Subscribe:

এলে তুমি ঘন বরষায়

সে বছর বৃষ্টির দেখা নেই।প্রতিদিন সকালে ঘুমঘুম চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই আর হতাশ হয়ে বৃষ্টির পিন্ডি উদ্ধার করি।আজও সকাল সকাল মেজাজ খারাপ হয়ে গেল,ধ্যাৎ,আজও কোচিংয়ে যাওয়া লাগবে!বাসার  পথ পেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো।ছাতা নিয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি ঘোড়ার মত দাঁড়িয়েই ঘুমাচ্ছিলাম।পায়ের শব্দ শুনে ডানে তাকাতেই দেখলাম তাকে।সাথেসাথে আমার মন ভালো হয়ে গেল।


কিন্তু করছে কি বেকুবটা?চোখ কচলে ঘুম তাড়াতে বুঝলাম,সে ক্যাংগারুর মতো লাফিয়ে কাদাপানি থেকে পা বাঁচানোর চেষ্টা করছে।ইস্,ইচ্ছা করছে কাদায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিই,জন্মের মতো ঢং ছুটে যাবে তখন বাবুসাহেবের।তখনি আমার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল।আমি আর কি করব,মিষ্টি করে হাসলাম।

পাশেই এক আন্টি বাজারের ব্যাগ হাতে  রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন,তিনি আমাদের হাসাহাসি বিনিময় দেখে ভ্রু কুঁচকে ভস্মদৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন,মনেমনে হয়তো ভাবছেন,ছিছি,মাঝরাস্তায় হাসাহাসি হচ্ছে যে খুব?লজ্জাশরমের বালাই নেই নাকি?আমার বিরক্ত লাগছিল খুব,মনে মনে বললাম,মর তুই!

জনাবেরও কি কাজ নাই?গাধাটা বৃষ্টির মধ্যে করে কি?সকাল সাতটা বাজে,পুরো রাস্তায় কেউ নেই,এসময় বাবুসাহেবের ভেজাভিজির শখ হয়েছে?রিকশা পাইনি একটাও,অনেকক্ষণ পর যে একটা রিকশা দেখা গেল,জনৈক আন্টি দৌড়ে দৌড়ে এগিয়ে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে আগেই সেটা নিয়ে নিলেন।সে হাত দিয়ে আমাকে ইশারা করল,হেঁটেই যেতে হবে।রাগ লাগছিল খুব।ফিরে না তাকিয়ে হাঁটা শুরু করলাম জোরে জোরে।

আর অবাক কান্ড,সে-ও পুরো রাস্তা আমার পিছে পিছে এল।স্যারের বাসার গলির মাথায় পৌঁছে আমি তার দিকে ফিরে হেসে বললাম,এতটুকু রাস্তা এগিয়ে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।এখন আপনি বাসায় যান।আমার পড়া আছে।তাকে উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে স্যারের বাসার দোতলায় উঠে গেলাম।



বারান্দায় কারো জুতা নেই,শুধু স্যারের দুটো ছেঁড়া স্যান্ডেল পড়ে আছে।ওদুটো তুলেই নিজের কপালে মারতে ইচ্ছে হলো।কেউ পড়তে আসেনি!আরে আশ্চর্য,আসবিই না যখন,ফোন করে আমাকে একবার বলা যেত না?মনে মনে বান্দরগুলোর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে ঝাড়লাম।বারান্দা দিয়ে বাইরে তাকাতেই আমার রীতিমত কান্না পেলো।বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে,এত জোরেশোরে নেমেছে যে ৩ হাত দূরের আমগাছও ঝাপসা লাগছে।সব পাজির দল বাসায় মাথা চাদরে ঢেকে আরামসে ঘুমোচ্ছে,আর আমি!

নেমে আসতেই দেখি,বাবুসাহেব ছাতা মাথায় স্যারের বাসার গেটের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে উঁকিঝুকি দিচ্ছেন।এ কি পাগলা নাকি?আমাকে বের হতে দেখেই সে অন্যদিকে ফিরে আমগাছের পাতা গুনতে শুরু করল।আমি সামনে এসে ভ্রু নাচাতেই কৈফিয়তের সুরে বলল,এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম...তোমার পড়া নেই??তাহলে একসাথেই বাসায় যাই।বলেই আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসি দিল একটা।

আমি অসহায় হয়ে গেলাম,ওই হাসিটা দেখলেই যে আমি দিশেহারা হয়ে যাই।মানুষটা এত সুন্দর করে হাসে কিভাবে?আমি আর কিছু না বলে মুখ নিচু করে হাঁটতে লাগলাম।

সে আমার থেকে বেশ দূরে,রাস্তার অন্য পাশ ঘেঁষে হাঁটছে।আমার ছাতাটা বেশ ছোট,ব্যাগ আর বইখাতা বাঁচাতে গিয়ে আমি অনেকটা ভিজতে ভিজতেই যাচ্ছি।তার সেদিকে খেয়াল নেই,সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে আর বকবক করে যাচ্ছে।আমিতো বৃষ্টির শব্দে ওপাশ থেকে কিছুই শুনতে পাচ্ছি না,তবুও খুব সিরিয়াস ভাব নিয়ে বড় বড় চোখ করে শুনছি আর মাথা নাড়াচ্ছি।কথা বলতে বলতে সে হাসছে একেকবার,আর আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠছে।

ইস্,বাতাসে আমাদের দুজনের ছাতাই উড়ে যেত যদি,একসাথে ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছে যে খুব।জনাবের কি রোমান্টিকতা বলে কিছু নেই নাকি?আমাকে ওর ছাতার ভেতর আসতে বললেও তো পারতো!

আমি হতাশ হয়ে প্রকান্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আর ভাবতে লাগলাম,ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে ভেঙে দিলে কেমন হয়?চশমা ছাড়া কানাবাবাটা চোখেই দেখে না বলতে গেলে।তখন আর যাবে কোথায়?আমার হাত ধরেই তো তাকে হাঁটতে হবে।নাহলে,ওকে ধাক্কা দিয়ে কাদায় ফেলেও দেয়া যায়,আমি টেনে তুলব তাকে;আইডিয়া মন্দ না!

এমন এক সকালবেলায় হাত ধরে ভেজাভিজির কথা ভাবছি,আমার তো একটুও লজ্জা লাগছে না।ভালোই তো লাগে ভাবতে!

আজ সকালেই বের হওয়ার কথা ভাবতে মেজাজ চিড়বিড়ে হয়ে গিয়েছিল,এখন বাসার সামনে এসে রীতিমত কান্না পাচ্ছে।

ও বলল,আসি।আমি চলে যাওয়ার পর বামে তাকিও,কিছু একটা আছে।আবার হেসে,উল্টো পথে পা বাড়াল।আমি ঝাপসাভাবে তার মিলিয়ে যাওয়া দেখলাম।পাশে তাকিয়ে দেখি,কয়েকটা দোলনচাঁপা রাখা,বৃষ্টিতে আধভেজা।
 


আমি মনে মনে বললাম-

'বহুদিন হল কোন্ ফাল্গুনে ছিনু আমি তব ভরসায়,

এলে তুমি ঘন বরষায়।'



- রৌদ্রবালিকা

No comments:

Post a Comment