Subscribe:

তোমাকেই আজ স্মরি

আজ ২৪শে মার্চ। আমার ৫৭তম জন্মবার্ষিকী।
জানো শাহানা, আজ পুরো দিনটাই ছিল কেমন যেন এলোমেলো- কিছুটা অতৃপ্তি ও কিছুটা ক্লান্তিতে ঘেরা। প্রতিটি সকালের মত আজও রক্তিম সূর্যটা সবুজের প্রান্ত অতিক্রম করে লাল আভায় সকালটাকে রাঙিয়ে দিয়েছিল। আজ কেন জানি নিজেকে প্রকৃতির এই বিচিত্র লীলাখেলার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিলাম না।


যদিও আজ দশটি বছর আমার এভাবেই কেটেছে ; তবুও মনে হচ্ছিল আজ সকালটা একটু ভিন্ন।  

জানো শাহানা, উঠানের দক্ষিণ দিকটায় একটা বড় কড়ই গাছ দাঁড়িয়ে আছে । প্রতিদিন সকালে একটা কোকিল এসে বসে ঐ গাছটারই মগডালে। বোধ করি অসীম পথের যাত্রাপথে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে নেয় ওখানে। আজ কিন্তু ও আমায় ফাঁকি দিয়েছে। আমি ঐ শূন্য ডালটার দিকে অনেকক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। কেন সে আজ এমন করল জানো শাহানা? হয়তো বা আজ আমার একটি বিশেষ দিন বলে।

শাহানা, তোমার মেয়েটা আজ অনেক বড় হয়ে গেছে। তার কোল জুড়ে এসেছে ফুটফুটে টুকটুকে একটি মেয়ে- তোমার নাতনী। হৃদয়টা জুড়িয়ে যায় ওকে দেখলে। গতকাল রাতে প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ায় ওকে নিয়ে ওরা হাসপাতালে গেছে- এখনো ফিরেনি। ওর নাম ‘দিয়া’- তোমার মেয়ের নামের সাথে মিল রেখে রিয়া-দিয়া। ঠিক হয়েছে যেন আমাদের মেয়ের মতই। আমি প্রায়ই তোমার প্রতিমা খুঁজে পাই রিয়া-দিয়ার মাঝে। আঁখির কোণে জমে থাকা জলটুকু ফেলতে পারি না, কেন জানো? শুনেছি, আমি এপাড় থেকে দু’ফোঁটা চোখের পানি ফেললে ওপাড়ে থাকা তোমার নাকি খুব কষ্ট হয়,তাই।

 আজ বড় একা হয়ে গেছি আমি।

শাহানা,  কতদিন ধরে তোমার মত করে কেউ আর মুখে ভাত উঠিয়ে দেয় না।চিবুতে একটু দেরি হলে কেউ আর তোমার মত কপালে ভাঁজ ফেলে আমার সাথে রাগ করে না। খাবারে ঝাল বেশি হলে কেউ আর তোমার মত চিন্তিত হয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় না। বড় কথা, ভাত খাওয়া শেষে সযতনে তোয়ালে দিয়ে মুখটা কেউ মুছে দিতে আসে না। বোধ করি, একটু বেশিই যত্ন নিতে আমার।

তোমার মনে পড়ে শাহানা, আমাদের বিয়ের আট বছরের মাথায় আমি যখন হুইল চেয়ারে বসে গেলাম তুমি ছয় বছর বয়সী রিয়া ও চল্লিশ বছর বয়সের শিশুরুপী আমাকে যেভাবে নিজের আঁচলে আগলিয়ে রেখেছিলে আমি তা আর নতুন করে বর্ণনা করতে চাই না। এটা ঠিক, আমি তোমাকে কখনও অপরূপা কিংবা অপ্সরী বলে ডাকি নি কিন্তু তুমি জানো কিনা জানি না, শুধু অপরূপা কিংবা অপ্সরী হলেই হৃদয়জয়ী সঙ্গিনী হওয়া যায় না- আমি তোমাকে পেয়েছি আমার জীবনের চালিকাশক্তিরূপে, জীবনের ছায়ারূপে।

 আজ দুপুরে আহারের সময় তোমাকে একটু বেশিই মনে পড়েছিল। কাজের মেয়েটা আজ ইলিশ দিয়ে কাঁকরোল রান্না করেছিল। এই কথাটা বলার আগে তোমার কাছে হাত জোর করে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, শাহানা। বিশ্বাস করো, ঐদিন আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাই নি। খুব খারাপ লাগছিল, তাই রাগে তরকারির বাটিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার হৃদয়ের যে রূপ আমি সেদিন দেখেছিলাম তা আজও আমার হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। তুমি খুব কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে আমার হুইল চেয়ারের পাশে বসে আমার দিকে অপরাধীর মতন তাকিয়ে শুধু বললে, “আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি বুঝতে পারি নি আপনি এটা পছন্দ করবেন না। অপরাধ আমারই।"

আমি নির্বাক হয়ে হা করে তোমার দিকে তাকিয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম- “এ তো মানুষ নয়, এ তো তার ঊর্ধ্বের কিছু”। সেই স্মৃতিচারণে আজ অনেক কষ্টে সেই খাবার খেয়েছিলাম- সেইদিনের অপরাধের কিছুটা প্রায়শ্চিত্তের নিমিত্তে।

আহার শেষে যখনই বিছানায় পিঠ লাগালাম, ঠিক তখনি তোমার সুমিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীতের মোহ আমাকে ব্যাকুল করে তুলেছিল। কিন্তু তোমার অনুপস্থিতি সেই ব্যাকুলতাকে নিরাশ করে দিয়েছিল। চোখদুটি একটু বুজতেই দেখি সেই তুমি, সেই করুণাভরা আবেগী মুখে আমার পাশে বসে তোমার সবচেয়ে প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রথম চারটি চরণ শুনালে-

“ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে-

আমার নামটি লিখো-- তোমার মনের মন্দিরে।

আমার পরাণে যে গান বাজিছে-

তাহার তালটি শিখো-- তোমার চরণ মঞ্জীরে”।

আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখি সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো। প্রতিদিনের মত খুব ধীরে ধীরে হুইল চেয়ারটি গড়িয়ে গ্রামের একেবারে পশ্চিমে যেখানে গ্রামের সড়কটি থেমে গেছে, সেখানে ছুটে যাই। যতদূর দৃষ্টি যায়- শুধু......... বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ।

 কেবল সন্ধ্যার এই সময়টার সাথে আমার হৃদয়ের সবটুকু চাওয়া, সবটুকু বেদনা মিশে যায়। রক্তিম সূর্য আবারও তার লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে-

কিন্তু এই আভা বিদায়ের। এ যেন আর কেউ না, এ যেন আমারই শাহানা সব কিছু ছেড়ে আমাকে এই বিস্তীর্ণ-নির্জন মাঠের প্রান্তে ফেলে রেখে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে আমারই ভালোবাসার অক্ষমতার জন্য আমার বাঁধন ছিন্ন করে বিদায় নিচ্ছে। প্রকৃতিও আজ তোমার পিছু নিয়েছে তোমাকে ফিরাবে বলে। মাঠের রাখালেরা আজ বাড়ির দিকে না ফিরে তোমার দিকে ছুটছে- ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে ফিরাবে বলে। পাখিরাও খুব দ্রুত ডানাদুটি নাড়িয়ে এগুচ্ছে তোমাকে ফিরিয়ে আনবে বলে।

কিন্তু আমাকে দেখ, আমি আজ অসহায়ের মত তোমার দিকে তাকিয়ে। আমার তো একজোড়া ডানা নেই, যে আমি উড়ে গিয়ে তোমাকে ফিরিয়ে আনবো। এমনকি আমার পা দুটি আজ থেকেও নেই, এই ছিল আমার নিয়তি, আমি এতোই হতভাগা যে ঐ রাখালদের সাথে হেঁটে গিয়েও তোমাকে ফিরানোর চেষ্টা করতে আমি অক্ষম।

শাহানা, আমার শাহানা! আমাকে তুমি ক্ষমা করো। আমি আজ তোমার বিদায়বেলার সাথী হতে পারিনি, পারিনি তোমাকে ফিরাতে তোমার অনন্তকালের যাত্রা থেকে...

চোখদুটি থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হল তাহের সাহেবের। লোনা জলের বিন্দুগুলো গাল বেয়ে তার দাঁড়ির শেষ মাথায় এসে জমা হয়। উপায়ান্তর না পেয়ে বিন্দুগুলো কোলের উপর পড়ে তার জামা ভিজিয়ে দেয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে সজল চোখের লোনা জল কিছুটা মুছতে পারলেও, হৃদয়ে জমে থাকা বিশাল মহাসাগরের লোনা জল সামান্য কমাতে পারেননি তাহের সাহেব। বরং লোনা জলের পরিমাণ কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। আর সেই জলে ডুবেই ওপাড়ে যাত্রা করলেন তাহের সাহেব।   

[ উপরের ভাষ্যগুলো তাহের সাহেবের ব্যক্তিগত ডায়েরির ২৪শে মার্চ পাতা থেকে নেওয়া। ডায়েরির ঐ পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠাতে লিখা ছিল-

“ শাহানা, আমি কখনও তোমার প্রিয় রবি ঠাকুরের গানের চরণ চারটির উত্তর দেই নি। আজ দিলাম-

“আমার মনের মন্দিরে তোমার নামটি লিখিলাম-

শাহানা! আমি তোমার গানের তালটি শিখিলাম”।

কিন্তু বোধ করি, একটু দেরি হয়ে গেল তোমার গানের সেই তালটি শিখতে। একটু না বরং অনেকটাই দেরি হয়ে গেল”।।

- কামরুল হাসান -

No comments:

Post a Comment