Subscribe:

"এইতো আর কিছুক্ষণ...."

নীলুদের ড্রয়িংরুমে ঢুকেই চমকে উঠলাম.....

সোফায় লুঙ্গি পরে যীশু-খ্রিষ্ট বসে আছেন...হেডফোন কানে গুঁজে,পেন্সিল দিয়ে খসখস করে কি যেন লিখছেন...

আমি লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম...

ভুল দেখছিনা তো !! এখানে যীশু-খ্রিষ্ট আসবেন কোত্থেকে??


ব্যাপারটা আসলে কি ঘটছে বোঝার জন্য ড্রয়িংরুমের পর্দা সরিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দেখছি মানুষটাকে...তার মাথায় হালকা বাদামী রঙের চুল...গালে চাপ দাঁড়ি...পাতলা চুল গুলো মাথায় কুকড়ে-মুকড়ে আছে...পুরোই Myth থেকে উঠে আসা কোন ক্যারেক্টার...

নীলু আমার ছোট বেলার বান্ধবী...আমাদের পাশের বাসায়ই থাকে...একসাথে বড় হয়েছি দুজন...গতকালই ভার্সিটির হল থেকে কয়েকদিনের জন্য বাসায় এসেছি...এসেই অভ্যাস মত নীলুর কাছে গেছি,এতোদিনের জমানো কথা গুলো উগরে দিতে...ছোট বেলা থেকেই ওদের বাসায় কখনো অনুমতি নিয়ে ঢুকার প্রয়োজন বোধ করিনি...দরজা খোলা পেলেই ঢুকে গেছি...

আজও তাই করেছিলাম...তাতেই এই বিপত্তি !!

আমি হা করে মানুষটার কান্ড-কারখানা দেখছি...দেখতে দেখতেই কখন রুমে ঢুকে গেছি,বুঝতেই পারিনি...হঠাৎ মানুষটার গলার আওয়াজে চমক ভাঙ্গল...

অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি...খুব দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে আমাকে বললেন,"Hello"

সাথে আরো অনেক কিছু বললেন...আমি কিছুই বঝিনি...এতদিন ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করায়,বন্ধুমহলে আমার যে দাপট ছিলো,মূহুর্তেই তা চুরমার হয়ে গেলো...

আমি বেশ অনেকটা বিব্রত...দৌড়ে পালাব কিনা ভাবছি...

এমন সময় নীলু আরেকজন ছেলেকে নিয়ে রুমে ঢুকল...পরিচিত হয়ে জানলাম,ছেলেটি ওর কাজিন,শোভন...অস্ট্রেলিয়াতে থাকেন...সেখানেই পড়াশোনা..দেশে বেশ কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছেন...

নাম-ধাম শুনে বুঝলাম,এই শোভন ই নীলুর boyfriend...নীলুর মুখে অনেক শুনেছি তার কথা...ছবিও দেখেছিলাম,তাই প্রথমেই কেমন চেনা চেনা লাগছিলো...

আর যাকে যীশু ভেবে ভুল করেছিলাম,তিনি শোভনের বন্ধু...নাম Samuel Lukas...সবাই Sam বলেই ডাকছে তাকে...বন্ধুর মুখে বাংলাদেশের প্রশংসা শুনে,তার নাকি খুব দেশ দেখার শখ হয়েছে...তাই পোটলা-পুটলি নিয়ে বন্ধুর সাথে চলে এসেছেন...

Sam এর সাথে কথা বলতে হলেই ইংরেজীতে কথা বলতে হবে,তাই আমি তার ধার দিয়েও গেলাম না...শোভনকেই বললাম,"নীলুর মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি...পরিচিত হয়ে ভাল লাগল..."

শোভন সাথে সাথে বললেন,"এই শুকনো অভিবাদনে কাজ হবে না...Sam বাংলাদেশ দেখতে এসেছে...তাই নীলু এবং আপনার উপর দায়িত্ব চাপানো হল,এ শহরে যত সুন্দর জায়গা চেনেন,সব ঘুরিয়ে দেখাবেন আমাদের..."

বুঝলাম আরামের দিন শেষ...বাইরে ঘুরাফিরা আমার একদম অপছন্দ...আর নীলু আমার একদম উল্টা...একবার ঘর থেকে বের হলে,তাকে সহজে ঘরে ঢুকানো যায় না.. শোভনের এই প্রস্তাবে তাই আমি যথেষ্ট বিরক্ত হলাম...তৈরি হয়ে গেলাম খুব বোরিং কিছু সময় কাটানোর জন্য...

যতটা বোরিং সময় কাটাবো ভেবেছিলাম,ততটা কাটেনি...প্রথম দিকে,Sam এর সাথে ঘুরতে বের হওয়া নিয়ে আমার যথেষ্ট আপত্তি ছিলো...
বাইরের ছেলে আমার বরাবরই অপছন্দ...শুনেছি,এরা খুব সহজে মেয়েদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে,তারপর দুদিনে প্রেম,অতঃপর "Break Up"....বাইরের মুভি গুলিতে তো তাই দেখেছি...

তবে যেমনটা ভেবেছিলাম,তেমনটা সে নয়...তাই হয়তো বেশ ভালো লেগে গেছে তাকে.....একটু একটু কথা বলাও শুরু করেছিলাম...
টেনশনের চোটে যখনই ওর সাথে উল্টা-পাল্টা ইংলিশে কথা বলি,ভদ্রতার নিকুচি করে সে তখন হা হা করে হেসে উঠে...আমিও তখন "প্রশ্রয়ের হাসি" হাসি...

কথায় কথায় জানলাম,খুব নাকি ভালো স্কেচ করে Sam...প্রথম যেদিন দেখেছিলাম তাকে,সেদিনও নাকি তাই ই করছিলো...আমাকে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেছিলো,আমি যেনো তার ছবির মডেল হই...আমি সাথে সাথে মানা করে দিয়েছি...

৫ মিনিটের জন্যও কারো সামনে পোজ দিয়ে বসে থাকা আমার জন্য অসম্ভব ব্যাপার...প্রচন্ড হাসি পায় আমার...

তবে,Sam বসে থাকল না...এরই মধ্যে সে নীলু আর শোভনের বেশ কিছু স্কেচ করে ফেলল...নিজের চোখে না দেখলে,বিশ্বাসই করতাম না,কেউ এতো ভালো ছবি আঁকতে পারে !!

প্রায় প্রতিদিনই আমরা Sam কে শহর এর প্রতিটা দর্শনীয় জায়গা দেখাতে লাগলাম...একসময়,সবই দেখিয়ে ফেলে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম...বাংলাদেশের সৌন্দর্য,শহর দেখিয়ে Sam কে বোঝানো সম্ভব নয়...পুরাপুরি ভাবে তা বুঝাতে হলে,তাকে বংলাদেশের গ্রাম দেখাতে হবে,নদী দেখাতে হবে,দেখাতে হবে নদীর বুকে ভেসে বেড়ানো নানান রকমের নৌকা,দেখাতে হবে,বিস্তীর্ণ সবুজ চাদরে ঢাকা মাঠ...কিন্তু,এভাবে ছেলেদের সাথে এত লম্বা সময়ের জন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিলো না আমার...
তাই,ভাবছি আর কি করা যায়??

আমাদেরকে বাঁচিয়ে দিলো পহেলা বৈশাখ...আর কয়েকদিন পরেই নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার জন্য বাঙ্গালীর সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী উৎসবের রঙে রাঙ্গবে শহর...আশা করছি,Sam খুব পছন্দ করবে এই উৎসবটা...ঠিক হল,সেদিন আমি আর নীলু লাল পেড়ে শাড়ি পরব,শোভন আর Sam পরবে সাদা পাঞ্জাবী...Sam কে নিয়ে একটু দোটানায় ছিলাম,পাঞ্জাবী পরতে রাজী হবে কিনা কে জানে??বাসায় যেকোন কিছু পরতে তার কোন আপত্তি নেই...কিন্তু ঘরের বাইরে বেরোলেই সে বিচিত্র সব সাজে বের হয়...আমার অবশ্য পাঞ্জাবীতে Sam কে দেখার খুব ইচ্ছা...ভীনদেশী ছেলেটাকে পাঞ্জাবীতে কেমন লাগে জানার খুব আগ্রহ আমার...

পহেলা বৈশাখের সকালে শাড়ি পরে তৈরি হয়েই নীলুদের বাসায় চলে এলাম...সবাই তৈরি হলে বের হয়ে যেতে হবে...তা নাহলে,আনন্দ শোভাযাত্রায় আর অংশ নেয়া হবে না...গিয়ে দেখি সবাই তৈরি হয়ে আমার জন্যই অপেক্ষা করছে...

Sam এর দিকে তাকালাম...সাদা পাঞ্জাবীতে তাকে বড় ভালোমানুষের মত দেখাচ্ছে...

আমাকে এভাবে তাকাতে দেখে নীলু-শোভন মিটিমিটি হাসতে লাগলো...অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম...

Sam সামনে এসে ইংরেজীতেই বলল,"তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে..আমি এভাবেই তোমার একটা স্কেচ করতে চাই...আমি বেশি সময় নিব না,প্লীজ..."

আমি খুব সাবধানে এড়িয়ে গেলাম...বললাম,"এক্ষুনি বের হয়ে যেতে হবে,তানাহলে শোভাযাত্রা মিস হয়ে যাবে..."

সকালে ভার্সিটিতে ঢুকেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম...নতুন বছরের এই আগমনকে বরণ করে নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ও আজ নতুন রুপে সেজেছে...চারিদিকে আজ রঙের ছড়াছড়ি,বাতাসে আনন্দের কানাকানি...

আনন্দ শোভাযাত্রায় বেশ হই-হুল্লোড় করলাম সবাই,পান্তা ই্লিশ ও খেলাম বেশ মজা করে...এরপর কিছুটা জিরিয়ে নেয়ার জন্য,শহীদ মিনারের সিঁড়িতে বসলাম...

সকালে শোভন আর Sam দুজনই গোলাপগুচ্ছ কিনে নিয়েছিলো...
অনেক নাটকীয়তার পর কিছুক্ষণ আগে শোভন,নীলুকে ফুলগুলো দিয়েছে...নীলুর চোখে মুখে আনন্দ ঝরে পড়ছে...

আমিও দুজনের আনন্দ প্রাণ ভরে দেখছি...হঠাৎ,Sam আমার সামনে হাটু গেঁড়ে বসে পড়ল...ফুলগুলো আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় বলল,"অর্ণা,আমি তোমাকে ভালোবাসি..."

আমি নীলু আর শোভনের দিকে তাকালাম...ওদের হাসিমুখ দেখে বুঝলাম,ওরা আগেই জানত সব...

আমার চোখে পানি এসে গেলো...আনন্দে নয়,কষ্টে...

আমি জানি,এ ভালোবাসা কতটা অসম্ভব...Sam অন্য দেশে মানুষ...তার ধর্ম,সংস্কৃতি,রীতি-নীতি সব কিছু ভিন্ন...আজ ভালোবাসায় সায় দিলে,দুদিন পর আমার পরিবার বা সমাজ কেউ মেনে নিবে না এ অসম সম্পর্ক...

বলতে দ্বিধা নেই,আমি বেশ পছন্দ করতে শুরু করেছিলাম Sam কে...এই পছন্দের কোথাও ভালোবাসা ছিলো কিনা,জানি না...জানতে চাই ও না...তাই ওকে কঠোর কন্ঠে বললাম,

- "আমি তোমাকে ভালবাসি না ।"

ওই দিনের পর আমি নীলুদের বাসায় খুব একটা যাই না...কেমন একটা চাপা কষ্ট অনুভূত হত হৃদয়ের গহীন কোণে...আমার রুমের চার দেয়ালে বুকে জমে থাকা চাপা কষ্টগুলোকে তাই বন্দী করার চেষ্টা করতে থাকলাম...

নীলু বেশ কয়েকবার আমাকে Sam এর সাথে দেখা করতে অনুরোধ করেছে...আমি রাজী হইনি...ভয় হত,আমার চোখ দেখলেই হয়তো মনের সব দ্বিধা ও বুঝে ফেলবে...

...হ্যাঁ,আমি চাই নি আমার ভয়টা সত্যিতে পরিণত হোক...চাইনি মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলতে...তাই মনের সব কুঠুরির খিল শক্ত করে এঁটে দিলাম...মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিলাম,"আমি সব ভুলে যাব,সব..."

সকালে নীলু এসেছিলো...আমাকে জানিয়ে গেলো,আজ দুপুরেই শোভন আর Sam ঢাকায় চলে যাবে...অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে যাওয়ার টিকেট কনফার্মড হয়ে গেছে...কাল তাদের ফ্লাইট...যাওয়ার আগে শেষ একবার Sam আমার সাথে দেখা করতে চায়...

বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠল...তবুও নিজেকে শান্ত রাখলাম...বার বার বোঝালাম নিজেকে,"Sam একবার চলে গেলে,একসময় সব ভুলে যাব,সব...ইরেজার দিয়ে ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মূহুর্ত স্মৃতির পাতা থেকে মুছে ফেলব...এইতো আর কিছুক্ষণ মাত্র..."

নীলুদের ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করছি... সেদিন এখানেই ওর সাথে প্রথম পরিচয় হল...আজ এখানেই সব কিছুর সমাপ্তি ঘটবে...

Sam এসে আমার সামনে বসল...বিষন্ন চোখজ়োড়া মেঝের দিকে স্থির হয়ে আছে তার...কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে ওকে...
কিছুই কি বলার নেই ওর??

দুজনই চুপচাপ বসে আছি...হঠাৎ Sam উঠে এসে একটা গিফট আমাকে দিতে দিতে বলল,"Sorry for everything.."
আর কিছুই বলেনি সে...কিংবা বলতে পারেনি...

আমি ফিরে এলাম আমার বাসায়...গিফট টা খুলে দেখলাম...অনেকগুলো কাগজ একসাথে রাখা সেখানে...প্রতিটা কাগজে আমার ছবি আঁকা...

খুব যত্ন নিয়ে আঁকা নিখুত "আমি"...

একটা কাগজে,আমার জন্য ছোট্ট একটা নোট লেখা...অনুবাদ করলে কিছুটা এমন দাঁড়ায়,

"আমি কখনো সামনে মডেল না রেখে মানুষের ছবি আঁকিনি...এটিই আমার প্রথম কাজ,সম্ভবত এটিই শেষ...তোমাকে কষ্ট দেয়ায় আমি খুব দুঃখিত...ভাল থেকো..."

চিঠি পড়ে আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম...শেষবারের মত Sam কে চলে যেতে দেখব...দৃষ্টি সীমানায় যতক্ষন থাকে ততক্ষন দেখতে চাই আমি...কিন্তু ঝাপ্‌সা চোখে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না পোড়া চোখ দুটো...দুচোখে রাজ্যের বৃষ্টি জমেছে,মনে জমেছে রাজ্যের মেঘ...এ কষ্টের সূচনা কোথায় জানা নেই আমার...আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম...মনে মনে বললাম,"এইতো আর কিছুক্ষণ..."
 



- ফারহানা নিম্মী

No comments:

Post a Comment