Subscribe:

অশ্বারোহী যোদ্ধা এবং মৌটুসী পাখির গল্প

প্রেমের যুদ্ধের  এক বীর দম্পতির  গল্প 

টিএসসির মাঠের এক কোনে একটি মেয়ে সিগারেট খাচ্ছে, পাশে ছেলেটি অসহায়ের মতো তা চেয়ে দেখছে । দেখে যে কেউ ভাববে সমাজটা নষ্ট হয়ে গেলো । কিন্তু মেয়েটি কেন সিগারেট খাচ্ছে  ? কারন মেয়েটি প্রতিজ্ঞা করেছিল ছেলেটি যতদিন সিগারেট খাবে মেয়েটিও ছেলেটিকে সোজা করার জন্য সিগারেট খাবে । একসময় মেয়েটি বিরক্ত হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয় সিগারেটের টুকরো ।
ভালো লাগে না এই ছাতার জীবন ।” বলে মেয়েটি । ছেলেটি পাশে এসে বসে , হাত ধরে মেয়েটির ফিসফিস করে বলে  , “দেখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে ”। সায়হ্ন বেলায় মৌনতার মধ্যে দিয়ে তারা অনুভব করে পরস্পরের ভালোবাসাকে, স্বপ্নের জাল বোনে অনাগত ভবিষ্যৎকে নিয়ে। এই হচ্ছে ফারিছ আর মৌটুসী । 

ফারিছের সাথে মৌটুসীর প্রথম দেখা হয়েছিল, ফারিছের সহপাঠী প্লাবনদের বাসায় । দিনটি ছিল ১৯৯৬ সালের ৩১শে’ ডিসেম্বর । আর ছিল মৌটুসী প্লাবনের বাবার বন্ধুর মেয়ে। বাবার বদলির চাকরীর সুবাদে এই নতুন শহরে মৌটুসীর পরিবারের আসা । টুসীকে প্রথম দেখার পরই ফারিছের মনের ভিতরে কেমন জানি লাগছিল , কিন্তু সে বুঝে উঠতে পারছিল না কেন এরকম লাগছে, বা কি এই অনুভূতির নাম । আর তখন বুঝে উঠবার মত বয়সও তার ছিল না । কারন সে যে কেবল মাত্র ক্লাস টু’তে উঠছে , সমাজের চোখে একদম নাবালক বাচ্চা । 

কিন্তু তারপরও চঞ্চল সেই সেই মেয়েটি কেড়ে নিয়েছে ছোট্ট ফারিছের চোখের ঘুম । আসবার  পথে যদিও আড়চোখে দু’চার বার মৌটুসীর দিকে তাকিয়েছে কিন্তু তাতে তাকে দেখার তৃষ্ণা আরোও বেড়েছে, কমেনি । বিধাতা হয়তো এই ছোট্ট দুই নিস্পাপ প্রাণের  ব্যাকুলতা বুঝতে পেরেছিলেন । তাই পরদিন ফারিছ স্কুলে গিয়ে দেখে মৌটুসী ছুটে বেড়াচ্ছে স্কুলের মাঠে । আনন্দে ভরে ওঠে তার মন, যাক অন্তত রোজতো তার দেখা পাওয়া যাবে । কিন্তু টুসী ভর্তি হয়েছে তারই ক্লাসে ঠিকই কিন্তু অন্য সেকশনে। তাই রোজ লুকিয়ে এতে প্রান ভরে না ফারিছের । ছোট্ট মনে শুধুই মৌটুসীকে দেখবার আশা । তারপর মরার উপর খঁরার ঘাঁ হিসাবে আসে ভর্তি যুদ্ধ। আলাদা করে দেয় দুজনকে। দু’জন চলে যায় শহরের দু প্রান্তের দুই বিদ্যাপীঠে । কিন্তু প্রাণের আকুতি এই বাধা মানবে কেন ? তাই ফারিছ আরো খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে টুসী কোন এক কোচিং এ ভর্তি হয়েছে । তাই সেও ভর্তি হয়ে পড়ে সেখানে । চলতে থাকে জীবন আবার পুরনো ধারায় । এভাবে গড়িয়ে যায় বছর । হঠাৎ একদিন বদলী হয়ে যাবার খবর আসে মৌটুসীর বাবার । ফারিছ এটি  জানতে পারে  খুব  দেরিতে । অস্থিরতায় কেপে উঠে ফারিছের মন । এখনও যে বলা হয়নি তার মনের কথা  বহুবার  চেষ্টা  করেও  বলতে পারেনি সে  টুসীরা যেদিন  চলে যাবে  ঠিক তার আগের দিন দুটি কমিকস আর দুটি তাজা লাল গোলাপও দিয়ে আসে সে  মনের কথাগুলো বলবার জন্য হাত ধরেছিল , কিন্তু কেন জানি কিছুই বলা হয়নি  বাসায় ফিরে এসে ধিক্ দেয় নিজেকে  পরে ঠিক করে চিঠি লিখবে  রাতের মধ্যে কাচা হাতে লিখেও ফেলে চিঠি  পরদিন সকালে চলে যাবে টুসী 
 
সকালে ঘুম ভাঙ্গে মায়ের বকাবকিতে  দ্রুত তৈরী হয়ে , চিঠি প্যান্টের পকেটে পুড়ে নেমে পরে রাস্তায় রুদ্ধশ্বাসে এক দৌড়ে টুসীদের বাসার সামনে এসে থামে সে।কিন্তু সব কিছু কেমন জানি খাঁ খাঁ করছে  সব কেমন জানি ফাঁকা দেখাচ্ছে  খুব কষ্টে বড় লোহার গেট ধাক্কে ভেতরে ধুকতেই দারোয়ান এসে জানায় মিনিট পাঁচেক আগেই চলে গেছেন ওরা  ফারিছের সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে আসে , ভেতর থেকে ডুকরে উঠে যেন সব  বছরের পর বছর পুষে রাখা মনের কথা গুলো আর বলা হয় না  বিধাতাকে সে দিন বড়ই নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল তার । শার্টের হাতায় চোখ মুছতে মুছতে ক্লান্ত মনে ফিরে যায় সে। এলোমেলো হয়ে আসে সব । কিন্তু জীবন যে থেমে থাকে না । চলতে থাকে টুসী বিহিন জীবন । এভাবে চলে যায় নয় নয়টি বছর । কিন্তু তখনও ফারিছ ভুলেনি সেই ছোট্ট টুসীকে । আগলে রেখেছে তার কোমল মনে । আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তার দেখা পাওয়ার 
২০১১ সাল, তখন ফারিছ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ঢাকায় । জীবন গাড়িতে চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে একদিন খুজে পায় টুসীকে এই ফেসবুকে । পাঠায় বন্ধুত্তের হাতছানি । চিনতে পেরে সম্মতিও জানায় সে । ভাবতেও পারেনি এভাবে খুঁজে পাবে । দুজনই হতবাক । চলতে থাকে খোঁজ খবর আদান প্রদান । এভাবে এক দিন মনের অস্থিরতাকে ঠেকাতে না পেরে চেয়ে বসে তার মুঠোফোনের নাম্বার , পেয়েওযায় । শুরু হয় কথা বলা । দিন কয়েক পাড় হবার পর টুসী আমন্ত্রন জানায় দেখা করার । ছুটে চলে আসে ফারিছ । নয় বছর পর দেখা হয় দুজনার । মুহূর্ত কয়েক হতবাক হয়ে ছিল দুজন । তারপর , তারপর শুরু হয় দুজনার অফুরন্ত কথা , এ যেন শেষ হয় না । ঐ দিন যাবার সময় বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসে । রাতে ঘুম যেন আর আসতে চায় না । এতদিন যা স্বপ্ন দেখেছে ফারিছ আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে । কোন মতে রাত পার করে । পরদিন ফারিছ আবার দেখা করার প্রস্তাব জানায় । টুসীও রাজি হয়ে পরে । দেখা করে এক পরন্ত বিকেলে । কথার ফাঁকে বিভোর হয়ে চেয়ে থাকে টুসীর মুখপানে । বলতে চায় মনের কথা , কিন্তু পারে না । ওদিন বাসায় যাবার সময় সাথে যাবার আবদার করে ফারিছ , টুসীও না বলতে পারে না । রিক্সা নেয় ওরা । বিধাতা যেন সব আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন । রিক্সায় ওঠার পর শুরু হয় ঝুম বৃষ্টি । এক মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে যায় সব , স্তব্ধ হয়ে যায় ওরা । “টুসী , ভালবাসবে আমাকে”, হুট করে বলে বসে ফারিছ । আবার চুপ হয়ে যায় ওরা । ভালবাসার প্রবল শক্তির কাছে নাকি সব নত হয়ে যায় , টুসীও পারেনি । দুজন নতুন করে এক জীবনের সূচনা ঘটায় । শুরু করে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে । এখনও তারা এক সাথেই আছে । অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পার করে এখনও তারা একসাথে । টুসী এখনও অবিরাম চেষ্টা করে চলছে ফারিছের অগোছালো জীবন গোছাবার । প্রতিনিয়ত শাসন করে রাখছে ফারিছের চঞ্চলতাকে । বানাতে চাইছে মানুষের মত মানুষ । আর ফারিছ হয়ে উঠেছে চরম অবুঝ কিছুই বুঝতে চায় যে । এ নিয়ে টুসীর অভিযোগের শেষ নেই । কবে যে ঠিক হবে পাগল তা হয়ত বিধাতাই জানেন ।

দুজনে আছে ভালোই , অনেক সুখে , অনেক শান্তিতে............অনেক খুনসুটির মধ্যে...আজ পর্যন্ত...থাকবে আগামীতেও ।




Mahbuba Moutushee

No comments:

Post a Comment