Subscribe:

কুরবানির গরু

ছোটবেলায় একবার দাদীর কাছে গল্প শুনছিলাম –বেহেশত আর দোযখের গল্প। যদিও দাদী দোযখের কথা খুব একটা বলতে চাইতেন না। তাঁর যুক্তি ছিল, “দোযখের কথা শুনে কি করবি, তোরে কইলাম বেহেশতে যাবার লাগবি”। বেহেশতের দুধের নহর, বিশাল ফলের বাগান আর রাজপ্রাসাদের গল্প শুনতে শুনতে আনমনে বিভোর হয়ে গিয়েছিলাম কল্পনার কোনও রাজ্যে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ ছিল বেহেশতের হুরপরীদের রূপ যৌবনের বর্ণনা! অবাক বিস্ময়ে জানতে চাইলাম,


-‘দাদী, হুরপরীরা কি অনেক সুন্দর?’

-‘হ দাদাভাই, পুরাই দুধে আলতা গায়ের রঙ!’

-‘আমাদের শেফালীর মত নাকি?’

মুখ ফসকেই কথাটা বলে ফেলেছিলাম, তখন বুঝতে পারি নাই যে -ওটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল! দাদী একটু আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন, পরক্ষনেই মুচকি হাসি দিয়ে বললেন,

“হ দাদাভাই, এক্কেবারে আমাগো লাল পরী শেফালীর লাহান!”

শেফালী এই সৈয়দ বাড়ীরই মেয়ে- আমার দাদার ছোট ভাইয়ের বড় ছেলের ঘরের বড় মেয়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোনও কমতি ছিল না আমাদের গ্রামে, তবুও গ্রামের বিশাল বাড়ীটা সে একাই যেন আলোকিত করে রেখেছে! প্রতি বছরই শহুরে বন্ধুবান্ধব ছেড়ে পরিবারের সাথে গ্রামে ছুটে যেতাম- আত্মীয়দের সাথে কুরবানির ঈদ করবো বলে। যদিও শেফালী কে দেখার উদগ্রীব বাসনাও সেই ক্ষেত্রে গোপন প্রভাবক হিসেবে কাজ করত!

 

কিন্তু দাদী তো সেই গোপনীয়তা কে চপেটাঘাত করে বাড়ীর অন্দর মহলে ছড়িয়ে দিলেন, “আমাগো মানিক ভাই তো পিরিতির ফান্দে পইরা গেছে। অহন কি হইব?”। বুবু তো এই খবর শুনে যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেলেন। সুযোগ পেয়েই আমারে খ্যাপানোর মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে চলে আসলেন,

“কিরে মাইনকা বান্দর, তুই নাকি প্রেমে পড়ছিস? কি কলি যুগ আইলরে! নাক টিপলে এখনও দুধ পরে, আর সেই পুচকা নাকি প্রেম করে”। আমি চরম বিরক্তি নিয়ে বললাম,

- ‘বুবু তুমি কি যাবা আমার সামনে থেকে’।

- ‘আহারে, পুচকা দেহি আবার রাগ দেখায়! নে বান্দর, কাঁঠাল খা’।

- ‘তুমি তো জানোই, আমি কাঁঠাল খাই না। যাও ভাগো!’

- ‘খাবি না মানে, এইটা শেফালীদের গাছের কাঁঠাল। তোরে খাইতেই হবে!’

 

উফফ! বুঝলাম বাড়ীর অন্দর মহল এখন আর আমার জন্য নিরাপদ না। রেগেমেগে দৌড়ে বেরিয়ে এলাম উঠানে- দেখলাম আব্বা গরু কিনার জন্য চাচাদের নিয়ে গরুর হাটে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি কাছে গিয়ে বললাম,

-‘আব্বা আমিও যাব আপনাদের সাথে’।

- ‘তুই গিয়ে কি করবি বাবু? তুই তো গরুর কিছুই বুঝস না’।

- ‘কি যে বলেন না আব্বা! আশেপাশের সব বাড়ীর কুরবানির গরু আমি দেখেছি। আমি নিজেই এখন গরু বিশেষজ্ঞ’।

আব্বা হাসতে হাসতে বললেন, “ আচ্ছা যা, একটা লাঠি আর দড়ি নিয়ে আয়”।

আমিও নাচতে নাচতে লাঠি আর দড়ির সন্ধানে গেলাম, জীবনে প্রথম বারের মত গরু কেনার অভিযানে বের হচ্ছি। কিছুটা রোমাঞ্চিত তো বটেই! কিন্তু আমার সেই উত্তেজনার আগুনে পানি ঢেলে দিলো কোনও কিন্নর কণ্ঠী নারী, “কিরে, গরুর মত লাফাতে লাফাতে কই যাস?”

কার এত্ত বড় সাহস! ঝটকা মেরে পিছন ফিরে তাকালাম। হায়! এত দেখি আমার লাল পরী শেফালী। মেয়েটা আবারও তুই তকারি শুরু করছে! যদিও আমি ওর চেয়ে বয়সে খুব একটা বড় না। তবুও আমি যে ওকে কেন তুমি তুমি করে ডাকি সেইটা বোঝার মত ঘিলু কি ওর মাথায় নাই? মনের দুঃখটা গোপন করে বললাম,

-‘কই আর যাব! গরু কিনতে যাই’।

-‘গরু কিনতে যাস? কেনরে, তুই নিজেই তো একটা গরু’।

- ‘তাইলে তুমি কি? পাকনামি বাদ দিয়া নিজের চরকায় তেল দাও গিয়া। আমি গেলাম’।

- ‘যা যা, তোর মত একটা ল্যাংড়া গরু নিয়া আসিস। যাতে সারা উঠান জুইড়া লাফাইতে থাকে’।

বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো আমার লাল পরী। আমিও আর পিছন ফিরে তাকালাম না। আমার ভালবাসার প্রতি চরম অবমাননা মুখ বুঝে সহ্য করে পা বাড়ালাম হাটের পথে। মন কে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে – নারী হৃদয় বড়ই ছলনাময়ী!


হাটে পৌঁছেই ভিমড়ি খেয়ে গেলাম- এতো গরু! আব্বা তো মজা করে বলেই ফেললেন, “সাবধানে থাকিস, এতো গরুর ভিড়ে তোকে না আবার হারিয়ে ফেলি”। আমি অবশ্য খোঁচাটা না বোঝার ভান করলাম। বরং আমাকে হাটে নিয়ে আসার গুরুত্ব ও সার্থকতা প্রমাণ করার জন্য নিজের বিদ্যা জাহির করতে লাগলাম,

- ‘বুঝলেন আব্বা, গরুর শিং বাঁকানো না থাকলে আসলে শাহী ভাবটা আসে না। পিঠের কুজ যত বড় হবে, গরু হবে ততই সুন্দর। আর পাছাটা যত চওড়া হবে, ঠ্যাং এর গোশত তত বেশি হবে’।

-‘তাই নাকি মানিক বাবু! তুই তো দেখি পুরাই- পাছা বিশেষজ্ঞ হয়ে গেছিস!’

-‘ইস, আপনি কি সব উল্টাপাল্টা কথা যে বলেন না। যাই হোক, আমাদের গরুর কালার কিন্তু লাল হবার লাগবে”।

-‘ধুর বোকা, লাল কোন রঙ হল নাকি। গরু সুন্দর হইল- কুচকুচে কালা, চামড়া জানি চকচক কইরা ঝিলিক মারে!’

- ‘না আব্বা, আমি কাউয়া কালারের গরু কিনমু না। আমার লাল গরু লাগবে’।

- ‘হঠাৎ লাল রঙের দিকে ঝুঁকলি কেন? লালীর প্রিয় রঙ লাল বলে?’

- ‘লালী? কোন লালীর কথা বলছেন?”

- ‘আরে, আমাদের শেফালী! সারাক্ষণ তো লাল রঙের জামা পড়ে ঘুরাঘুরি করে’।

- ‘ইস, আপনি আর কোনও নাম খুঁজে পাইলেন না? তালুকদার বাড়ীর গাভীটার নামও তো লালী!’

- ‘তাতে কী? শেফালী কে গাভী বললেই তো তোর খুশি হওয়ার কথা- তুই নিজেও তো একটা গরু!’

 

আমি কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। বুঝলাম, অন্দর মহলের কানাকানি আব্বার কান পর্যন্তও পৌঁছে গেছে। অনেকটা চুরি করে ধরা পড়ে যাওয়ার লজ্জায় যেন চুপ মেরে গেলাম। আশেপাশের গরুগুলোও যেন আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। আমি সেই সকল নির্বোধ চোখজোড়া গুলো উপেক্ষা করে উদাস মনে হাঁটতে লাগলাম। হঠাৎ কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলো- “ওই গরু, গরু, গরু”।

আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই কে যেন আমাকে ধাক্কা মেরে পাশে সরিয়ে দিলো। পরক্ষনেই পিছনে কেউ একজন আর্ত চিৎকার দিয়ে উঠলো, তাকিয়ে দেখি- আব্বা! আমাকে বাঁচাতে গিয়ে পিঠে গরুর গুঁতা খেয়েছেন। গরু তো নয়, যেন লাল রঙের ছোটখাটো হাতীর বাচ্চা! পাঁচ-ছয়জন মিলে দড়ি টেনেও সামলাতে পারছেনা। ভাগ্য ভালো যে মাথায় শিং নাই! আমি ভয়ের চোটে কেঁদে দিলাম, “আব্বা, আপনার কিছু হয় নাই তো?”

আব্বা আমাকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, “ধুর গাধা! কাঁদার কি হল? গরুর হাটে এলে তো দুই একটা গুঁতা খেতেই হবে। আর দেখলিতো, লাল রঙের গরুগুলা তোর মতই বজ্জাত”। বলেই আমাকে হতবাক করে দিয়ে আব্বা গরুটার মালিকের সাথে দামাদামি শুরু করে দিলেন। যেন কিছুই হয়নি। এই পাগলা গরুটাই কেন কিনতে হবে? মনে মনে ভাবলাম বটে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস তখন হলনা।

অবশেষে অনেক দর কষাকষির পর বিশ হাজার টাকায় হয়ে গেলো দফারফা, আমাদের গরু কেনা অভিযানের সফল পরিসমাপ্তি। কিন্তু এতো দূরের পথ হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে ভেবেই আমার পা ব্যথা শুরু করল। কি আর করা, গরুর পিঠে সওয়ার হয়েই রওনা দিলাম বাড়ীর পথে। গরুটাও গলায় ফুলের মালা জড়িয়ে বেশ বীর দর্পে হেলেদুলে চলছিলো আমায় নিয়ে। যদিও তার এহেন ভদ্র আচরণে আমার যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেগ ঘটাল। মনে হচ্ছিল শেফালীর লাল জামা দেখলেই গরুটা তার আসল রূপ প্রদর্শন করবে আর আমাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে আমার প্রেম পিরিতির সুমহান মর্যাদা কে ধূলায় লুটাইয়া দিবে।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল বলতেই হবে, নিরাপদেই বাড়ী ফিরলাম। কিন্তু কোথায় আমার লাল পরী! আশেপাশের সব বাড়ীর মানুষ এসে গরু দেখে গেলো তবুও আমার লাল পরীর কোন খবর নাই। একে একে সবাই চলে গেলো গরুর কাছ থেকে, শুধু আমি বসে রইলাম পথ চেয়ে। শেষ বিকেলে দেখা মিলল লাট সাহেবের বেটি কে, নাচতে নাচতে ঢুকল উঠানে- “ ওমা! চাচা দেখি দুইটা গরু কিনা আনছে- একটা বড় গরু আরেকটা পিচ্চি গরু!”

ধুর! এতক্ষণ ধরে কি বসে ছিলাম প্রেয়সীর মুখে ‘পিচ্চি গরু’ ডাক শুনবো বলে! এর চাইতে বুবুর ‘মাইনকা বান্দর’ নামটাও অনেক শ্রুতিমধুর। চরম হতাশা নিয়ে পলায়ন করবার মনস্থির করলাম। কিন্তু থামিয়ে দিলো আমার লাল পরী-

 - ‘আরে যাস কই, গরু যে বসে আছে। দাঁড় করিয়ে দেখাবিনা? নাকি তোর মত ল্যাংড়া গরু নিয়ে আসছিস’।

- ‘গরু কি তোমার জন্য সারাদিন দাঁড়াইয়া থাকবে নাকি লাট সাহেবের বেটি!’

- ‘আহা, রাগ করিস কেন? একটু দাঁড় করা না’।

লাল পরীর এহেন আবদার উপেক্ষা করাটা মোটেও সহজসাধ্য ছিল না। নিরুপায় হয়ে বীর দর্পে পা বাড়ালাম গরুর পিছনে। লেজটা ধরেই ‘হেইও’ বলে দিলাম জোরসে এক টান। কিন্তু হায়! আমার বীরত্বে কালিমা মোচন করে গরু মহাশয় কোন ভাবান্তর দেখাইল না! উপায়ন্তর না দেখে  কষে দিলাম গরুর পাছায় এক বাড়ি। ‘ঠাশ!’- না, গরু কে মারার শব্দ নয়। গরুর লেজ কর্তৃক আমার গালে থাপ্পড় খাইবার শব্দ!

আমি গবেটের মত গালে হাত দিয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম আমার পরীর দিকে। এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখবার আনন্দে তার হাসি যেন আর থামছেনা। কি সুন্দর রিনিঝিনি হাসি! সত্যি সত্যি যেন বেহেশতের হুরপরী নেমে এল মর্ত্যে! মনে মনে শাসিয়ে দিলাম গরুটা কে, প্রেয়সীর অমন হাসির প্রতিদানে আজকের মত বেঁচে গেলি। নইলে তোর খবর করে ছাড়তাম ব্যাটা!

অবশ্য বীরত্ব দেখানোর একটা সুযোগ পেয়ে গেলাম ঈদ এর দিন। অন্য সব বাচ্চারা যেখানে দূর থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে গরু জবাই দেখছিল সেখানে আমি গেলাম গরু ধরার জন্য। অবশ্যই সেটা গরুর পা বেঁধে মাটিতে ফেলার পরে! হুজুর যখন ‘আল্লাহু আকবার’ বলে গরুর গলায় ছুরি চালিয়ে দিলেন তখন ফিনকি দিয়ে রক্তের ছিটা ভিজিয়ে দিলো আমার পাঞ্জাবী। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম বয়ে চলা রক্তের স্রোতের দিকে।

“কিরে ভয় পেয়েছিস?”, আব্বার ডাক শুনে হুঁশ ফিরল। আশেপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলাম  শেফালী আছে কিনা। তারপর মাথা নেড়ে সায় দিলাম, ‘হুম’। আব্বা পাশে এসে দাঁড়ালেন, মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ভয় পাওয়ার কিছু নাই বাবু! এই পশু তো কুরবান করলাম আল্লাহর জন্য। আর আসল পশু তো লুকিয়ে আছে তোর আর আমার মনের ভিতর- ওটাকেও কুরবান করতে হবে”। আমি একটু ভাব ধরার জন্য বললাম, “আমিতো ছোটো মানুষ, আমার ভিতরে কি আর পশু আছে?”

“ও আচ্ছা, তুই ছোটো মানুষ, তাই না! বাপের পাঞ্জাবীর পকেট থেকে টাকা চুরি করে আইসক্রিম খাওয়ার সময় কি মনে থাকেনা তুই ছোটো মানুষ? যা ফাযিল, দৌড় দিয়ে চাটাই নিয়ে আয়”। ঈদের সালামি হিসেবে এমন ঝাড়ি উপহার পাওয়ায় আমি কিছুটা লজ্জিত হয়েই দৌড় দিলাম। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, আর কখনো চুরি করবো না। অবশ্য সেই সুযোগও আব্বা দিলেন না। কেননা, সেটাই ছিল আব্বার সাথে আমাদের শেষ ঈদ!


ঈদের তিন দিনের মাথায় গভীর রাতে হার্ট অ্যাটাক করলেন আব্বা। দ্রুত থানা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। কিন্তু এতো রাতে কোন ডাক্তারের দেখা মিলল না সেথায়। ঢাকায় নেবার জন্য দৌড়াদৌড়ি শুরু করলেন চাচারা। কিন্তু আব্বা বরাবরের মতই যেন ঝামেলা এড়িয়ে গেলেন, অনেকটা নীরবেই চলে গেলেন দাদীর গল্পের সেই অচেনা দেশে!

মৃত্যুর গভীরতা বোঝার বয়স তখনো হয়নি, তবুও এতোটুকু বুঝতাম- কাফনের চাদরে ঢেকে কাউকে কবর দিলে সে আর কখনো ফিরে আসবে না। চোখের সামনেই যেন সৈয়দ বাড়ীর আনন্দপুরী রুপান্তরিত হল বিষাদ মহলে। বুবু, শেফালী, দাদী, চাচী- সবার চোখেই জল, কাঁদছে না কেবল আমার মা! এতো অল্প বয়সে স্বামী হারানোর শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা। আমি মার হাত ধরে বোকার মত বললাম, “আব্বা কি আর ফিরবে না কোনোদিন?”

মা উত্তর দিলেন না, এক দৃষ্টিতে মেঝের দিকে নিস্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবারও বোকার মত মার হাত ধরে ঝাঁকি দিলাম, “আব্বা না এলে আমি গরু কিনতে যাব কার সাথে? কথা বল মা!” এইবার যেন শোকের পাহাড় ভেঙে বাঁধভাঙা কান্নার স্রোত নেমে এল! আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন মা!

দেখতে দেখতে তিরিশ বছর পেরিয়ে গেলো, আজও শুকোয়নি মা এর অশ্রুজল!

শুভ্র শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে নীরবে কেঁদে চলেছেন, তিরিশ বছরের একাকীত্বের বোঝা আজ বার্ধক্যের মলিনতায় স্পষ্ট প্রতীয়মান। আপনি বেঁচে থাকলে হয়ত খুশি হতেন আব্বা; কেননা আপনার সেই গরু আর গাভী- আমরা দুজনেই আজ দেশের নামকরা ডাক্তার! আপনার মত বিনা চিকিৎসায় আর মরতে দিব না কারো বাবা কে।


প্রতি বছরের মত এবারো সামনে এসে দাঁড়িয়েছি দেয়ালে ঝুলানো আপনার সেই ভাবগম্ভীর মুখশ্রীর সামনে। রোমন্থন করলাম ফেলে আসা মুহূর্তগুলোর স্মৃতি! আর মনে মনে বললাম, আপনাকে ছাড়াই গরু কিনতে যাচ্ছি আব্বা- দোয়া করবেন। তবে এবারের দোয়াটা হতে হবে একটু স্পেশাল। এবার যে আপনার নাতি- আমার আর শেফালীর একমাত্র আদরের দুলালও যাচ্ছে গরু কেনার অভিষেক অভিযানে!

তার যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার প্রস্তুতিটাও আমার চাইতে এক কাঠি সরেস- মাথায় গামছা বেঁধে বিদ্রোহী যোদ্ধার মনোভাব, গায়ে কালো গেঞ্জিতে ‘বুল ফাইট’ লেখা রাগান্বিত ষাঁড়ের ছবি- যার নাক দিয়ে আবার সিগারেটের ধোঁয়া বের হচ্ছে! পিঠে ঝুলানো চে গুয়েভেরার মুখশ্রী আঁকা এক ঝোলা-যার ভিতরে আছে পানির বোতল, গরুর মালা আর ডিজিটাল ক্যামেরা! আজকে রাতের মাঝেই নাকি গরুর হাটের উত্তেজনাকর ছবিগুলোর আপলোড দিতে হবে ফেসবুকে। কে জানে- সেখানেও তার কোন লাল পরী, নীল পরী আছে কিনা!

ছেলের চাহিদা অনুযায়ী গরু কিনতে হলে পকেট ভর্তি করে টাকা নেয়ার লাগবে। এখন তো আর বিশ হাজার টাকায় বাজারের সেরা গরু পাওয়া যায় না, বড়জোর সেরা ছাগল টা পাওয়া যেতে পারে! তার উপরে আপনার নাতিও আমার মতই ‘পাছা বিশেষজ্ঞ’-তার পছন্দের গরুর পশ্চাৎদেশ নাকি হতে হবে ইয়া মোটা! মাথায় থাকতে হবে উঁচু বাঁকানো শিং, আর পিঠে থাকতে হবে টিলার মত কুজ!

সব ই ঠিক আছে- কিন্তু সমস্যা একটাই। গরুর চামড়া নাকি হতে হবে-কুচকুচে কালা, যেন চকচক কইরা ঝিলিক মারে! শত হোক – আপনারই তো নাতি!

 

 

***[কম বেশি সবাইকেই মুখোমুখি হতে হয় এই নির্মম বাস্তবতার –যখন জীবনের আনন্দঘন কোন মুহূর্তে পাশে থাকবেনা তার - কাছের কোন মানুষ!]***

...  Jöy Saröwar ...

No comments:

Post a Comment