর ভালবাসা আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অন্য এক জগতে অন্য এক পৃথিবীতে।

কিভাবে দুই মাস কেটে গেল টেরই পেলামনা। সময় বদলাতে লাগল সেই সাথে বদলে যেতে লাগল আমার আদরের বাবুই। যে মানুষ ঘুম ভেঙ্গেই ফোন করত আমাকে, দশটা পার হয়ে এগারোটা বেজে,যেত তবু তার ফোন অফ থাকত। জানতে চাইলে বলত কাজের চাপ বেশি,বাসায় ফিরতে রাত হয় তাই ঘুম ভাঙতেও দেরি হয় আর ফোন অন থাকলে ঘুমের ডিস্টার্ব হয় তাই ফোন অফ রাখে। আস্তে আস্তে সময়টা বাড়তে লাগল এগারোটা থেকে বারোটা তারপর একটা। আমি রাগ করলে উল্টে ও রাগ করে বলত-তোমার মত আবেগি মেয়ের সাথে আমি কিভাবে সংসার করব, বুঝতে হবেতো আমার কাজ থাকে তাছাড়া তোমাকে বারবার ফোন করে কি বলব আমি, আই লাভ ইউ ছাড়া তো আর কিছু বলার দেখিনা। আমি বলতাম ঠিক আছে সেটুকুই অন্তত বল । আমি তোমাকে রেখে এত দূরে থাকি তুমি যদি দিনে অন্তত দুই তিনবার ও কল না দাও আমি তবে কি নিয়ে থাকি। ও তখন আরও রেগে বলত,"নিয়ম করে কাউকে কল দিতে আমি বাধ্য নই।"

কষ্টে নীল হলাম। ধীরে ধীরে অচেনা এক জগতের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল আমার চেনা বাবুই, যে জগতে ভালবাসার পরিবর্তে আছে শুধু অবহেলা, সত্যের পরিবর্তে মিথ্যা আর মিথ্যা। আমি ওকে আর ফোন দিয়ে ডিস্টার্ব করতাম না। শুধু দুপুরে খাওয়া নিয়ে ও খুব অনিয়ম করত তাই প্রতিদিনকার অভ্যাসমতো দুপুরে ছোট্ট একটা এস এম এস লিখতাম-খেয়ে নিও বাবুই ।  আই লাভ ইউ। জানতাম কোনো রেসপন্স পাবনা তবু কোথায় যেন একটা আশা লুকিয়ে থাকতো হয়ত রিপ্লাই করবে কিন্তু প্রতিবার ই মিথ্যা প্রমাণিত হতে লাগলাম।

কিছুদিন পর ও আবার এল আমার কাছে। আশায় বুক বাঁধলাম হয়ত আবার আমার পুরোনো বাবুইকে ফিরে পাব আমি। ভুল ভাঙল পরদিন দুপুরে। আমি কখনও ওর মোবাইল চেক করতাম না। এস এম এস টোন পেয়ে ওর মোবাইল টা হাতে নিলাম, ও তখন সিগারেট আনতে বাইরে গেছে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করে এস এম এস টা পরলাম। সেখানে লেখা- "তোমার কি ফোন রিসিভ করতে কষ্ট হয়, একবার ঢাকা আসো তোমাকে ফোন রিসিভ করা শিখাব।" গোপনে নাম্বারটা সেভ করে রাখলাম। ও সেদিন ই ঢাকা ফিরে গেল। ওই নম্বর এ কল দিলাম, মেয়েলি কণ্ঠ পেয়ে জানতে চাইলাম ওর সাথে তার কি সম্পর্ক। মেয়েটি বলল আট বছর আগে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিল ওরা। বিয়ের পর সে টের পায় তার স্বামীর চরিত্র খারাপ কিন্তু ততদিনে তার গর্ভে ওর সন্তান জায়গা করে নিয়েছে তাই অনিচ্ছা সত্তেও ওর সাথে সংসার করে যাচ্ছে।

নিজের কান কে বিশ্বাস করতে পারলাম না। মনে হল কোথাও ভুল হচ্ছে, ওকে ফোন করে জানতে চাইলে ও সব স্বীকার করল। সাতরঙা রংধনুটা মিলিয়ে গিয়ে আমার পৃথিবীটা এবার আর সাদাকালো নয় শুধু কালোই রয়ে গেল।

মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের সংসার ভাঙ্গতে পারলাম না, পারলাম না সন্তানের কাছ থেকে তার পিতাকে কেড়ে নিতে। সব দুঃখ কষ্ট, সব অপমান সাথে নিয়ে আমি ই দূরে সরে গেলাম। দূরে সরে গেলাম ঠিক ই তবু জানিনা কেন যেন মনের কোথাও আশা পুষে রাখতাম হয়ত সে আমার খোঁজ নেবে, জানতে চাইবে আমি কেমন আছি,কিভাবে আছি। কিন্তু কোনদিনই সে আর আমাকে  খোঁজেনি। বুঝলাম তার ভালবাসাটাও মিথ্যে ছিল। ওকে ভুলে যেতে চাইলাম, ভুলেও গেলাম তবে ওকে নয়, ভুলে গেলাম খেতে, ঘুমুতে, ভুলে গেলাম হাসতে।

সমরেশ এর কালপুরুষ উপন্যাসে মাধবীলতা অনিমেষ কে বলেছিল "আমরা মেয়েরা বড় বেশি উদার হই বলে তোমরা পুরুষেরা চিরকাল বেঁচে যাও"।
আমি উদার হতে চাইনা খুব সাধারণ একজন মানুষ হতে চাই। আমি ওকে ক্ষমা করতে চাইনা, আমার রঙ্গিন পৃথিবীর সব রঙ কেড়ে নেয়ার অপরাধে ওর শাস্তি চাই।

ওর সাথে যোগাযোগ নেই প্রায় পাঁচ মাস হতে চলল। মা বাবা সবাই বলছে ওর নামে কেস করতে, ওকে ওর অপরাধের শাস্তি দিতে। কিন্তু জানিনা কেন আজ ও পারিনি ওকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে। আপনারাই বলুন আমি উদার হব নাকি খুব সাধারণ একজন মানুষই থাকব ?



ফারজানা নিপা







(আসলে এই পৃথিবীতে ভালবাসা নিয়ে মানুষের সমান দুটো ভাগ।

একভাগ ভালোবাসার জন্য হাহাকার করে মরে, আর আরেকদল ভালোবাসাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে।

যারা ভালবাসাকে নিয়ে খেলতে পছন্দ করে, তাদের মত অভাগা আসলে পৃথিবীতে আর একজনও নেই।

একটা সময় আসবে, তখন হাজার খুঁজলেও এমন সত্যিকারের ভালবাসা আর পাওয়া যাবে না।

সৃষ্টিকর্তা মানুষ সহ প্রতিটা জীবজন্তু বা পশুকে কম-বেশি জৈবিক তাড়না দিয়েছেন । মা্নুষই একমাত্র জীব যারা এই চাহিদার উর্ধ্বে আবেগ এবং ভালবাসাকে স্থান দিয়ে জীবনে চলার পথের সঙ্গী খুঁজে নেয় , বিয়ের মত চমৎকার একটা সম্পর্কে নিজেকে জড়িয়ে। এই আবেগ এবং ভালবাসাই মানুষের সাথে আর অন্য পশুগুলোর মধ্যে পার্থক্য করে দেয়। 

সেসব মানুষগুলোর (!) জন্য ধিক্কার, যারা ভালবাসাকে অপমান করে, আর অনুভূতিগুলোকে ব্যবহার করে। মানবজাতির অংশ হিসেবে আমরা তাদেরকে অস্বীকার করছি...


আর এই মানুষগুলো, যারা একটুখানি ভালবাসার জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে, তাদের জন্য শুধু একজনের ভালবাসাই নয়, সবার ভালবাসাই জমা আছে ।



সালাম জানাই পৃথিবীর সেই মানুষগুলোকে যারা এই নিঃশর্ত ভালবাসার মহান এবং বিরল গুণ নিয়ে জন্মেছেন।


-অ্যাডমিন প্যানেল of ভালবাসার গল্প

No comments:

Post a Comment