Subscribe:

অতঃপর...

আজ সকালে ঘুম ভেঙেছে বিন্দারের ফোনে। যারা আমার আগের লেখাগুলো পড়েছেন, তারা বোধহয় আমার এই ভাগিনাকে ভাল করে চেনেন। বিন্দারের ফোন মানেই সেখানে বিশেষ কিছু থাকবে। সেই বিশেষ কিছু টা কী হতে পারে আমার ধারনার বাইরে। আমি যদিও বিন্দারের মামা, তারপরও আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, এই শিশুর কাছে আমি কিছুই না। বাঁদরামি ব্যাপারটাকে বিন্দার রীতিমত আতংক বানিয়ে ফেলেছে। আর ভয়টা সব সময় আমারই বেশি। ওর টার্গেট কেন জানি সবসময়ই আমি। নিরীহ লোকের দিকে দুর্জনেরা বেশি বেশি নজর দেয়। বিন্দারটাও এর ব্যাতিক্রম না।


-হ্যালো মামা...তুমি আমাদের বাসায় কবে আসবা? তোমার জন্য মুরগী রাখছি।
-আমি হলের ডাইনিং এ মুরগী খাই। সমস্যা নাই। তুমি মুরগী খাও। পেট ভরে খাও।
-জ্যাতা মুরগী নাতো মামা!! মরা মুরগী, পলিথিন দিয়া প্যাঁচায়ে রাখছি। হা হা...তোমারে লোকজন শকুন কয়...!!

আমি ফোন রেখে দেই। সামনে থাকলে, চড়ায়ে বিন্দারের মুরগী খাওয়ানো ছুটায়ে দিতাম। পরে আবার ভাবি, আরে বিন্দারের দোষ দিয়ে তো লাভ নাই। বিন্দারতো এম্ননিতেই ইঁচড়ে পাকামোর শেষ পর্যায়ে আছে। এখন ব্লু বেল্ট, কয়দিন পর ব্ল্যাক বেল্ট পাবে। ওর জাস্ট একটা উছিলা দরকার ছিল। সেই উছিলাটা তো ওকে দিয়েছে ইশিতা। 

ইশিতা সম্প্রপ্তি আমাকে রেজা শকুন/শকুন রেজা বলে ডাকে। শুধু সে ডেকেই ক্ষান্ত হয় না। খুব ভালবাসা নিয়ে আমার ফেসবুক ওয়ালে সেটা লিখেও দিয়ে আসে।

 দিন কয়েক আগে বিন্দারও ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। এখন তার একমাত্র কাজ হল, তার মামা কী করছে, সেটা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এবং যথা সময়ে তার মার কাছে সে তথ্য হালনাগাদ করা। বিন্দারের মা(আমার বোন) সে তথ্য আবার আমার মার কানে দেন। পুরা চক্রীয় একটা ব্যাপার। বিন্দার এবং তার দুষ্টচক্র। 

দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে ফেলি। আমার শকুন নামকরণের প্রসার তাহলে হচ্ছে, ফেসবুক থেকে!! নাহ, বিন্দারটাকে রিমুভ মারতে হবে।

ইশিতা প্রসঙ্গে আসি। এই মেয়ের সাথে আমার প্রাগৈতিহাসিক প্রেম। ঈশিতা ফার্স্ট ইয়ারে এসেই আমার হাতে কট খেয়েছে। প্রেমবর্ষ হিসেব করলে, তিন বছর প্রায় শেষ হই হই ভাব। এই তিন বছরে পৃথিবীতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নায়ক 'এম এ জলিল অনন্ত' 'খোঁজ দি সার্চ' এর পর 'রান দি দৌড়'  নিয়ে আবার ঢাকা কাঁপাতে আসছেন। দেশ পেয়েছে একজন কালজয়ী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনরা তাদের শাষন গুটিয়ে, এখন স্মৃতিপটে। এক কালের মাঠ কাঁপানো আশরাফুল এখন দুইের বেশি রান করতে পারেন না। মুসার পরে মুহিতও দেখিয়ে দিল কিভাবে এভারেস্ট জয় করতে হয়। 

চারপাশে যখন এতো পরিবর্তন, তখন ইশিতাই বা অপরিবর্তিত থাকবে কেন। ইশিতাও বদলেছে। ওর চেহারার লক্ষ্মী লক্ষ্মী ভাবটা পক্ষী হয়ে অনেক আগেই উড়াল দিয়েছে। এখন ঝগড়া করার সময় আমি ইশিতার মুখে ঢাকার রাজপথ দেখি। বিচিত্র সব অনুভূতির বিক্ষিপ্ত দৌড়াদৌড়ি দেখি। কখনও পুলিশ হয়ে আমাকে জয়নাল আবেদিন ফারুক ভেবে কঠিন মাইর দেওয়ার একটা শক্ত ইচ্ছা দেখি,কিংবা পিকেটার হয়ে আমার উপরে ওর নির্ভুল নিশানায় ইটা বর্ষণের তীব্র আকাঙ্ক্ষা দেখি। 

অথচ এই মেয়ে তিন বছর আগে জোরে কথা পর্যন্ত বলতে পারতো না। একটু কিছু হলেই চোখের ট্যাপ টা খুলে দিত। আমরা দেখতাম, কিভাবে একটা মেয়ে তুচ্ছ কারণে বেহিসাবে চোখের পানি ফেলতে পারে। সেই ইশিতার গত তিন বছরে অভবানীয় মৌল এবং ভৌত পরিবর্তন হয়েছে। হিন্দি সিরিয়াল দেখে কুটনি হয়েছে(মৌল পরিবর্তন), আর মুখ বাঁকিয়ে ঝগড়া করা শিখেছে(ভৌত পরিবর্তন)। 

আমার অবশ্য বিশেষ কোন পরিবর্তন হয়নি। বরং আমি আগের চেয়ে বেশি সহনশীল হয়েছি। উদার হয়েছি। সহনশীলতার একটা উদাহরণ দেই। ইশিতার একটা বিলাই আছে, থুক্কু বিড়াল আছে।( ইশিতার বিড়ালকে বিলাই বলা নিষেধ,এতে বিড়ালের অপমান হয়)। 

আমি ওদের বাড়িতে গেলেই এই বিলাই আমাকে ওর বাবা ভেবে পায়ে এসে লুটোপুটি খায়। বাবা ভাবটাই স্বাভাবিক। ইশিতা বিলাই মাতা, সেই সুত্রে আমিও বিলাই পিতা। কিন্তু পিতা হিসেবে আমি খুবই নির্মম,মুহূর্তেই ইচ্ছা করে ইশিতার বিলাইটাকে ফুটবল বানিয়ে বা'পায়ের জোরালো শটে মাঝমাঠে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু আমি সেটা করিনা। কারণ আমি একজন প্রেমিক। আমি হৃদয়ের সব ভালবাসা হাতের তালুতে নিয়ে আসি। তারপর সে হাতে বিলাইকে আদর করে দিই। বিলাই আদর পেয়ে চোখ বন্ধ করে। আমি ব্যাকুল হয়ে ইশিতাকে দেখিয়ে বলি,'দেখ দেখ!! বিলাইটা না সো সুইট। ঠিক তোমার মত।' ইশিতা চোখ পাকিয়ে তাকায়, প্রশংসা করলাম, না পিন মারলাম ও গম্ভীর হয়ে বোঝার চেষ্টা করে। ইশিতার জন্য তখন আমার খুব মায়া হয়। আহারে!!প্রেমিক দুষ্টপ্রকৃতির হলে, প্রেমিকাদের কষ্টের সীমা নাই...

আজ এই বিলাইমাতার জন্মদিন। বিলাইমাতা আজ একুশে পড়বে। খুব ভাল হয় যদি,ওকে বড়সর একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যায়। প্ল্যান অনুযায়ী একটু পর, ওর সাথে তুমুল একটা ঝগড়া করা হবে। ওকে কাঁদানো হবে। তারপর ঠিক বারটায় ওর বাসার সামনে গিয়ে একটা নাটক করা হবে। নাটকের দৃশ্যগুলো এখনও গুছিয়ে নিতে পারিনি। তবে আমার ইচ্ছা আছে,ও বারান্দায় আসা মাত্রই এলাকা কাঁপিয়ে 'তোমাকে অনেক ভালবাসি ইশিতা' বলে একটা চিৎকার দেব।

তারপর দৌড় দিয়ে পালাবো। ইশিতার বাবা লোক বেশি সুবিধার না। ধরতে পারলে, মজনুগিরি ছুটিয়ে দেবে। 

প্ল্যান অনুযায়ী আমি ইশিতাকে ফোন দিলাম।

-হ্যালো ইশিতা...
-হম বলো।
-শোন,আজ রাতে আমার খুব ইম্পরট্যান্ট একটা কাজ আছে। সারা রাত ফোন অফ থাকবে।
-রাতে তোমার কি কাজ? আর সারা রাত ফোন অফ থাকবে এটার মানে কি?
-কোন মানে নাই, ফোন অফ থাকবে এটাই হলো মানে। মেলা বক বক করছি। ফোন রাখলাম।
-তুমি আসলেই আজকে রাতে আমাকে ফোন করবে না?
-কোন চান্সই নাই। তুমি ঘুমিয়ে পর। আর ঘুম না আসলে, হিন্দি সিরিয়াল দেখতে পার। 

আমার কথা শেষ হবার আগেই ইশিতা ফোন রেখে দেয়। পরিকল্পনার প্রথম অংশ সফল হলো। 

আমি রাত বারটার বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে, ওর বাসার সামনে পজিশন নিলাম। ফোন হাতে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে উঠি। ওকে বারন্দায় আসতে বলতে হবে। হাতে সময় কম।

খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করলাম, ইশিতার ফোন বন্ধ। রাত বারোটা বেজে গিয়েছে অনেক আগেই। চারপাশের সব শুন্যতা তখন আমার চোখে ভর করেছে। আমি দাড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় করছি। অন্তহীন এক অপেক্ষা...

সে রাতে ইশিতাকে আর বলা হলনা, যে পাগলামিটা আজকে ওর জন্য করতে এসেছিলাম,সেটা না করতে পেরে কী সীমাহীন কষ্টের ভেতর দিয়ে আমি যাচ্ছি। সারে চারটা পর্যন্ত ওর বাসার সামনের ফুটপাতে বসে থাকলাম। ইশিতাতো এতো তারাতারি ঘুমিয়ে পড়ে না, কেন জানি মনে হচ্ছিল ও একবার বারন্দায় আসবেই। আমার সব ধারনা ভূল প্রমানিত হল। ইশিতা সে রাতে আর বারান্দায় এলো না। 

এর পর তিন দিন আমাদের কথা হয় নি। চতুর্থ দিনে ইশিতা ফোন করলো।

-হ্যালো...
-হম কি খবর?
-কোন খবর নাই। শোন,তিন দিন তোমাকে ফোন করিনি। তুমি নিজেও আমাকে অন্তত একটা বার ফোন করবে, সেটুকুও উচিত মনে কর নি। মাঝে আমার জন্মদিন বলে একটা দিন ছিল।তুমি সেটাও ভুলে গেলে। তারপরও আমি এসব কিছুই মনে রাখিনি। তুমি বাইরে আসো। আমি দাড়িয়ে আছি। দুপুরে একসাথে খাব। 

ইশিতা একটানা অনেক কথা বলে ফেলে। ওর কথাগুলো শোনার পর কেন জানি আমার মনে হয়, এই মেয়ে আমাকে একদমই বোঝে না। ও ভাবলো কিভাবে যে, আমি ওর জন্মদিন ভুলে যাবো??

-শোন ইশিতা, তোমার জন্মদিন, ব্যাপারটা কিন্তু খুব একটা আহামরি কিছু না। যখন তোমার জন্মদিন, ঠিক সেই সময়ে পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে অন্য কেউ মারা যাচ্ছে। আর এতো লোকের জন্মোৎসব কিংবা মৃত্যুৎসব কোনটা পালন করার মত সময়ই আমার হাতে নেই। 

-তুমি এইভাবে কথা বলছ কেন?
-যেভাবেই বলি, খুব সত্যি কিছু কথা বলেছি। আর আমার শরীরটাও ভাল না। তুমি বাসায় যাও।

ও সেদিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল কী না, আমি আর খোঁজ নেই নি। মাথায় একটা ব্যাপারই ঘুরছিল সারাদিন, এই মেয়ে কী এতোদিনে আমাকে একটুও বুঝে উঠতে পারে নি। আর না বুঝে কাউকে কি ভালবাসা যায়? 

দুই সপ্তাহ হতে চলল। আমাদের যোগাযোগ নেই। আমি এর মাঝে একবার জ্বরে পড়লাম। প্রতিদিন বিকেল বেলা গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। খাওয়া দাওয়ারও বেহাল দশা। বাইরে গিয়ে খাওয়ার মত ইচ্ছা হয় না। সারাদিন চোখ লাল করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে জানালা দিয়ে আকাশ দেখি। 

এরই মধ্যে একদিন রাতে "কৌটা তন্ময়" রুমে আসে। 'কৌটা তন্ময়' ইশিতাদের সাথে পড়ে। হলের নব্য রাজনীতিবিদ। তন্ময় নাকি ভাল ককটেল বানায়। সে জন্য নামের আগে 'কৌটা' বিশেষন যুক্ত হয়েছে।

-ভাইয়া শরীর খারাপ নাকি?
-হম,জ্বর খুব পেইন দিচ্ছে।
-ভাইয়া একটা হেল্প লাগবে যে।
-কি হেল্প?
-শ পাঁচেক টাকা লাগবে। ক্লাস থেকে পোলা পান ট্যুরে যাচ্ছে সিলেট। 
-তোর কাছে টাকা নাই?
-জী না ভাইয়া নাই।
-যা গিয়া ককটেল বানা। তারপর নীলক্ষেত গিয়ে ওইগুলা সেল দে। দশটা বেচতে পারলেই পাঁচশ টাকা পকেটে।
-ভাইয়া দেন না। আসলেই টাকা নাই।

 শরীর এমনিতেই ভাল না। কৌটার সাথে বক বক করার টাইম নাই। ওকে টাকাটা দিয়ে বিদায় করে দেব, ঠিক এই সময় কৌটা আমাকে অবাক করে দিয়ে, আমার হাতে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। 

-কিরে কার চিঠি এটা?
-আপনার। ইশিতা দিয়েছে আপনাকে। আপনারা পারেনও ভাই। এই যুগে আইসা চিঠি চালা চালি করেন। 
-কৌটা কথা কম। টাকা পাইছস, এখন বিদায় হ।

কৌটা চলে যাওয়ার পর, আমি ইশিতার চিঠি খুলি।

প্রিয় অকর্মণ্য উজবুক 

আজ রাতে ক্লাশের সবাই সিলেট যাচ্ছে। রাত শোয়া দশটায় বাস। আমি যাচ্ছি ট্রেনে। কমলাপুর থেকে এগারোটায় সিলেটের শেষ ট্রেন। আমার বুদ্ধি তোমার মত না। তারপরও কী মনে করে জানি, দুইটা টিকেট কাটলাম।

তুমি আসবে কী না, সেটা তোমার বাপার। 


আমি ঘড়ি দেখলাম। সাড়ে দশটার উপরে বাজে। জীবনের সেরা দৌড়টা দিতে হবে আজকে । ইশিতা মেয়েটা স্টেশনে একা একা অপেক্ষা করছে...



-রেজা শাওন

No comments:

Post a Comment