আমি তন্ময়। চলুন আপনাদের আজ একটা গল্প শোনাই। শুনেছিলাম ভালবাসায় নাকি পাগলামী না থাকলে তা পূর্ণতা পায় না। আরও শুনেছিলাম ভালবাসতে হলে এবং ভালবাসাকে জয় করতে হলে অনেক ধৈর্য্যের প্রয়োজন। সে ধৈর্য্যের সাথে বিশ্বাসের সমন্বয় না থাকলে অমূল্য সম্পর্কটা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। ছাত্রজীবনের বিরাট একটা অংশ বড় ভাইয়া আপুদের কাছ থেকে এসব উপদেশ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছিল।
একসময় ভাবলাম নাহ, আর শুনে কাজ নেই। এবার নিজেই প্রেম করে দেখিয়ে দেব আর ছোট ভাইবোনদের কাছে ইচ্ছেমত উপদেশবাণী ঝাড়বো। তাড়াহুড়ো করে প্রেম করতে গিয়ে প্রথমেই অত্যন্ত সফলভাবে ব্যর্থ হলাম। কোন রান না করে ব্যাটসম্যান আউট হয়ে গেলে যেমন লাগে আমার হল সে অবস্থা। ফ্রেন্ড সার্কেলে রীতিমত প্রেস্টিজ পাংচার হল। আমির, রাসেল, পাপ্পু, সায়মা, রিমি মিলে আমাকে ইচ্ছেমত পচাতে লাগল। আমি লক্ষী ছেলের মত ওগুলো হজম করতাম।
অনার্স শেষ বর্ষে পরিচয় হল স্নিগ্ধার সাথে। ও তখন ফার্স্ট ইয়ারে নতুন এসেছে। পড়াশোনা নিয়েই বেশি কথা হত। টুকটাক গাইডলাইন দেখিয়ে দিতাম আর কি। কিন্তু নোট আর সাজেশান দেখাতে দেখাতে ছোট্ট এ সম্পর্কটা যে একদিন আমাদের অনেক বড় একটা স্বপ্ন দেখাবে এটা ঘুণাক্ষরেও টের পাই নি।
স্নিগ্ধা এমনিতেই অনেক হাসি খুশি। তবে ওকে সবচেয়ে ভাল দেখায় মুচকি হাসিতে। যেন ও সব কিছুই জানে, বুঝে কিন্তু বলবে না। ওর সাথে আমি কথায় পেরে উঠতাম না বলে আগেই সারেন্ডার বলে দিতাম। উপলব্ধি করতাম কিছু ক্ষেত্রে স্বেচ্ছায় পরাজিত হবার সুখ বিজয়ের আনন্দের চেয়েও বেশি। ওর মনে অনেক মায়া। মায়াটাই সবচেয়ে বেশি টানতো আমাকে। কথা বলার সময় তার মায়াবী চোখ দুটো আমাকে টেনে নিয়ে যেত তার গভীরে। এভাবে কেটে গেল তিন মাস। হঠাৎ একদিন স্নিগ্ধা জানালো ও যে ছেলেকে পছন্দ করত সে নাকি রিফিউজ করে দিয়েছে। আমার এতদিন ধারণা ছিল শুধু ছেলেরাই আগে প্রপোজ করে। যাক, মেয়েরাও তাহলে বেশ এগিয়েছে বুঝা গেল। কিন্তু স্নিগ্ধাকে আমি কি বলব এটাই বুঝতে পারছি না। আমি এমনিতেই গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তার ওপর বিপদে ওকে কি বলে সান্ত্বনা দেব দ্রুত ভাবছিলাম। আমি তখন পণ্ডিতসুলভ আচরণে সাধারণ উপদেশগুলো অসাধারণ ভঙ্গিমায় দেবার চেষ্টা করলাম। এই যেমন- যা হয়েছে হয়ত তোমার ভালর জন্যই, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব আর সবচেয়ে পার্ট নিয়ে একবার কেশে সবার শেষে যে কথাটা বললাম সেটা হল, “আরে বাবা, আমিতো আছি”; স্নিগ্ধা বলল, প্লিজ কথাটা আরেকবার বল না! এই প্রথম স্নিগ্ধা আমাকে তুমি করে বলল। কথাটা আবার বললাম তাকে। এরপর স্নিগ্ধার মুখে যা শুনলাম তার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। “এতক্ষণ যা বললাম সব বানানো”- ফিক করে হেসে স্নিগ্ধা আমার বা কনুইয়ে জোরে একটা চিমটি কেটে উঠে চলে গেল। আমি কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে বসে থাকলাম।
একসময় স্নিগ্ধা আমার ওপর অনেক ডিপেন্ডেন্ট হয়ে গেল। আমিও ওর মায়ার বাঁধনে এমনভাবে জড়িয়ে গেলাম যে মোহ, আবেগ, ভাললাগা আর ভালবাসার মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পেলাম না। পরে ভেবে দেখলাম, নিজে ঠিক থেকে সুখী থাকাটাই আসল কথা। তাহলে কেনই বা পার্থক্য খুঁজতে যাব, কেনই বা জীবনের না পাওয়ার হিসাব মেলাব। আমার পড়াশোনা শেষ হবার পর স্নিগ্ধাকে সরাসরিই বললাম, আচ্ছা আমরা বিয়ে করছি কবে? ও বলল, একই দিনে বিয়ে করতে চাও নাকি আলাদা দিনে? আমার শুনে মাথা গরম হয়ে গেল। বললাম, প্লিজ এভাবে বোলো না, প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে আমার। এ কথা শুনে সে অভিজ্ঞ পাত্রীর মত উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, হমম দেখি- আমার পছন্দের তালিকায় যে তিনজন আছে লটারিতে যার নাম আগে আসবে আমি তাকেই বিয়ে করব। এটা শুনে আমার কথা বলার এনার্জি এক নিমিষেই অর্ধেক হয়ে গেল। আমি অভিমান করে চলে যাবার জন্য উঠতেই স্নিগ্ধা আমার হাত ধরে বলল শুনবে না কোন তিনজন? আমি দুর্বলভাবে হ্যা সূচক সম্মতি দিলাম। স্নিগ্ধা আমার কানের কাছে এসে খুব আস্তে করে বলল, তুমি, তুমি আর তুমি।
এর কয়েক বছর পর অনেক চড়াই উৎরাই পার করে আমাদের বিয়ে হল। সে কাহিনী আর নাই বা বললাম। সবচেয়ে অদ্ভূত ব্যাপার হল বিয়ের পরই মনে হল অনেক ভারী এক চিন্তার বোঝা নেমে গেল ঠিকই কিন্তু দায়িত্ব যেন বেড়ে গেল আরও। তবে দায়িত্বকে আমি কখনই বোঝা মনে করিনি। নতুন জীবন শুরু করার পরপরই খোদা প্রদত্ত এরকম অনুভূতি আগে আর কখনই পাই নি।
এক মাস পর। একদিন রাতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি স্নিগ্ধা আমার পাশে নেই। আমি পানি খেতে উঠলাম। হঠাৎ বুঝতে পারি স্নিগ্ধা ড্রয়িং রুমে কার সাথে যেন কথা বলছে আর একটু পরপর হাসছে। বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠল আমার। পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরুলাম। দেখলাম সোফায় বসে ও একটু পরপর মোবাইলে তাকাচ্ছে আর ফিসফিস করে কথা বলছে। সন্দেহ আমার ভেতর দানা বেঁধে উঠল। ভাবছি জোরে একটা চিৎকার দেই। আমার কান্নায় গলা ধরে আসছে। খুব সাবধানে স্নিগ্ধার পেছনে গিয়ে দাড়ালাম। ও টের পেল না। কি কথা বলছে এবং কার সাথে কথা বলছে বুঝার চেষ্টা করছি যদিও জানি ওর প্রাইভেসি নষ্ট হবে। কিন্তু আমাদের ভালর জন্যই আমাকে জানতে হবে। খুব করে শোনার চেষ্টা করলাম কি বলছে। একদম সেই স্টাইলে কথা বলছে যখন ওর সাথে আমার সম্পর্ক ছিল। ওর অগোচরে আমি চুপিচুপি শুনেই যাচ্ছি কথাগুলো। সবশেষে খুব আস্তে করে ওর যে কথাটা শুনে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলাম না সে কথাটা হচ্ছে, - জান আই লাভ ইউ ঠু।
সাত দিন পরের কথা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল বজ্রপাতের শব্দে। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। বর্ষাকালের বৃষ্টি বলেই কিনা টানা তিনদিন ধরে হয়েই যাচ্ছে। কিছুটা অনিয়মের কারণে আজ আমার জ্বর, মাথাব্যথা। আমি একা শুয়ে আছি। স্নিগ্ধার কথা ভাবছি। ও কি করছে এখন? ভাবতে ভাবতেই স্নিগ্ধা ঘরে ঢুকল। “দেখি জ্বর কত তোমার। ভাল কথা বলিতো তাই তোমার কানে যায় না। এত এত জায়গায় একজন মানুষ ননস্টপ ছুটাছুটি আর খাটাখাটি করে কী যে মজা পায় কে জানে। ওমা! এখনও জ্বর কমে নি। মাথাটা ধুয়ে দিতে হবে তোমার দেখছি” স্নিগ্ধা ভোর পর্যন্ত আমার পাশে থেকে জলপট্টি দিয়ে দেয়। আমার পছন্দের চিকেন কর্ণ স্যুপ বানিয়ে নিজে খাইয়ে দেয়। আলতো করে চোখ টিপে দেয় আমার। আমি ঘুমের রাজ্যে চলে যাই পরম মমতায়।
এখনও মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দেখি পাশে স্নিগ্ধা নেই। পাশের ঘর থেকে ফিসফিস কথা আর হাসি শুনতে পাই। আর আমিও মনে মনে বলি- পাগলী একটা। আর যাই হোক আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি কখনই স্নিগ্ধাকে সন্দেহ করব না। যে পাগলীটা আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝতে চায় না, আমার জন্য নিজেকে পুরোপুরি উজাড় করে দিয়েছে তাকেই যদি সন্দেহ করি তাহলেতো নিজেকেই অবিশ্বাস করা হবে। এ আমি কিছুতেই হতে দেব না। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমি স্নিগ্ধার মাথার চুলগুলো সরিয়ে তার কপালের বা পাশের তিলটায় হাত বুলিয়ে দেই।
ওহ হো! আপনাদেরতো বলাই হল না সে রাতের ঘটনাটা। স্নিগ্ধার নাকি প্রায়ই অনেক রাতে আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। আমার খুব সকালে অফিস বলে ও আর আমার ঘুম ভাঙ্গায় না। তাছাড়া ঘুমালে নাকি আমাকে সবচেয়ে সুন্দর দেখায়- এটা ওর বক্তব্য। সুন্দর জিনিস কি কেউ ভেঙ্গে দিতে পারে? তাই সে পাশের ঘরে চলে গিয়ে মোবাইলে আমাদের রেকর্ড করে রাখা আলাপচারিতা বারবার শোনে আর আমার সাথে কাল্পনিক কথা বলে তার মনের সাধ মেটায়। যেদিন আমি ওকে প্রপোজ করি সেদিন ও নাকি আগেই বুঝতে পেরেছিল কি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। তাই সেদিনের কনভার্সেশানও মোবাইলে রেকর্ড করে রেখেছিল সে। অথচ আমাকে এতদিন বলেও নি! মেয়েরা মাঝে মাঝে কেন যে এত বেশি বুঝে ফেলে সত্যিই বিরক্তিকর। তবে স্নিগ্ধা নামের এই পাগলীটা এখন আমাকে বিরক্ত না করলেই যে বরং আমার খারাপ লাগে! হয়ত এটাই আমাদের ভালবাসা।
FB ID: Rajeen Reasat
ব্লগার রাজিন
No comments:
Post a Comment