Subscribe:

অন্ধকারের গল্প

পিচ্চি একটা মেয়ে এসে বলে গেল, “আফনেরে মাসি ডাকে”। বিরক্তিতে মনটা ভরে গেল আসমা বেগমের। এই ঘরের মাসিটা এতো খাচ্চর! একশ বার তাকে বলা হয়েছে যে এখন আসমা কোন কাস্টমার নিতে পারবে না তবুও ডাকে। এতো টাকার খাই বুড়িটার!



আসমা বেগম, বয়স একুশ খারাপ পাড়ার বাসিন্দা। ভদ্রলোকরা যাকে বলে পতিতালয়। পতিতালয়- যেখানে পতিতারা থাকে। আসমা বেগম সমাজের চোখে পতিতা। শব্দটা মনে মনে একবার উচ্চারণ করে আসমা। যাদের কারণে সে আজ এখানে, তাদের তো কেউ পতিত বলে না। ষোল বছর বয়সে এখানে প্রথম আসে আসমা। প্রথম প্রথম কাঁদলেও এখন আর কাঁদে না সে। এই জীবনকে মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন কিছু শরীরলোভী মানুষ আসবে তার কাছে। নিতান্তই ভালোবাসাহীন কিছু দৈহিক সম্ভোগের পর ক’টা টাকা ফেলে তারা চলে যাবে- এটাকেই নিয়ম ভেবে দিন কাটাচ্ছিল আসমা।


নিয়মের হেরফের হয় মাস তিনেক আগে। আজকের মত সেদিনও মাসি ডেকেছিল। কোনরকমে শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আসমা যায়। দেখে মাসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা চেহারার একটা ছেলে। বুড়িটা বলে, “যাও এরে ঘরে নিয়া যাও। ভালো কইরা যত্ন কইরো”। আসমা তাকায় ছেলেটার দিকে। সাদামাটা কম বয়সী একটা ছেলে। বয়স আর কত হবে, এই ২৫/২৬। অনেকেই আসে। আসমা “আসেন” বলে ঘরের দিকে আসা শুরু করে। পেছন পেছন সঙ্কুচিতভাবে ছেলেটা এসেছিল। ঘরে এসে আসমা ঘুরে দাঁড়ায়। ছেলেটা জবুথুবু হয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল। বোঝাই যায় এই প্রথমবার এপাড়ায় আসা। আসমা তার চিরাচরিত ভাষায় বলেছিল, “কি গো নাগর! ভয় পাইতাসো কেন? ভয়ের কিসু নাই। আসো কাসে আসো!” ছেলেটা কয়েক পা এগিয়ে বিছানায় এসে বসে।
-        কি করবা নাগর? বুক দেখবা? ব্লাউজ খুলবো?
আসমাকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা বলেছিল, “আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? আপনি নিশ্চয় সবসময় এভাবে কথা বলেন না!” আসমা একটু থমকে গিয়েছিল। আউলা কিসিমের মানুষ সবসময়ই আসে, কবি সাহিত্যিক, আর্টিস্ট, কিন্তু কেউ আসমাকে আপনি করে বলে না কখনো। কেউ চিন্তাও করে না যে পুরুষ মানুষের সাথে শোওয়া ছাড়াও তার আরেকটা জীবন আসে। মাঝে মাঝে কিছু এন জি ও এর লোকও আসে। তারা কিছু কথা বার্তা বলে চলে যায়। তবুও এ পেশায় আসার পর এটাই প্রথম আপনি ডাক শোনা। আসমা ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকায়। বাচ্চা চেহারার ছেলেটার সব কিছুই সাদামাটা শুধু চোখদুটো বাদে। চোখদুটোর মাঝে অন্য পুরুষের মত কামনা-বাসনা নয়, বরং দৃষ্টিতে ছিল বিষন্নতা। আসমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল, “অভ্যাস হইয়া গ্যাসে। কেন্তু আফনে আসলে কি চান?” প্রশ্নটা শুনে ছেলেটা খুব হকচকিয়ে যায়। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “আমি বোধহয় কিছু চাই না”। আসমা কিছু বলে না, চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ বসে থেকে ছেলেটা চলে যায়।


এরপর প্রায়ই আসতো ছেলেটা। টুকটাক কথা বলে চলে যেত। কথায় কথায় জানা যায় ছেলেটার নাম পল্লব। পল্লব কখনো আসমাকে ছুঁতো না। শুধুই কথা বলতো, চেয়ে চেয়ে দেখত। আসমা পরেও জিজ্ঞেস করেছিলো যে পল্লব কেন তার কাছে আসে? পল্লব বলেছিল, “আমি নিজেকে খুঁজতে আসি”। আসমা বোঝেনি। যাদের হাতে পয়সা থাকে তাদের মাথায় এরকম কতো আউলা কিসিমের চিন্তা ঘুরে! সে আর এ বিষয় নিয়ে কথা বাড়ায় নি।


সেদিনও পল্লব এসে খাটে বসেছিল। আসমা একটু দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে নখ খুঁটছিল। পল্লব হঠাৎ এগিয়ে এসে আসমার কাঁধ ধরে বলেছিল, “আসমা আমি তোমাকে একটু দেখি?” পল্লবের চোখে ছিল কৌতূহল, শুধুই কৌতূহল। আসমা মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই পল্লব আসমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে লাগলো, ঘাড়,গাল, গলা। পল্লব সেদিন ডুবেছিল আসমার শরীরে। এ ঘটনা আসমাকে নাড়া দেয় নি। নাড়া দেয় পরেরদিনের ঘটনা। পরেরদিন পল্লব আসতেই আসমা তার মুখে মদের গন্ধ পায়। পল্লব আসমাকে ধরে বলেছিল, “আসমা, আমি তোমাকে ভালোবাসি”। শান্তভাবে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিল আসমা। একটু দূরে সরে সে শান্ত কণ্ঠে বলেছিল, “আফনে আর এইহানে আসবেন না। আফনে এক্ষনি যান”। পল্লব অবাক চোখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে যায়। না, পল্লব আর আসেনি।


আসমা ভালোবাসায় বিশ্বাস করে না। যেদিন তার ভালোবাসার মানুষটা তাকে এখানে এনে বেঁচে দেয় সেদিন থেকেই ভালোবাসার উপর থেকে আসমার সমস্ত বিশ্বাস উঠে গেছে। আসমা বুঝেছিল পল্লব তাকে কখনো ভালোবাসেনি। পল্লব কখনো এই পাড়ার কারো সাথে শুতে আসতো না। পল্লব এই জীবনটাকে বুঝতে আসতো। সে রাতে ঝোঁকের মাথায় ঐ কাজটা করার পর অনুতপ্ত হয়ে সে আসমাকে ভালোবাসার কথা বলে। কথাটা সত্যি নয় দেখেই তাকে মদ খেয়ে আসতে হয়। এই মোহ দুদিনেই কেটে যাবে। না, আসমা পল্লবকে ঘৃণা করেনি। বরং সে পল্লবের কাছে কৃতজ্ঞ। এই একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম কেউ লোভ নয়, কামনা নয় বরং শ্রদ্ধা নিয়ে তার শরীর স্পর্শ করে। তাকে শারীরিক সন্তুষ্টির যন্ত্র ভেবে নয় বরং তাকে এক নারীর দৃষ্টিতে দেখেছিল পল্লব। আসমা কি করে পল্লবকে ঘৃণা করে।


এইসব চিন্তা করতে করতে উঠে দাঁড়াল আসমা। দাঁড়াতেই সমস্ত শরীরে কাঁপন আসলো। দৌড়ে গিয়ে বারান্দার কোণায় গিয়ে বমি করলো সে। আতঙ্কিত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আসমা। মাথার মাঝে দ্রুত গতিতে হিসাব চালালো। তবে কি তার শরীরে আরেকটা প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে! পল্লবের সাথে সেদিনের পর সে আর কারো সাথে বিছানায় যায়নি। তবে কি এটা পল্লবের সন্তান! আসমা দ্রুত গত কয়েকদিনের কথা চিন্তা করলো। মা হওয়ার সমস্ত লক্ষণ যে তার মাঝে ছিল তা এখন চোখে পড়লো আসমার। হাত দিয়ে নিজের পেটটা একটু স্পর্শ করলো সে। তার বাচ্চা, পল্লবের বাচ্চা। কোন লোভী-কামুক পুরুষ নয়, পল্লবের শিশু। আসমার চোখে ভেসে আসলো এক ফুটফুটে ছেলের ছবি- মাথা ভর্তি চুল, অবিকল পল্লবের মত ঝকঝকে চোখ।


সাথে সাথে অনাগত সন্তানের আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল আসমার। মনে পরে যায় কদমের কথা। বাচ্চা হওয়ার কথা শুনে বুড়িটা কিসব শিকড় বাকড় খাওয়ালো। তাতে মেয়েটা বাচ্চা পেটে মরেই গেল। না, আসমা তার বাচ্চাকে মরতে দেবে না। কিন্তু এই নরকে সে তার বাচ্চাকে বড় করবে না। এতদিন একলার যেমন তেমন করে চলেছে, এখন তার উপর তার নিজেরসহ তার বাচ্চার ভার। এখন সময় এসেছে এই নরক থেকে বের হবার। তড়িঘড়ি করে যে কটা টাকা সাথে ছিল তা গুছিয়ে নিল। নষ্ট এই জায়গাটা রাতে ঘুমায় না। আসমা অপেক্ষা করতে লাগলো ভোরের। নতুন সূর্য যখন পুব আকাশে উঁকি দেয়া শুরু করলো তখন আসমা বেগম পা বাড়ায় অজানার দিকে, কোন এক নতুন সূচনার দিকে…..



-সিন্থিয়া ইসলাম

No comments:

Post a Comment