Subscribe:

শেষ হয়ে যায় কাছে থাকার দুপুর...

বসে আছি তো আছিই, আমার রাজপুত্তুর মশাইয়ের কোনো খোঁজ নাই। ফোন দিলাম। সুন্দর করে বললো, ‘ময়না, ইক্টুখানি দাঁড়াও’। বুঝে নিলাম আমার রাজপুত্তুর মশাইয়ের মতলব ভালো না। তিনি আমাকে তো সহজে তেল মারার মানুষ নন! মনে মনে যত্ত করম গালি আসে দিতে লাগলাম। ইতর, বদমাইশ, ফাজিল, কান্ডজ্ঞানহীন, অপদার্থ... কিছুই বাদ গেলো না। সামনে তো আর পারি না, তাই কি আর করা! মনেই মনেই মনের ঝাল মিটাই। লোমকূপ বেয়ে যে ঝর্না ঝরছে বুঝতেই পারছি। সূর্য মামা আজ ভীষন রেগে আছে মনে হচ্ছে।


অনবররত ফোন দিচ্ছি, ধরে না। একবার মনে হইলো ফোনটা দেই আছাড়। খানিক পরেই মায়া হইলো, কারন ফোনটা আমার বাপজানের টাকায় কেনা। রাগে রোদের মধ্যেই দাঁড়ায়ে থাকলাম। আগে যখন প্রায়ই দেখা হইতো, আমি কখনোই ওর আগে আসতে পারতাম না। অথচ আজ আমি লেট করে আসার পরও সে আসে নি। আজ কাঁদতেও ইচ্ছা করতেছে না। কাঁদবো কার জন্যে! ঠেকা পড়ছে ভারি আমার! যে আমার সাথে দেখা করে না, ব্যস্ততার নাম করে ফোন ধরা পর্যন্ত প্রায় বাদ দিয়ে দিছে বলা যায়, তার জন্য এতো কেনো! খানিক পর আবার খারাপ লাগলো, ‘ইস, ও তো আমাদের জন্যেই করতেছে এতো কিছু। খালি খালি বেচারার দোষ দিচ্ছি আমি।’ দুপুর বেলা, আশেপাশে কেউ নাই। ভীষন রাগ হচ্ছিলো। মাথার মধ্যে যুদ্ধ চলছিলো, রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার। অনেক্ষন পরে দেখলাম আমার রাজপুত্তুর মশাই একখানা ভাঙ্গা রিক্সা ছুটিয়ে আসছেন। রিক্সায়ালাকে বিদায় করে দিয়ে তিনি আমার সামনে দিয়ে ছাঁয়ায় যেয়ে বসে পড়লেন। আমাকে দেখলেনই না! মেজাজ গেলো আবার চড়ে। একবার ভাবলাম চলে যাই, আবার কাছে গেলাম।

-‘আমারে কি তোমার চোখে পড়ে নাই!’
=‘পড়বে না কেনো! জলজ্যান্ত পাঁচ ফিট তিনের একটা পেত্নীরে চোখে না পড়ার কি আছে?’
  চোখ ঘুরায়ে তাকালো আরার দিকে।
-‘তা এতো রেখে পেত্নীরে প্রোপোজ করছিলা ক্যান?’
=‘তুমি কি জানো যে আমার সাথে থাকতে থাকতে তুমিও সুন্দর হয়ে গেছো!”
  দুষ্টামির হাসিটা বেশ স্পষ্ট।
-‘জ্বি না, তোমার সাথে থাকতে থাকতে বান্দর হচ্ছি।’
=‘উহু, বান্দরের বউ হচ্ছো।’
-‘দেরি হইলো ক্যান আজ?’
=‘ডেটিং এ গেছিলাম তো, তাই।’
-‘ডেটিং ভালো হইছে?’
=‘হুম। চরম!’
-‘লুইচ্চা কোহানকার!’
=‘তুমিও ভুল বুঝলা! জানো বাকিরাও একই কথা বলতো। আমাকে আসলে রোমান্টিক বলা যায় বুঝছো! তোমার তো অন্তত বোঝা উচিত ছিলো।’
-‘আমিই কেনো, বাকিরা কি দোষ করলো?’
=‘কারন তুমি আমার বউ।’
-‘আর বাকিরা?’
=‘খালি একই কথা বলো। তোমার জন্যে সবাইকে ছেড়ে দিয়েও কি ভুল হইলো! যখন ওরা ছিলো তখন কোনো খোঁচা খাইতাম না। এখন নাই, আর এখন খোঁচা খাইতে খাইতে পঁচে গেলাম। ভালো হয়েও কি ভুল করলাম আমি! এখন আমার মধ্যে যদি এতো রোমান্স থাকে তো আমি করতে পারি বলো।’
-‘তোমার মুখ না থাকলে যে কি হইতো!’
=‘প্রেম করতে পারতাম না।’
  দিলাম গোটা কতক কিল আর ঘুষি।

বেশ অনেক্ষন চুপ করে বসে আছি। এই কয়দিনে কি কি নতুন গান তার পছন্দ হইছে তাই সে একের পর এক আমাকে শোনাচ্ছে। অনেক্ষানি দূরে বসে আছে। মেজাজটা আবারও তাওয়ার উপর পড়লো।
-‘এতোখানি দুরেই বসে থাকতে হবে?’
=‘দুরত্ব বজায় রাখতে হয়। ট্রাকের পিছনে দেখো না লেখা থাকে, ‘একশ হাত দূরে থাকুন’।’
-‘আমি ট্রাক?’
=‘তা না তো কি! তোমার স্বাস্থ্য আমার চাইতে ভালো।’
-তো যাও আমার পিছে যায়ে বসো।’
=‘তুমিই কষ্ট পাবা আমার চেহারা দেখতে পাবে না বলে।’
-‘আমি কোন দুঃখে কষ্ট পাবো।’

সত্যি সত্যিই উঠে গেলো। রাগে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। দশ সেকেন্ড পরেই অনুভব করলাম দুইটা হাত আমাকে জড়িয়ে ধরেছে পিছন থেকে। ফিউজ হয়ে গেলাম। তবু মনের বিরুদ্ধে বলে উঠলাম, ‘ছাড়ো। ঢং করতে হবে না।’
=‘ঢংও করবো, ছাড়বোও না।’
শক্ত করে বলে উঠলাম, ‘ছাড়বা, কি না?’
সেই চিরচেনা জেদ আর রাগের সংমিশ্রনযুক্ত চেহারাখানি তার দেখা দিলো।
=‘সিওর তো ছাড়বো!’
প্যারালাল কানেকশানে টোটাল কারেন্ট মাপার ব্যর্থ চেষ্টায় পুরা কাট-আউটই পুড়ায়ে ফেললাম। কিছুই বলতে পারলাম না। খানিক পরে বললাম, ‘কেউ দেখে যদি...’
=‘মানুষের তো আর কাজ নাই এই রোদে এইখানে আসবে।’
আদুরে ভাব নিয়ে বসে থাকলাম ওর বুকের কাছে। কিন্তু বুক পর্যন্ত যাইতে পারতেছিলাম না। অতৃপ্তি আর রাগ দুইটাই একসাথে ভর করলো।
-‘বাবু...’
=‘হু...’
-‘বদলে যাচ্ছো তুমি।’
=‘বড় হচ্ছি না!’
-‘আমি কি ছোট হচ্ছি?’
=‘সে জন্যেই তো কিছু করার চেষ্টা করতেছি।’
আরও একবার হেরে গেলাম। এই মানুষটার কাছে হারতেও কেনো জানি কোথায় একটা সুখ লুকায়ে আছে। চুপ করে থাকলাম।
-‘বাবু...’
=‘বলো...’
-‘এইভাবে ভালোবাসবে তো সারা জীবন?’
=‘সম্ভবত..’
-‘সম্ভবত কেনো?’
=‘বলতে পারতেছি না। বর্তমানে নাই বলে যে ভবিষ্যতে আরো কেউ আসবে না তা কি করে বলি!’
-‘আবার!’
=‘তুমিই তো শুনতে চাও।’
-‘চলে যেতে পারবে আমাকে ছেড়ে।’
=‘তা আর সম্ভব না। শেকল পড়ে গেছে তোমার হাতের সাথে আমার হাতের।’
-‘বদলে যাবে না তো?’
=‘তা তো বলতে পারি না।’
-‘মানে?’
=‘আমি তো ভবিষ্যতে আরো ফর্সাও হইতে পারি, আবার আরো কালোও হয়ে যাইতে পারি।’

বলা নাই কওইয়া নাই ধাপ করে এসে কোলে শুয়ে পড়লো।
-‘কেউ যদি দেখে তোমার বাপরে ডেকে আনে।’
=‘আরে আমি তো বাপেরই ছেলে।’
-‘কি খারাপ! বাপরেও ছাড়ো না!’
=‘বাদ দাও তো।’

চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। মুখটা খানিক ঝুকায়ে রোদটা ঠেকালাম ওর মুখের উপর থেকে। চোখ বন্ধ করে আদর নিতে লাগলো আমার রাজপুত্তুর।

নাকটা টিপে দিলাম একবার। চুলে হাত বুলায়ে দিতে থাকলাম। রাজপুত্তুর মশাই আমার চুপ! এতো সুন্দর লাগতেছিলো! তাকায়ে ছিলাম একভাবে। একটু বেশিই ঝুকে যেয়ে একটা ছোট্ট আদর দিয়ে দিলাম আমার জানপাখি বাবুইসোনাটার কপালে। তবু সে চুপ। পকেটে ওর ফোনটা ভাইব্রেশন দিয়ে উঠলো। ওর মা ফোন দিছে। ঠাস করে আন্টিকে বলে ফেললো, ‘তোমার বউমার সাথে আছি। বাসায় আসতে আরো পাঁচ মিনিট লাগবে।’ আন্টি বলে উঠলো, ‘ওরে নিয়ে এসে একসাথে দুপুরে খাইলেই তো পারতি, রোদের মধ্যে ঘোরার কি দরকার।’ ফোন রেখেই বলে, ‘বাপ মা টাইম অটাইমও বুঝে না। আমি কি তাদের ডেটিংএ ডিস্টার্ব দিতাম যে আমারে দেয়।’
-‘তোমার মুখে কি কিছুই আটকায় না বাবু!’
=‘নাহ।’

ওর হাতের আঙুলের ভাঁজে আমার আঙুল্গুলো রেখে বসে থাকলাম আরো কিছুক্ষন।
এই মানুষটার পাশে হাঁটলে নিজেকে খাটো লাগে। কিন্তু অসম্ভব ভালো লাগে। আমাকে রিক্সায় তুলে দিয়ে বাসায় ঢুকে গেলো। মনটা কেমন জানি হয়ে গেলো। ওর সাথে থাকার সময়গুলো এতো দ্রুত যায় কেনো!

শেষ হয়ে গেলো আরো একটা কাছে থাকার দুপুর...



-অবন্তি

No comments:

Post a Comment