নদীর পাড়ে বিকেল বেলা বসে থাকতে ভালো লাগে রাশেদের।নিজের ভীতরে একটা কবি কবি ভাব চলে আসে।হয়তো সারাদিনের গুমোট ভাবটাও কেটে যায়। মিশার সাথে সম্পর্কটা ভেঙ্গে যাবার পর কোন কিছুতেই মন দিতে পারছিল না সে। ভার্সিটি লাইফে মিশার আসলে একটা সাপোর্টের দরকার ছিল।যেন মানুষ ডিসটার্ব না করে।সবাই জানে সে এনগেজ।ব্যাস। রাশেদের সাথে পুরো সময়টাই ছিল টাইম পাস। সম্পর্কটা ভেঙ্গে দেবার সময় এসব কথাই বলছিল মিশা।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।একটা মেয়ে কিভাবে এরকম কথা বলতে পারে?
বন্ধুরা অনেকেই আকার ইঙ্গিতে বুঝাতে চেয়েছে কিন্তু তাদের কথা কানে তুলেনি তখন।যেই ভালো বিয়ের প্রপোজাল আসলো অমনি পগার পার।নিজেকে শক্ত রাখতে মারাত্মক কষ্ট করতে হচ্ছে রাশেদের।ঢাকা তাই যেন আরও অসহ্য হয়ে উঠছিল ওর কাছে।তাই গ্রামের বাড়িতে এসে নিজের কষ্টটাকে কমিয়ে আনার এক ধরণের চেষ্টা করছে ও নিয়মিত।এখানে তার সবচেয়ে ভাল বন্ধু মোতালেব চাচা।উনার নিজের একটা চায়ের দোকান আছে বাজারে।প্রায়ই সন্ধ্যার দিকে সেখানে গিয়ে বসে রাশেদ।দু’কাপ চা খায় আর সেই সাথে সবার বিভিন্ন আলোচনা খুব উৎসাহের সাথে শোনে সে।
মোতালেব চাচার কাছ থেকে অনেক গল্প শোনে রাশেদ।আগে তার কয় বিঘা চাষের জমি ছিল,কিভাবে নদীর ভাঙ্গনে বিলিন হয়ে গিয়েছে,তার একটা নৌকা কিভাবে মেম্বার ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে বাগিয়ে নিয়েছে,আরও নানা কেচ্ছা।মাঝে মাঝে তার মনটা বড়ই উদাস দেখে রাশেদ।
সন্ধ্যার কিছু পরেই পৌছল মোতালেব চাচার দোকানে।এসেই দেখল ঝাঁপি দিচ্ছে চাচা।“কি চাচা আজ এত তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করছেন যে?”
“বাজান,বাড়িত কাম আছে একটু আগে যাওন লাগব।”
“বাড়িতে কেউ অসুস্থ নাকি?”
কথাটা শোনার পর কোন জবাব দেননা চাচা,চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে আছেন রাশেদের দিকে। কেমন যেন বিব্রত বোধ করলো রাশেদ।দোকানে তালা দিয়ে হাঁটা শুরু করলেন মোতালেব চাচা।রাশেদ পিছন পিছন আসতে লাগল। চাচা জানতে চাইলেন “তুমি কই যাও?”
“চলেন চাচা আপনাদের বাড়ি যাব”। রাশেদের কথা শুনে কেমন যেন ইতঃস্তত বোধ করলেন তিনি। “বাজান আমার ঘরে বওনের একটা ভাল চেয়ার ও নাই।ঘরে আমি একলা আর আমার মাইয়া।তোমারে কই বইতে দিমু কও?
“চাচা আমি তো বসতে যাচ্ছি না আমি যাচ্ছি আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই।আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ গুরুতর অসুস্থ।যদি আমি কিছু কাজে লাগতে পারি?”
“হ আমার মাইয়াটা।কি রোগে যে ধরলো ওরে” কন্ঠ্যে হতাশা মোতালেব চাচার।
বাজার থেকে তেমন দূরে না চাচার বাড়ি। বাড়ি না বলে বরং খুপরি বলাই ভাল। একপাশে মাটি গভীর গর্ত করে টয়লেটের মত বেড়া দিয়ে কি একটা করা হয়েছে সেখান থেকে দুর্গন্ধ আসছে।টেকাই দায়।খুপরির আর এক পাশে ময়লা আবর্জনার স্তুপ।মাটির উঠান পরিষ্কার করা হয়না বহুদিন।সবথেকে বড় ধাক্কাটা খেল রাশেদ খুপরির ভিতরে ঢুকে।সেখানে যা দেখতে পেল তা দেখার জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
একটা কঙ্কাল, হ্যাঁ কঙ্কালই বলা চলে, কোন এক সময় সেটা একটা মেয়ে ছিল।এখন কঙ্কাল।পাশে একটা ছেলে বসা।রাশেদেরই সমবয়সী হবে খুব সম্ভবত।ছেলেটা মেয়েটার কাপড় বদলে দিচ্ছে।আগের কাপড়টা প্রস্রাবে ভিজে গেছে।অসহ্য একটা পরিবেশ।রাশেদ দম বন্ধ করে দেখতে লাগলো ছেলেটার কাজ।ছেলেটা মেয়েটার কাপড় বদলানোর আগে ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে মেয়েটার শরীর মুছে দিল।তারপর আরেকটা কাপড় পরিয়ে দিল।প্রতিটা কাজ বিনা দ্বিধায় করছে ছেলেটা।বোঝা যায় ছেলেটা অনেকদিন ধরেই মেয়েটার শুশ্রূষা করে আসছে।মোতালেব চাচাও হাত লাগালেন,মেয়েকে পাঁজাকোলা করে উঁচু করলেন,নিচের ভেজা কাথাটা সরিয়ে নিল ছেলেটা,তারপর মেয়েকে মাটিতেই শোয়ালেন চাচা। ভেজা কাঁথা নিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা।
“চাচা এই ছেলেটা কে?” জানতে চাইল রাশেদ
“মেয়ের জামাই।” এটুকু বলেই চুপ করে রইলেন। রাশেদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল।এখনও কেমন যেন খটকা লাগছে ওর।ছেলে বেশ শক্ত সমর্থ দেখতে শুনতেও ভালো।জেনে শুনে এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করলো কেন?কিন্তু প্রশ্নটা মুখের কাছে এসে আটকে গেছে রাশেদের। ওর মনের কথা যেন বুঝতে পারলেন মোতালেব চাচা। “বুঝছি কি জিগাবা।আমি ও বুঝিনা পোলাডা ক্যান এইখানে পইরা আছে?......তুমিই জিগাইও”
এর মাঝে ছেলেটা এসে একটা কাঁথা এনে বিছিয়ে দিল মেয়েটির পিঠের নিচে।তারপর মেয়েটাকে আবার শুইয়ে দিল।মোতালেব চাচা ছেলেটার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন রাশেদকে।ছেলেটার নাম সগীর।গঞ্জে টেম্পো চালায়।আর বিকালের পর চলে আসে এখানে।
এক বাটি স্যুপ জাতীয় কি যেন(পরে রাশেদ জেনেছিল এটা ভাতের মাড়) এনে একটা চামচে করে খাইয়ে দিচ্ছিল সগীর মেয়েটাকে।মেয়েটার নাম শারমিন।পুরো গিলতে পারে না মেয়েটা,গাল বেয়ে অর্ধেকই পড়ে যাচ্ছে।মুখে কোন কথা নাই।শুধু আ আ করছে।তখন কয়েক চামচ পানি খাইয়ে আবার ভাতের মাড় খাওয়াচ্ছে। এভাবে এক বাটির অর্ধেক মাড় কোন রকমে খেল মেয়েটা।রাশেদ মনে মনে ভাবে এও কি জীবন হায় রে!!!
হাত মুছে সগীর মেয়েটাকে ঘুমানোর ইঙ্গিত করল। এর পর বাইরে বেরিয়ে গেল।আর মোতালেব চাচা তখন পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলাচ্ছেন।চোখের কোনে পানি জমতে শুরু করেছে যেন তার।এ দৃশ্য দেখে রাশেদ নিজেকে যেন আর ধরে রাখতে পারল না।বাইরে এল সে সগীরের সাথে কথা বলতে।কেন যেন ছেলেটাকে দেখে তার হতাশ মনে হয়নি।
“আপনে ত রাশেদ ভাই না?শহর থাইকা আইছেন?”
হ্যাঁ
“আপনের কথা কইছে বাজানে। আপনে অনেক ভালা লোক।“
“আপনি কিভাবে জানলেন?”
“ভাইজান,উনি আমার শ্বশুর কিন্তু আমার বাপের থাইকা বেশি।আমার বাপেরে আমি দেখি নাই।মায়ে আমারে ছোড কালে ফালাইয়া থুইয়া গেসিল।আমারে এই লোকটাই পালছে,হের মাইয়ার লগে আমার বিয়া হওনের কথা আছিল”
এতক্ষনে রাশেদ বুঝতে পারলো ছেলেটা কেন এই পরিবারের প্রতি আন্তরিক।তাই অনেকটা দায় বদ্ধতা থেকেই ও মেয়েটার সেবা শুশ্রূষা করছে বলেই মনে হল।কিন্তু ভুল ভাঙ্গল সগীরের কাছ থেকে বাকি কথা গুলো শুনে।
ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে সগীর।এরপর তার মা তাকে ফেলে আরেক লোকের সাথে চলে গিয়েছে।এর দুয়ারে ওর দুয়ারে ভিক্ষা করতে করতে ঠাই মেলে এই মোতালেব চাচার কাছে।তার ঘরে থেকেই এইট পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে সে।এরপর ঢাকায় একটা গার্মেন্টসে চাকরী নেয় সে।শারমিনকে সে পছন্দ করতো মনে মনে।মোতালেব চাচাও অমত করেন নাই।একটু ভাল থাকার আশায় শারমিনকেও একটা চাকরী পাইয়ে দিয়েছিল সগীর।তখন পরিবারের অবস্থা ভাল ছিল।সেই উচ্ছল শারমিনকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল।অনেক আশা ছিল তার।কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙ্গে দিল একটা দূর্ঘটনা।
সেদিন গার্মেন্টসে গিয়েছিল না সগীর।মাঝে মাঝে ট্যাক্সিতে কিছু খ্যাপ মারতে যেত।সেদিনের মত খ্যাপ দিতে গিয়েছিল দেখে যায় নি।গার্মেন্টসে দুপুরের দিকে শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লেগে যায় ছয় আর সাত তলায়।।শারমিন কাজ করত সাত তলায়।আগুনের জন্য কেউ সামনের সিড়ি ব্যাবহার করতে পারছিল না।লিফট অচল হয়ে গিয়েছিল।শয়ে শয়ে মানুষ তখন পিছনের সিড়ি দিয়ে নামতে গিয়েছিল।কিন্তু মানুষের চাপাচাপি তে হঠাৎ রেলিং টপকে নিচে পড়ে যায় শারমিন।তখনও তার হুঁশ ছিল আর ব্যাথায় কাৎরাচ্ছিল কিন্তু সেদিকে দেখার সময় ছিলনা কারও।উল্টো মানুষের চাপে পদদলিত হয় শারমিন।ঘটনার প্রায় অল্পকিছুক্ষন পর খবর পায় সগীর।হাসপাতালে শারমিনের শরীরটা দেখে বুঝার উপায় ছিল না যে ঐ শারমিন।সারা শরীরে ব্যান্ডেজ।নিথর হয়ে গিয়েছিল সগীর।
ডাক্তারদের অপরিসীম চেষ্টায় বেঁচে গেল শারমিন।কিন্তু বেঁচে রইল মরে যাবার মত করেই।সারাজীবনের জন্য পক্ষাঘাতগ্রস্থ।চিকিৎসার সময় অনেকের কাছ থেকে অনেক টাকা ধার নিয়েছিল সগীর চড়া সুদে।এখন চেষ্টা করছে সেই ধার শোধ করার।ঢাকায় আর ছিলনা সে।চলে আসলো গঞ্জে।এখানে বিকাল পর্যন্ত টেম্পো চালায় সে।ততক্ষন মেয়ের কাছে থাকেন বাবা।এরপর দোকানে যাবার পর সগীর ই থাকে মেয়েটার পাশে।আজ হঠাৎ কেমন কেমন যেন করছিল মনে হচ্ছিল এখনই বোধহয় মারা যাবে,তাই দ্রুত মোতালেব চাচাকে খবর দিয়েছিল সে।
“ভাইজান আপনের মত আমার যদি টাকা থাকত তয় আমি অরে অনেক ডাক্তার দেখাইতাম।আমার কর্য করা লাগতো না। গরীবের কেউ নাই ভাইজান এক আল্লাহ ছাড়া।“ বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।
রাশেদ তাকিয়ে থাকে সগীরের দিকে। অনেক টাকা তার নেই তবে তার পরিবারে অভাবও নেই।এই মুহূর্তে তার কাছে যদি টাকা থাকত তবে সব দিয়ে দিত এই সগীর নামের অপরিচিত অল্প শিক্ষিত ছেলেটাকে।সগীর মোতালেব চাচা এদের জীবনের কষ্টের কাছে নিজের কষ্টটাকে একটা পাখির পালকের ওজনের মতই হালকা মনে হচ্ছে রাশেদের।
সগীরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিল রাশেদ।কিছু হয়তো করতে পারবে না এই পরিবারের জন্য তবে অন্তর থেকে দু’আ করবে সে।সগীর ওর মাঝে ভালবাসার সংজ্ঞাটা নতুন করে লিখে দিয়েছে।
হঠাৎ করে একটা প্রশ্ন উঁকি দিল ওর মনে।আজ যদি শারমিনের জায়গায় সগীর হত তবে সেই সময়ে কি সগীর কাছে পেত শারমিনকে?
-JM Imran
(ঈদ গল্প লেখা প্রতিযোগিতা)
No comments:
Post a Comment