Subscribe:

অপারেশন ফার্মগেট

১৬ই ডিসেম্বর,১৯৭১
ঢাকার রেসকোর্স ময়দান। সময়টা প্রায় বিকাল ৪টার কাছাকাছি। জেনারেল অরোরা, মাঝে জেনারেল নিয়াজী এবং তার পাশে মুক্তিবাহিনীর একজন তরুণ অফিসার দৃপ্ত পদক্ষেপে সামনের দিকে হেটে চলেছেন আত্নসমর্পনের জন্য নির্ধারিত স্থানের দিকে।কাঁধে ঝোলানো চায়নীজ অটোমেটিক রাইফেলটি যেন বোঝাতে চাইছে এখনো যে কোন অপ্রিয় এবং আকষ্মিক ঘটনার জন্য প্রস্তুত তিনি। তরুনের নাম মেজর হায়দার।


 যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত যিনি ছিলেন কুমিল্লা সেনানিবাসের কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের একজন অফিসার। পরবর্তীতে বিদ্রোহ করে যোগ দেন মুক্তিসংগ্রামে। বিদ্রোহী ক্যাপ্টেন হায়দার ২ নং সেক্টরের মেজর খালেদ মোশাররফের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। অক্টোবরের সাত তারিখ মেজর খালেদ মোশাররফ নিয়মিত ব্রিগেড “k” ফোর্সের দায়িত্ব গ্রহণ করলে মেজর হায়দার ২ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেলাঘরে অবস্থিত ২ নং সেক্টরের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে মেজর হায়াদার মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডো, বিস্ফোরক ও গেরিলা ট্রেনিং করাতেন। মূলত তার হাতেই গড়ে ওঠে ৭১ এর এক ভয়ংকর গেরিলা বাহিনী, যে বাহিনীর ভয়ে সাত ঘাটের পানি খেত খান সেনার দল। একের পর এক দুঃসাহসী অভিযানের মাধ্যমে এই বাহিনী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর নজর কেড়ে্ নিয়েছিল অতি অল্প সময়ের মধ্যেই। এ দলে ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমী এবং বদি, সামাদ, জুয়েল, পুলু, বাদল, চুল্লু সহ আরো কিছু অদম্য সাহসী এবং মেধাবী কিছু তরুণ। প্লাটুনটির নাম “ক্র্যাক প্লাটুন”।

তারুণ্যের জোয়ার তোলা এই নামটির সাথে আমরা অনেকেই পরিচিত। ঢাকা শহরে অনেকগুলো সফল এবং বিধ্বংসী অভিযান চালায় এই দলটি। পরিচালিত অভিযানগুলোর মধ্যে “অপারেশন ফার্মগেট” একটি; যার সময়কাল মাত্র এক মিনিটের মত, তবে বিস্তৃতি ব্যাপক।

গতকাল ক্র্যাক প্লাটুনের বিচ্ছুগুলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে সফল বোম্বিং করে। পরবর্তী টার্গেট – ফার্মগেটের চেকপোস্ট। ট্রাফিক আইল্যান্ডের মধ্যে তাবু খাটিয়ে চেক পোস্ট তৈরী করেছে খান সেনা এবং পাকি পেয়ারা রাজাকার বাহিনী। পাশের ফুটপাতে অবস্থান নিয়েছে মিলিটারি পুলিশ, এদের হাতেও লাইট মেশিনগান। নিরাপত্তা ব্যাবস্থা বেশ জোরদার বোঝা যাচ্ছে, তাই যা করার অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা এবং দ্রুততার সাথে করতে হবে।

৭ আগস্ট, ১৯৭১
সামাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায় সবাই বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে আজকেই আক্রমণ চালাবে তারা। সে অনুযায়ী প্ল্যানও ঠিক করে ফেলেন প্লাটুনের সদস্যরা।অপারেশনের সময় নির্ধারিত হল রাত আটটা এবং এর জন্য সময় বরাদ্দ থাকবে ১ মিনিট।

সারা দিনই যতটা সম্ভব নজরে রাখা হল পুরো এলাকাটিকে।অপারেশনের আগে শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে একটা ধারনা থাকলে কাজ করতে সুবিধা হবে।সন্ধ্যাবেলায় শেষবারের মত খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা গেল পাকিদের পজিশন আগের মতই আছে।তবে সেনাদের জায়গায় মিলিটারি পুলিশের আনাগোনা বেশী নজরে পড়ছে।

অস্ত্রসজ্জিত গেরিলা দলটি এখনই বেড়িয়ে পড়বে অপারেশনে।দলে আছে জুয়েল,আলম , পুলু , স্বপন,সামাদ আর বদিউজ্জামান।সামাদ গাড়ী চালাবে।সবার হাতে স্টেনগান,আলমের হাতে চায়নীজ এল,এম,জি।অতিরিক্ত অস্ত্রের মধ্যে সামাদের কাছে আছে রিভলবার,জুয়েল আর পুলুর কাছে আছে ফসফরাস গ্রেণেড আর গ্রেণেড-৩৬।

সন্ধ্যার কিছু পরে ঢাকার রাস্তায় সবুজ রঙের একটি টয়োটা করোনাকে দুর্নিবার গতি নিয়ে ছুটে চলতে দেখা যায়।হলিক্রস কলেজের অভিমুখে গলির সামনে এসে চটপট ঢুকে পড়ে গলির ভিতরে।গলির মাথায়,যেখান থেকে খান সেনাদের নাস্তানাবুদ করে আবার সহজেই নিরাপদে চলে যাওয়া যাবে এমন একটি জায়গায় গিয়ে নিঃশব্দে থামে সবুজ টয়োটা করোনাটি।নেকড়ের মত নিঃশব্দে কিন্তু দুর্নিবার গতিতে গাড়ী থেকে নেমে আসে দলটি।যার যার মত পজিশন নিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করে দেয়। সাথে চলে গ্রেনেড ও ফসফরাস বোমার তান্ডব।এক মিনিটের মধ্যেই খান সেনা আর পাকি পেয়ারা রাজাকারদের দিগ্বিদিক অন্ধকার করে দেয় চৌকষ গেরিলা দলটি।মুহুর্তেই মরনের সাধ পায় পাঁচ মিলিটারি পুলিশ ও ছয় রাজাকার।অপারেশন শেষ করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যায় তারা।
এই ঘটনা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে সারা ঢাকায় আর নতুন উদ্যম যোগ করে সারা দেশের মুক্তিকামী জন মানুষের মনে ।আর সেইসাথে ব্যাপক ভীতি সঞ্চার করে খান সেনা আর তাদের দোসর রাজাকারদের মধ্যে। এভাবেই অনেকগুলো সফল অপারেশন চালায় এই ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা।

সফল এই অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন বদিউল আলম।হুমায়ুন আহমেদ পরিচালিত “আগুনের পরশমণি” ছবিটি মূলত তার উপর ভিত্তি করেই নির্মিত হয়।তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের একজন এক্স ক্যাডেট ছিলেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী এবং করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

২৯ আগস্ট ধানমন্ডিতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর জালাল উদ্দিন সাহেবের বাসায় তাঁর ছেলে ফরিদ, জাফর আহমেদ ও পারভেজ হাসানদের সাথে যথারীতি তাশ খেলছিলেন বদিউল। এখানে বুন্ধুদের সাথে প্রায়শই তিনি তাশ খেলার আড্ডায় বসতেন। তারা যখন খেলায় মত্ত, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাক-বাহিনীর একটি দল হঠাৎ করেই বাড়ি ঘেরাও করে। বদিউল জানালা টপকে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তা কাজে আসেনি। পাক-হায়েনারা সেখান থেকে শুধু বদিউলকেই ধরে নিয়ে যায়। এরপরে তার আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। দেশ স্বাধীন হলে শহীদ বদিউল আলমকে বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত করা হয়।


তথ্যসূত্রঃ 

মূলত ইন্টারনেটভিত্তিক
একাত্তরের দিনগুলি-জাহানারা ইমাম



-দিবস কান্তি দাস

No comments:

Post a Comment