Subscribe:

সাদা...কালো...অথবা রঙিন ছড়ি

নীল???? সবুজ??? উঁহু...... সবগুলোই কালো...... মিশমিশে কালো। তবুও গন্ধটা মনমাতানো...... অনেক সুন্দর। কতদিন এমন গন্ধ পাইনি!!! সেই যখন ছোটবেলায় গ্রামে বেড়াতে যেতাম... ছোট্ট ভাইবোন গুলোর সাথে হারিয়ে যেতাম জংলি বনে... তখন পেতাম এমন গন্ধ। কিন্তু ঐ ফুলগুলো তো এমন কালো ছিল না!!! ওগুলো যে কতও রঙিন ছিল... তা ভাবতে গেলে এখনও নেশা ধরে যায় মনে। কিন্তু এখন........................আমার জগতের শুধু ফুল কেন...... গোটা জগতটাই কালো। নীল ফুলও কালো... সবুজ ঘাসও কালো। শুধু গন্ধটা আলাদা।


"এই...... পড়ে যাবি তো!!!!! সামনে সিঁড়ি আছে।" আদির চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পাই। সাবধান হই। ওর হাতটা ধরি, সিঁড়ি পার হই। ও থাকলে কখনই আমাকে সাদা ছড়িটা নিতে দেয় না। বলে "আমি তোর ছড়ি, চলার পথে সব বাধা আমি সামাল দেব।" একবিন্দুও মিথ্যা বলেনি ছেলেটা। সাদা ছড়িটা তো পথ চলতে, পথের বাধা সামলাতেই কাজে লাগে। সে কাজ আদি সাথে থাকলে ও দিব্যি করে। অথচ একটা সময়... আমি পথ চলতে গেলে আশপাশের সব্বাইকে সাবধান থাকতে হত। দুরন্ত আমি চলার পথে কতও কি যে এলেবেলে করে দিতাম... তার কোন হিসেব ছিল না। কারো এটা ভাঙতাম, কারো ওটা। আবার কখনও লাফাতে লাফাতে নিজের ঠ্যাংও ভাঙার অবস্থা করতাম। এই আদি যে কত-শত বার স্কুলে আমার হাতে মার খেয়েছে, শুধু ওর প্রিয় নীল কলমটা আমাকে লিখতে না দেয়ার জন্য। শুধু নীল কলমটাই... এ জীবনে আমি ওর থেকে আর যা চেয়েছি, কোনোকিছুতেই ওর না ছিল না। কি এক অদ্ভুত ভালোবাসা ছিল ওর ঐ কলমটার জন্য, কে জানে???? আসল ব্যাপারটা হল... ছেলেটা নিজেই অনেক অদ্ভুত। পিচ্চিকাল থেকে এই ছেলের আরেকটা অদ্ভুত স্বভাব আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা। যখন একটু বড় হলাম, বন্ধুদের আড্ডায় ও যখন এই বদ কাজটা বারবার করতো, তখন বন্ধুরাই আমাকে কানে কানে বলত... "জানিস, ও তোকে ভালবাসে। ঐ জন্যই তো ওভাবে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে। পাত্তা দেইনি কখনই। কতও জন-ই তো তাকিয়ে থাকে... তাই বলে কি সবাই ভালবাসে??? আর সবাই বাসলেই বা কি??? আমি কি সবাইকে বাসব???? ভালোবাসা, ভাললাগার ব্যাপারগুলো কখনও খুব ভালো বুঝতাম না। তাই এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতেও যেতাম না বেশি একটা। ভেবেছিলাম... যেদিন ভালোবাসা কে অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে পারব, সেই দিন-ই কেবল ভালবাসব। তার আগে নয়।

আমি ব্যস্ত ছিলাম মা-বাবা আর আমার স্বপ্নগুলো নিয়ে। একমাত্র মেয়েকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল মা আর বাবার। তাদের মেধাবী মেয়ে একদিন অনেক বড় হবে, দুনিয়াজুড়ে নাম করবে... এই ছিল তাদের আশা। আমিও ছিলাম প্রত্যয়ী। স্কুলে ছিলাম ফার্স্ট গার্ল... বিপুল প্রতাপে অসাধারণ রেজাল্ট নিয়ে স্কুল পার করি। আদিও কম ছিল না। আমার পিছু পিছু সবসময় সেকেন্ড হত। তবে বন্ধুত্ব আমাদের কখনই নষ্ট হয়নি। মাঝে মাঝে ভাবতাম... ও কেন ফার্স্ট হয় না?? আমাকে হারতে দেখলে ওর কষ্ট হবে??? এই জন্য????? ভেবে কোন সমাধান কখনই পেতাম না। পাওয়ার চেষ্টাও করতাম না। সেই যে নিজের স্বপ্ন গুলো এক সুতায় গাঁথতে ব্যস্ত ছিলাম... নিজের জীবনটা সুন্দর করার চিন্তায় মগ্ন ছিলাম...আমার সময় কোথায় ছিল... অন্য কিছু নিয়ে ভাবার????

কলেজে উঠেও আমার রেজাল্ট ভালো হতেই থাকে। উচ্ছ্বসিত ছিলাম নিজেকে নিয়ে। বন্ধুরাও সবসময় উৎসাহ দিত আরও ভালো করার জন্য। আমাকে ঘিরেই আড্ডা বসতো... বন্ধুরা যেন মধ্যমণি করে রাখত আমায়। আর ঐ আদি............ সে তার অভ্যাস একটুও বদলাতে পারে না। একই কলেজে ছিলাম... সে আড্ডার মাঝেও আড়চোখে আমাকেই দেখত... আর আমি ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওকে মারতাম... অনেক মারতাম। কিল-ঘুসি, চড়-থাপ্পর ছিল আমার পক্ষ থেকে ওর জন্য নিত্য উপহার।

অনেক আনন্দের ছিল সেই দিনগুলো... রঙে রঙিন... উচ্ছলতায় ভরপুর। হঠাৎ একদিন........................ সব রঙ যেন এক নিমিষে ছাই হয়ে গেল।

কেমিস্ট্রি ল্যাবে ছিলাম সেই দিন। ল্যাবে আমি বরাবর-ই দ্রুত কাজ করতাম। এই জন্য টিচারদের কাছে বকাও খেতাম। যদি অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যায়... এই ভয়ে উনারা বকা দিতেন খুব। কিন্তু আমি তো কারো কথা শোনার পাত্রী নই। সবসময় দুরন্তপনা করতে করতেই এই হাল। সেই দিন ল্যাবেও অনেক দ্রুত কাজ করছিলাম। এসিড দরকার পড়ল। খুঁজতে খুঁজতে দেখি ওটা অনেক ওপরের তাকে। বোতলটা টান দিতে গিয়ে ওটার আলতো করে লাগানো মুখটা খুলে গেল। অনেক এসিড এসে পড়ল...... একদম আমার চোখে...... যন্ত্রণায় কাতরে উঠলাম। তারপর........................

সেইদিনের পর থেকে আমার পৃথিবীটা অন্ধকার। নিকষ কালো আঁধার। মানতে পারতাম না আমি। বারবার চিৎকার করে উঠতাম... কান্নায় ভেঙে পড়তাম। স্বপ্নগুলো ফিকে হতে থাকে। আর হয়তো কখনও পড়াশুনা হবে না... এই ভেবে বেদনায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হতাম। মা- বাবারও সামর্থ্য ছিল না আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার। তারা তো নিজেরাই শোকে মুহ্যমান। মা সারাদিন কাঁদত। আমার থেকে লুকিয়ে... তবু আমি বুঝতাম। অনেক ডাক্তার দেখান হল। কেউ-ই আশা দিতে পারলেন না আবার আমার চোখে আলো ফিরিয়ে দেয়ার। প্রথম প্রথম অনেকে দেখতে আসতো। সাহস দিত। আস্তে আস্তে সবার আসা কমে যেতে লাগল। বন্ধুরা ফোনেও খোঁজ নেয়া কমিয়ে দিল। এক জন শুধু প্রতিদিন দেখতে আসতো। নিজের হাতে আমার অনেক কাজ করে দিত। সে আদি। আমার হাতে শত মার খাওয়া... সেই শান্ত চুপচাপ আদি। আমার অন্ধকার পৃথিবীতে আমি ওকে নতুন করে আবিষ্কার করি। ছেলেটা তার নিজের অসাধারণ মানসিক দৃঢ়তা আমার মাঝেও গেঁথে দিতে লাগল। স্বাপ্নিক আমি যখন ভুলতে বসেছিলাম স্বপ্ন দেখতে... ও আবার আমাকে তখন স্বপ্নের দেশে পথা চলাতে শুরু করল। ওর আগ্রহে ব্রেইল শেখার সূচনা। ও নিজে কলেজের পাট চুকাল... ওর চেষ্টায় এক বছর পর আমিও পাশ করলাম। ততদিনে ও নামকরা এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম...এত সাহস, অনুপ্রেরণা সব ওর থেকেই পাওয়া। শুধু আমার স্বপ্নগুলোই নয়... ওর হাত ধরে আমি নতুন করে পৃথিবীকেও আবিষ্কার করতে শুরু করি। আমার আঁধার কালো একলা মুহূর্তগুলো ও রঙে ভরিয়ে দিতে থাকে। বইয়ের মাঝে মুখ গুঁজে থেকে থেকে আমার আজীবন যে জগত কে দেখা হয় নি... ও আমাকে সেই জগতে নিয়ে যায়। প্রতিদিন নতুন নতুন এক গাদা সিডি নিয়ে আসতো... সুন্দর সুন্দর গানের সিডি। যে গান জীবনের কথা বলে... ভোঁতা অনুভূতি গুলো নতুন করে জাগাতে শেখায়। আমি শুনি আর ভাবি... চিন্তার জগত কি আসলেও এতটা বিস্তৃত হয়??? কেমন করে এত সুন্দর গানগুলো ভাষা পায়... সুর পায়???? আস্তে আস্তে মিউজিক আমার শিরায় শিরায় ঢুকে যেতে শুরু করে...আমার নিত্যদিনের অসাধারণ সঙ্গী হয়ে যায় নানা দেশের নানান রকমের মিউজিক।

চোখদুটো আমার চিরকালের জন্য নীরব হয়ে গেলেও শুধুমাত্র আদির কারণে হতাশা আমাকে একবিন্দুও ছুঁতে পারেনি। মনের চোখ দিয়ে ও আমাকে দেখতে শেখায়। এখন আমি গন্ধ দিয়ে... অনুভূতি দিয়ে অনেক কিছু উপলব্ধি করতে পারি। অনেক উপলব্ধির মাঝে সবচেয়ে বেশি করে অনুভব করি, আদির ভালোবাসার শুদ্ধতা। সেই শুদ্ধতার জোরেই স্কুলে আমার অকারণ আইসক্রিম এর আবদার মেটাত, হুট করে hang-out এর প্রস্তাবও মেনে নিত, মাঝরাতে ফোন করে অঙ্ক বুঝতে বললে নির্দ্বিধায় গভীর আগ্রহ ভরে ঘণ্টা খানেক ধরে অঙ্ক বুঝাতো, খুব সকালে আমার হাঁটতে যেতে ইচ্ছে করলে ওকে ফোন করে বললেই রাজি হয়ে যেত, তাতে ওর যত কষ্ট-ই হোক না কেন। এখন যখন ভাবি... আমার চোখ অজান্তেই ভিজে ওঠে। কেন তখন বুঝতে পারিনি... কেন তখন ভালোবাসার মুগ্ধতা আমাকে ছুঁয়ে যায়নি?? কেন এত বোকা ছিলাম আমি???? এইভাবে স্বর্গীয় এক অনুভুতিকে কিসের মায়ায় পায়ে ঠেলেছিলাম??? নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগতে থাকে... কারণ এই আকাশের মতো বিশাল মনওয়ালা কাব্যিক আর অদ্ভুত ছেলেটাকে আমিও যে ভীষণ ভালবাসি... সেই সত্যিটাও আমাকে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে। এখন ওকে বললে ও যদি ভাবে অসহায় আমি এখন ওর কাছে আশ্রয় চাই বলেই স্বার্থপরের মতো এখন ভালবাসার কথা বলছি!!!!! ও যদি না বোঝে যে আমি ওর ভালবাসাকে ভালবেসেই ওর ভালোবাসার পথের সঙ্গী হতে চাই!!!  আর ও নিজেও যে কখনও মুখ ফুটে বলেনি ভালোবাসার কথা! আমি কিভাবে বলি??? পচা ছেলেটা এইবারও আমার প্রবলেম সলভ করে ফেলে। হুট করে একদিন একটা আংটি পরিয়ে দেয় আমার বাম হাতের অনামিকায়। আস্তে করে বলে... "বিয়ে করবি আমাকে???" আমি লজ্জায় লাল হই... ভাবি কি করে বুঝল ছেলেটা???? আমি শক্ত করে ওর হাতটা ধরি... বলি... "সত্যি-ই সারাজীবন আমার সাদা ছড়ি হয়ে থাকবি তো????" ও কিছু বলে না... কিন্তু আমি বেশ বুঝতে পারি ওর চোখ জলে ভরে গেছে...সেই জলে চিরটা কাল আমার সাদা,কালো... অথবা রঙিন ছড়ি হয়ে থাকার মৌন সম্মতি।

-নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

No comments:

Post a Comment