Subscribe:

স্মৃতিকথা

সেদিন ছিল শনিবার। সকাল ৯ টা।  মোবাইলটা বেজে উঠল। ঘুম ঘুম চোখে মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই ঘুম গায়েব। শ্রাবণীর কল।

-- "হ্যালো ।"  -- "হ্যালো নীল, এখনো ঘুম থেকে উঠিসনি ? এক্ষণি উঠ।" 
--  "কেনো?" 
--  " আমি এখন কোথায় জানিস?" 
--  "কোথায়?" 
--  "তোর এলাকায়।" 

-- "আমার এলাকায় মানে?" 
--  "হু, আমি কলা ভবনের সামনে আছি। ৫ মিনিটের মধ্যে আয়।" 
          

 শ্রাবণী। আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। বন্ধু বলা ঠিক হবে না। কারণ, স্কুলে থাকতে একদিনও আমি আর শ্রাবণী ঝগড়া না করে থাকতাম না। প্রতিদিনই কিছু না কিছু নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া হতই। যেদিন ঝগড়া হত না, সেদিন যেন আমাদের পেটের ভাত হজম হত না, পরদিন তাই সকাল সকাল ক্লাসে গিয়েই শুরু হয়ে যেত। কখনো কখনো ঝগড়া এমন পর্যায়ে যেত যে ৩/৪ দিন কেউ কারো ছায়া পর্যন্ত মারাতাম না। পরে আবার কথা শুরু হতো ঝগড়া দিয়েই। বেশিরভাগ দিনই আমিই কথা শুরু করতাম। যেদিন স্কুলে শেষ ক্লাস করলাম, সেদিন শ্রাবণী বলেছিল, তোমাকে অনেক মিস্‌ করব নীল। আমি কিছুই বলিনি। শুধু মনের অজান্তে কোথায় যেন একটা কষ্ট অনুভব করেছিলাম, কিছু হারানোর কষ্ট, কিছু ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। তারপর ছয়টা বছর আর শ্রাবণীর সাথে আমার কোন যোগাযোগ হয়নি। সময়ের স্রোতে স্মৃতিকে বিসর্জন দিয়ে গড্ডালিকা প্রবাহে দিন কাটাতে লাগলাম। কলেজ পেড়িয়ে ভার্সিটিতে পা রাখলাম। মাঝে মাঝে শ্রাবণীর কথা মনে পড়ত, কিন্তু নিতান্তই মনে পড়ার ছলে বিস্মৃতির তলে হারিয়ে যেত স্মৃতিগুলো। ভার্সিটির ক্লাসগুলো যখন চরম  boring লাগতো, তখন প্রায়ই মিস্‌ করতাম শ্রাবণীকে, ইচ্ছে হত আবার যদি শ্রাবণীর সাথে স্কুলের দিনগুলোতে ফিরে যেতে পারতাম।        

 আজ প্রায় ছয় বছর পর শ্রাবণীর সাথে দেখা হতে যাচ্ছে। ফেইসবুকের কল্যাণে গত কয়েকদিন আগে আবার যোগাযোগ হয় শ্রাবণীর সাথে। ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে বের হলাম। একটা রিক্সা নিয়ে ছুটলাম কলা ভবনের দিকে। কলা ভবনে পৌঁছে কল দিলাম। 
-- "কোথায় তুই ?"

-- "তোর পিছনে।"            

 পিছনে ফিরতেই দেখি সেই চিরচেনা হাসি, যেই হাসিটা দেখলে স্কুলে আমার গা জ্বলে উঠত, আবার সেই হাসি না দেখে থাকতেও পারতাম না। হাসিটা আজ খুব ভালো লাগলো। শ্রাবণ মেঘের আড়াল থেকে উকি মারা সূর্য যেন এক চিলতে রোদ দিয়ে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। আমি শ্রাবণ মেঘের সেই রাজকন্যার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম। 
-- "কিরে, তুই তো দেখি অনেক বড় হয়ে গেছিস ।" শ্রাবণীর কথায় সম্বিত ফিরে পাই আমি।
-- "তুইও অনেক বড় হয়ে গেছিস। আর.......।" বলতে গিয়েও থেমে যাই আমি।
-- "আর কি ?"
-- "নাহ, কিছু না।" আমি ইত্স্থতঃ বোধ করি।"
-- "আরে বলে ফেল, আমিই তো।"
আমি শ্রাবণীর দিকে না তাকিয়ে বলি, " অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস আগের চেয়ে।"
শ্রাবণী এক হ্রাস বিস্ময় নিয়ে তাকায় আমার দিকে, "নীল, তোর মাথা ঠিক আছে তো ?"
-- "কেনো ?"
-- "না, জীবনে এই প্রথম তুই আমার প্রশংসা করলি।"         
 আমি কিছু বলি না, শুধু হাসি।



         শ্রাবণী বলে, "নাস্তা করিসনি নিশ্চয়ই?"........আমি মাথা ঝুঁকিয়ে হা বোধক সম্মতি দেই।.......শ্রাবণী বলে, "চল, জলদি নাস্তা করে নে। তারপর সারাদিন ঘুড়ব। তোর সাথে অনেক গল্প আছে।"

আমরা পাবলিক লাইব্রেরীর ক্যান্টিনে এসে বসি। শ্রাবণী আমার মুখোমুখি বসে। সকালের সূর্যটা জানালার ফাঁক গলে শ্রাবণীর মুখে এসে পড়ে। একটা অদ্ভুত আলো আধারির মায়াজাল তৈরি হয় ওর মুখটায়। আমি শুধু তাকিয়ে দেখি। শ্রাবণী অনর্গল কথা বলেই যায়। এতদিনের জমানো সব কথা যেন একসাথে বেরিয়ে আসতে থাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি কথাগুলো। কোনোটা আমার কানে ঢুকে, আর কোনোটা কানের ২ ইঞ্চি পাশ দিয়ে চলে যায়, কারণ শ্রাবণীর মুখের দিকে তাকিয়ে আমি হারিয়ে যেতে থাকি দূর থেকে দূরে, তাই কথাগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেও তা মস্তিষ্ক অবধি পৌঁছে না।       

 নাস্তা শেষ করে আমরা রিক্সায় উঠি। গন্তব্য - অজানা। উদ্দেশ্য - ঘুড়ে বেড়ানো। 




   রিক্সায় করে ঘুড়তে ঘুড়তে সিদ্ধান্ত নিলাম লালবাগের কেল্লায় যাব। আমিও আগে কখনো যাইনি, শ্রাবণীও যায়নি। লালবাগের কেল্লায় ঘুড়তে ঘুড়তে দুপুর হয়ে গেল। দুপুরে পুরান ঢাকায় লাঞ্চ করলাম আমরা। তারপর গেলাম আহসান মন্জিলে। সেখানে বিকাল পর্যন্ত থাকলাম। সারাদিন ঘুরাঘুরি শেষে এবার ফিরার পালা।  কিন্তু আমার তখন শ্রাবণীকে বিদায় জানাতে ইচ্ছে করছেনা। শ্রাবণীর মনেও কি একইরকম ইচ্ছে হচ্ছে ? সারাদিন শ্রাবণী আর আমি অনেক গল্প করেছি। গত ছয় বছরে কি কি ঘটেছে, কার কার সাথে পরিচয় হয়েছে, কলেজ লাইফের গল্প, ভার্সিটির গল্প, টুকিটাকি অনেক গল্প করলাম আমরা। গল্প যেন ফুরোতেই চায়না। বিদায়ের বেলায় তাই মনটা কেমন যেন করে উঠল। সৃষ্টিকর্তার প্রতি কিছুটা অভিমান হল, দিনটা আরেকটু বড় করলে কি এমন ক্ষতি হত, আজকের সূর্যটা একটু দেরিতে অস্ত গেলে কি খুব বেশি সমস্যা হত?     

 শ্রাবণীকে বাসায় পৌছে দিলাম। যতক্ষণ ওকে দেখা গেছে দূর থেকে তাকিয়ে দেখেছি। বাসায় ফিরার পথে মনটা কেমন যেন শূণ্যতায় ভরে উঠল। খানিক পরেই শ্রাবণী কল দিল। 
-- "বাসায় পৌছেছিস ?"
-- "না, এখনো না। আরেকটু সময় লাগবে।".....আমি উত্তর দেই।

-- "ওকে, বাসায় পৌছে ফোন দিস। আর সাবধানে যাস।"......বলেই ফোন রেখে দেয় শ্রাবণী।      

 জীবনটা আমার বাঁক নিতে শুরু করেছে আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। হৈমন্তীকে পেয়ে অপুর যেমন মনে হয়েছিল "আমি ইহাকে পাইলাম", ঠিক তেমনি আমার মনে হচ্ছিল আকাশের চাঁদ তারা গুলো যেন আমাকে ধরা দিতে শুরু করেছে, কিন্তু আমি তাদের ধরার কোন চেষ্টাই করছি না, কারণ তাদের চেয়ে আরো শত কোটি গুণ মূল্যবান কিছু আমার জন্য হাতছানি দিচ্ছিল। শ্রাবণী আমার জীবনে ধ্রূব সত্য হয়ে দেখা দিয়েছিল। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, যে কোন মূল্যেই হোক শ্রাবণীকে আমি আর হারাতে দিবনা আমার জীবন থেকে। শ্রাবণী আমার জীবনে ক্ষণজীবিনী রাত্রি বিদায়ের শিশির বিন্দুটি নয়, সে আমার জীবনের আজ এবং আগামীর বৃষ্টিধারা।      

 সেদিন রাতে অনেক গল্প করি আমরা ফোনে। ঘুমকাতর আমার ঘুম যেন স্বর্গরাজ্যে বেড়াতে চলে গেল। আমার মনে আছে, সেদিন ভোর সাড়ে ৫ টা পর্যন্ত গল্প করি আমরা। শেষে শ্রাবণী জোর করে ঘুমোতে পাঠায় আমাকে। ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে আসে শ্রাবণ. হ্যা শ্রাবণ, আমার জীবনের স্বপ্নীল স্রোতস্বিনী শ্রাবণী।      

 পরদিন সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে যায়। আমার ঘুম আর ভাঙ্গে না। ১টার দিকে ফোন দেয় শ্রাবণী। 
-- "এখনো ঘুমাচ্ছিস ? বেলা কয়টা হল খবর আছে?"
-- "আরেকটু ঘুমোই না, প্লিজ।".....ঘুম ঘুম চোখে বলি আমি।
-- "না, আর এক মুহূর্তও না, এক্ষণ উঠ। আমি পাঁচ মিনিট পর আবার ফোন দিচ্ছি, মুখ ধুয়ে আয়, যা।"  


 নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও বিছানা ছাড়ি। সুবোধ বালকের মত পাঁচ মিটের মধ্যে মুখহাত ধুয়ে আসি। একেই বুঝি বলে............যেই আমি কিনা ৫/৬ বার না ডাকলে ঘুম থেকে উঠতাম না, সেই আমি একটা ফোনকলেই উঠে গেলাম? নিজের এই পরিবর্তনে খুব খুশী না হলেও খারাপ লাগে না। অন্তঃত একজন মানুষ তো আমার ঘুম ভাঙ্গার জন্য অপেক্ষা করছে, আমার কথা ভাবছে......এটা ভাবতেই একটা অন্যরকম ভালো লাগা ভর করে আমার উপর।      

 সেদিনের পর থেকে প্রতিদিন শ্রাবণী আমাকে ঘুম থেকে ডেকে দিত। আবার যেদিন আমি আগে উঠতাম সেদিন আমি ওকে ডেকে তুলতাম। আমি রাত জেগে পড়তাম, আর শ্রাবণী আমাকে কিছুক্ষণ পরপর কল দিয়ে জাগিয়ে রাখত। কখন খাবো, কখন ঘুমাবো, কখন পড়ব- এই বিষয়গুলো আর আমার হাতে থাকে না.....আমার অন্তর জগতের রাজকন্যা তার নিজ দায়িত্বে আমার ভালো মন্দ সকল কিছুর দায়িত্ব নিজ হাতে তুলে নিল। আমিও শ্রাবণীর অনেক খেয়াল রাখতাম। এভাবে দিন দিন আমাদের মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে। যদিও আমরা কেউ কাউকে কখনো বলিনি যে ভালোবাসি, কিন্তু দুইজনই বুঝতে পারতাম। আর দুইজন বুঝতে পারতাম বলেই হয়তো বলার কোন প্রয়োজন পড়েনি। আমাদের একজনের কষ্ট অন্যজনকে অনেক বেশি কাঁদাতো। আবার ছোট ছোট আনন্দগুলোও নিজেদের মধ্যে শেয়ার না করা পর্যন্ত যেন আনন্দের প্রকৃত সাধ উপলব্ধি করতাম না।   

   একদিনের একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। সেদিন রাতে শ্রাবণী আমার সাথে ফোনে কথা বলছিল। কথা বলতে বলতে চা ঢালতে গিয়ে হঠাৎ ও নিজের হাতে গরম চা ঢেলে দেয়। ফোনেই আমি 'ওফ' শব্দ শুনতে পাই। আমি জিজ্ঞাসা করায় বলে কিছু না, কিন্তু আমি জোর করায় ও বলতে বাধ্য হয়। সেই মুহূর্তে আমার যে কেমন লেগেছিল সে কথা বলে বুঝাতে পারব না। শ্রাবণীর অনেক কষ্ট হচ্ছিল, আর আমি দূর থেকে কিছুই করতে পারছিলাম না। শ্রাবণীর কষ্টের কথা ভাবতেই চোখে পানি এসে পড়ল। স্রষ্টার কাছে শুধু প্রার্থনা করলাম, "তুমি আমাকে কষ্টটা দিয়ে ওকে ভালো করে দাও খোদা, ছোট্ট মেয়েটা তো এত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।" শ্রাবণী ছিল ছোট্ট বাচ্চাদের মত innocent, আমার কাছে ওকে মনে হত ছোট্ট একটা পরীর মত, জীবনের কিছুই যেন বুঝত না সে আমাকে ছাড়া। সেদিন সে বলেছিল, "নীল, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তুমি এসে যদি একবার আমার হাতটা জড়িয়ে ধরতে, আমার কষ্ট অনেক কমে যেত।" ইচ্ছা করছিল ছুটে যাই আমার শ্রাবণধারার কাছে, দুহাত দিয়ে ওর হাতটাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলি, "তোকে এতটুকু কষ্টও পেতে দিব না আমি, তোর সবটুকু কষ্ট আমাকে দিয়ে দে।"......কিন্তু যেতে পারিনি, এতরাতে ওর বাসায় আমার উপস্থিতিটা কেউ স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখত না। দূর থেকে সহ্য করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না, যদিও ওর হাতের জ্বলাটুকু আমার হৃদয়টাকে অনেকখানি জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। প্রকৃতি ও সমাজের কাছে আমরা নিতান্তই অসহায়। কে জানত, ভবিষ্যতে হয়তো আরও অনেক অসহায়ত্ব অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য........ 





         সকাল থেকে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। সারা আকাশ মেঘলা। মেঘলা আকাশ আমার একদম ভালো লাগতো না আগে। কিন্তু আজ আকাশটাকে অনেক ভালো লাগলো। আড়মোড়া ভেঙ্গে ঘুম থেকে উঠে ঘড়ির দিকে তাকালাম, এ কি !!! ১০ টা বাজে, ১১টার সময় শ্রাবণীর সাথে কফি হাউসে দেখা করার কথা। তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে বের হলাম। আমার লাল রেইনকোটটা নিলাম সাথে, এটার রং দেখে শ্রাবণী প্রথমদিন খুব হেসেছিল। শ্রাবণী যখন হাসে তখন আমার অদ্ভুত এক আনন্দ লাগে। ইচ্ছে করে এমনই হাসিমুখে যদি ওকে সারাটা জীবন রাখতে পারতাম।        

 কফি হাউসের ভিতরটা একবার উঁকি মেরে দেখলাম, নাহ এখনো আসেনি শ্রাবণী। বাইরে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম আমি। খানিক পরেই একটা রিক্সা এসে থামলো, রিক্সার ভিতর থেকে উঁকি দিল শ্রাবণী, হাত দিয়ে আসার জন্য ডাক দিল আমাকে।         
"রিক্সায় উঠ".... আদেশের সুরে বলল শ্রাবণী। সুবোধ বালকের মত রিক্সায় উঠলাম আমি। শ্রাবণী আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, " তোকে না বললাম এই রেইনকোটটা পড়লে তোকে কার্টুনের মত দেখায়, তারপরও আজ আবার পড়েছিস?"        
"কার্টুন দেখলে তোর হাসি পায় শ্রাবণী ?"       
"পায়-ই তো।"        
"সেজন্যই তো পরি, তোর হাসিটা দেখতে আমার খুউব ভালো লাগে।"        

 " তাই বুঝি, খুব কথা বলা শিখেছিস, তাই না !"         

 রিক্সায় করে ঘুড়তে ঘুড়তে একসময় বৃষ্টি ঝুম বৃষ্টিতে রূপ নেয়।। শ্রাবণী আমাকে বলে, " চল্‌, বৃষ্টিতে ভিজি।" শ্রাবণীর এমন অকস্মাৎ বৃষ্টিতে ভিজার আহবানে আমি একটু হকচকিয়ে উঠি। ও যে কতটা সহজ-সরল সেটা ওর এসব শিশুসুলভ আচরণ থেকেই বুঝতে পারতাম। শ্রাবণীর ভিতরের মনটা ছিল তাপ লাগা মোমের মত নরম। সেই মনে অনেক ছোট ছোট দুঃখ কষ্ট চেপে রেখেছিল মেয়েটা। শুধু আমি জানতাম এসব দুঃখ কষ্টের কথা। তাই মনে মনে আমার প্রতিজ্ঞা ছিল, যে কোন কিছুর বিনিময়ে শ্রাবণীর মুখের হাসিটাকে ধরে রাখব, রাখতেই হবে, কারণ, আমি যে ওকে অনেক বেশি ভালোবাসি।        

 সেদিন দুজনে অনেক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম। শ্রাবণীর বৃষ্টিভেজা হাতটা যখন প্রথমবার ধরেছিলাম, ও একটু কেঁপে উঠেছিল। আমার হাতের মাঝে নরম হাতটাকে খুব যত্নে রেখেছিলাম, ওর হাতটুকু যেন অত্যন্ত নিরাপদ আশ্রয় খুজে পেয়েঁছিল আমার মাঝে। শ্রাবণীর চোখে পরম আনন্দের চরম এক অনুভূতি দেখেছিলাম সেদিন। হঠাৎ বিকট গর্জনে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। আকস্মিক ভয়ে শ্রাবণী জড়িয়ে ধরল আমাকে। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ স্ফূলিঙ্গ খেলে গেল। শ্রাবণী চোখ বন্ধ করে আমার বুকে মাথা রাখল। আমিও হাত দিয়ে ওকে আগলে রেখেছিলাম, যেন মহাবিশ্বের সকল অপশক্তির হাত থেকে আড়াল করে রেখেছি আমি ওকে। বর্ষার নুপুরধ্বনি ছন্দে বি-চ্ছন্দে নৃত্য করছিল আমাদের ঘিরে, প্রকৃতি যেন তার সুর-লহরী মেলে দিয়েছিল আকাশে বাতাসে। অসাধারণ সে মুহূর্ত, অপরিমেয় সে অনুভূতি।         

 বৃষ্টি শেষে কফিহাউসে ঢুকলাম আমরা। গরম ধোঁয়া উঠা কফি খেলাম তৃপ্তি ভরে। কফি হাউসের পাশেই ফুলের দোকান। সেখান থেকে গাজরা কিনে শ্রাবণীর খোপায় গুজেঁ দিয়েছিলাম। কি যে অপরূপ সুন্দরী লাগছিল ওকে সেই মুহূর্তে তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। স্বর্গের অপ্সরীও শ্রাবণীর সৌন্দর্যের কাছে হার মেনেছিল সেদিন। বৃষ্টিস্নাত সমগ্র প্রকৃতি সাক্ষী, এত সৌন্দর্য এর আগে আমি কখনো দেখিনি, ভবিষ্যতেও কখনো আর দেখব কিনা জানি না। রজনীগন্ধা শ্রাবণীর খুব পছন্দ। গুনে গুনে আটটা রজনীগন্ধা তুলে দিলাম শ্রাবণীর হাতে। এই আটটা রজনীগন্ধার আটটা অর্থ আছে। শ্রাবণীও জানে সেটা। ফিরার পথে আমাকে একটা সিডি কিনে দিল শ্রাবণী--- শ্রীকান্ত আচার্যর "আমার সারাটা দিন, মেঘলা অকাশ, বৃষ্টি, তোমাকে দিলাম......"         

 আসলেই সেদিন শ্রাবণী ওর সারাটা দিন, মেঘলা অকাশ, বৃষ্টি আমাকে দিয়েছিল। সেই দিনটা চলে গেছে। কিন্তু শ্রাবণীর সাথে প্রথম বৃষ্টিতে ভিজার সে অনুভূতি আজও আমার স্মৃতিতে চির অমলিন। তারপর থেকে প্রায়ই আমরা  বৃষ্টিতে ভিজতাম, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে রিক্সায় করে ঘুড়ে বেড়াতাম, কখনো হাটতে হাটতে অনেক দূর চলে যেতাম। একদিন বৃষ্টিতে ভিজার পর আমার জ্বর হল। সেদিন শ্রাবণী কেঁদে কেঁদে বলেছিল, "আমার জন্যই তোর এমন হল, আমি যদি বৃষ্টিতে না ভিজতে চেতাম, তাহলে তুই আজ অসুস্থ হতি না।" আমি ওকে আশ্বস্ত করার অনেক চেষ্টা করলাম। মনে মনে শুধু বলেছিলাম, "শ্রাবণকন্যা, তুই আমাকে এত বেশি ভালোবাসিস কেন ?"...শ্রাবণকন্যা হয়তো আমার মনটাও পড়তে পারতো, তাই যাওয়ার বেলায় বলেছিল, "আমি যদি তোর খেয়াল না রাখি তাহলে আর কে রাখবে, বল্‌ ।" 



        
 সাদা শাড়ি, লাল পাড়...ছোট্ট একটা লাল টিপ...আর খোপায় গোঁজা একটা রক্তলাল গোলাপ। পায়ের নুপুরে সুর তুলে তড়িঘড়ি করে সামনে এসে দাড়ালো শ্রাবণী...
-"স্যরি, লেইট করে ফেলেছি।"
আমি ঘড়ি দেখলাম, " খুব বেশি না, মাত্র ত্রিশ মিনিট লেইট করেছিস।" বলেই কিছুটা রাগ হওয়ার ভান করলাম আমি।

শ্রাবণী তার স্নিগ্ধ হাসিটা দিয়ে আহ্লাদ করে বলল, " মাত্র তিরিশ মিনিটই তো লেইট করেছি, শোন্ না, এত রাগ করিস কেন, ত্রিশ ঘন্টা তো আর করিনি, তাইনা?"...আমি মনে মনে বলি, ত্রিশ ঘন্টা কেন, তোর জন্য ত্রিশ বছরও অপেক্ষা করতে কোনো সমস্যা নেই আমার...       

 আজ পহেলা বৈশাখ। বছরের প্রথম দিন, তাই আর ঝগড়া করলাম না বেশি। বছরের প্রথম দিনটা খারাপ গেলে নাকি পুরো বছরটা খারাপ কাটে। আচ্ছা, প্রথম দিনটা ভালো কাটলে যে পুরো বছরটা ভালো কাটবে তার কি কোনো গ্যারান্টি আছে? না থাকুক, তারপরও, শ্রাবণীর সাথে স্কুল জীবনে অনেক বৈশাখ উদ্‌যাপন করলেও আজকের বৈশাখটা একটু অন্যরকম। শ্রাবণীর উপর খুব বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারিনা আমি, শ্রাবণীও সেটা জানে। তাই তো আমি যখন রাগ করি তখন সে আহ্লাদ দিয়ে কথা বলে আমার রাগ ভাঙ্গাতে চায়। আর শ্রাবণী যখন রাগ করে, আল্লাহ !!! মেয়েরা যে কত রাগ করতে জানে!!! পানের থেকে চুন খস্‌লেই রাগ। অন্য মেয়েদের কথা আমি বলতে পারব না, কিন্তু আমার শ্রাবণকন্যার রাগ অন্যরকম। তার রাগ মানে হল 'তোর সাথে আর কথাই বলব না...', 'তোকে যদি জিন্দিগিতে আমি আর আমার  voice শোনাই...'। আর রাগ করার পর যদি আমি কখনো মোবাইলে কল দেই সত্যি সত্যিই voice শোনায় না। কলটা রিসিভ করে হালকা গলা ঝাড়া দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় মাত্র, পরক্ষণেই নিশ্চুপ। আমিও ভালো করেই জানি শ্রাবণীর রাগ কিভাবে ভাঙ্গাতে হয়। দুই-একটা মিষ্টি কথাই যথেষ্ট। আর খুব বেশি রাগ করলে একটা সুন্দর sorry sms . ব্যাস, রাগ শেষ।  
      আজকের পুরো দিনে কি কি করব, সব কিছুই ঠিক করা আমাদের। সকালে যাব টিএসসি, দুপুর পর্যন্ত সেখানে থেকে বিকালে আশুলিয়া যাব। আশুলিয়া আমাদের দু'জনেরই খুব প্রিয় জায়গা। তুরাগ নদীর পাড়ে বাতাস আর বাতাস। সেখানে বসে বসে গল্প করতে করতে কত দিনকে যে সন্ধ্যা বানিয়েছি তা কেবল আমরাই জানি। বাতাসের সাথে সাথে কাশফুলগুলো দুলে, অসম্ভব সুন্দর সে দৃশ্য, অকল্পনীয় সে মুহূর্ত। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। নদী তীরের ঠান্ডা বাতাসে হারিয়ে গেলাম দুজনে। শ্রাবণী মনে হয় সেদিন একটু বেশিই হারিয়ে ছিল।
- " নীল, আকাশের নীলের সাথে তোর মিলটা কি জানিস ?" নদীর উপরের নীল আকাশটার দিকে তাকিয়ে বলে শ্রাবণী।
- "কি ?"
- "দু'টোই অনেক বিশাল। আর অমিলটা বলতে পারবি?"
- "কি?"
- "আকাশের নীল সবার, কিন্তু তুই শুধু আমার।" বলেই লাজুক হাসি দিয়েছিল শ্রাবণী। সেই হাসির অর্থটা আমি স্পষ্ট পড়তে পেরেছিলাম সেদিন। শ্রাবণীর চোখে মুখে সেদিন আমার জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিলাম। অনেক অনেক ভালোবাসা। শ্রাবণী সেদির প্রশ্ন করেছিল আমায়, "আকাশের নীলের মত দিন শেষে হাড়িয়ে যাবি না তো তুই, নীল?"...আমার হাত দু'টো ধরে বলেছিল, "কথা দে, কক্ষনো আমাকে ছেড়ে যাবি না।"

কথা দিয়েছিলাম সেদিন শ্রাবণীকে। যে কথা মনের ভিতরে অনেকদিন ধরেই বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছিলাম আমি। আজ কথাটা বলতে গিয়ে আবেগী হয়ে উঠি। ভালোবাসা যে কতটা গভীর হতে পারে তা ভালোবাসাই কেবল বুঝতে পারে। ভালোবাসার এই ছোট ছোট স্মৃতিগুলোই ভালোবাসাকে অম্লান করে রাখে, বাড়িয়ে দেয় ভালোবাসার প্রতি অনুরাগ।      

 সেদিন যাবার বেলায় শ্রাবণী আমাকে একটা বই gift করেছিল- সুচিত্রা ভট্টাচার্যের 'কাছের মানুষ'। আর বলেছিল, "তুই যে আমার কাছের মানুষ, এটা কি তুই বুঝিস?"...আমি শুধু হাসি দিয়ে হাঁ বোধক মাথা ঝাকিয়েঁছিলাম। সেই হাসির মধ্যেই শ্রাবণীর সব উত্তর লুকানো ছিল। মনে মনে শুধু বলেছিলাম,    "I love you more than you do." 





৫  
        শ্রাবণী আর আমি একসাথে অনেক স্বপ্ন দেখতাম, কখনো ঘুমিয়ে, কখনোবা জেগে থেকেই। বেশিরভাগ সময় স্বপ্নগুলো আমিই দেখাতাম। আর শ্রাবণী স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিভোড় হয়ে যেত। ওর দু'চোখে লেগে থাকতো স্বপ্নগুলো। মাঝে মাঝে গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যেত ওর। আর তখন বাধ্য হয়েই আমাকেও জাগতে হত ওর স্বপ্ন শোনার জন্য। আবার কখনো গভীর রাতে স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে ঘুম ভাঙতো শ্রাবণীর,  আর তখনই আমাকে ফোন করত, যেন আমার গলার আওয়াজ শুনলেই ওর সব ভয় ভেঙ্গে যাবে। একদিন রাত ৩ টার সময় ফোন দেয় শ্রাবণী...
- "হ্যালো নীল, শোন, এইমাত্র না একটা ভয়ংকর স্বপ্ন দেখেছি।"
আমি ঘুমঘুম চোখে জবাব দেই, " ভালো তো।"
- "ভালো ? আমি স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছি, আর তুই বলছিস ভালো ? যাহ, তোর সাথে আর কোন কথা নেই।"
ততক্ষণে আমার ঘুমদেবতা ইহলীলা সংবরণ করেছেন, "আরে শোন্ শোন্, 'ভালো' মানে তো 'ভালো না',  মানে 'ভালো না' বলতে গিয়ে 'ভালো' বলে ফেলেছি। এখন বল কি দেখে এত ভয় পেয়েছিস ?"
- "থাক, এখন আর শুনে কাজ নেই।" অভিমান করে বলে শ্রাবণী।
- "আরে বল্ না।" যদিও আমি জানতাম যে স্বপ্নের কথা আমাকে না বলা পর্যন্ত ওর ঘুম আসবে না, তবুও আমি অনুরোধ করি। এটা সব মেয়েই খুব পছন্দ করে। নিজের পছন্দের কাজটা অন্যের অনুরোধের পর সম্পাদন করতে তারা খুবই ভালোবাসে। শ্রাবণীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তাই আমি অনেক করে অনুরোধ করি।
- "শোন্‌ তাহলে, স্বপ্নে না তোকে দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নটা তো দুঃস্বপ্ন ছিল, তোকে বললে যদি সত্যি হয়ে যায়?"
আমি যতই বারণ করি, শ্রাবণী আমাকে  বলবেই জানি। শুধু আমার অনুরোধের জন্য প্রতীক্ষা তার, সবই বুঝি আমি। তাই বলি, "অসুবিধা নেই, বলে ফেল, আমিই তো।"
আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই শ্রাবণী অনর্গল বলতে থাকে। আর ওর স্বপ্নের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি আমি।       
 আমার পাশে অন্য কোন মেয়েকে কল্পনাই করতে পারতো না শ্রাবণী। আমাদের ক্লাসে মিরা নামের একটা মেয়ে ছিল। আমাকে একদিন ওর সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে কি যে অভিমান করেছিল শ্রাবণী, সে কথা বলে বুঝাতে পারবো না। বাসায় ফিরে ওর কপোল বেয়ে শ্রাবণধারাও নেমেছিল নিশ্চয়ই। গভীর রাতে আমাকে ফোন দিয়ে বলে, "নীল শোন, এইমাত্র না স্বপ্নে দেখলাম তুই আর মিরা বৃষ্টিতে ভিজছিস, আমি এত করে ডাকছি তোকে, তুই আমার কথা শুনিসই না, আমার সাথে তোর এমন করাটা কি ঠিক হল বল ?"
শ্রাবণীর কথা শুনে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। ও যে এত অল্পতেই এতটা আঘাত পাবে আমি ভাবতে পারিনি। আমি ওকে আশ্বস্ত করি, কথা দেই আর কক্ষনো এমনটা হবে না। সেই মুহূর্তে আমি চোখ বন্ধ করে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম শ্রাবণীর চোখ থেকে ঝর্ণাধারার মত অশ্রু বিসর্জন হচ্ছিল। নিজেকে আমার অনেক বড় অপরাধী মনে হতে থাকে। পরদিন শ্রাবণীকে ছুঁয়েপণ করি, আর কক্ষনো কোন কারণে ওকে কাঁদাবো না। তারপর থেকে আর কক্ষনো এক ফোঁটা জল ওর চোখ থেকে আসতে দেইনি আমি।      

 দেখতে দেখতে আমার পরীক্ষা চলে আসে। রাত জেগে পুস্তক সাধনা শুরু করতে হয় আমাকে। আমার সেই রাত্রি জাগরণের সাথী হয় শ্রাবণী। একটু পরপর কল আর মেসেজ দিয়ে দিয়ে জাগিয়ে রাখতো ও আমাকে। রাতে কতক্ষণ পড়ব, কখন ঘুমাবো, ঘুম থেকে কখন উঠব সবই শ্রাবণী নিজে নিয়ন্ত্রণ করত। আগে কখনো পরীক্ষার মাঝে এতটা রুটিনমাফিক চলিনি আমি। ফলশ্রুতিতে সেবার আমার পরীক্ষার ফলাফল আগের সব পরীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি ভালো হয়েছিল, এই কৃতিত্বটুকু পুরোপুরিই শ্রাবণীর। ওর ভালোবাসার কাছে চিরঋণী হয়ে যাই আমি।    
     শ্রাবণীর একবার খুব জ্বর হয়েছিল। আমাকে একেবারেই জানতে দেয়নি ও, আমি শুধু শুধু চিন্তা করব তাই । জ্বর এতটাই বেশি ছিল যে রাতে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আমি পরদিন সকালে খবর পাই। খবর পেয়ে ছুটে যাই হাসপাতালে। আমাকে দেখে ওর জ্বর যেন অর্ধেক ভালো হয়ে গিয়েছিল। অভিমান করে বলেছিল, "এত দেরি করেছিস কেন আসতে ?"      
 জ্বরের জন্য রাত থেকে কিচ্ছু মুখে দেয়নি শ্রাবণী। আমি মুখে তুলে খাইয়ে দেই ওকে, ঔষধ খাওয়াই, সারারাত ওর হাতটাকে আমার হাতের মাঝে নিয়ে বসে থাকি ওর বিছানার পাশে। সারারাতের ক্লান্তিতে ভোরে নিজের অজান্তেই চোখদুটো বন্ধ হয়ে আসে আমার। শ্রাবণীর হাতটাকে হাতের মাঝে আগলে রেখেই চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করি আমি। সকালে উঠে এ দৃশ্য দেখে প্রচন্ড রাগ করে শ্রাবণী। আমাকে বলে, "তোকে সারারাত জেগে থাকতে কে বলেছে?"..."তোর আনেক কষ্ট হয়েছে জেগে থাকতে তাই না ?"..... আমি বলি, "তোর জন্য এক রাত কেন, হাজার রাত জাগতেও এতটুকু কষ্ট হবে না আমার, শ্রাবণী।" একথা শুনে মনে মনে খুশী হলেও মুখে তা প্রকাশ করেনি শ্রাবণী, শুধু বলেছিল, "আর যদি কক্ষনো এমন করিস, তাহলে দেখবি সবাইকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাব একদিন।"

"নীল তোকে কোথাও যেতে দিবে না শ্রাবণী , কোত্থাও না।"- আমার কথা শুনে শ্রাবণীর মুখে হাসি ফুটে উঠে। সেই হাসিটা ঘাসের ডগায় ভোরের শিশির কণার মত স্নিগ্ধ - পরম শান্তির।  



৬         
 শ্রাবণী চলে গেছে আজ প্রায় দুইমাস হতে চলল। ডিসেম্বরের ৩ তারিখ, স্পষ্ট মনে আছে দিনটা। সেদিন বিকেলে শ্রাবণীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম আমি ওর ভার্সিটির সামনে। ৫ টায় আসার কথা ছিল ওর। অপেক্ষার প্রহরগুলো যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল মহাকালের অনন্ত স্রোতে। এদিকে শ্রাবণীর মোবাইলও বন্ধ। ৫টা পেড়িয়ে ৬টা বেজে যায়।  তারপর ৭টা। কখনোতো এমন হয় না। যত সমস্যাই হোক শ্রাবণী আমাকে একটা ফোন দিয়ে তো জানাবে। এক একটা সেকেন্ড সময় অনিশ্চয়তা আর অজানা আশংকায় ভরিয়ে দিচ্ছিল মনটাকে। কোন বিপদ হল না তো ওর ? এদিকে সন্ধ্যার সূর্যটাও নিজের বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে অস্তগামী হওয়ার উপক্রম করছিল। অন্ধকার নেমে আসতে শুরু করে চারদিকে। হঠাৎ কর্কশ স্বরে বেজে ওঠে  মোবাইলটা।
- "হ্যালো, নীল ভাইয়া বলছেন ?" ওপাশ থেকে কান্নাজড়িত কন্ঠ শুনতে পাই আরাফের। আরাফ শ্রাবণীর ছোট ভাই।
- "হ্যা বলছি।"
- "ভাইয়া, আপনি তাড়াতাড়ি স্কয়ার হাসপাতালে চলে আসেন।"
- "কেন?" ভয়ে আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোতে চায় না। "শ্রাবণী কোথায় আরাফ ?"         
 আরাফ স্বশব্দে কেঁদে উঠে। "ভাইয়া, আপু একটু আগে অ্যাকসিডেন্ট করেছে, আপনি এক্ষুণি চলে আসেন।"
আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। দৌড়ে একটা ট্যাক্সিতে উঠি আমি। ড্রাইভারকে দ্রুত স্কয়ার হাসপাতালে যেতে বলি। পান্থপথের মোড়ে এসে গাড়ি প্রচন্ড জ্যামে পড়ে, আর এগোতে পাড়ে না। আমি গাড়ি থেকে নেমে দৌড়তে থাকি পাগলের মত। মনে মনে স্রষ্টাকে ডাকি।           
 হাসপাতালের নিচতলায় ইমারজেন্সি রুমের সামনে আরাফকে দেখতে পাই। আমাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে আরাফ।
- "ভাইয়া, আপু আর নেই।"         

 আমি কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। আমার চারপাশের সময় যেন থমকে দাড়ায়। পুরো পৃথিবীটাকে মিথ্যে মনে হয় আমার, এইমাত্র যা শুনলাম সেটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন হয় খোদা !!!  কিন্তু না, নিষ্ঠুর এ জগতে নিষ্ঠুরতাই মহাসত্য। আমার চারপাশে ঘন অন্ধকার নেমে আসে। মাটিতে লুটিয়ে পড়ি আমি, জ্ঞান হারাই।    

        অনেক্ষণ পর আমার জ্ঞান ফিরে আসে। শ্রাবণীকে যে ঘরে শুইয়ে রাখা হয়েছে আমাকে সে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।  শ্রাবণী এখানে শুয়ে আছে আর ওর সৌন্দর্যের আলোয় সমস্ত ঘর আলোকিত। আমার প্রেয়সী, মৃত্যু তোমার জীবনের সমস্ত মধু পান করে নিয়েছে তবু তোমার সৌন্দর্যকে ম্লান করতে পারেনি এতটুকু। তুমি মৃত্যূতে পরাজিত নও, সৌন্দর্য আজ তোমার রক্তিম ঠোঁট ও গালে লেগে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন এখনই ঘুম ভেঙ্গে উঠে এসে পরম ভালোবাসায় আমাকে আপন করে নিবে আগের মত। শ্রাবণীর ঘুম আর কক্ষনো ভাঙ্গে না। আমাকে একা রেখে অনেক নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ও কবরে।   

        সময় গড়াতে থাকে। কিন্তু আমার কাছে শ্রাবণহীন প্রতিটা ক্ষণ দূর্বিষহ মনে হতে থাকে। আমার প্রতিটা কাজেই আমি শ্রাবণীর ছোঁয়া অনুভব করি। শ্রাবণীর দেওয়া উইন্ড চাইমটা আজও টুংটাং শব্দে বাতাসে ঝংকার তুলে - শ্রাবণীর অনুপস্থিতিটাকে খুব বেশি মনে করিয়ে দেয়। আজও মাঝে মাঝে মনের অজান্তেই শ্রাবণীর ফোনে কল দিয়ে ফেলি, ওপাশ থেকে অপারেটরের যান্ত্রিক শব্দে সম্বিৎ ফিরে পাই। আমার ভিতরের শূন্যতা কেবল আমিই অনুভব করি। আমার চোখের পানি দূর থেকে দেখতে পায় শ্রাবণী, তাইতো স্বপ্নে সেদিন এসে খুব করে বকে গেছে আমাকে, "বোকা ছেলে, ছেলেরা এভাবে কাদেঁ নাকি?" পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় প্রতিশোধ হল ক্ষমা। শ্রাবণীর দূর্ঘটনার জন্য যে ঘাতক বাসটি দায়ী ছিল সেটাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।            

 শ্রাবণী আজ নেই, কিন্তু শ্রাবণীর স্মৃতিগুলো আজও আমি বয়ে বেড়াচ্ছি আমার মাঝে। আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে তোমার স্মৃতি আজীবন থাকবে শ্রাবণকন্যা। তুমি আমার অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের কল্পনা আর ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা। তাই তোমাকেই উৎসর্গ করলাম আমার এই স্মৃতিকথা। 


(আমার জীবনের  সত্য কাহিনী অবলম্বনে  রচিত, শুধুমাত্র শেষ অংশটুকুতে  সত্য থেকে সামান্য পরিবর্তন  করে লিখেছি কাহিনীর প্রয়োজনে)
ফয়সাল মোস্তফা
ফেইসবুক আই ডি : faisalmaximus
ইমেইল : faisalmaximus@yahoo.com

No comments:

Post a Comment