Subscribe:

"আমার !" ( একটি গল্পের অপমৃত্যু )

বাবা সেনাবাহিনীতে চাকরী করতেন বলে খুব অল্প বয়সেই দেশের অনেকগুলো জায়গায় থাকাতে আর লেখাপড়া করতে হয়েছে । কুমিল্লায় জন্ম হল, তারপর মঙ্গলবার, যশোর, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম হয়ে সাভার এসে থামলাম । তখন সাল ২০০০ সহস্রাব্দ । সাভার ক্যান্টঃ বোর্ড স্কুলে পড়ি । অষ্টম শ্রেণীতে ।


মার্চের মাঝামাঝি একটা সময়ে প্রতিদিনকার মতো ক্লাস চলছিলো । বাংলা ক্লাস । সুমি ম্যাডাম আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলেন । তাঁর মতো এমন অদ্ভুত চমৎকার একজন শিক্ষক আরেকটা খুঁজে পাওয়া  দুষ্কর । এটা নিয়ে অভিভাবক মহলেও ভিন্নমত ছিল না । প্রত্যেককে সমান আদর করতেন বলেই হইতো এটা সম্ভব হয়েছিল । ক্লাসের মাঝখানে দপ্তরী চাচা একটা মেয়েকে নিয়ে এলো ক্লাসের দরজায় । ফুটফুটে মিষ্টি চেহারার মেয়েটার মুখের অস্থিরতার সাথে তার আশ্চর্য সুন্দর স্থির চোখগুলোকে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিলো না । ম্যাডাম ওকে ক্লাস এ নিয়ে এসে বলল, “ওর নাম শশী । আজ-ই ভর্তি হয়েছে । ওর বাবা কয়েকদিন আগে বদলি হয়ে এখানে এসেছেন । তাই এখন থেকে ও তোমাদের সাথেই পড়বে ।”

একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম । ক্লাসে আমার রোল ছিল ৩ । তাই বসার কথা ছিল রোল ৪-এর সাথে । কিন্তু রোল ৪ এর বাবা জাতিসংঘ শান্তিদূত হিসেবে বাইরে চলে যাবার পর ওরা সপরিবারে গ্রামে চলে যায়। ফলে একায় বসতে হয়েছিল কয়েকটা দিন । শান্ত সুন্দর চোখের মেয়েটাকে আমার পাশেই বসতে হল । অবোধ কিশোর হৃদয় সেদিন কোন এক অজানা  ভাষায় কিছু বলেছিল হয়তোবা ।

ঘরকুনো স্বভাবটা একটু বেশীই ছিলো বলে কিনা জানিনা, খুব ভালো কোন বন্ধু ছিলো না ক্লাসে । কথাও বলতাম না খুব একটা । তিনটা দিন পেরিয়ে যাবার পরও একটা কথাও হয়নি শশীর সঙ্গে । চতুর্থ দিনে শশী নিজেই এসে বলল,

-কি নাম তোমার ?

-নাঈম ।

-শুধুই নাঈম ?

-হ্যাঁ । তো ? তুমি বেশী কথা বল !

কথাটা শুনার পর একরকম কথা বলাও বন্ধ করে দিল শশী । চুপচাপ ক্লাসে এসে পাশে বসতো । আবার নিরবেই চলে যেত ।

শশীর এই আচরণটা আমার ভেতরের কোথাও নাড়িয়ে দিয়েছিল । খুব তাড়াতাড়িই আমার সেদিনের ভুলটা স্পষ্ট হয়েছিল আমার চোখে । কিন্তু সাহস হচ্ছিলো না কোনমতেই আগবাড়িয়ে গিয়ে কথা বলার । ভুলটা আমাকে আমার মধ্যে পুড়াচ্ছিল প্রতিনিয়ত ।

একদিন সাহস করে বললাম,

-সর‍্যি ।

-কি ?

-আই এম সর‍্যি ।

-ওহ । কিন্তু কেন ?

-সেদিনের আচরণের জন্য।

- ঠিক আছে ।

-কি ঠিক আছে ?

-সব ।

-সত্যি ?

-হুম ।

সেদিন থেকে তার নিষ্পাপ হাসিটা আমাকে বিমোহিত করতো ।

তার চঞ্চলতা আমাকে আমার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিলো অনেকখানি । একটা সহজ সুন্দর বন্ধুত্ব আমাদের ঘিরে ফেললো । বাবার কলিগ থাকায় তাদের পরিবার আর আমাদের পরিবারের মধ্যে সম্পর্কটাও ছিল ঈর্ষা করার মতো ।

সহস্রাব্দ শেষ হলো । ২০০১ ততদিনে একতৃতীয়াংশ ভ্রমন তার শেষ করে নিয়েছে । প্রথম সাময়িক পরীক্ষার পর ১৫ দিনের বন্ধের নোটিশটা পেয়েছিলাম পরীক্ষা শুরুর আগেই । পরীক্ষা মাঝেই শশী একদিন বলল এবারের বন্ধটা নাকি ও ওদের দাদুবাড়িতে কাটাবে । পরীক্ষার টেনশনে ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাইনি ততোটা । পরীক্ষার শেষদিন শশী এসে বলল,

-দোস্ত, কাল দাদুবাড়ি চলে যাচ্ছি ।

অনেক খুশি-ই দেখাচ্ছিল ওকে । আমি বললাম,

-কি ! কিন্তু কেন?? আর আমাকে আগেই বা বলিসনি কেন?

-বলছি তো তোকে । তুই ভুলে গেছিস বোধহয় ।

-১৫ টা দিন তুই দাদুবাড়ি একা একা কাটাবি ! আর আমার-ই বা সময় কাটবে কিভাবে?

-একা কে বলল ! আম্মু যাচ্ছে আমার সাথে । আরে, ১৫ দিন খুব বেশি একটা সময় না । দেখতে দেখতে কেটে যাবে । আর জানিস, আমার দাদুবাড়ির পাশে সুন্দর একটা বিল আছে । জায়গাটা অনেক সুন্দর ।

-জানি তো । তুই আগেও বলেছিস । তবুও যাসনা ।

-কেন ??

-এমনি । আমি বলছি, তুই যাসনা । এখানেই থাক, দেখবি আমরা বন্ধুরা মিলে অন্নেক মজা করব ।

-নাঈম, তুই অনেক ছেলেমানুষ । কি বলছিস বোকাদের মতো । জানিস, আমি কত্ত দিন যায়না দাদুবাড়ি । এবার অন্নেক মজা হবে ।

- আচ্ছা, যা ভাগ । যেখানে খুশি যা ।

-ধুর বোকা । ১৫ দিন-ই তো শুধু । তারপরতো চলেই আসবো ।

-হুম ।

একটু অভিমান মিশিয়েই কথাগুলো বলতে চেষ্টা করেছিলাম ওকে । কিন্তু ধরে রাখা কি এতোই সহজ ?

পরদিন ওর আম্মুর সাথে ফরিদপুর চলে গেল শশী ।

গল্পের পরের কথা গুলো শশীর দাদীর মুখে শুনা -


শশীর দাদুবাড়ির প্রিয় জায়গাটা ছিল বাড়ির পাশে বাঁধানো ঘাটটা । স্বচ্ছ বিলের পানি আছড়ে পড়তো সেই ঘাটে । শশী যে বার এলো, প্রচুর শাপলা জন্মেছিল বিলের স্থির পানিতে । বিকেলে পৌঁছে শশী যখন বিলের ঘাটে এলো, শশী খুঁজে পেলো, অসংখ্য শ্বেত্ব শুভ্র শাপলা ফুলে ঢেকে গেছে যতদূর চোখ যায় । নিস্পাপ সেই সৌন্দর্যে ভরে উঠলো শশীর মন । একটা আকুলতা জেগে উঠলো তার মনে । ছুঁয়ে দেখার আকুলতা ।

দাদী আর চাচা তার পাশেই ছিলো । শশী তার চাচাকে বলল,

-চাচা, আমাকে কয়েকটা শাপলা ফুল তুলে দেন ।

-কিন্তু মা, এখনতো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে । কাল দুপুরের আগে তোমাকে ঠিক তুলে দেব অনেকগুলো । এখন হাতমুখ ধুয়ে খেতে আসো ।

চাচার কথায় শশীর মন ভরল না । দাদীকে বলল,

-দাদী, আমার শাপলা লাগবে এক্ষুনি ।

-দাদু, তোর চাচু তো বলেছে, কাল ঠিক এনে দেবে । এখন খেতে চল । সবাই বসে আছে ।

শশী ঘরে ফিরে এলো । তার বিমোহিত চোখ তাকে ডাকছিল অজানাতে । আম্মু, দাদী, চাচার গল্পে সাড়া দিচ্ছিল না । চঞ্চলা কিশোরীর হঠাৎ এ পরিবর্তন ততোটা নজরে পড়েনি কারও ।

দাদীর পাশে শুয়েও সে শুধু ভাবছিলো স্বপ্নের মত সেই বাস্তবতাটাকে । পাবার আকুলতা তার সামর্থের জ্ঞানকে লোপ করে দিলো ।

তখনো ততটা ভোর হয়নি । পূব আকাশে আলোর দেখা মিলছিলো মাত্র । নিঃশব্দে শশী দাদীর পাশ থেকে উঠে এলো । ঘাটে এসে বাঁধা নৌকায় উঠে বসল । বৈঠা বেয়ে চলে এলো স্বপ্নের খুব কাছাকাছি । স্বর্গীয় একটা মোহে আচ্ছন্ন হল শশীর হৃদয় । কয়েকটা শাপলা তুলে রাখলো নৌকার পাটাতনে । সবচেয়ে বড় যে শাপলাটা, তার কাছাকাছি গেলো শত শাপলাকে পাশ কাটিয়ে । দুহাতে লতাটা ধরে হ্যাঁচকা একটা টান দিলো । শাপলাটা উঠে এলো না, তাঁকে নিয়ে নিয়েছিলো সহস্র শাপলার বুকে ।

শশীকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো সেদিন দুপুরে । শাপলার বিলে ভেসে উঠা ওর চুল গুলো জানিয়ে দিয়েছিলো ওর মৃত্যুর খবর ।

আমরা খবরটা জানলাম পাঁচদিন পর, যখন তার বাবা-মা ফিরে এলো গ্রাম থেকে । কাঁদতে পারিনি । প্রচণ্ড জ্বরের ঘোরে পড়ে রইলাম কয়েকটা দিন । ততদিনে শশীর পরিবার অনেকটা সয়ে উঠেছিল । কিন্তু আমি পারিনি । বেঞ্চের খালি থাকা পাশটা বারবার জানান দিচ্ছিলো তার অস্তিত্বহীনতার কথা । তাকে বলা শেষ কথাগুলো নাড়া দিচ্ছিলো বারবার । কেন গেলি তুই ? ? তোকে বলেছিলাম, তুই না থাকলে কিভাবে চলবে, তবুও কেন চলে গেলি??

যখন ও ছিলো, তখন বুঝতে পারিনি, তুই শুধু আমার বন্ধুই ছিলি না, আমার কাছে আরও বেশি কিছুই । একেবারে আমাকে রেখে চলে গিয়ে না বুঝালে হতো না?? তুই বোকা, স্বার্থপর ।

আমার সময় থেমে থাকেনি । বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর বন্ধুরা মিলে ঘুরতে গিয়েছিলাম কুষ্টিয়াতে, লালন পল্লীতে । নিশ্চুপ শশী সেইবার আবার নাড়া দিলো । ভাবলাম, একবার ওর দাদুবাড়ি হয়ে যাব । ফরিদপুর চলে এলাম একটা বন্ধুকে নিয়ে । আম্মুর থেকে নেয়া ঠিকানা ধরে যখন পৌঁছলাম ওর দাদুবাড়ি, দেখলাম, সেই জৌলুশটা আর নেই । শশীর চলে যাবার পর ওর মা একেবারে চলে এসেছিলো সেখানে । অনেকদিন পর কাছে পেয়ে যার পর নাই খুশি হয়েছিলেন । শশীর দাদীর মুখে সব ঘটনা শুনলাম । তারপর দাদীর সাথে সেই ঘাটে এলাম, শশীর প্রিয় জায়গাটা ।

সেইবার কোন শাপলা ছিল না বিলের বুকে । সেই নিষ্ঠুর বিলটাই ছিল মৃতপ্রায় । হয়তো আমার কষ্টটা স্রষ্টা পর্যন্ত পৌঁছেছিলো । যে শশীকে সরিয়ে দিয়েছিলো সবার থেকে, আমাকে আলাদা করে দিয়েছিলো আমার থেকে, সেদিন তার মুমূর্ষু দশা দেখে আমি তৃপ্ত হয়েছি ।

ভালো থাকিস শশী, স্বর্গে অপেক্ষা করিস আমার জন্য ।


-Latiful kabir Sujon

No comments:

Post a Comment