Subscribe:

চৈত্র

চৈত্র মাসে খুব একটা বৃষ্টি হয় না এখানে। তারপরও কোথা থেকে জানি ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টি আর থামতে চায় না।
রাশেদ ছাদেই দাঁড়িয়ে ছিল। চৈত্রের এই অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি তার সারাটা শরীর ভিজিয়ে দিল।
পকেট থেকে খুব সস্তা দামের একটা সিগারেট বের করে ধরাল সে।
দামী সিগারেট কেনার মতো সামর্থ্য তার নেই।


আয়েশী ভঙ্গিতে সেই সিগারেটটা টানতে থাকে রাশেদ।   
চারপাশে পূর্ণিমার চাঁদের আলো, বৃষ্টিটাও কিছুটা কমে গেছে এখন। টিপ টিপ বৃষ্টিতে একটা দুঃখী মানুষ সিগারেট টানছে, কিছুক্ষন পর পর আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়ছে, বুকের ভেতরের সবটুকু কষ্টকে বের করে দিতে চাইছে যেন! অসাধারন একটা দৃশ্য, তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয় শুধু।
দূর থেকে চুপচাপ সবকিছুই দেখছিলো বীথি। দাদাকে অসাধারন লাগছিল তার।
অন্য সময় হলে দাদাকে সিগারেট খেতে নিষেধ করতো, কিংবা বাবার কাছে নালিশ দেয়ার ভয় দেখাতো।
কিন্তু আজ ভিন্ন ব্যাপার।
কাল সকালেই দেশের বাইরে চলে যাবে দাদা। অভাবের এই সংসারটার ঘানি টানার আর কেউ নেই। বাবা অনেক দিন ধরেই অসুস্থ, মন্টুটাও সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ায়। যা করার দাদাকেই করতে হবে।
বীথির মনটা খারাপ হয়ে যায় ভীষন, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে।
আর কেউ তাকে কানি বুড়ি বলে ক্ষেপাবে না, দামী চকলেট কিংবা আইসক্রিম কিনে দেবে না, অদ্ভুত রকমের জন্মদিনগুলোতে কেউ আর দামী বইও উপহার দেবে না তাকে।
সৃষ্টিকর্তার উপর ভীষণ অভিমান হয় তার, প্রিয় মানুষগুলোকে তিনি কত সহজে দূরে সরিয়ে দেন! দাদার সাথে আবার কবে দেখা হবে কে জানে?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মেয়েটা।
"দাদা, চা খাবি?"- বীথি জিজ্ঞেস করে।
হাতের সিগারেটটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে রাশেদের, বীথিকে চা নিয়ে আসতে বলে সে।  
ছাদের রেলিং এ ঝুঁকে চারপাশটা দেখতে থাকে রাশেদ।
ভাবতে ভীষন অবাক লাগে তার, মফস্বল শহরের রং উঠে যাওয়া পুরনো এই বাড়িটাতে কখন যে পনেরটা বছর কেটে গেল!  
প-নে-র-টা বছর!! ভাবা যায়? কত স্মৃতি ছড়ানো তাতে, কত রং বেরংয়ের একেকটা দিন। বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে তার।
রাস্তার শেষ মাথার চায়ের দোকানটার দিকে তাকায় রাশেদ।
বিদ্যুত নেই।
হ্যাজাক লাইটের আলোয় চায়ের গ্লাস হাতে জম্পেশ আড্ডা দিচ্ছে কয়েকজন।
নাজমুল,ইশতিয়াক আর অনিমেষরাও হয়ত আছে।
শুধু রাশেদ নেই। মনটা খারাপ হয়ে যায় তার।
ভাঙ্গা টেবিলটাতে বসে হয়ত আর আড্ডা দেয়া হবে না।
চায়ের গ্লাস হাতে রাতের পর রাত নির্ঘূম কাটবে না।
বুকের ভেতরের জমানো কষ্টগুলোর কথাও হয়ত আর কাউকে বলা হবে না।
অনিমেষদের কথা অনেক মনে পড়বে রাশেদের।
বীথি চা দিয়ে যায়।
সারাদিন মেয়েটা অনেক কেঁদেছে, দেখলে বোঝা যায়। রাশেদের খারাপ লাগে। তার মত একটা বদ্দ উন্মাদকে সবাই এত আপন ভাবে কেন কে জানে!!
বাবার কথা মনে পড়ে রাশেদের।
মানুষটাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না তার।
সারাটাজীবন শুধু কষ্টই করে গেলেন, বিনিময়ে তেমন কিছুই পেলেন না।
ইদানীং বাবাকে দেখলে ভীষন মায়া হয় তার, কেমন জানি বিপর্যস্ত আর পরাজিত মনে হয়।
বাবার ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখটার ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে বারবার।
এই অসহায় মানুষটাকে দেখার মত আর কেউ রইল না।
চা টা শেষ করে আনমনে পায়চারী করতে থাকে রাশেদ।
রাত প্রায় এগারটার মতন বাজে।
টিপটিপ বৃষ্টিটা এখনো থামে নি, চারপাশটা বেশ নির্জন হয়ে গেছে।
এরমধ্যেই কোথা থেকে জানি মন্টুটা এসে হাজির হয়।
"দাদা, তুই কি কাল সকালেই চলে যাচ্ছিস?"
"হুম্‌ম্‌"- রাশেদ উত্তর দেয়।
মন্টু সিগারেট ধরায়। এ কাজটা সে আগেও অনেকবার করেছে। দাদাকে খুব বেশি ভয় পায় না সে। রাশেদও অবশ্য তেমন কিছু বলে না তাকে।
দুজনেই চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে।
মন্টুর দিকে তাকায় রাশেদ।
আহারে, একটা বাইক কেনার কত সাধ ছিল ছেলেটার, টাকার অভাবে সেটা আর কিনে দেওয়া হয়নি।
নিজের কথা ভাবে রাশেদ, একসময় তারও অনেক স্বপ্ন ছিল, সেইসব স্বপ্ন আর পূরণ হয় নি। কোনদিন পূরণ হবে বলেও মনে হয় না। বুকের ভেতরটা বেশ ভারী হয়ে উঠে তার।
রাত অনেক হয়ে গেছে।
মা নীরবে ছাদের দরজার কাছে এসে দাঁড়ান, আঁচল দিয়ে চোখের জল মোছেন, একবার শুধু বলেন, "ঘুমাতে আয়"।
রাশেদের চোখদুটো ছলছল করে উঠে।
এত আদর করে কেউ আর ঘুমাতে বলবে না।
বৃষ্টিতে ভিজতে বারণ করবে না।
পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে না কেউ।
কতদিন পর দেশে ফিরবে রাশেদ?
পাঁচ বছর? দশ বছর?..... কিংবা আরো বেশি সময়ও লাগতে পারে!!
পাগলীটার (বীথির) হয়ত ততদিনে বিয়ে হয়ে যাবে, পরের ঘরে চলে যাবে সে। বিয়ের পর তো সবাই দূরে সরে যায়, সে ও হয়ত আর এতো আপন থাকবে না!
মন্টুটাও নিশ্চয়ই এমন থাকবে না, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে অনেক।
বাবার সাথে আর দেখা হবে কিনা কে জানে, বাবার শরীরের অবস্থটা খুব বেশি ভালো না, যেকোনো সময় একটা কিছু ঘটে যেতে পারে।
অনিমেষরা হয়ত তার কথা ভুলেই যাবে। কত নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয় হবে তাদের, তার মতো তুচ্ছ মানুষকে মনে রাখার কি দরকার?
আজ থেকে অনেক বছর পর চৈত্রের কোন এক রাতে হয়ত আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে।
আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠবে।
রং উঠে যাওয়া পুরনো এই বাড়িটার ছাদে রাশেদ হয়ত আবার বৃষ্টিতে ভিজে যাবে, টিপটিপ বৃষ্টিতে সিগারেট ধরাবে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়বে।
কিন্তু সেদিন তার পাশে কেউ থাকবে না।
এই পৃথিবীতে মানুষ আসলে বড্ড একা, আপনজন বলতে তার কেউ নেই।
বৃ্ষ্টিটা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে।
দু'হাতে মুখ ঢেকে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে রাশেদ।
তার দু'চোখের জল আর চৈত্রের অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির জল মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

এ.বি. এম. আব্দুল আলি ভুঁইয়া

No comments:

Post a Comment