Subscribe:

আজো বৃষ্টি ঝরে

পাঁচটাকা ছিল আমার প্রতিদিনের বরাদ্দ। বাসা থেকে বেশ ভালভাবে বলে দেওয়া হত দুটি কথা- ক্যান্টিন থেকে বার্গার কিনে খাস আর আচার-টাচার খাবি না খবরদার। কিন্তু আমি তখন বেশ হিসাব জানি। একদিন পরপর অ্যাশ কালারের স্কুল প্যান্টের পকেটে দশ টাকা জমে। ক্লাসে ঢোকার আগেই জমানো টাকা দিয়ে এক প্যাকেট ম্যারিডিয়ান কিনতাম। চিপসটা খেতে খুব যে মজা ছিল তাও না। কিন্তু প্যাকেটের ভিতর রুদ্ধশ্বাসে হাত ঢুকাতাম নতুন কোন "ট্যাজো" পাবো তার মীমাংসায়। সতের হাজার পাঁচশ পয়েন্টের টারজান পেয়ে ভুলে যেতাম দিবা ম্যাডামের জন্য মুখস্ত করে আসা "সুখ" কবিতার প্রথম লাইন। ক্লাস চলছে; মাঝে মধ্যেই হাত পকেটে চলে যেত। স্পর্শ করে নিশ্চিত হতাম যে সবকিছু ঠিক আছে।


একসময় ট্যাজোর জায়গা দখল করল চাচা চৌধুরী-সাবু-বিল্লু-পিঙ্কিরা। এরপর লারা-ল্যান্স ক্লুজনারদের পোস্টারে ঘর ছেয়ে ফেলা। এককোনায় জ্বলজ্বল করত রানী-প্রীতি। এরপর আসে সেবা প্রকাশনীর যুগ। অনুবাদ-তিন গোয়েন্দা-কিশোর হরর। একটু বড় হয়ে মাসুদ রানা কিংবা অঞ্জন দত্তের "পারবোনা হতে আমি রোমিও/ তাই দুপুর বেলাতে ঘুমিও/ আসতে হবে না আর বারান্দায়।"

কিন্তু একদিন দত্তদার কথাকে ভুল প্রমান করে রোমিও হয়ে গেলাম। জুলিয়েটকে দেখে বুঝলাম আমিই রোমিও। যদিও তাকে একথা বলা হয় নি। কতকিছুইতো ছিল বলার মত। বলতে চেয়েছিলাম প্রতিদিন স্কুলে যাও না কেন?? এত ফাঁকিবাজ হলে চলে? বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় একটু আস্তে হেঁটো। স্কুলে বেণী করে যেতে হবে কেন?? বারান্দায় কি আরো বেশিক্ষন থাকা যায় না? নতুন স্কুল ড্রেসটার গলার কাটটা বেশি বড়। ল্যান্ডফোনটা তোমার রুমে থাকলে কি ক্ষতি। সত্যি বলছি তোমাকে বিরক্ত করবো না। শুধু "হ্যালো" শুনেই ফোন রেখে দিব। চোখে শুধু শুধু কাজল দিও না। ওতে তোমার চোখের অপমান। ছোট টিপ; হালকা রঙ। বলা হয় নি গোলাপী রঙের জামাটায় তোমাকে ভাল্লাগে না। সাদা ফুটকিওয়ালা নীল জামাটা। এমনি আরো কত কি!!

মাথার উপর সুর্য থাকতে থাকতেই ছাদে চলে যেতাম। যদি তাকে দেখা যায়। কখনো-সখনো চোখাচোখি হত। ফলাফল আমার গোটা তিন-চার হার্টবিট মিস। আমিতো চেয়েছিলাম সারাজীবনই যেন আমার হার্টবিট থেমে থাকে। চেয়েছিলামতো অনেক কিছুই। স্কুলের দারোয়ান থেকে শুরু করে তোমার প্রাইভেট টিউটর- হতে চেয়েছিলাম। বিকেলবেলা ছেলেরা বাসার সামনে শর্টপিচ ক্রিকেট খেলত। আমিও খেলতাম। খেলতাম না বলে দাঁড়িয়ে থাকতাম বললেই ভালো হয়। কোন এক জানালা দিয়ে একটি মুখ দেখব- এই আশায়।

আমি কিন্তু তোমাকে বলতেই চেয়েছিলাম। জানতে চাইতাম আমার জুলিয়েট হবে কিনা। কতদিন বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রিহার্সেল করেছি তা ঐ আয়না সাক্ষী। রিহার্সেলে কখনো আমার হাত ধরতে, কখনোবা "না" বলতে, আবার কখনো......না থাক, এইটা না বলি। তোমাকে দেব বলে একটা "সামওয়ান স্পেশাল" কার্ডও কেনা হয়েছিল। কার্ডটা এখনও আছে ড্রয়ারের ভেতর। ড্রয়ারে আরো আছে একটা রাবার। একদিন তুমি স্কুলে যাবার সময় ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল কিভাবে জানি। একটুপর আশেপাশে তাকিয়ে টুক করে তুলে পকেটে চালান করে দিয়েছিলাম।

-আজকে বিকালে বাসায় থাকিস।
-কেন?
-তোকে নিয়ে একটু হাসপাতাল যাবো।
-তোমার কি শরীর খারাপ?
-না। পাশের বিল্ডিং-এর একটা মেয়ে আছে না- তোদের স্কুলেইতো পড়ে। চিনিস না??
বুঝলাম কার কথা বলা হচ্ছে। সারা বাড়ি থর থর করে কেঁপে উঠল।
-হু।
-ওতো হাসপাতালে অ্যাডমিট।
-কি হয়েছে??
গলার স্বর কাঁপছে। চেষ্টা করছিলাম স্বাভাবিক থাকতে।
-হেপাটাইটিস-বি। খুব খারাপ অবস্থা। যাবি আমার সাথে?
তখন মনে হচ্ছিল আমি তিরিশ তলা থেকে লাফ দিয়েছি। বুকটা খলি খালি লাগছিল খুব। অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুধু বললাম "যাব"। চোখ জ্বালাপোড়া করছিলো । জলদি গিয়ে মুখে পানি ছিটালাম।

আমার আর আম্মুর সাথে হাসপাতাল যাওয়া হয় নি। তার আগেই কি একটা ফোন আসল। আম্মু আমাকে বলল যাওয়া লাগবে না। একাই যাবে সে। কেন জানি গলা কাঁপছিল তার। আমিও আর জানতে চাই নি কেন যাওয়া লাগবে না। শুধু...শুধু আম্মু যাওয়ার পর খালি বাসায় চিৎকার করে কেঁদেছিলাম।

মাঝে মাঝে কার্ডটা খুলে দেখি। রাবারটা ছুঁয়ে দেখি। আর বৃষ্টি ঝরাই। যেখনেই থাক অনেক ভাল থাক। দেহের জুলিয়েট নাইবা হলে; আত্নার জুলিয়েট হয়ে থাক।
-Imran Niloy

No comments:

Post a Comment