Subscribe:

রাতজাগা তারা

"গিফট হিসেবে আনারস নিয়ে আসছেন?আপনি কি মানসিক প্রতিবন্ধী? "
 "কেন?মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া কি কেউ আনারস কেনে না?"-সাইফ খুব সহজ সরল মুখ করে উত্তর দিল।
রোদেলা কিছু না বলে গটগট করে ভিতরে চলে গেল ।

সাইফকে গলাধাক্কা দিয়ে বাসা থেকে বের করে দিতে ইচ্ছা করছে তার।সাইফ রোদেলার বাবার বন্ধুর ছেলে।মেডিকেল থার্ড ইয়ার এ পড়ে।রোদেলার ধারণা তাকে গাধা বললে গাধাও মানহানির মামলা করে দেবে।দুই সপ্তাহ ধরে সাইফ রোদেলাকে ফিজিক্‌স পড়ায়।রোদেলা সাইফকে প্রথম দিন জিজ্ঞেস করেছিল,"মেডিকেল এ পড়ে ফিজিক্‌স পড়াইতে আসছেন কেন? আপনার তো বায়োলজি ভালো পারার কথা"
সাইফ উত্তর দিয়েছিল,"কি করব, তোমার তো ফিজিক্‌স টিচার দরকার ছিল!"


 মেয়েদের ছেলেদের মন বোঝার অসাধারণ ক্ষমতা থাকে। রোদেলার এই ক্ষমতা একটু বেশিই আছে।সাইফ নামের এই বোকা ছেলেটা যে তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে সেটাও রোদেলা খুব ভালো বুঝতে পারে। সমস্যা হল সাইফ মুখে কিছুই বলে না।সে তার ভালোবাসা বুঝানোর জন্য অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে।সেই কর্মকাণ্ডর একটা অংশ হল রোদেলার জন্মদিনে গিফট হিসেবে আনারস নিয়ে আসা।

 পরের দিন রোদেলাকে পড়াতে গিয়ে আরেকবার ধসে গেল সাইফ। এমনিতেই গতকালের ঘটনার জন্য সে অসম্ভব ভয়ে ভয়ে ছিল।অলরেডি ৩ বার দোয়া ইউনুস পরেছে। ড্রইং রুমে ঢুকে রোদেলা সাইফকে দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়ালো।তারপর জিজ্ঞেস করল,"সাইফ ভাই, আপনি কি কালার ব্লাইনড?"
"কি যে বল, মেডিক্যাল ভর্তির সময় তো কালার ব্লাইনড টেস্ট হয়!"

"কালার ব্লাইনড না হলে আপনি এই কটকটে সবুজ রঙের শার্ট কিভাবে কিনলেন?আমাকে তো ফ্রী দিলেও আমি নিতাম না।"

সাইফ পুরোপুরি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।রোদেলা বলল,"আপনি এই মুহূর্তে আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হন।এক থেকে পাঁচ গুনব,এর মধ্যে যেন আপনাকে বাসার বাইরে দেখি।"সাইফ করুণ স্বরে বলল ,"নিউটনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সূত্রটা বুঝিয়ে দিয়ে তারপর না হয় যাই।"

"আপনি বলদের মত কাজ করেছেন এটা হল ক্রিয়া।আর আমি আপনাকে বাসা থেকে বের করে দিচ্ছি এটা হল প্রতিক্রিয়া।নিউটনের সূত্র আমি আপনার চেয়েও ভালো বুঝেছি।"
সাইফ বলল,"তুমি এত রাগ করছ কেন?"
রোদেলা হুংকার দিল," এক......."
সাইফ বলল," বেশির ভাগ হার্ট অ্যাটাকের কারণ কিন্তু উত্তেজিত হওয়া।বেশি উত্তেজিত হলে ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়।ব্রেনে অ্যাড্রেনালিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।তারপর............."

রোদেলার গলার স্বর আরও উঁচু হল,"দুই................"

সাইফ হতাশ চোখে দরজার দিকে এগুলো।একবার পিছু ফিরে তাকাল, যদি রূপসীর রাগ কমে...
তাকে পিছু ফিরতে দেখে রোদেলা এবার মুখ লাল করে আরও তীব্র গলায় বলল,"তিন..........."
 কলাপসিবল গেটের কাছে গিয়ে সাইফ রোদেলার ডাক শুনল,"এই যে বেকুব লোক!"

গালভর্তি হাসি নিয়ে পিছু ফিরল সাইফ।রোদেলা মেয়েটার রাগ একটু বেশি,কিন্তু মনটা বড্ড নরম!সুন্দরীদের অনেক বড়সড় দোষও রূপের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়।আর এই সামান্য রাগ একটা ব্যাপার হল নাকি?
রোদেলা বলল,"আপনাকে বসতে বলার জন্য ডাকিনি।সুতরাং বোকার মত দাঁত দেখানো বন্ধ করেন।টেবিলের উপর থেকে আপনার মান্ধাতার আমলের মোবাইলটা নিয়ে যান দয়া করে।"

এই দজ্জাল মেয়ের প্রেমে সে যে কিভাবে পড়লো, তাও এক রহস্য ।প্রথম দিন রোদেলাকে দেখার পর তার শুধু একটা কথাই মনে এসেছিলো,"পাইলাম,আমি উহারে পাইলাম!"

 কতদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোচিঙের সামনে দাঁড়িয়ে থেকেছে শুধু এক পলক রোদেলাকে দেখার জন্য ।ওকে দেখা মাত্র নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেত সাইফের।একদিন সে কোচিঙের সামনে সাইকেল এর উপর থেকে উল্টে পরে গিয়েছিল।তাই দেখে রোদেলার সে কি হাসি!একসাথে অনেক গুলো কাঁচের চুড়ি টুংটুং করলে যেমন শব্দ হয়,অবিকল তেমন হাসি!ওই হাসি দেখে সাইফের ছোটখাটো একটা স্ট্রোক হয়ে গিয়েছিল প্রায়।সারারাত ঘুমাতে পারেনি।সেদিনই সে ঠিক করেছিলো, বিয়ের পর প্রতিদিন রোদেলার সামনে একবার করে সাইকেল থেকে পড়ে যাবে।একদিন রোদেলা কোচিং থেকে বের হয়ে সরাসরি সাইফের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাইফের মনে হল তার হৃৎপিণ্ডটা হঠাৎ থেমে গেছে।একবার ভাবল উল্টো দিকে ঝেড়ে একটা দৌড় দেবে।দৌড় দিতে গিয়ে দেখল পা নাড়াতে পারছে না। রোদেলা কোন রকম ভূমিকা না করেই বলল,
" আপনি রোজ আমার কোচিঙের সামনে হাবলার মত দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?"

সাইফ ঘামতে ঘামতে উত্তর দিল,"না মানে,এই রাস্তাটায় খুব হাওয়া।ফ্রেশ বাতাস আবার ফুসফুসের জন্য খুবই উপকারী।"
"পুরো ঢাকা শহরে শুধু আমার কোচিঙের সামনেই ফ্রেশ বাতাস?"
সাইফ সেদিন কোনমতে পালিয়ে বেঁচেছিল।তার কিছুদিন পর রোদেলার বাবা সাইফকে বললেন,"আমার মেয়েটা একদম উচ্ছন্নে গেছে বুঝলে বাবা?সারাদিন কি সব হিন্দি সিরিয়াল দেখে আর ফেসবুক নিয়ে বসে থাকে।প্রিটেস্টে ফিজিক্‌স এ পেয়েছে ৪১। তুমি একটু ওকে প্রতিদিন ফিজিক্‌সটা দেখিয়ে দিও বাবা।"

এই হল রোদেলাকে পড়াতে আসার ইতিহাস।

 রোদেলা আজকে অনেক যত্ন করে চোখে কাজল দিয়েছে।মার কাছ থেকে নিয়ে সবুজ রঙের একটা শাড়ী পরেছে।গাধা সাইফ আজকে দেরী করছে কেন এত?প্রতিদিন পারলে সময়ের পনেরো মিনিট আগে আসে।আর আজকে রোদেলা এত সময় ধরে সাজল,সে কোন রাজকার্য করছে যে এত দেরি হচ্ছে?সাইফকে এই অপরাধের শাস্তি হিসেবে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা উচিৎ।সাইফকে দিয়ে যে কিছুই হবেনা, এটা রোদেলা বেশ ভাল বুঝতে পেরেছে।তাই সে যুগান্তকারী একটা সিদ্ধান্ত নিল।সাইফকে একটা চিঠি লিখে ফেললো,

সাইফ  ভাই,
আপনি এত নির্বোধ কেন?আপনার মুখে কি পারাল্যাইসিস যে এতদিনেও আমাকে কিছু বলতে পারলেন না?আমাকে এত ভয় পান কেন আপনি?আমি ধমক দিলেইআমার কোচিঙের                সামনে আসা বন্ধ করে দিতে হবে?আপনার মাথায় কি আল্লাহ এক ছটাক বুদ্ধিও দেয় নাই?জানেন,আমার প্রিয় রঙ এখন সবুজ।আচ্ছা সাইফ ভাই,এক কাজ করলে কেমন হয় বলেন তো? আপনি আর আমি দূরে কোথাও চলে যাই চলেন।যখন আকাশ কাঁপিয়ে ঝুম বর্ষা নামবে আপনি আর আমি হাত ধরাধরি করে ভিজব।আপনি কখনও খেয়াল করেছেন যখন আপনি খুব মনোযোগ দিয়ে আমাকে নিউটন এর সূত্র বুঝাতেন,আমি তখন তারচেয়েও অনেক বেশি মনোযোগ দিয়ে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতাম?আপনি এত ভিতু কেন?মনে আছে একবার আমি তাকিয়ে থাকার সময় আমার চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় কি ভীষণ লজ্জা পেয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন?কতদিন আমি আপনার মোবাইল এ ফোন করেছি।আপনার মুখে হ্যালো শোনার পরই  রেখে দিতাম। আপনি আমাকে পড়িয়ে যখন চলে যেতেন,সাইকেল এর চেইন পড়ে গেছে এমন ভান করে আমাদের বাসার দিকে বারবার ফিরে তাকাতেন।আমিও কিন্ত আমার বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম,যতক্ষণ আপনাকে দেখা যেত।আমি যদি আমার ভবিষ্যৎ সবগুলো জন্মদিনের গিফট হিসেবে জীবনের বাদবাকি জোছনা রাতগুলো আপনার চোখের তাকিয়ে কাটাতে চাই,আপনি কি বলবেন তখন?

  পুনশ্চঃ সেদিন আমার বাসায় যে বান্ধবী এলো তার দিকে অমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন কেন? আর যদি অন্য কোন মেয়ের দিকে তাকাতে দেখি তাইলে আপনার খবর আছে।


গল্পের পরের অংশটুকু বেশ হেসেখেলে অনুমান করা যায়......অতঃপর উহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিল!কিন্তু বাস্তবতা আসলে মাঝে মাঝেই গল্পের নাটকীয়তা দেখে আড়ালে বিদ্রুপের হাসি হাসে।
আর মনে মনে বলে......পিকচার আভি বাকি হায় মেরে দোস্ত!
 রোদেলার চিঠিটা পড়ে কেমন লেগেছিল সাইফের?না,রোদেলা সেটা জানতে পারেনি কখনো।যেদিন সাইফের রোদেলাকে পড়াতে আসার কথা ছিল,সেদিন ছিল হরতাল। বাটার সিগন্যাল এর মোড়ে প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে ছোট্ট  একটা বুলেট এসে ঠিক বুকের বাম পাশটায় লেগেছিল সাইফের।রোদেলা এরপর অনেকদিন মানসিক হাসপাতালে ছিল।এখন ওকে
 বাসায় আনা হয়েছে।কাউকেই চিনতে পারেনা।মাঝে মাঝেই গভীর রাতে একটা স্বপ্ন দেখে ওর ঘুম ভেঙে যায়।

একটা ছেলে সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।একটু পর গেট খুলে সবুজ শাড়ী পরা একটা মেয়ে বের হল।মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ছেলেটাকে ছুঁয়ে দিতে যায় ,ঠিক সেই সময় স্বপ্নটা ভেঙে যায়। বাকিটা রাত রোদেলার আকাশের দিকে তাকিয়ে কেটে যায় ।একটা তারা তার খুব পরিচিত মনে হয়।মনে হয় দূর আকাশের দূরত্ব মুছে তারাটা ওর কাছে ছুটে আসতে চায়।বুকটা অদ্ভুত শূন্যতায় কেমন যেন হাহাকার করে......কিন্তু কেন যেন ওর কিছুই মনে পরেনা..... কিছুই না..........




-আয়শা কাশফী

No comments:

Post a Comment