Subscribe:

“তারা এবং মানুষদুটো”

কুটু আর কুটি । স্বামী আর স্ত্রী । দুজনের সংসার । ছোট্ট-খাট্ট সুখের সংসার । ছোট্ট একটা বাসা , সাথে ভুরি ভুরি ভালবাসা । আগের বাসাটা থেকে এবারের বাসাটা আরো সুন্দর , আলো বাতাসের আনাগোনা বেশি । ঘুম থেকে উঠলেই চোখের সামনে খুব সুন্দর পুকুর চোখে পড়ে । পুকুরে লাল শাপলার ছড়াছড়ি । আর কি দরকার ? খুব বেশি একটা গাড়ির শব্দ নেই , শুনশান পরিবেশ ।
আশেপাশের মানুষগুলোও ভাল , ওরা অনেকদিন ধরেই ধরেই আছে কিন্তু কেউ তেমন একটা জ্বালায়নি । নিজের মত করে বেচে আছে তারা । বৃষ্টির সময়ও তেমন একটা ঝামেলা নেই । সব মিলিয়ে বলা যায় , সুখ আছে তাদের মনে ।

তাদের প্রতিবেশী দম্পতিকেও দেখলে সুখীই মনে হয় । তাদেরও দুজনের সংসার । নতুন এসেছে । দেখলেই বোঝা যায় ভালবাসার বিয়ে । অন্তত কুটু আর কুটি সেটা বোঝে । ওদের আর বেশি কিছু বোঝার প্রয়োজনই বা কি ? কুটু আর কুটি তো মানুষ না ।

এক জোড়া চড়ুই পাখি । কাব্য সাফার বিয়ে হয়েছে তিন মাস । গত সপ্তাহে ওরা এ বাসায় এসেছে । ছোট বাসা ,  দুটো রুম , একটা বাথরুম আর রান্নাঘর । মালিককে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলে দোতলাটা ম্যানেজ করতে ভালোই কষ্ট হয়েছে । তার ওপর আবার ঢাকা শহরের বাসার যা ভাড়া , শুনলেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে । তাই সব কিছু দেখেশুনে এই বাসাটাই সাধ্যের মধ্যে বলে মনে হয়েছে । সাফা খুবই পরিষ্কার থাকা মানুষ , তাই শুরুতেই পুরো বাসা ঝাড়ু দিয়ে , মুছে টুছে একাকার করে ফেলেছে । পুরোন সব জিনিস ফেলে দিয়েছে , শুধু একটা জিনিস ছাড়া । সেটা হল বেডরুমের ভেন্টিলেটরের ভেতর ছোট্ট পাখির বাসাটা ।

যেদিন বাসা পরিষ্কার পর্ব চলছে , সেদিন কুটু আর কুটি তাদের বাসার চিন্তায় অস্থির । কারন এর আগের বাসার মেয়েটা একদিন পরিষ্কার করতে গিয়েই ওদের বাসাটা ফেলে দিয়েছিল । সে থেকে বাসা পরিষ্কার করা দেখলে কুটু খুব ভয়ে থাকে , কুটিকে নিয়ে দূরে সরে থাকে আর মনে মনে প্রার্থনা করে যেন বাসাটা অক্ষত থাকে ।
পাখির বাসাটা দেখেই সাফার ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল । ওদের বাসার বারান্দায় ও এমন একটা বাসা ছিল । কিন্তু সেখানে কোন পাখি থাকত না । সাফা পাখি দেখলেই ডাকত আর বলত “এই পাখি , আমার বাসায় থাকবে ?” পাখিগুলোর কেউ ই তার কথা শোনেনি । আজ হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে হাসি পেল খুব । চারপাশে তাকিয়ে সাফা পাখি খুজতে লাগল । তখনি জানালার বাইরে গাছের দিকে চোখ পড়ল ।

কুটু কুটিকে নিয়ে ডালে বসে আছে আর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছে । কি মনে করে মেয়েটা হাসল । তারপর এদিকে তাকাল । কুটি তো ভয়ে অস্থির । কুটু কুটিকে ডানার ভেতর আড়াল করে রেখে বসে থাকল ।
চড়ুই দুটিকে দেখে সাফার মনে হল বাসাটা তাদেরই । যাক , এবার তো অন্তত পাখিওয়ালা বাসা পাওয়া গেল । নেমে এল সাফা । ভাবল – থাক না চড়ুই দুটো , ছোটবেলার ইচ্ছা পুরণ হোক ।

কুটু খেয়াল করে মেয়েটা ওদের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবল , তারপর বাসাটা ওভাবে রেখেই নেমে এল । মেয়েটার চোখে আনন্দ দেখতে পেল ওরা । যাক , মেয়েটা তাহলে ভালো মানুষ ।
সেদিন রাতে কাব্য আর সাফা বেডরুমে বসে । কাব্য সাফার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে ।
-এই যে সাধের জামাই
-জ্বী বলুন বেগম
-আজকে আমি দুটো কারনে অনেক খুশি
-কি কারন জানতে পারি ?
-হুম , একটা হল আজ আমাদের নিজেদের বাসায় প্রথম রাত আর অন্যটা হল আজ আমার একটা ছোটবেলার ইচ্ছা পুরণ হয়েছে ।
-ইচ্ছা টা কি ?
-চড়ুই পাখির ইচ্ছা
-মানে ? একটু খোলাসা করবেন বেগম ?
-ওই দেখ ওপরে , দেখেছ , দুটো চড়ুই পাখি । আমার ইচ্ছা ছিল আমার বাসায় পাখি বাসা বাধবে । জোড়া পাখি ।
-হুম , সব ই ঠিক আছে । কিন্তু সমস্যা হল......
-এখানে আবার সমস্যা কি ?
-সমস্যা হল – আমার বৌকে আদর করার সময় ওরা যদি দেখে ফেলে তাহলে.........
-যাহ শয়তান কোথাকার......
কুটু আর কুটি বসে বসে মানুষ দুটোকে দেখছিল । ওরা আগের মানুষগুলোর চেয়ে আলাদা । দুজন দুজনের খুব আপন বলে মনে হয় । কুটুরা খেয়াল করে মেয়েটা ওদের দিকে তাকিয়ে কি যেন বলল , তারপর ছেলেটা কিছু বলতেই মেয়েটা তার ওপর ঝাপিয়ে পড়ল ।
কুটি জিজ্ঞেস করল “ওরা কি করছে ?”
কুটু তার বৌকে জড়িয়ে ধরে বলে “ভালবাসা করছে”

এভাবে কেটে যেতে থাকে সময় । দিন গড়িয়ে রাত হয় , দুপক্ষেরই ভালবাসা গভীর হয় । কাব্য  সকালে অফিসে যায় , সাফা ঘরের এটা ওটা করে , সারা ঘরে নেচে বেড়ায় । হঠাৎ করে খেয়াল করে- ও যেই ঘরে যায় , চড়ুই দুটো সেই ঘরেই উড়ে আসে । ব্যাপারটায় খুব মজা পায় সে । দিগুন খুশিতে নাচতে থাকে । আর কুটু কুটি মেয়েটার খুশি দেখে আনন্দ পায় । রাতে কাব্য এলে খাবার পর সাফা কি কি হল তা শোনায় । চড়ুই পাখি দুটো আজ কতক্ষন ওর পিছে পিছে ঘুরেছে সেটা বলতে কক্ষনো ভোলেনা সে । বলে নিজেই হাসে । দুজনে ওপরে তাকিয়ে দেখে চড়ুই দুটো ওদের দেখছে । কাব্য সাফাকে আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে । সাফা স্বামীর বুকে মুখ লুকায় । আস্তে করে বলে “কি করছ , ওরা দেখছে তো” । কাব্য বলে “দেখুক না , ঘরের লোকই তো , দেখুক” । ঘরের ভেতর মিষ্টি ভালবাসার গন্ধ । সাফা একটা গান ছেড়ে আবার স্বামীর কোলে মুখ লুকায়-
“তুমি বরুণা হলে হব আমি সুনীল
তুমি আকাশ হলে হব শঙ্খচিল
তুমি নদী হলে হব আমি জল
তুমি শ্রাবণ হলে হব শ্রাবণঢল............”
কুটু কুটিও নিজেদের মাঝে ডুবে যায় , হারায় ভালবাসার জগতে ।
এক মাসে মাথায় সাফা কাব্যকে জানায় তার মাঝে নতুন একটা জীবনের আগমন ঘটেছে । কাব্য বাবা হতে যাচ্ছে । খুশিতে পাগল হয় কাব্য । সাফাকে নিয়ে শুরু হয় তার চঞ্চলতা । সবাইকে খবরটা জানানো হয় । সবাই বাসায় এসে সাফাকে দেখে যায় ।

আসেননা শুধু কাব্যর মা ।
কাব্যর বাবা আগেই মারা গেছেন । মা ই কাব্যর সব । কাব্যর এ বিয়ে মা কেন যেন মেনে নিতে পারেননি । এ বিয়েতে কাব্যকে তার বোন অনেক সাহায্য করেছে , কারন মা কখনোই কাব্যর ভালবাসা মেনে নিতেন না । মার কথা – ভালবাসা করে বিয়ে করলে কেউ সুখী হয়না । দুজনের কেউ না কেউ কষ্টে থাকে । কিন্তু কাব্য সেটাকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য তার ভালবাসাকে বিয়ে করে । মা সেটা মানতে পারেননি আজও । কাব্য মাকে ফোন দিয়েছিল । কিন্তু মা কথা বলেননি । তাই কাব্য সাফাকে নিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতে যায় । মা তাদের দেখে দরজা আটকে বসে থাকেন । কাব্যর বোন সাফাকে দেখে খুব খুশি হয় , মাকে বের হতে বলে । কিন্তু মা বের হননা । তাই কিছুক্ষন অপেক্ষা করে চলে যায় ওরা । এভাবেই চলছিল ।

 হঠাৎ একদিন......
বাসায় পানি নেই । পাশে বাসা থেকে পানি আনতে গিয়ে পড়ে পেতে ব্যাথা পায় সাফা । সে বাসার ফরিদা আপা কাব্যকে ফোন দেন আর সাফাকে হাসপাতালে নিয়ে যান । হাসপাতালে এসে দিশেহারা হয়ে যায় কাব্য । সাফা অপারেশন থিয়েটারে । ফরিদা আপার কাছে থেকে শোনা যায় সাফা পেটে খুব ব্যাথা পেয়েছে । আর কিছু শুনতে ভালো লাগেনা কাব্যর ।

দুঘণ্টা পর ডাক্তার বের হয়ে আসেন ।
“ মা এখন সুস্থ । বাট উই আর সরি.........
বাচ্চাটাকে বাচানো যায়নি । ”
কথাটা বুকে এসে লাগে । শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে । পৃথিবীটাকে অনেক নিষ্ঠুর মনে হতে থাকে । কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা কাব্য । ওটি রুমে ঢুকে দেখে সাফা চোখ বুজে শুয়ে আছে । ঘুমোচ্ছে । মেয়েটা এখনো কিচ্ছুই জানেনা । কিন্তু যখন জানবে তখন ? কি করেবে সে ? নাহ , আর ভাবতে পারেনা কাব্য । সব কিছু ঘোলা হয়ে আসে ।
সকাল থেকেই মেয়েটাকে দেখা যাচ্ছেনা । কুটি কুটুকে বলে “মেয়েটা কই , কিছু হয়নি তো ?” কুটু মাথা নাড়ে । কিছুই জানেনা সে । রাত হয় । ছেলেটাকেও দেখা যায়না । পরদিন সকালে ওরা ঘরে আসে । কুটু কুটি খেয়াল করে কি যেন একটা নেই । আগের মত আনন্দ নেই । মেয়েটার মুখ সাদা হয়ে আছে । কোনমতে তাকে ধরে আনছে ছেলেটা , চোখে শুধু কষ্ট আর কষ্ট । রুমে এনে শুইয়ে দেয়া হয় সাফাকে । ওভাবেই পড়ে থাকে মেয়েটা । শুন্য দৃষ্টি জানালের বাইরে গিয়ে আটকে থাকে । খুব কষ্ট হয় কুটির । স্বামীর ডানার ভেতর মুখ লুকায় সে ।

কাব্য অফিস থেকে ক’দিনের ছুটি নিয়েছে । সাফাকে সুস্থ করা দরকার । ব্যাপারটায় খুব শক খেয়েছে মেয়েটা । কাব্য সারাদিন সাফাকে নিয়ে বসে থাকে , এট ওটা বলে , বোঝায় ব্যাপারটায় কারো কোন হাত নেই , গান শুনায় , হাসে , খাইয়ে দেয় ইত্যাদি । আর সাফা , শুধু জানালার বাইরে চেয়ে থাকে আর কাদে , মাঝে মাঝে বলে “আমায় মাফ করে দিও , আমায় মাফ করে দিও” । কাব্য চোখের পানি আটকে রেখে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে সাফাকে , বলে “তোমাকে অনেক ভালবাসি সোনা , তোমার কোন দোষ নেই ” ।

কাব্য ওপরে তাকিয়ে খেয়াল করে চড়ুইদুটো চুপ করে বসে আছে । যেন ওরাও কষ্ট পাচ্ছে ।
সপ্তাহ খানেক চলে যায় । সাফাও খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে । কাব্যর ছুটিও শেষ হয়ে যায় । এর মাঝে কাব্যর মা একবার বাসায় আসেন । খুব অবাক হয় কাব্য । বাসায় ঢুকে কিছু বলেননা কাব্যর মা । সাফাকে একপলক দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নেন । কাব্য কিছু বলতে যাবে , এই সময় মা দরজার দিকে পা বাড়ান । বলেন “আমি এখানে থাকতে আসিনি । শুধু তোমাকে দেখে গেলাম । খুব তো সুখে আছ মনে হচ্ছে । শোন , আমি যা ভাবার ভেবে নিয়েছি । তোমাকে আবার বিয়ে দেব আমি । মেয়ে দেখা শুরু করব......” মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাইরে নিয়ে আসে কাব্য । সাফা এগুলো শুনতে পারলে কি যে করবে খোদা জানে ।
কথাটা শুনে বিশাল একটা ধাক্কা খায় সাফা । কাব্য ইতিমধ্যেই তার মাকে বাইরে নিয়ে গেছে । সাফা আস্তে করে বিছানায় বসে পড়ে । চোখ দিয়ে পানি গড়াতে থাকে অনবরত । মনের ভেতর একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খায়-কেন এমন হল ?
কোন উত্তর পায়না সে ।
কুটু কুটি খেয়াল করে মেয়েটা কাদছে । আর একটা গান বাজছে পাশে । গানের সুরটা আগে যে গানটা শুনত তার নয় , নতুন কোন সুর । সেই সুরে আস্তে আস্তে সারা ঘরে কষ্ট ছড়িয়ে পড়তে থাকে ।
গত কয়েকদিন ধরে অফিসে যাওয়া শুরু করেছে কাব্য । ও অফিসে গেলেই সাফা সেই করুণ সুরের গানটা শোনে । শুনতে গেলেই খেয়াল করে চড়ুই পাখি দুটো চুপ করে বসে থাকে । মাঝে মাঝে সাফার মনে হয় ওর কষ্টটা পাখিদুটোও বোঝে । আবার মনে হয় এ কি করে সম্ভব । ওরা তো মানুষ নয় , ছোট চড়ুই পাখি । কিন্তু তবু ওদের সামনে কাদতে এত খারাপ লাগে কেন ?
প্রশ্নটার কোন উত্তর মেলে না ।

সকাল হয়েছে । মাত্র কাব্য বাসা থেকে বের হল । সাফা দরজা আটকে রুমে ঢুকতেই দেখে কাব্য ফোন রেখে গেছে । ফোনটা টেবিলের ওপর রাখতেই বেজে ওঠে । কাব্যর বোনের ফোন । এখন কি করা , ফোনটা তো ধরা উচিত । ভেবেই ফোনটা রিসিভ করে সাফা । ও কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে কাব্যর বোনের কান্নাজড়ানো কন্ঠ শোনা যায়-
-ভাইয়া রে , তুই ভাবীকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যা । মা-র মাথা খারাপ হয়ে গেছে । মা তোর জন্য পাত্রী দেখছে । আজ সকালে তোকে নিয়ে যাবে মেয়ের বাসায় । ভাইয়া তুই পালা । মা রেডি হচ্ছে । এক্ষুনি তোকে ফোন দেবে হয়ত । মা আসছে । আমি রাখছি । তুই পালা ভাইয়া ।
ফোনটা কেটে যায় । সাফার মনে হয় বুকের ভেতর সুতোটা ধরে কেউ হ্যাচকা টান দিয়েছে , ছিড়ে গেছে সব স্বপ্ন । নাহ , আর ভাবতে পারছেনা সাফা । তার কাব্য অন্য কারো হবে , এটা কি করে সম্ভব ?
তবে সে সে এতটাই অপারগ ?
তার ভালবাসা কি এতটাই তুচ্ছ ?
কাব্য কি সত্যিই তাকে ছেড়ে যাবে ?
আর কেনই বা যাবে না , সাফা কি তাকে কিছু দিতে পেরেছে ? পারেনি , সন্তানের মুখটাও দেখাতে পারেনি ।
নাহ , আর ভাবতে পারছেনা সাফা । সিদ্ধান্ত যা নেবার নিয়ে ফেলেছে সে । কঠিন সিদ্ধান্ত ।


কুটু আর কুটি দেখে মেয়েটা পাগলের মত কি যেন খুজছে । হ্যা , পেয়েছে ।
দড়ি খুজছিল সাফা । পেয়েছে । রুমের ফ্যান বন্ধ করে দড়িটা তার সাথে শক্ত করে বেধে নেয় । বাসার সবকটা জানালা , দরজা খুলে দেয় । হু হু করে বাতাস ঢুকতে থাকে । তারপর আস্তে করে সেই করুণ গানটা ছেড়ে দেয় ।
আবার কষ্টের সুরটা বেজে ওঠে । কুটি হঠাৎ আতকে ওঠে । ফ্যানের সাথে ঝুলানো জিনিস , এটা সে আগে কোথাও দেখেছে । হ্যা , মনে পড়েছে । ছোট থাকতে দেখেছিল । তখন বাবা মা ছিল সাথে । কুটি মাকে জজ্ঞেস করেছিল “মা , মানুষটি কি করছে ? ”  মা উত্তর দিয়েছিলেন “মানুষটা অনেক দুঃখ পেয়েছে রে মা । সে এখন নিজে নিজে মারা যাবে ” সেদিন ওদের চোখের সামনে মানুষটা মারা যায় । কুটি সেদিন খুব ভয় পেয়েছিল ।
আজ আবার সে জিনিসটা দেখে ভয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে । কুটি চিৎকার করে স্বামীকে বলে “আমি ওটা চিনি । মেয়েটা এখন নিজেকে মারতে চায় । ও মারা যেতে চায় । তুমি কিছু করো গো , নইলে মেয়েটা মারা পড়বে ।”
পাশের রুম থেকে টুলটা এনে বিছানার ওপর ওঠে সাফা । শেষবারের মত প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় । চোখ বুঝে মনে করে কাব্যর সাথে তার স্মৃতিগুলোর কথা । খুব কান্না আসে , চোখের পানি আর বাধ মানেনা । তবু নিঃশব্দে কাদে সাফা । চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করে । কিন্তু তখনই মনে পড়ে নিজের ম-র কথা । মা সবসময়ই বলতেন “সাফা মা , যখন খুব খারাপ লাগবে তখন চিৎকার করে কাদবি । তোর কান্না ঠিকই তোর ভালবাসার মানুষ শুনতে পাবে , তোর জন্য ছুটে আসবে ” । কিন্তু না ,আজ শব্দ করা যাবেনা , কাব্য যদি শুনে ফেলে । তবু শেষবারের মত মনে মনে বলে-
 “ওগো , তুমি কি শুনতে পাও ?”
 এইসময় নিচে কেচিগেট খোলার আওয়াজ ভেসে আসে । নাহ , আর দেরি করা যাবেনা । বিছানা থেকে নেমে গানের ভলিউম আরো বাড়িয়ে দেয় সাফা । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে ।
কুটু কি করবে বুঝতে পারেনা । রুম থেকে বের হয়ে বাসার সামনে তারস্বরে চেচাতে থাকে ।
কাব্য বাসার সামনে ফেরত এসেছে , ফোনটা নেবার জন্য । ইদানীং কি যে হয়েছে সবকিছু ভুলে যায় । কেচিগেট খুলতে গিয়ে খেয়াল করে চড়ুই পাখিদুটোর একটা ওকে দেখে খুব চেচাচ্ছে । এমন করে তো পাখিটা ডাকেনা । হলো টা কি ?

 কাব্যর মনে পড়ে একবার ওরা ঘরে থাকার সময় হঠাৎ রান্নাঘর থেকে পাখিদুটোর চেচানি শুনতে পাওয়া গিয়েছিল । কি মনে করে কাব্য রান্নাঘরে গিয়ে দেখেছিল জানালা মোছার কাপড়ে আগুন লেগেছে । কাপড়টা চুলার ওপরের তারে টাঙ্গানো ছিল । চুলা জ্বলতে থাকায় শুকাতে শুকাতে একসময় আগুন ধরে গেছে । কোনমতে ওরা দুজনে মিলে আগুন নেভায় । সেদিন চড়ুই পাখিদুটো যদি না থাকত , তা হলে কিছু একটা হয়ে যেত ।
এখনো ভাবছে কাব্য । সেদিনের পরে তো আর এভাবে চেচায়নি পাখিটা । তবে কি সাফার কিছু হয়েছে ? ও ঠিক আছে তো ?

আর কিছু না ভেবে তাড়াতাড়ি কেচিগেট খুলে ঢোকে কাব্য । দৌড়ে দোতালায় উঠে দেখে দরজা খোলা । ভেতর থেকে হঠাৎ একটা গান দিগুন শব্দে বাজতে থাকে.....................

“বন্ধু তোমার পথে সাথীকে চিনে নিয়ো
মনের মাঝেতে চিরদিন তাকে ডেকে নিয়ো
ভুলোনা তারে ডেকে নিতে তুমি
বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিয়ো..................”

By : Blockhead Hasnat
hasnat.iut09@gmail.com

No comments:

Post a Comment