Subscribe:

ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া

যারা বাবাইকে ব্যক্তিগত ভাবে চেনে, তারা জানে বাবাইয়ের একটা ছদ্মনাম আছে। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। এই নামের উদ্ভাবক সে নিজেই। এবং তার এই নাম নিয়ে জাহিদ ও নোভেরা বর্তমানে মহা দুশ্চিন্তায় আছে। বাবাইয়ের বয়স পাঁচ বছর এবং সবে মাত্র লিখতে শিখেছে ও। কিন্তু সারা ঘর-বাড়ির যতটুকু হাতের নাগালে পায়- চক আর রঙ পেন্সিল দিয়ে নিজের দেয়া নাম লিখে ভরিয়ে ফেলেছে- “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া”! বাসায় কোনো মেহমান বেড়াতে এলে বাবাইকে যখন জিজ্ঞেস করে, “বাবু তোমার নাম কি?”


বাবাই গম্ভীর মুখে জবাব দেয়, “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া।”
সবাই তখন হাসি চেপে বলে, “ভাল নাম কি?”
“ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া বাবাই!” কঠিন মুখে প্রশ্নকর্তার দিকে তাকায় বাবাই।
নোভেরার ছোট বোন মিথিলা গত সপ্তাহে পরীক্ষা শেষে বাসায় এসেছে বেড়াতে। সেদিন ঘরে ঢুকেই সে আবিষ্কার করল বাবাই ওর মাথায় ছোট একটা হেলম্যাট পরে খুব গম্ভীর মুখে খাবারের টেবিলের নিচে বসে মনোযোগ দিয়ে একটা খাতায় পেন্সিল দিয়ে কিছু লিখছে। পাশে দাবার বোর্ড সাজানো। খেলবে মনে হয়। মিথিলা ব্যাগ রেখে ঝুঁকে ডাকল ওকে, “বাবাই সোনা? কি করো টেবিলের নিচে?”
বাবাই খাতা থেকে মুখ না তুলে ভারী গলায় বলল, “ডায়েরী লেখি খালা মণি।”
মিথিলা আগ্রহি মুখে দাবার বোর্ডটা ঠেলে সরিয়ে টেবিলের নিচে এসে ঢোকে, “কি লেখো?”
খটাস করে খাতাটা বন্ধ করে দেয় বাবাই, “গোপন মিশনের কথা। তোমাকে দেখানো যাবে না।”
মিথিলা অবাক হয়ে দেখল খাতার কভারে ভাঙ্গা ভাঙ্গা করে লাল রঙ পেন্সিল দিয়ে বাবাই লিখেছে- “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার গোপন মিশন সমূহ”

কৃত্রিম দুঃখি ভাব দেখালো মিথিলা, “আমাকেও দেখাবে না? তোমার একমাত্র খালামণি কে?”
“না।” কঠোর গলায় সাফ মানা করে দিল বাবাই।
“না দেখালে কিন্তু কেঁদে ফেলবো! ভেউ ভেউ!” কান্নার ভান করে মিথিলা।
বাবাইয়ের মনটা একটু নরম। খালামণিকে কাঁদতে দেখে সে খাতাটা এগিয়ে দিল।
“নেও দেখো। আম্মুকে দেখাবা না। আম্মু খালি থাবড়া দেয় কিছু করলেই।” সামান্য দুঃখি গলায় বলল। সুতরাং মিথিলাকে কথা দিতে হল যে সে বাবাইয়ের আম্মুকে কিছু বলবে না।
খাতা খুলে মিথিলার আক্কেল গুড়ুম। পেন্সিল দিয়ে বাবাই নানান ধরণের দৈত্য এঁকে রেখেছে। তার ফাঁকে ফাঁকে গাবদা গোবদা অক্ষরে লেখা-
      ১. আজকে বাসার পিছনের ড্রেন থেকে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া একটা বেড়াল ছানাকে উদ্ধার করেছে। তাকে লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আম্মুর শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করাতে পারলে ভাল হত। কিন্তু আম্মু শ্যাম্পু ধরতে দেয় নাই। কান ধরে বাথরুম থেকে বের করে দিয়ে বলেছে, “দূর হ সামনে থেকে বান্দর কোথাকার! যেখান থেকে এনেছিস সেখানে রেখে আয়!” ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া বেড়ালটাকে ডাস্টবিনের কাছে ছেড়ে দিয়ে এসেছে। ওখানে বেড়ালটার মাকে পাওয়া গেছে। 
      ২. আজকে কারেন্টের দুইটা তার ছিঁড়ে এক করে জোড়া দিয়ে সুইচ টিপে দিয়েছি। কিন্তু কেন জানি আমাদের বিল্ডিং এর মেইন সুইচে আগুণ ধরে গেছে। আমি আগুণ নিভাতে পানি নিয়ে গেছিলাম। আম্মু কোত্থেকে জানি এসে কান ধরে টানতে টানতে বাসায় নিয়ে গেছে। ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার মন খারাপ। বিন্তির সামনেই আম্মু কান ধরে নিয়ে গেছে বাবাকোয়াকে! 
এরকম প্রায় দশ বারোটা ঘটনা লেখা। মিথিলা খুব অবাক হল- এতটুকুন বাচ্চা কত সুন্দরে করে লিখে ফেলেছে ঘটনা গুলো! দুলাভাইয়ের হাত পেয়েছে বোঝা যায়। জাহিদ এরকম লেখা লেখি করত বিয়ের আগে। এখন কমিয়ে দিয়েছে। কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। কিন্তু বাবার ধারা বজায় রেখেছে বাবাই- সেটা বোঝা গেল।
বাবাইয়ের খাতার মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখা। বাকি পৃষ্ঠা গুলো খালি। এখানে শেষ দিকে লিখেছে সে-
             “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার একজন পাখি সঙ্গী দরকার।”
মিথিলা ওই লাইনটা পড়া মাত্রই বাবাই বলে উঠল, “খালামণি? একটা পাখি কিনে দাও না? আমার ঘাড়ে বসে থাকবে।”
মিথিলা হেসে ওর গাল টিপে দিল, “আচ্ছা দিবো। কি পাখি চাই আমার বাবাই সোনাটার?”
“বড় পাখি। অনেক বড় পাখি।” হাত দিয়ে দেখালো সাইজ।
মিথিলা মুখ টিপে হাসল, “যাও দিবো কিনে। খুশি তো?”
বাবাইয়ের মুখে হাসি আর ধরে না। সে দাবার বোর্ড টেনে নেয়। এখন খালামণির সঙ্গে দাবা খেলবে। মিথিলা খাতাটা কোলের ওপর খুলে রেখে দাবা খেলতে লাগল বাবাইয়ের সঙ্গে।
নোভেরা গোসল করে বাথরুম থেকে বেরিয়ে অবাক হয়ে দেখল মিথিলা আর বাবাই ডাইনিং টেবিলের নিচে বসে দাবা খেলছে। মিথিলা কোলের ওপর খুলে রাখা খাতাটার পৃষ্ঠা উল্টে উল্টে দেখছে আর চাল দিচ্ছে। বেশ কিছুদিন ধরে বাবাইকে ঐ খাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে কি সব লেখতে দেখে নোভেরা। জিজ্ঞেস করলেই খাতা লুকিয়ে ফেলে। দেখবে দেখবে করেও দেখা হয়নি। মিথিলাকে দেখেই বলে উঠল, “কিরে? তুই কখন এলি? টেবিলের নিচে কি?  আর ঐ খাতায় কি এত পড়ছিস?”
মিথিলা কিছু বলার আগেই বাবাই খাতাটা নিয়ে বন্ধ করে ফেলল, গম্ভীর গলায় বলল, “গোপন জিনিস। বলা যাবে না।”
মিথিলা হেসে চোখ টিপল নোভেরার দিকে চেয়ে, “ক্যাপ্টেন বাবাকোয়ার অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র। জন সাধারণের জন্য নিষিদ্ধ!”
সরু চোখে বাবাইয়ের দিকে তাকালো নোভেরা। টেবিলের আরো ভেতরে সিঁটিয়ে গেল বাবাই। একটা নিঃশ্বাস ফেলে নোভেরা বলল, “বান্দরটা সারাদিন ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুঁড়িয়ে অঙ্গার করে তারপর খাতায় সেই সব অ্যাডভেঞ্চার লেখে বেড়ায়- না? কান ধরে আচ্ছা মত ধোলাই দিলেই সোজা হয়ে যাবে।” কঠিন হয়ে গেল মুখ।
বাবাইয়ের হয়ে সাফাই গাইলো মিথিলা, “আহহা! এত বকো কেনো আপু? আমাদের বাবাই দুলাভাইয়ের মত কত সুন্দর করে লেখে!”
“তোর দুলাভাই হয়েছে এক বান্দর, এইটা হয়েছে তার ছাও! দুই বান্দরের অত্যাচারে আমি আছি মহা বিপদে! যখন তখন পিঠা বানিয়ে দিতে বলে। রেগে গেলে বাপ বেটায় মিলে সুর করে বলে-
‘গাল ফুলানির মাউ
পিঠা ভাজা দাউ,
এত পিঠা খাবে কে?
বিন্তিকে দিয়ে দাউ!”
মিথিলা তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। হাসবে কিনা বুঝতে পারছে না।
“হাসপাতালেও গিয়ে রুগী দেখে শান্তি পাই না। কারণ জানি বাসায় এসে দেখবো নতুন কোনো ঘটনা ঘটিয়েছে এই ছেলে! পাশের বাড়ির মেয়েটাকে সেদিন গুলান চালানো শিখাতে গিয়ে কি করেছিস জানিস?”
“কি করেছে?” হাসি চেপে বলল মিথিলা। বাবাইয়ের দিকে আড় চোখে তাকালো একবার, বাবাই গম্ভীর মুখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
“গুলান মেরে ওদের একটা ডিম পাড়া মুরগী মেরে ফেলেছে! হাতের কি টিপ ক্যাপ্টেন সাহেবের!” ঝাঁঝাঁলাও গলায় বলল নোভেরা।
হাসতে লাগল মিথিলা টেবিলের নিচেই। বাবাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিন্তিদের মুরগীটাকে ও ইচ্ছা করে মারেনি। সামনের টিউবয়েল সই করে মারতে গিয়ে মুরগীটাকে মেরে ফেলেছে। কোত্থেকে যে ঠিক ঐ সময়েই হেলতে দুলতে মুরগীটা টিউবয়েলের সামনে এলো- ভেবে পায় না বাবাই। বিন্তিকে নিয়ে মুরগীটাকে গোসল দেয়ার পর সাদা রূমালে কাফন বেঁধে টিউবয়েলের পাশে জানাযা পড়িয়ে কবর দিয়েছে বাবাই। একটা সাইন বোর্ড লাগানোর ইচ্ছা ছিল মৃতা মুরগীর নামে। কিন্তু আম্মুর ধোলাই খেয়ে ভয়ে আর বলতে পারেনি। নিজেই একটা বানিয়ে দেবে ঠিক করেছে। কবরটা সিমেন্ট দিয়ে বাঁধাই করে দেয়ার চিন্তা ভাবনা আছে বাবাইয়ের। এ নিয়ে বাবাকে বলেছিল। জাহিদ বলেছে ইট, বালু, সিমেন্ট- সব জোগাড় করে দেবে। কিন্তু এত দিন হয়ে গেল একটাও দেয়ার নাম নেই। সেটা নিয়েও বাবাইয়ের মনে অনেক দুঃখ।

মিথিলা ক্যাপ্টেন বাবাকোয়াকে একটা বড় মুরগী কিনে দিয়েছে। কাঁটাবনে নিয়ে গিয়েছিল বাবাইকে। কোনো পাখিই তার পছন্দ না। সব গুলো নাকি ছোট। তার বড় পাখি দরকার। শেষ মেষ হয়রান হয়ে ফেরার পথে মিথিলা কাঁচা বাজার থেকে ওকে বড় একটা সাদা ফার্মের মুরগী কিনে দিয়েছে। বাবাই সেটা পেয়ে মহা খুশি। মুরগীও তো পাখি!

ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া আজ একটা চোর ধরেছে। ঘটনাটা ঘটেছে দুপুর বেলা। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর নোভেরা একটু ঘুমায়, জাহিদ অফিসে থাকে। তাই বাবাইকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরে তখন। কিন্তু বাবাইয়ের ঘুম আসে না দুপুরে। নোভেরা ঘুমিয়ে গেলেই উঠে পড়ে, পা টিপে টিপে নেমে যায় বিছানা থেকে। তারপর মিথিলাও নেইযে ওর সাথে একটু দাবা খেলবে। একা একা দাবা খেলতে ভাল লাগে না বাবাইয়ের।

আজকেও সবদিনের মতই নোভেরা ঘুমিয়ে যেতেই বাবাই খুব সাবধানে মার ঘুম না ভাঙ্গিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল। প্রথমে মুরগীটাকে নিয়ে এল। বাবাই মুরগীটার গলায় লাল ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখে। পায়ে যে বাঁধতে হয় সেটা বোধ হয় জানে না ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। অনেক গরম পরেছে আজ। মাথায় নীল হেলম্যাটটা পরে রান্না ঘরে চলে এল। ফ্রিজের কাছে এসে খুব কায়দা কসরত করে টেনে খুলল দরজাটা। দরজার পকেট গুলোয় সারি সারি পানি, কোক, লেমনেড আর ওষুধের বোতল রাখা। কুয়াশার উড়ছে তার মাঝে। বাবাই মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। কত সুন্দর করে কুয়াশার মত হাওয়া এসে সব ঠান্ডা করে দিচ্ছে!

মুরগীটাই ইতিউতি করে চাইছে। সেটাকে ফিতা ধরে টানল, “লেফটেনেন্ট মুরগী, দেখেছো কত সুন্দর! সব ঠান্ডা করে দিচ্ছে উয়াশা এসে। বাহিরে কত গরম! আসো আমরা ভেতরে বসে থাকি। পরবর্তী মিশন নিয়ে আলোচনা করার জন্য টপ সিক্রেট জায়গা দরকার। এখানে করা যাবে।”

লেফটেনেন্ট সাহেব ভীত চোখে একবার ফ্রিজের দিকে, একবার বাবাইয়ের দিকে তাকালো। কিছু বোঝার আগেই বাবাই তাকে বোগল দাবা করে ফ্রিজের তাক খুলে ভেতরে উঠে বসে পড়ল। টেনে দরজা লাগিয়ে দিল।
ফ্রিজের দরজা লেগে যাবার পর বাবাই আবিষ্কার করল লাইট নিভে গেছে! দরজা লাগানোর সঙ্গে সঙ্গে যে লাইট নিভে যায় জানতো না। কারেন্ট চলে গেল নাকি? বাবাই আর মুরগীটা চুপচাপ বসে থেকে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাবাইয়ের একটু ভয় ভয় করতে লাগল। খিদে লেগেছিল। হাতড়ে হাতড়ে একটা তরমুজের টুকরা পেয়ে গেল। সেটা খাওয়া শুরু করল বাবাই। “বুঝলে লে. মুরগী, ফ্রিজটা খুব আজব জায়গা। বাহিরে কত গরম। আর এইখানে- কত ঠান্ডা। বাহিরে দিন, এইখানে রাত! আমাদের নিয়মিত এইখানে আসা উচিত। পরবর্তী আলাপ-আলোচনা গুলা আমরা এখানেই করবো। আম্মু জানতে পারবে না তাহলে।”
লেফটেনেন্ট সাহেব মৃদু কঁক কঁক করলেন দূর্বল গলায়। সময় গড়াতে লাগল ধীরে ধীরে। বাবাই ফ্রিজের মোটরের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ পাচ্ছে না। ঠান্ডা লাগছে এখন। শীত শীত করছে। পাতলা গেঞ্জিতে কুলাচ্ছে না। কাঁপা শুরু করেছে ঠান্ডার চোটে। দাঁতে দাঁত বাড়ি খাচ্ছে।
“লেফটেনেন্ট মুরগী, আমাদের বের হওয়া উচিত- কি বলো?” ঠক ঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বলল ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া।
মুরগী বেচারার ভয়ে আধা মরা অবস্থা তখন। কঁক কঁক পর্যন্ত করছে না ঠিক মত।
সিদ্ধান্ত নিল ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া- এবার বেরুনো দরকার। বের হওয়ার জন্য সবে দরজা পা দিয়ে ঠেলতে শুরু করেছে- ঠিক তখনি বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। আচমকাই ফ্রিজের ভেতরের লাইট জ্বলে উঠে দরজা খুলে গেল।
বাবাই গোল গোল চোখে চেয়ে দেখলো ফ্রিজের দরজার সামনে লুঙ্গি মালকোঁচা দেয়া ময়লা গেঞ্জি পরা একটা মিশ মিশে কালো লোক বিরাট কাপড়ের বোঁচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! নাকে নিচে ঝাঁটার মত গোঁফ, মাথায় চক চকে টাক। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। দীর্ঘ একটা মুহূর্ত একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা।
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া আর লেফটেনেন্টে মুরগী এক সঙ্গে যত জোরে চিৎকার দিল ভয়ে, তার তিন গুণ জোরে চিৎকার দিয়ে লোকটা ওখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে গেল!
বাবাইয়ের চিৎকার শুনে নোভেরা আগেই লাফিয়ে উঠেছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে ধেড়ে গলায় আরেকটা চিৎকার শুনে সামান্য অবাক হল। বাসায় তো বাবাই আর নোভেরা ছাড়া আর কেউ নেই। মিথিলা বাহিরে গেছে, জোছনার মা গেছে গ্রামের বাড়ি। আর জাহিদও গেছে অফিসে। তাহলে পুরুষ কন্ঠে কে চেঁচালো!
দৌড়ে রান্না ঘরে এসে ঢুকলো নোভেরা। রান্না ঘরের দরজা জুড়ে লিকলিকে শরীরের লোকটাকে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল। বাবাইকে দেখা গেল সে ফ্রিজের ভেতরে মুরগীটাকে নিয়ে বসে আছে। মাথায় হেলম্যাট। ভীত চোখে তাকিয়ে আছে রান্না ঘরে পড়ে থাকা লোকটার দিকে। নোভেরা ঠান্ডা মাথার মানুষ, সহজে ভয় টয় পায় না। লোকটার মাথার কাছে পড়ে থাকা কাপড়ের ঠোঙ্গাটা টেনে খুলে দেখল- নানা রকমের ছোট খাটো দামী জিনিস পত্র, ঘড়ি, পার্স, চেন হাবিজাবি জিনিসে ভর্তি। বোঝাই যাচ্ছে চোর। ভর দুপুরে যে চোর আসে সেটা জীবনে প্রথম দেখছে নোভেরা। লোকটা গ্রিল কেটে ঢুকেছে। এই বিল্ডিং এর কয়েকটা বাসায় চুরি করে তারপর এখানে এসেছিল। বাবাইকে ফ্রিজের ভেতর বসে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে বেহুশ হয়ে গেছে। চোরের হার্ট যে এত দূর্বল হয় জানা ছিল না নোভেরার।
দ্রুত সামলে নিল বিস্ময়ের ধাক্কাটা। ব্যবস্থা নিল।
গেটের দারোয়ান কমলার বাপকে ডেকে লোকটাকে বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে। জ্ঞান ফেরাতে ফেরাতে থানায় ফোন করে পুলিশ ডাকল। যতক্ষণে জ্ঞান ফিরেছে চোরটার ততক্ষণে সারা বিল্ডিং’এ খবর হয়ে গেছে। সবাই চলে এসেছে চোরটাকে দেখতে।
চোর সাহেব বোকা বোকা মুখে বসে আছে মেঝেতে। কি ঘটছে যেন বুঝতে পারছে না। বাবাই ডাইনিং টেবিলের ওপর মুরগীটা নিয়ে বসে গরম হরলিক্স খাচ্ছে। ঠান্ডা ধরে গেছে দেখে নোভেরা খেতে দিয়েছে। গা গরম হবে তাড়াতাড়ি।
জাহিদ সবে মাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। অবাক মুখে বাসায় ঢুকেই বলল, “কি ব্যাপার? এত মানুষ কেনো? এইটা কে আবার!” চোরটাকে দেখে আৎকে উঠল।
নোভেরা একটা চেয়ার টেনে বাবাইয়ের কাছে বসেছে। ক্লান্ত গলায় বলল, “তোমার ছেলে চোর ধরেছে আজ।”
চোখ কপালে তুলল জাহিদ, “তাই নাকি! কীভাবে?”
“ফ্রিজে ঢুকে বসেছিল তোমার ছেলে। তিব্বতি লামার মত সন্ন্যাসী হবেন মনে হয়। ধ্যান করতে ঢুকেছিলেন ভেতরে। চোর সাহেব পানি খেতে ফ্রিজ খুলেছিল। তোমার ধ্যান মগ্ন ছেলেকে দেখে ওখানেই ফিট হয়ে গেছে।”
জাহিদ কয়েক সেকেন্ড নোভেরার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপরেই ঘর ফাটিয়ে হাসা শুরু করল। ছেলের পাশে গিয়ে টেবিলে উঠে বসল। হেলম্যাটের ওপর হাত বুলিয়ে দিল আদর করে, “কিরে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া? সত্যি সত্যি চোর ধরে ফেলেছিস নাকি!”
বাবাকোয়া হাঁচি দিল সশব্দে, “আমি কলার ধরে ধমক দিতেই বেহুশ হয়ে গেল! ভয় পাইছে!” চোর সাহেব ভীত দৃষ্টিতে তাকালো বাবাইয়ের দিকে। বাবাই হাঁচি মেরে চোখ পাকিয়ে তাকালো।

পুলিশ এসে যখন চোরটাকে নিয়ে যাচ্ছে বাবাকোয়া হাঁচি দিয়ে যাচ্ছে তখনো!


দু দিন পরের কথা।
ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া টেবিলের নিচে বসে খাতায় খস খস করে লিখছে পেন্সিল দিয়ে। লেফটেনেন্টে সাহেব পাশে চুপ চাপ বসে আছেন। বাবাইয়ের লেখা দেখছে গভীর মনোযোগ দিয়ে।
      ১৭. ফ্রিজের ভেতর থাকা ভাল না। সর্দি লাগে। এর থেকে দুপুর বেলা আম্মুর সঙ্গে ঘুমানো অনেক ভালো। ঠান্ডা লাগে না। এখন থেকে দুপুরে ঘুমাবে ক্যাপ্টেন বাবাকোয়া। 
খাতা বন্ধ করে উঠে গেল বাবাই। টেবিলের নিচে দাবার বোর্ড সাজিয়েছিল লেফটেনেন্টের সঙ্গে এক দান খেলবে ভেবে। কিন্তু এখন আর খেলতে ইচ্ছা করছে না। ঘুম আসছে। মুরগীটাকে খাঁচায় নিয়ে রেখে এলো। নোভেরা ঘুমিয়ে ছিল। বাবাই হেলম্যাট খুলে আম্মুর পাশে উঠে শুয়ে পড়ল। ঘুম ঘুম লাগছে খুব বাবাইয়ের।
ঘুমের মধ্যেই নোভেরা ছেলেকে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিল। বাবাই অবাক হয়ে চোখ পিট পিট করে তাকালো। ঘুমটা চলে গেছে। গভীর ভাবে একটা দম নিল বাবাই। আচ্ছা আম্মুদের গায়ের গন্ধ এত ভাল হয় কেনো?


পৃথিবীর সব বাবাইদের প্রতি অনেক অনেক ভালোবাসা আর ভালোবাসা। তোমরা আছো বলেই পৃথিবীটা এত সুন্দর!
                                                                                                                                - লেখক ]

লেখকঃ মোঃ ফরহাদ চৌধুরী শিহাব
facebook: Nithor Shrabon Shihab

No comments:

Post a Comment