Subscribe:

একজন ভালবাসাবিমুখ নারীর গল্প

নীরাকে যারা চেনে,তারা বিশ্বাস করে নীরা হচ্ছে এই শতাব্দীর নারী কুম্ভকর্ণ।একবার ঘুমাতে পারলে তাকে ডেকে তোলে সাধ্য কার?তাই যেদিন সকাল আটটায় ক্লাস থাকে,তরু খালা ভোর ৬টা থেকে ডাকা শুরু করেন নীরাকে।সাড়ে সাতটায় হয়ত চোখ মেলে নীরা,বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে আবার ঘুম।সেই কিছু একটা হল,আজ ভার্সিটি যাবনা খালা।সেই নীরাকে যদি সকাল সাতটায় নিজে নিজে উঠে ব্রেকফাস্টের জন্য ডাকাডাকি করতে শোনা যায়,সেটা ব্রেকিং নিউজ ছাড়া আর কি!তরুখালা নাস্তার প্লেট নিয়ে রুমে ঢুকে দেখেন চুল মুছছে নীরা।


‘কিরে এই সকাল বেলায় গোসল করলি যে!তোকে তো গোসলের জন্য ঘণ্টাখানিক ধাক্কাতে হয়’।

-খালা!আজকের দিনটা কি অন্য সব দিনের মত?

-কেন?আজকের স্পেশালিটি কি?

-আজ ভ্যালেন্টাইন ডে না?দীপ্তকে নিয়ে সারাদিন ঘুরব।

-আচ্ছা,এই তাহলে ঘটনা!গতকাল পহেলা ফাল্গুন গেল,শাড়ী পরাতে পারলাম না,আর আজ লাল শাড়ী!

মুখ বাঁকায় নীরা-ধুর খালা,২টা ব্যাপারকে এক করছ কেন?ভালবাসার সাথে কি কিছুর তুলনা চলে?আর তুমি বুঝবে কি করে?ভালবেসেছ কখনো?

বলেই খেয়াল করল নীরা,তরুখালা বরাবরের মতই চুপ মেরে গেলেন।এই ব্যাপারগুলো নিয়ে কথা উঠলেই খালা নীরব।খালাকে আবার চেপে ধরে নীরা।আচ্ছা খালা,কেন বিয়ে করলে না তুমি?আজ পর্যন্ত ভালবাসা,প্রেম,বিয়ে নিয়ে তোমাকে কিছু বলতে শুনিনি।কেন এড়িয়ে যাও?

-ঐযে বললি ভালবাসার আমি কি বুঝি?যেটা বুঝিই না সেটা নিয়ে বলব কি?যা নাস্তা খেয়ে বের হ।

-ওয়েট খালা।আই গেস,লাভ নিয়ে তোমার ভেতর কিছু একটা আছে।কেউ কি তোমাকে ছ্যাঁকা দিয়েছিল খালা?

-কি বকবক শুরু করলি সকালবেলা?

-খালা,প্লিজ।বলনা!ভালবাসা দিবসে তোমার ভালবাসার গল্পটা শুনি।

-আমার ভালবাসার কোন গল্প নেইরে।

-খালা প্লিজ!খাবনা কিন্তু।

-খুব ব্ল্যাকমেইল করিস তুই।আমার তেমন কোন গল্প নাই।আর যা আছে,শুনতে কিন্তু ভাল লাগবেনা তোর।তোদের মত এত এক্সপ্রেসিভ ছিলাম না আমরা।

-বলনা খালা!

কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন খালা।হয়ত গুছিয়ে নিলেন।তারপর শুরু করলেন,‘ওর নাম ছিল অরুণ।আমার ডিপার্টমেন্টেরই ছিল।দুবছরের সিনিয়র।এত হ্যান্ডসাম ছিল দেখতে যে আমরা মেয়েরা নবীনবরন অনুষ্ঠানেই দুম করে ওর প্রেমে পরে গিয়েছিলাম।কিন্তু আমি কখনোই মুখ ফুটে বলতে পারবনা জানতাম।তাই চেষ্টাও করিনি।‘

চেঁচিয়ে ওঠে নীরা।‘শিট।এত্ত ভীতু ছিলে তুমি?’

-হ্যাঁরে।কিন্তু জানিস,ওকে না দেখলে খুব অস্থির লাগতো।তাই ক্লাস না থাকলেও ভার্সিটি যেতাম।শুধু ওকে দেখতে।ও চমৎকার আবৃত্তি করত।ওদের একটা গ্রুপ ছিল।রোজ বিকেলে আড্ডা মেরে,কবিতা পড়ে আর হেঁড়ে গলায় গান করে সময় কাটাত।শুধু ওকে দেখব বলে একদিন ওই গ্রুপে জুটলাম।খুব হাসল ও,খুকি এটা কিন্তু সিনিয়র গ্রুপ।আমাদের কথাবার্তার সেন্সর নেই।আমি বললাম,তাতে আমার সুবিধাই হবে।

একটু অবাক হয়েই ও বলল,আচ্ছা!

একটা কথা জানিস তো?কাশি আর প্রেম লুকানো যায়না।আমার চোখে ও ঠিকই প্রেমটুকু দেখে ফেলেছিল।একদিন একা ডেকে বলল,এই মেয়ে যা অনুভব কর,তাকে শ্রদ্ধা করতে পারনা কেন?

মাথা নিচু করে রইলাম।বলল,বলতে না পারলে কিন্তু হারাবে।

তবু বলতে পারলাম না।মেয়েলি সংস্কার আমার গলা টিপে রইল।পরদিন ওকে দেখলাম আমারই বান্ধবী এশার সাথে হাঁটছে।বাদাম খেতে খেতে হেসে গড়িয়ে পরছে।সহ্য হলনা।ক্লাস শেষে বেড়িয়ে একা পেয়ে বললাম,আপনাকে ভালবাসি জেনেও আপনি এশাকে...কথা না শেষ করেই কেঁদে ফেললাম।ও হাসল,নইলে তোমার মুখ থেকে বের হত কথাটা?তাই প্ল্যানমত এশাকে নিয়ে...

-ওয়াও খালা।কি স্মার্ট ছিলেন উনি!

-হ্যাঁতো।ভারী পাজি।তাইতো আমাকে এভাবে ফেলে গেল।

-কি হয়েছিল খালা?উনি কি আর কাউকে ভালবেসে তোমাকে ছেড়ে গেলেন?

-ঠিক তাই।ও আমার থেকে অনেক বেশি ভালবেসেছিল দেশটাকে।বাসবে না কেন বল?মাকে কি ভাল না বেসে পারা যায়?

-মানে?উনি ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন?ওহ মাই গড!

-আমরা তখন ভালবাসায় বিভোর।হঠাৎ করেই দেশের অবস্থা খারাপ হতে লাগল।ক্লাস হতনা ঠিকমত।তাই দেখাও হতোনা।কি যে কষ্ট!আমাদের তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন ছিল না।বাসায় একটা ল্যান্ডফোন ছিল,কিন্তু বাসার মেয়েদের ফোন ধরার লাইসেন্স ছিলনা।আর একটা ছেলে ফোন করে আমাকে খুঁজলে কি হবে ভাবাই যায় না।সাহস করে ও একদিন বাসায় এসে হাজির।ভাগ্যিস বাবা ছিলেন না তখন।আমি তো ওকে চিনতেই পারছিলাম না।চোখের নিচে কালি,চুল এলোমেলো।বলল,তরু আমি যদি হঠাৎ উধাও হয়ে যাই,আমাকে ভুলে যাবে?অবাক হয়ে বললাম,উধাও হবে কেন?আর তোমাকে আমি এ জীবনে ভুলতে পারবো না।অপেক্ষায় থাকব যদি ফিরে আসো!

-তাই থেকো তরু।অন্তত যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত।আমি ফিরে আসব।তোমার জন্য।

কেঁপে উঠেছিলাম।কিন্তু ওকে না যেতে দিয়ে উপায় ছিলোনা আমার।যার বুকের মাঝে দেশপ্রেমের জোয়ার,আমার প্রেম দিয়ে তাকে বাঁধার উপায় ছিল না।মাঝে মাঝে চিঠি পাঠাতো কাউকে দিয়ে।বাবা ভয়ে আমাদের গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।ওর কোন খবর পেতাম না।কি যে ভয়াবহ দিন কেটেছে!তোদের বইগুলোতে ওই ভয়াবহতার একশভাগের একভাগও উঠে আসেনি।যাই হোক,যুদ্ধের পর ঢাকায় এসে নিজেদের বাড়িটাকে পেলাম ধ্বংসস্তূপ।বাবা বাসা ভাড়া করলেন।বসে বসে ভাবতাম ওতো এই বাসার ঠিকানা জানেনা।কিভাবে খুঁজে পাবে আমাকে?একদিন দুপুরবেলায় হঠাৎ দাঁড়িগোঁফের জঙ্গল নিয়ে এক লোক এল।ভাবছিলাম কে না কে!বড়পা এসে বলল,লোকটা নাকি আমার সাথে কথা বলতে চায়।ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সামনে গিয়ে বললাম,আমাকে খুজছেন আপনি?লোকটা হাসল,আমাকে চিনতে পারছনা তরু?আমি দীপক,অরুণের বন্ধু।

নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল আমার।দীপকদা,আপনি?কিভাবে খুঁজে পেলেন?অরুন কোথায়?এলনা?রাগ করেছে?আমি তো যোগাযোগ রাখতেই পারিনি।বাবা বাড়ি ছেড়ে গেলেন আমাদের নিয়ে...।

দীপকদা চুপ করে রইল।অন্যমনস্ক হয়ে দাড়িগোঁফের জঙ্গলে হাত চালাল।তার সেই চুপ থাকা দেখে আমার বুকটা ধক করে উঠেছিল।একটু পর,বলতে গেলে নিজের সাথে যুদ্ধ শেষে মুখ খুলল দীপকদা,

--তরু,একটা দেশ স্বাধীন করা অনেক বড় ব্যাপার।অনেকটা সন্তান জন্ম দেয়ার মত।মা যেমন দিনের পর দিন সন্তানকে গর্ভে রেখে,ত্যাগ স্বীকার করে সন্তানকে আলোর মুখ দেখান,আমরাও তেমনি এতগুলো মাস ধরে রক্ত দিয়ে,প্রিয়জনকে বিসর্জন দিয়ে দেশটাকে জন্ম দিয়েছি।এত মহৎ একটা অর্জনের জন্য যারা তাঁদের প্রিয়জনকে উৎসর্গ করেছে,তাঁরাও মুক্তিযোদ্ধা।আমি তাঁদের স্যালুট করি।তোমাকে স্যালুট তরু।

ফুঁপিয়ে উঠল নীরা।খালা একটু হাসলেন।কি পবিত্র একটা আলো ফুটে উঠেছে তার মুখে।বললেন,ধুর বোকা,কাঁদিস না।আমি কাঁদিনি,জানিস?একফোঁটাও চোখের পানি ফেলিনি।দেশকে ভালোবেসে আমার ভালবাসার মানুষটা শহীদ হয়েছে,এই গর্ব কি কম?অনেকে বলেছে,তরু,মেয়েদের তো একটা অবলম্বন লাগে,তুই একা কিভাবে থাকবি?আমি তো একা না রে।অরুণ তো আমাকে গোটা একটা দেশ দিয়ে গেছে।আমি যখন স্বাধীন দেশটায় নির্ভয়ে হাঁটি,তোদের ভালবাসা দেখি,তখন অরুণ আমার পাশেই থাকে।ও আমাকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেছে।আমি করছি।যতদিন যুদ্ধাপরাধী পিশাচগুলোর বিচার না হবে,যুদ্ধ চলবে।

নীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,আমি সরি খালা।আমাকে মাফ করে দাও।তারপর দাঁড়িয়ে বলল,তোমাকে স্যালুট খালা।খালা বুকে জড়িয়ে ধরলেন নীরাকে,যে বুকে তিনি ধরে রেখেছেন সমুদ্রগভীর ভালবাসা।

জ্ঞাতব্যঃখুব স্বাভাবিক,মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখিনি।আমার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জ্ঞান খুবই সীমিত।পাঠ্যবইয়ের আধাসত্য-আধা বানোয়াট ইতিহাস পড়ে,কিছু সিনেমা দেখে,গল্পের বই পড়ে আমি আমার মত করে মুক্তিযুদ্ধকে অনুভব করি।আমি স্বীকার করি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার যোগ্যতা হয়ত আমার নেই।তারপরও মুক্তিযুদ্ধে আরও অনেকের মত প্রিয়জনহারা তরুখালার ছবিটা আঁকতে অসুবিধা হয়নি আমার।কিন্তু আমার লেখার ক্ষমতা কল্পনার ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম।কষ্ট করে পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

আবারো স্যালুট জানাই তাঁদের,যাঁদের জন্য আজ নিজের দেশে বসে স্বাধীনভাবে লিখতে পারছি।

facebook id:Farzana Tabassum Sheela

No comments:

Post a Comment