Subscribe:

অন্যরকম শেষের কবিতা

আমার মাকে ছোটবেলা থেকেই একটা ঘরে সব সময় আটকে রাখা হতো।নিয়মিত বিরতিতে তিনি সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চিৎকার করতেন ।খুব বেশি মেজাজ খারাপ হলে হাতের কাছে যা পেতেন ছুঁড়ে মারতেন।একবার আমার দিকে বঁটি ছুঁড়ে মেরেছিলেন ।সেই থেকেই তাকে প্রায় আজরাইল এর কাছাকাছি ভয় পেতাম।তিনি যখন আমার জন্মের ঠিক তিন মাস এর মাথায় পাগল হয়ে যান,আমার বাবা তখন আমার ছোটোখালাকে বিয়ে করেন।
  যদিও এজন্য কখনই বাবাকে ভিলেন মনে হয়নি।কারণ ছোটোখালাই আমাকে মায়ের আদর দিয়ে মানুষ করেছেন।আমার প্রাচীনপন্থী এবং কিঞ্চিৎ মৌলবাদী বাবার সাথে প্রায় যুদ্ধ করে আমাকে অনার্স এ ভর্তি করিয়েছিলেন খালা । কিন্তু সেকেন্ড ইয়ার এ বাবা ঠিক করেন কন্যারূপী আপদটাকে ঘাড় থেকে নামানো এখন অতি জরুরি।

                               যেদিন পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে এসেছিল,বসার ঘরে গিয়ে দেখি এক গাদা মানুষ খুব হাসিহাসি মুখ করে বসে আছে।এরপর কি ঘটবে তাও জানতাম।আমাকে হাঁটতে বলা হবে,দাঁত সব গুলোই আছে,নাকি ২-১ টা সংখ্যায় কম আছে তার পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে।রাঁধতে পারি কিনা,ঘরের কাজ করতে পারি কিনা তার একটা বিরাট ইন্টারভিউ হবে।আমি বসা মাত্রই ফাজিল টাইপ একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল,"বলুনতো লাবণ্যর সাথে অমিত এর প্রথম কোথায় দেখা হয়?শেষের কবিতা পরেছেন তো?"আমি প্রচণ্ড বিরক্তি চেপে উত্তর দিয়েছিলাম,"জানিনা"।ছেলেটা বলে উঠল,"আপনাদের ড্রয়িংরুম এ"।আমি চোখ সরু করে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ।আমার অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে সে বলল, "আমার নাম অমিত রায়হান। আপনার বাবার সাহিত্যবোধ খুব ভাল।মেয়ের নাম লাবণ্য,মেয়েজামাই খুঁজে বের করেছেন অমিত নামের।"খুব একটা উঁচুদরের রসিকতা করা হয়েছে এমনএকটা ভাব নিয়ে সে ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো।একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে এরপর সে আমার বাবার ব্যাটারি দেয়া রেডিওটার মত বকবক করতে লাগলো।বুদ্ধিমান পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে ফেলেছেন যে এই বাঁচাল ছেলেটার সাথেই বিয়ে ঠিক হয়ে গেল আমার।


                              সেইদিন থেকে তার কথা না শুনলে কেমন যেন অস্থির লাগত। মোবাইল এর রিংটোন বাজলে ২-৩ টা হার্ট বিট মিস হয়ে যেত।যদি দেখতাম অন্য কারো কল,রাগে গা জ্বলে যেত।মেসেজ টোন শুনে ইনবক্স খুলে যদিদেখতাম জিপির মেসেজ,ইচ্ছা করত মোবাইলটা আছাড় দিয়ে ভেঙ্গে ফেলি।নিজেও বুঝতে পারিনি এত তীব্রভাবে কিভাবে মানুষটাকে ভালবেসে ফেললাম!


                               বিয়ের দিন বরযাত্রী আসার কথা রাত ৮ টায়।বাবার ভাড়া করা ব্যান্ড পার্টির  লোকেরা অকারণেই একটু পরপর তুমুল শব্দে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে।রাত ১০ টা পেরিয়ে গেল।বর যাত্রী এল না।অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠলো আমার ।একটু পর শুনলাম মেয়ের মা পাগল এটা জানতে পেরে ছেলের বাবা ফোন করে বলেছেন তারা আসবেন না। পুরো বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেল।বিয়ের শাড়ী পড়া আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।এর ঠিক ৪ দিন পর জেদের বশে আমার বাবা আবার আমার বিয়ে ঠিক করে ফেললেন।যে ভদ্রলোক আমার কন্যাদায়গ্রস্থ পিতাকে উদ্ধার করলেন তিনি আমার চাচার বন্ধুর ছেলে।মা বাবা কেউ নেই।তার একবার বিয়ে হয়েছিল।বিয়ের রাতেই তার স্ত্রী তার পূর্বপ্রেমিকের সাথে পালিয়ে যায়।বিয়ের পরদিন সকালেই আমাকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন।


                              আপাতদৃষ্টিতে বিশেষত্বহীন একজন মানুষ।সাধারণ চেহারা,সাধারণ কথা বার্তা।সরকারী অফিস গুলোতে কিছু কর্মচারী রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বসে থাকেন।আমার স্বামী অনেকটা সেরকম।যদিও তিনি পেশায় একটা কলেজ এর অঙ্কের টিচার।খুব গম্ভীর ।একটু পরপর মনোযোগ দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করেন।আমাকে বিয়ে করে পরোপকার করেছেন,এটা ছাড়া আর কোন ভাবনা তার মাথায় ছিল বলে মনে হয় না।আমার অবশ্য এর বেশি কিছু দরকারও ছিল না।দরকার ছিল পরিচিত সবার কাছ থেকে পালানোর।যে অপমান আমার হয়েছিল তা মোছার সাধ্য ছিলনা,তাই পালিয়ে বাঁচাটাই ছিল একমাত্র চাওয়া।


                                 শুরু হল তার আর আমার অদ্ভুত জীবন।আমার স্বামী প্রতিদিন সকালে চুপচাপ নাশতা খেয়ে চলে যান।বিকালে ফিরে খেয়ে কিছুক্ষণ বই পড়েন,তারপর ঘুমান।রাতে টিভি তে খবর দেখে একটু পরপর আফসোস জাতীয় একটা শব্দ করেন,তারপর ঘুমিয়ে পড়েন।মোট কথা,তিনি একজন আদর্শ রোবট।বিয়ের পরদিন আমাকে বলা তার প্রথম কথা ছিল,"লাদেনকে মনে হয় সত্যিই মেরে ফেললো,বুঝলা?"আমি কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম,আর তিনি পেপার পড়ায় মন দিলেন।খাওয়া দাওয়া নিয়েও তার কোন অভিযোগ নেই।একবার ভুলে লবণ দিয়ে চা বানিয়েছিলাম।তিনি কোন রকম মুখভঙ্গির পরিবর্তন না করেই প্রতিদিনের মত চা খেয়ে কলেজ এ চলে গিয়েছিলেন।আরেকবার তার প্রচণ্ড জ্বর হল,আমি যখন বুঝতে পারলাম জিজ্ঞেস করলাম,"আমাকে বলোনি কেন যে তোমার জ্বর?"খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন,"আমার জ্বর এটা খামাখা তোমাকে বলার কি আছে?"

                                  আমার স্বামীর এই নির্লিপ্ততা যে আমার খুব খারাপ লাগত,তা না।আসলে এতেই স্বস্তি পেতাম।ভালবাসার অনুভূতি গুলো আমার অমিত এর সাথেই হারিয়ে গিয়েছিল।আমার শেষের কবিতা ওখানেই শেষ হয়ে গেছে।এত কিছুর পরও কিছুতেই ওকে ভুলতে পারতাম না।প্রতিটা দিন মনে হত হয়ত একদিন অমিত আসবে,আমাকে নিয়ে যাবে।হয়ত এখনো ভালবাসে আমাকে।মানব মন বড়ই বিচিত্র,হাজার প্রতারিত হয়েও ভালবাসার মানুষের অপেক্ষায় থাকে।ভালবাসার মানুষের হাজারো উপেক্ষা একটা ভালোবাসার কথাতেই ভুলে যাওয়া যায়।আমিও হয়ত ব্যাতিক্রম ছিলাম না.......

                                   আমার স্বামীর প্রতি ভালবাসার টান কখনও অনুভব করেছি বলেও মনে পড়েনা।তিনিও ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে যেতেন আমার সাথে কথা বলার সময়।একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,"দুপুরে কি খাবে?"তিনি ভীষণ বিব্রত হয়ে উত্তর দিলেন,"না মানে...... ইয়ে.. আসলে.. দুপুরে তো খাওয়া লাগবে....মানে আমিতো সবই খাই....মানে... ইয়ে এক গ্লাস পানি দিতে পারবে?"একদিন রাতে তাকে সরাসরি বললাম,"তুমি আমাকে বিয়ে করেছ,আমার বাবার সম্মান বাঁচিয়েছ,আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।কিন্তু আমি আর তোমার সাথে থাকতে চাচ্ছি না।আমি মুক্তি চাই।তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাচ্ছি?"আমার স্বামী শুধু মাথা নেড়ে বললেন,"বুঝেছি।"


                                  সেদিন খুব বর্ষা ছিল রাতের বেলা।সারারাত আমার স্বামী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।প্রবল বর্ষণের সাথে যে তার চোখের জল মিশে গিয়েছিল,বুঝতে পারছিলাম।অবাক হয়েছিলাম খুব।সেদিন ব্যাগ গুছাতে গিয়ে হঠাৎ কি মনে করে আমার স্বামীর আলমারির ড্রয়ার খুললাম।দেখলাম আমার হারিয়ে যাওয়া একটা কানের দুল,অনেক দিন ধরেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না।একটা কাগজ,খুলে দেখলাম বাজারের ফর্দ,আমার হাতে লেখা।আর পেলাম একটা পুরনো জমে যাওয়া নেইলপলিশ,একটা হোমিওপ্যাথি ওষুধ এর ভাঙা শিশি,একটা শেষ হয়ে যাওয়া পাউডার এর বোতল,আর একটা পুরনো ছেঁড়া গল্পের বই-আমার প্রিয় "শেষের কবিতা"।সব গুলো জিনিসই আমার..হয় ফেলে দিয়েছিলাম অথবা হারিয়ে গিয়েছিল।কিন্তু এসব জিনিস আমার স্বামীর আলমারির ড্রয়ার এ কিভাবে এল বুঝতে পারছিলাম না।পরের দিন রাতের ট্রেন ছিল।আমাকে ট্রেন এ উঠিয়ে দিয়ে আমার স্বামী চলে গেলেন।

                                     আচমকা আমার মনে পড়ল সকালে তো নাস্তা বানানোর কেউ নেই।নাস্তা না খেয়েই হয়ত কলেজ এ চলে যাবে। শার্টটা আয়রন করে দেবে কে?মানিব্যাগটা হয়ত খুঁজেই পাবেনা।কেন জানিআমার রোবট স্বামীর জন্য বুকের ভেতর উথলে উঠে কান্না পেল।যাকে এক মুহূর্তের জন্যও ভালোবাসিনি,তার চলে যাওয়াটা হঠাৎ করে আমার শূন্য পৃথিবী আরও শূন্য করে দিল।ট্রেন এর হুইসেল বাজল,একটু একটু করে আমি আমার মুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।কিন্তু ভেঙে ফেলা শেকলটা তখন কেন জানি মুক্তির চেয়েও আকাঙ্ক্ষিত লাগছিল।অনেক দিন পর আমার চোখের আগল খুলে গেল।কান্নায় ভিজে গেলাম।


                                  হঠাৎ দেখলাম দৌড়াতে দৌড়াতে আমার স্বামী ট্রেন এর কামরায় ঢুকল।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,'এই ট্রেনটা একটু বেশিই জোরে চলে,কি বল ?রাতের ট্রেন এ একা মেয়েমানুষ যাওয়া ঠিক হবেনা,তাই চলে এলাম।কালকের ক্লাসগুলো মিস হবে অবশ্য......." কথা শেষ করার আগেই আমি দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ওকে।এত কান্নাও জমে ছিল আমার চোখে!আমার রোবটও দেখি চশমা খুলে চোখ মোছার চেষ্টা করছে।আর বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।বোকা মানুষটার এক হাতে আবার বেলি ফুলের মালা!আমাকে না দিয়ে বেকুবের মত শার্ট এর পিছনে হাত নিয়ে লুকিয়ে রেখেছে।আমি বুঝলাম সব শেষের কবিতায় লাবণ্য তার ভালবাসাকে হারায় না।আমার শেষের কবিতায় হয়ত অমিত নেই,আছে এক রক্ত মাংসের রোবট।যে হৃদয় উজাড় করে ভালবাসতে পারে।কিন্তু প্রকাশ করার অস্বস্তিটুকু কাটিয়ে উঠতে পারেনা।যে হয়ত শেষের কবিতার অমিত এর মত সপ্রতিভ না,কথার জাদু দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারেনা কাউকে,কিন্তু হৃদয়ের পবিত্রতায় সে হাজার অমিত এর চেয়ে বেশি।


                             যে তার ভালোবাসার মানুষের স্পর্শ করা জিনিসগুলো আগলে রাখে,কিন্তু হাতটা ধরে ভালোবাসার স্পর্শ দিয়ে অমিত এর মত বলতে পারেনা," ভালোবাসি"।কিন্তু তাতে কি? ও না পারলেও আমি তো পারি।তাই কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,"গাধা কোথাকার! আমি তোমাকে ভালোবাসি!"মুচকি হেসে আমার হাত ধরে ও বলল,"আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছিলে কেন তাহলে?"আমি কোন উত্তর দিলাম না।আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম ওকে......



-আয়শা কাশফী
facebook id:Aysha Kashfee

No comments:

Post a Comment