Subscribe:

"গতি"

এখনো ৪ দিন বাকি । অনেক কষ্টে মনে হলো যেহেতু সকালে প্রথম আলোর নকশা পড়েছিলাম, সেহতু আজ মঙ্গল বার । তার মানে আজ ১০ ফেব্রুয়ারী । অথচ টাকা টা জমা দেয়ার কথা, মানে লাস্ট ডেট হলো ১৫ ফেব্রুয়ারী । ১৪ তারিখের মধ্যে টাকা টা ম্যানেজ না হলে... নাহ ব্যাবস্থা একটা হবেই । অন্য কিছু চিন্তা করতে রাজী নয় সুমন । এই সুযোগ কিছুতেই হাত ছাড়া হতে দিবেনা সে । চাকরি নামক ‘হাতের মোয়া’ অদৃশ্যই রয়ে গেল তার কাছে । বছর দুয়েক আগে ভেঙ্গে যাওয়া বসন্তের ইস্যু ও সেই চাকুরি । টিউশনি করে প্রেম করা যায় সংসার তো করা যায়না ।


দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুমন । দুই বছরের গদগদে ঘা টা মনের অজান্তেই শুকিয়ে যাচ্ছিলো অনিমার জন্যে । কিন্তু অনিমাকে বিন্দু মাত্র বুঝতে দেয়নি সে । পড়াশুনার বাইরে কোন প্রসঙ্গই তুলতনা সে । অন্যথায় হয়তো লজ্জায় পড়তে হতো আবার টিউশনিটাও হারাতে হতো ! যদিও সে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করতো অনিমা অ্যাবসেন্ট মাইন্ডেড ... বিষয়টা সে এড়িয়ে চলতো । যার পায়ের নিচে মাটি নাই তার এমন আশা করাটাও বুঝি পাপ । অন্তত তার মতন চালচুলোহীন একটা ছেলের জন্যে .... সারাজীবন বন্ধুদের কাছ থেকে ‘কেলাস’ শব্দটি শুনেই অভ্যস্ত সে । কিন্তু সবাই তাকে পছন্দ করে তার মনের অদ্ভুত সরলতার জন্যে ।

থাক সে কথা, দীর্ঘশ্বাস... কেমন জানি চিনচিনে কষ্ট হল যখন গত সপ্তাহে ওদের আমি জানালাম যে আমি আর পড়াতে যাচ্ছি না...  অবশ্য এমনিতেই খুব বেশিদিন পড়ানো হতোনা । সামনে ওর এইচ.এস. সি. পরীক্ষা । এখন শুধু মডেল টেস্ট দেওয়ার জন্যে একটি কোচিং এ ভর্তি হয়েছে সে । তবুও ঢাকাতে থাকলে আরও কিছুদিন গাইড লাইন দিতে,সেই সাথে কাছ থেকে দেখতেও পারতো আর কি... দেখতে দেখতে প্রায় বছর দুয়েক হয়ে গেলো এই বাড়িতে যাওয়া আসার ।  অনিমার প্রতি চরম দুর্বলতা ছাড়া ও এই পরিবারের সাথেও একটা অদৃশ্য সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো । কিন্তু তাদের কি কোন অনুভুতি আছে এ ব্যাপারে? না থাকার ই কথা । বেশী ধনীদের নাকি এমনিতেই অনুভুতি একটু কম থাকে! অনিমাও কি তাকে একটুও মিস করবেনা? কিছুটা আনমনা সুমন...


নাহ কোন রোমান্স নয়। তার টাকা চাই,টাকা ! ভাগ্যের কম্পাসটা এবার তার দিকেই ঘুরছে বলে মনে হচ্ছে। নইলে কবেকার সেই নেংটু কালের বন্ধু সেলিমের সাথেই বা দেখা হবে কেন ! কত অন্তরঙ্গ বন্ধু ই না ছিল ওরা। কিন্তু বাবার ট্রান্সফার আর ঠিকানা হারিয়ে ফেলার পর  কালের পরিক্রমায় আর যোগাযোগের চেষ্টাও করা হয়ে ওঠেনি । চিটাগাং এক্সপোর্ট- ইমপোর্ট এর একটা ভাল পোস্টে আছে সে। অফিসের কাজেই ঢাকা এসেছিল সেলিম । তারপর একুশে বইমেলা শুরু হয়েছে খেয়াল হওয়ায় বইমেলায় ঢুঁ মারতে গিয়ে এসেছিল সেবা প্রকাশনীর স্টলে ।

এক সময় ওরা দুজন ‘মাসুদ রানা’ আর ‘তিন গোয়েন্দা’র কোন বই ই বাদ রাখত না। সেই ‘সেবা’র স্টলে গিয়েই আচমকা সাক্ষাত ! সেই ‘সেলু’ স্যুটেড বুটেড সাহেব ! অনেক কথা বার্তার পর পাকা কথা হল সব কিছু ঠিক থাকলে এই ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ থেকেই তার সহকর্মী হতে পারবে সুমন। কিন্তু তার জন্যে কিছু ঝামেলা পোহাতে হবে আর কি ! খালি হওয়া পোস্ট টা ইতোমধ্যে কাকে যেন প্রায় সিলেক্ট করে ফেলছে। এই ঝামেলা দুর করতে কমসে কম হাজার পঞ্চাশেক টাকা লাগবে! সেলিম নিজেই বলেছে ও হাজার বিশেক টাকা ধার দিতে পারবে... সাথে এও বলে দিলো,“তুই হাজার তিরশেক ম্যানেজ কর”। এত অল্প সময়ে এই টাকা ম্যানেজ করাও যে কঠিন হবে লজ্জায় তা আর বলতে পারেনি সুমন।

বাসায় একটা ফোন করেই সব সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারে সে... কিন্তু মা মারা যাবার পর বাবার ২য় বিয়ের কারণে বাবার প্রতি উপেক্ষা আর ঘৃণায় কোন সাহায্যও নেয়না সে। তার দীর্ঘ মেস জীবনের ইতিহাসের কারণ ও এটিই। এর আগে ভাল একটা চাকুরি পেয়েছিল সে। কিন্তু সে অফিসের বস যে তার বাবার বন্ধু এটা জানতে পেরে সন্দেহের গন্ধে সরে পড়ে সে তখুনি!


১৩ ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার। মেসের বারান্দায় পায়চারীরত। তার কারনে বারান্দাটা ফুতপাতে পরিনত হয়েছে যেন! মাথার মধ্যে কয়েকটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। চাকুরি, টাকা, অনিমা আর মেসের জিনিসপত্র। অনিমার বাবা-মা সপ্তাহ খানেক হল সিলেটে গেছেন বেড়াতে। কাল আসবেন। যার কারনে ওখানকার টাকাটা এখনও বেধে আছে। গত দুমাসের টাকা পেলে ব্যাংকের গচ্ছিত কিছু টাকা সহ হাজার ছাব্বিশেক টাকা নিয়েই কাল রাতে রওনা দিবে চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে। মেসের জিনিসপত্রের কোন সুরাহা হলনা । তার রুমমেট গেছে চারুকলা ফাল্গুনী উৎসবে। রুমের জিনিসপত্র নিয়ে কথা বলতে হবে।

এদিকে বাড়িওয়ালার সাথেও একটু ঝামেলা হচ্ছে। মেস ছাড়ার এক মাস আগে জানানোর কথা ছিল । এখানেও একটু ছাড় দিতে হচ্ছে আর কি ! পায়চারী করতে করতেই পকেটের শেষ সিগারেটটা শুরু করে সে । “নাহ! যাচ্ছি তো যাচ্ছি-ই! সরাসরই বলবো তাকে!” আবার একটু পিছু হটে সে। “ নাকি তার জন্যে কোন ডায়েরীতেই লিখে দেব...উমম ম... নাকি মোবাইলে ম্যাসেজ পাঠাবো...!” তার কাছে অনিমার মোবাইল নাম্বার থাকলেও কখনই ফোন করা হয়নি।  আসলে ইচ্ছে করেই করেনি । অনিমা পড়তে না চাইলে ফোন দিত। আর প্রয়োজন হলে বাসার ল্যান্ডফোনেই কল করতো সুমন। তখন তো আর এমন চিন্তাভাবনা ছিলনা ! “হাহহা !” আপন মনেই হেসে ওঠে সে। পরক্ষনেই আবার ভাবে, নাহ কোন ডকুমেন্ট রাখা ঠিক হবেনা । তাকে সরাসরি-ই বলবে। তবুও তার জন্যে সযত্নে লেখা ম্যাসেজটি সেভ করে রাখে সে। সে তার মুখ থেকেই শুনতে চায় কেন সে মাঝে মাঝেই এতো আনমনা হয়ে যেত... কেনই বা সে অসুস্থ থাকলেও পড়াতে আসতে বলতো...


১৪তারিখ বিকেল। পত্রিকা না পড়লে তার খেয়ালই হতনা যে আজ ভ্যালেন্টাইনস ডে! ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলা! অনিমার জন্যে একটি ডায়েরী আর জ্যাকেটের পকেটে সযত্নে লুকানো ইয়া বড় একটি গোলাপ । অনিমাদের বাসায় গিয়ে পৌঁছালো বিকেল সাড়ে চারটার দিকে। মনে মনে অনিমাকে খুঁজছে সে। ড্রয়িং রুমে কিছুক্ষন বসতেই আংকেল আসলেন।

-      স্লামালেকুম! আংকেল ভাল আছেন?

-      ওয়ালাইকুমসালাম। এইতো চলছে আরকি ! তা তোমার খবর কী?

-      জী আংকেল ভালো । এই মাসের শেষের চিটাগাং এর একটা কোম্পানিতে ভালো একটি জব পেতে যাচ্ছি ইনশাল্লাহ। আজ একটু পরেই ট্রেনে রওনা হবো।

-      ভালো,খুব ভালো ! তাহলেতো তোমার হাতে বেশী সময় নেই । আমিও এখন একটু বাইরে যাব ! তোমাকে তো কখনও-ই কিছু দেওয়া হয়না । এই নাও, গত দুমাসের বেতন আর হাজার পাঁচেক টাকা আছে। ভালো দেখে জামাকাপড় কিনে নিও । আহ, লজ্জা করোনা, নাও বলছি!


সাদা খামটা নেয় সুমন লজ্জিত ও কিছুটা কম্পিত হাতে। ধন্যবাদ দিতেও ভুলে যায় সে !

-      আংকেল ইয়ে মানে অনিমাদের তো দেখছিনা...!

-      আর বলোনা ! আজ ও কলেজে গেছিলো সকালে, কী জানি কী প্রোগ্রাম ছিল ভালবাসা দিবস উপলক্ষে ! মোবাইলটা হারিয়ে এসেছে ! আমি একটু বকা দিতেই মুখ টুখ কালো করে নাওয়া খাওয়া বন্ধ ! তাই ওর মা জোর করে ওকে মার্কেটে নিয়ে গেছে মোবাইল কিনে দিতে।

-      ওহ আচ্ছা! (একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরোয় মুখ দিয়ে)। আংকেল অনিমার জন্যে এই ডায়েরী টা...

-      থ্যাংকস ! ওহ ভালো কথা উইদিন নেক্সট উইক আমরা বাসা চেঞ্জ করছি । দেখছনা কেমন অগোছালো ? কাল থেকেই কাজ শুরু করব। যাই হোক এরপর ঢাকা আসলে আমার মোবাইল এ ফোন দিয়ে বাসায় এসো...

“অনিমা নতুন নাম্বার নিচ্ছে, আর টি.এন্ড. টি তেও পাবনা !” মাথাটা ঘুরে ওঠে সুমনের।


ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সুমন। অন্য প্লাটফরমের এক বাচ্চার দৌড়াদৌড়ি দেখছে সে। কিছুটা অন্যমনস্ক। পকেটের গোলাপ টা বের করে শিশুটির দিকে ছুড়ে মারলো সে । শিশুটি অবাক হয়ে ফুলটির দিকে তাকিয়ে থাকে ! জীবনের অনেক কিছুই না বলা থেকে যায়...!

ট্রেনের গতির কাছে হারিয়ে গেল শিশুটি । জীবনের গতির কাছেও হয়তো একসময় হারিয়ে যাবে অনিমা...!   



-নীরব কবি
Facebook Id : Nirob Kobi

No comments:

Post a Comment