Subscribe:

একজন সাইয়্যারা ও একটি ভ্যাবলার গল্প

১ম পর্ব:  
রাইয়ানের কথাঃ 
২০ ফেব্রুয়ারী,২০০৭
বাংলা একাডেমীতে ১মবার ঢুকে ১টা বড় রকমের টাস্‌কি খেলাম। ওহ্হ,আমার নামটাই বলা হয় নি ,আমি রাইয়ান। এ বছর ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি, বাংলা বিভাগে। প্রথম প্রথম,তাই সবকিছুই খুব ভাল লাগছে। আজকে এসেছি একুশের বইমেলাতে,এত নাম শুনেছি এই মেলার,তবুও চমকালাম। ভাবিনি এত্ত বড় আয়োজন হবে। বই পড়তে আমার খুব ভাল্লাগে, সেই ছোটোবেলা থেকেই। হাঁটতে হাঁটতে এসে ঢুকলাম একটা স্টলে, তখনো জানতাম না,এখানেই দেখা পাব আমার স্বপ্নের সাইয়্যারার…………
  
টেবিলে রাখা বইগুলো ঘাঁটছি,দারুণ মজা লাগছে। হঠাৎ একটা বই হাতে এল,রবীন্দ্র সংকলন।পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ল একটা লাইন "মন চায় হৃদয় জড়াতে কারো চিরঋণে"---কি অসাধারণ একটি লাইন,মনে গেঁথে গেল কথাটা..না,এ বই আমার কেনাই লাগবে….ভিড়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম,সামনে আরেকটি বই দেখে এগোলাম,খেয়ালই নেই যে,আগের বইটি রেখে এসেছি। খেয়াল হতেই ফিরে চাইলাম,ওমা বইটি নেই….কি করব এখন,চারপাশে তাকাচ্ছি।হঠাৎ দেখলাম সামনে সাদা কামিজ পরা একটি মেয়ে,হাতে আমার অমূল্য রতন বইটি। কিন্তু একি বিপদ,মেয়েটা দেখি দোকানদারের সাথেই কথা বলছে,বইটা কিনবে নাকি। কি করি কি করি…ভ্যাবলার মত দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে করতেই মেয়েটা দিব্বি বইটা কিনে আমার সামনে দিয়ে গটগট করে চলে গেল।আমিও পিছু হটার নই,বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী। মেয়েটার পিছু নিলাম,ইচ্ছা মেয়েটাকে রিকোয়েস্ট করব বইটা আমার কাছে বিক্রি করার জন্য। কিন্তু সাহসে কুলোচ্ছে না,মুখচোরা আমি অপরিচিত মেয়েদের সাথে কথা বলা তো দূরের কথা,জীবনে মেয়েদের সাথে কথাই বলেছি মনে হয় হাতে গোনা দুতিনবার…কয়েকটা স্টল মেয়েটার পিছু পিছু ঘোরার পর ভাবলাম,থাকুক বইয়ের আশা ক্ষান্ত দিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাই…কিন্তু বিধি বাম,মেয়েটা দেখি ঘুরে তাকিয়েছে,আমার দিকেই আসছে। আমার তো আত্মা শুকিয়ে গেল,টের পেয়েছে নাকি যে আমি ওর পিছু নিয়েছি! ইয়া মাবূদ, ইয়াপরওয়ারদিগার, এই বিপদ থেকে বাঁচাও, ২ মুরগী সদকা দিব,প্রমিস্...

মেয়েটা সোজা আমার সামনে এসে দাঁড়ালো,সরাসরি জিজ্ঞেস করল, "কি ব্যাপার,আমার পিছু নিয়েছেন কেন?"ও বাবা,এতো দেখি তেজী মেয়ে ! জানিনা হঠাৎ আমার কি হল,চিরকালের মুখচোরা আমিও সোজা বলে দিলাম "আপনি একটু আগে যে বইটা কিনেছেন তা আমার চাই।" মেয়েটা হতভম্ব,এই জবাব আশা করেনি নিশ্চয়ই,বলল, "মানে?" আমি মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললাম-"ইয়ে মানে আসলে কি,আমি বইটা কিনতে চাচ্ছিলাম,একটা কবিতার লাই ন খুব পছন্দ হয়েছে তাই…কিন্তু আমি কেনার আগেই আপনি কিনে ফেলেছেন" মেয়েটা অবাক হয়ে বলল "কোন লাইন?" আমি লজ্জায় লাল হয়ে কোনমতে বললাম, "মন চায় হৃদয় জড়াতে কারো চিরঋণে।" ভাগ্যদেবী সহায় হলেন,আমার বিব্রত দশা দেখেই হয়তোবা মেয়ের মায়া হল,মুচকি হেসে বলল, "ঠিক আছে আপনি বইটা নিতে পারেন,আপনার যখন এত শখ,আপনাকে গিফ্ট দিলাম।"বলে হাসতে হাসতে চলে গেল,সাথে নিয়ে গেল আমার মনটা। জানি আজব শোনায়,কিন্তু হ্যাঁ,আমি ঐ মুহুর্তেই মেয়েটার হাসির প্রেমে পড়েছিলাম,কিন্তু আমি এত বড় এক গর্দভ,একটা কথাও বলতে পারিনি তখন,ভ্যাবলার মত শুধু দাঁড়িয়ে ছিলাম…  

এরপর কেটে গেল কয়েক দিন,কিছুই ভাল লাগে না। শুধু মেয়েটার কথা মনে হয়..বইটার দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি কোথায় তুমি সাইয়্যারা...মনের দুঃখে কয়েকদিন ক্লাসেও গেলাম না,তারপর একদিন ক্লাসে গেলাম,গিয়ে আরো খারাপ লাগলো,ভাবলাম ক্যান্টিনে যাই,মনের দুঃখ খাবার দিয়ে ভোলা আরকি......উফ্,ক্যান্টিনে এত ভিড়,একটা টেবিলও ফাঁকা নেই। কর্ণারের টেবিলে দেখলাম একটা মেয়ে বসা,ওদিকে এগোলাম,ইচ্ছা মেয়েটি উঠে গেলে বসব। কাছে যেতেই মাথা ঘুরে উঠল..এও কি সম্ভব,এ যে দেখি আমার স্বপ্নের সাইয়্যারা !সম্বিত ফিরে পেতেই ঠিক করলাম,না এবার অন্তত নাম না জেনে যাব না। বুকে সাহস এনে এগোলাম মেয়েটার দিকে,ওকি হাঁটুটা আবার কাঁপছে কেন,দোয়া দরূদ পড়ে এগোলাম,মেয়েটা আবার বিরক্ত না হয়.....ভাগ্যদেবী আবারো সহায় হলেন। কাছে যেতেই মেয়েটা মুখ তুলে চাইল..আহ্ কদ্দিন অপেক্ষা করেছি এই হাসি দেখার জন্য। মেয়েটা বলে উঠল,"আরে আপনি বইচোর দেখি!"আমি বললাম, "মানে?" মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল, "আমার বই টা চুরি করলেন না ওদিন।" আমিও হেসে ফেললাম । হঠাৎ ই যেন সাহস পেলাম,বললাম, "বসতে পারি?"সেই থেকে শুরু...জানলাম আমার সাইয়্যারার নাম আঁচল,সে এবার ইংলিশ বিভাগে ভর্তি হয়েছে,ওর সাথে বন্ধুত্ব জমে উঠতে বেশিদিন লাগল না।আমি যেমন মুখচোরা,ও তেমনি চঞ্চল ।সারাক্ষণ কথা বলে,একদম দাড়ি-কমা ছাড়া ননস্টপ ।ও বলে যায়,আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি আর মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলি ওকে কি কখনো বলতে পারব মনের কথা।

এভাবেই দিন কাটতে থাকল,আমাদের বন্ধুত্ব আরো ক্লোজ হয়েছে,সারাদিন একসাথেই থাকি,ক্লাস শেষ হলেই দেখা করি,তারপর সারাদিন একসাথে ঘুরাঘুরি, গল্প-আড্ডা-হাসি। ওকে আমি সাইয়্যারা বলেই ডাকতাম,একদিন জিজ্ঞেস করল এর মানে কি,আমি মুচকি হেসে বললাম, " PRINCESS"।ফাজিলটা শুনেই বলল, "দিব একটা গাট্টা,আমাকে তোর রাজকুমারী মনে হয়,আর তুই কি, তুই তো আস্ত একটা ভ্যাবলা কান্ত।"...বলতে বলতে ২ জনেই হেসে ফেললাম । চমৎকার ছিল দিনগুলি...কিন্তু আমার মনে একটাই অশান্তি,ও কি আমাকে পছন্দ করবে, আমি কি বলে দেব আমার মনের কথা...ভয় ও যদি আমাকে পছন্দ না করে,যদি রাগ করে আমার কথা শুনে,যদি বন্ধুত্ব ভেঙ্গে চলে যায়, আমার হতভাগার তো তখন গলায় দড়ি দেয়া ছাড়া ঊপায় থাকবে না...অবিশ্বাস্য শোনায়,এভাবেই চলে গেল ৪টি বছর...ঘুরেফিরে আবার এলো সেই ২০ ফেব্রুয়ারী, একুশে বইমেলা,না এবার আমার সাইয়্যারাকে মনের কথা বলেই ছাড়ব।
ঠিক করলাম, আমাদের প্রথম দেখা হবার দিনেই ওকে বলব মনের কথা। এরপর যা হয় হোক,আর পারছি না ।২০ ফেব্রুয়ারীর আগের কয়েকটা দিন খুব টেনশনে কাটলো,ওর সাথে ফোনেও ঠিক করে কথা বললাম না, যদি আগেই বুঝে ফেলে,ঠিক করলাম ওদিন সকালেই ফোন দিব। 


২০ফেব্রুয়ারী,২০১১,সকাল ৯টা
প্ল্যান রেডি,ওকে বলব বাংলা একাডেমীর,সামনে আসতে,আমার হাতে থাকবে গ্লাডীওলাস ফুল,সাইয়্যারার আবার গ্লাডীওলাস ফুল খুব পছন্দ
।কাছে আসলে বলব-"মন চায় হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণে"...আর সাথে যদি বৃষ্টি হয় তাহলে তো কথাই নেই।
ওকে ফোন দিলাম,জাস্ট বললাম "জরুরী কাজ আছে,বাংলা একাডেমীর সামনে আয়,আধা ঘণ্টার মাঝে"
আমি তখনি রওনা দিলাম,পাছে দেরি না হয়
।আজকে আমার সবকিছু পারফেক্ট হওয়া চাই,একটাও ভুল হলে চলবে না।রাস্তায় বেরোতেই ঝূম
বৃষ্টি,মন টা খুশি হয়ে ঊঠল,প্ল্যান মতই হচ্ছে সবকিছু,গ্লাডীওলাস কিনে রাস্তা পার হতে গেলাম,হাত থেকে পড়ে গেল ফুলটা।নিচু হয়ে ফুলটা তুলেই যেন জমে গেলাম...ঠিক আমার দিকেই এগিয়ে আসছে একটি ট্রাক ! বৃষ্টির জন্য আগে আওয়াজ শুনিনি। চারদিকে সবাই চিৎকার করছে,কিন্তু আমি নড়তেও পারছি না... প্রচণ্ড ধাক্কা,ঊড়ে পড়লাম রাস্তায় । হঠাৎ নীরব হয়ে গেল চারপাশ...চোখের সামনে ভেসে ঊঠলো সাইয়্যারার হাসি,তারপরই আমি তলিয়ে গেলাম গাঢ় আঁধারে...
রাস্তায় পড়ে রইলো ২টি গ্লাডীওলাস ,রক্তে মাখা............... 


২য় পর্বঃ

আঁচলের কথাঃ 
২০ফেব্রুয়ারী,২০১১,সকাল ৯টা
ফোন টা হাতে নিয়ে বসে আছি,ভ্যাবলাটা ফোন দেয় না কেন
। কি যেন হয়েছে রাইয়ানের,গত কয়েকদিন ধরে ঠিকমত কথাই বলছে না।ভ্যাবলাটা কি বুঝে না ওকে ছাড়া আমার একদমই ভাল লাগে না,আজকে চার বছর হল আমাদের দেখা হবার,নিশ্চয়ই তাও ভুলে বসে আছে। ৪ বছর আগের কথা মনে হতেই মন টা ভাল হয়ে গেল,কি ভ্যাবলার মতই না এসে বইটা নিয়েছিল আমার কাছ থেকে।,ঐ এক কবিতার লাইনের জন্য...পাগল আস্ত একটা। ঐদিন থেকেই ভাল লাগা,তারপর কবে জানি ভ্যাবলাটার প্রেমেই পড়ে গেলাম...কতদিন কতরাত অপেক্ষা করেছি,কখনো যদি শোনায় ভালবাসার গান...কিন্তু না,মুখচোরা ভ্যাবলাটাকে দিয়ে কিছুই হবে না...যা ভুলোমনা,হয়তবা আজকের দিনের কথাও মনে নেই...উফ্‌ফ ফোন বেজে উঠতেই দৌড়ে গিয়ে ধরলাম,নিশ্চয়ই ভ্যাবলা টা হবে...শুধু একটা কথা বলেই রেখে দিল-"জরুরী কাজ আছে,বাংলা একাডেমীর সামনে আয়,আধাঘণ্টার মাঝে।"আরেকটু কথা বললে কি হত...দরকারের বেশি একটা কথাও বলে না,কি জানি কি জরুরী কাজ,নিশ্চয়ই আবারো উনার কোন বই পছন্দ হয়েছে,এখন যাবেন বই কিনতে,আমাকেও যেতে হবে উনার সাথে। 

রেডি হয়ে বেরোলাম,বেরোতেই বৃষ্টি,যাই হোক আজকে অন্তত ওর সাথে বৃষ্টিতে ভেজা হবে। বাংলা একাডেমীর কাছে যেতেই দেখলাম মানুষজন জটলা পাকিয়ে দাড়িয়ে আছে। একজন খুব হাতপা নেড়ে বর্ণনা দিচ্ছেন,উনার কাছে গেলাম ভাল করে শোনার জন্য। "আহারে ছেলেটার না জানি কি অবস্থা,ট্রাকটা সোজা এসে ধাক্কা দিল,কেঊ বুঝতেও পারলো না ।হসপিটালে নেয়া হয়েছে,শুনলাম অবস্থা নাকি সিরিয়াস।" আমার নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল,কার কথা বলছে ওরা,আমার রাইয়ানের কি কিছু হয়েছে...পাগলের মত ফোন দিলাম ওকে,ফোন বন্ধ । মাথা ঘুরে উঠল আমার,অসুস্থ লাগছে...কী করব এখন ! মানুষ টাকে জিজ্ঞেস করলাম "কোন হসপিটালে নেয়া হয়েছে?"বলল, "ঢাকা মেডিকেলে "।রিকশা নিয়ে গেলাম,ডিএমসি তে ঢুকে এক নার্সকে পেলাম। উনি জানালেন যে সকালে এক ছেলে কে এডমীট করা হয়েছে,কেবিন নম্বরঃ১১৩। ছুটলাম সেখানে,আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করে যাচ্ছি,আমার রাইয়ানকে বাঁচিয়ে দেও আল্লাহ্,জীবনে আর কিছুই চাইব না তোমার কাছে...কেবিনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওর মুখ,ওইতো আমার রাইয়ান,কি শান্তভাবে শুয়ে আছে,সারা গায়ে ব্যান্ডেজ। ডক্টরকে দেখে জিজ্ঞেস করলাম প্যাশেন্টের কি অবস্থা...ডক্টর আশ্বস্ত করলেন, "একটুর জন্য বেচে গিয়েছেন,আরেকটু ব্লাড লস হলেই আর বাঁচানো যেত না।এক্সিডেন্টের সাথে সাথেই ভর্তি করা হয়েছে বলে রক্ষা।" বুকের ভেতর অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা শ্বাস টা ছাড়লাম,জীজ্ঞেস করলাম, "ওর সাথে কি কথা বলা যাবে?"ডক্টর বললেন, "একটু আগে উনার হুঁশ ফিরেছে,কথা বলতে পারেন,কিন্তু বেশি স্ট্রেস দিবেন না।"ঢুকলাম ওর কেবিনের দরজা দিয়ে,হাঁটার গতি কেন জানি একদম কমে গেল। কোনমতে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর মাথার পাশে । কান্না চেপে ডাকলাম, "এই ভ্যাবলা।" 
ও চোখ মেলে তাকালো আমার দিকে...হাসল আর ফিসফিস করে বলল-"মন চায় হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণে"
আর পারলাম না আমি,ওর হাত টা ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম....................

"KM"

No comments:

Post a Comment