সকাল ১১টায় ডাক পড়ল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আসছেন। গেলাম, রুমে ঢুকে লম্বা সালাম দিলাম, আমাকে অনেক যত্ন করে বসানো হল। ইঞ্জিনিয়ারের পরিবারের লোকজন টুকটাক প্রশ্ন করল, তারপর কেউ একজন বলল, “রেজাউল, তুই কিছু জিজ্ঞেস করবি?” বুঝলাম ইঞ্জিনিয়ারের নাম রেজাউল। এই প্রথম চোখ তুলে তাকালাম, মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভীষণ ছটফটে আমার জন্য বাবা একটা রোবট পছন্দ করল! রোবট ইঞ্জিনিয়ার আমাকে প্রশ্ন করলো, “Second year শেষ হতে আপনার কতদিন লাগলো?” প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললাম। মনে হোলো চাকরির ইন্টার্ভিউ দিচ্ছি বুঝি!
ইন্টার্ভিউ শেষ করে ফিরে আসাতে বান্ধুবি, মামী, দাদু, নানু...সবার প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত আমি! বলে পছন্দ ছেলে পছন্দ হয়েছে নাকি? আরে আমার পছন্দ দিয়ে কি হবে, সিদ্ধান্ত তো বাবার! তাও বললাম যে পছন্দ হয়নি, রোবট একটা! একটু পর আবার ডাক পরল, রোবট নাকি “একান্তে” কথা বলতে ছায় আমার সাথে! কি কথা বলব ওই মানুষটার সাথে যাকে শুধু নাম দিয়ে চিনি! গেলাম রোবটের কাছে, রোবট জিজ্ঞেস করলো কাউকে পছন্দ করি কিনা! হাসলাম কিছু না বলে। চুপ করে বসে রইলাম, রোবট ও দেখি চুপ। ওমা! রোবটের কি কথা শেষ! দুপুরে খাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার সাহেব স্বপরিবারে চলে গেল।সন্ধ্যায় আমার ছোট ভাই এসে জানালো ইঞ্জিয়ারের নাকি আজকেই বিয়ে করতে হবে! আর ১০/১২টা দিন পরে আমার সেমিস্টার ফাইনাল, এখন এই কি উপদ্রুব!

৮ জানুয়ারী ২০১০, রাত ১টা বেজে ১০ মিনিটে সত্যি সত্যিই আমার বিয়ে হয়ে গেল! কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছিল। রাত ৪টায় আমাকে সম্পূর্ণ অপরিচিত ১টা মানুষের সাথে রেখে সবাই চলে গেল! আমি তখনও ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারিনি, তার মাঝেই শুনলাম আমার পাশে বসে থাকা রোবট ইঞ্জিনিয়ার বলছে, “আমি খুব খুশি, তুমি?” আমি চুপ করে থাকি আর অবাক হয়ে ভাবি একটা সম্পূর্ণ অপিরিচিত মানুষের পাশে বসে এত খুশি হওয়ার কি আছে? পরদিন সকাল থেকে জীবন বদলে গেল, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব, আমার Huasband, আমার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেল! রোবট থেকে সে আস্তে আস্তে আমার কাছে মানুষ হয়ে উঠল। সেই মানুষটার জীবনের সবকিছুর সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, মাত্র সাত দিনে অপিরিসিম ভালবাসায় আমার জীবন ভরিয়ে দিল! আমি তার সাথে কুলিয়ে উঠতে পারিনা, মনে হয় এত ভাল মানুষটা কি করে বাসে! তার পরিবারের মানুষ গুলোর কাছে নিয়ে গেল একদিন, সেখানে দেখি ভালবাসার স্রোত, আমার শশুর,শাশুড়ি, ননদ, ননষ, সবার কাছে আমি অনন্য আপন একজন মানুষ! অবাক হয়ে ভাবি একেবারে নতুন একটা মানুষকে ওরা এত্ত ভালবাসে কি করে! সাতদিন পর আমাকে খুব বেশি একা করে দিয়ে সদ্য আপন হওয়া লোকটা চলে গেল তার কর্মস্থল নেদারল্যান্ডে। জীবনে প্রথমবার মনে হল আমার সবচেয়ে আপন মানুষটা দূরে চলে গেল! ইয়াহু মেসেঞ্জার, স্কাইপ কোন কিছুতে মানুষটাকে দেখে, কথা বলেই যেন মন ভরেনা! কি হল আমার!
আর আমার নতুন পরিবার,নতুন মা-বাবা আমাকে তাদের ভালবাসায় ডুবিয়ে রাখলেন! পরাশুনার সুবিধার জন্য বাবা-মা’র কাছেই রইলাম। আর সেই অবাক করা ভালবাসার অধিকারি পরিবার তাদের ছেলের কথা মনে হলে আমাকে দেখতে আসেন! কি অদ্ভুত ভালবাসা দিয়ে ভরা মানুষ গুলোর মন! অনেক গল্প শুনেছি যে স্বামী সাথে না থাকলে তার পরিবার অনেক বেশি যন্ত্রনা করে! কিন্তু আমার শাশুড়ি কখনও “মা” না বলে আমাকে ডাক দেননি, গাছের পেয়ারা পাকলে আমার শশুর সেটা আমার জন্য নিয়ে আসেন। আমার ভিসা হয়নি দেখে আমার শাশুড়ি আমার চেয়েও বেশি কাঁদেন, একমাসের জন্য গিয়ে আমি আর আমার স্বামী তিনটা দেশ ঘুরে আসি, আমার শাশুড়ি সেটা বুক ফুলিয়ে মানুষকে বলেন। একবার ও দেখিনি তাকে আক্ষেপ করতে যে এতগুলো টাকা খরচ হচ্ছে!
বাবাকে ধন্যবাদ দেই মনে মনে এরকম ভীষণ ভাল কিছু মানুষের সাথে আমাকে জুড়ে দেয়ার জন্য। আমার বাবা যখন পেঁপে কিনতে যান তিনি সবচেয় খারাপটাই টাকা দিয়ে নিয়ে আসেন, একই ঘটনা আমার শ্বশুর ও করেন আর তার ছেলে এমন গরুর গোশত কিনে আনে যেটা সারাদিনে ও সিদ্ধ হয়না! কিন্তু তারপরও এই তিনজন আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ বাবা, শ্রেষ্ঠ স্বামী। আমি আমার শাশুরিকে আমার মা’র থেকে আলাদা করতে পারিনা! ২জনই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা! আমার স্বামীকে নিয়ে আমার প্রিয় সিনেমা “টাইটানিক” দেখতে বসলে সে আমাকে টাইটানিকের আর্কিটেকচার বুঝায়! আর তাকে আমি আরও বেশি ভালবাসি...আর মনে মনে বলি, “ধন্যবাদ বাবা, এরচেয়ে ভাল জীবনসঙ্গী পৃথিবীতে আর কেউ হতে পারতোনা।”
-শাম্মী
FB ID: ফারহানা করিম শাম্মী



Dhaka Time
No comments:
Post a Comment